দেবদাস চক্রবর্তী : মূর্ত জীবনের বিমূর্ত রূপকার

mofidul_hoque
Published : 17 March 2008, 06:11 AM
Updated : 17 March 2008, 06:11 AM


দেবদাস চক্রবর্তী (১৯৩৩-২০০৮), ছবি: নাসির আলী মামুন, ২০০২


নাইয়র ১, ১৯৯০

বাংলাদেশের চারুকলার সুর-তান যাঁরা বেঁধে দিয়েছেন, চলার পথের ছন্দ যুগিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে যেসব নাম মনে পড়বে দেবদাস চক্রবর্তী হয়তো তাঁদের একজন নন, কিন্তু সেটা একান্তই মামুলি বিচার, মোটা দাগে অভ্যস্ত দৃষ্টিতে বিবেচনা, সেই বিচারে পূর্ণাঙ্গ ছবি যে মিলবে তা নয়। আসলে পুরো ছবিটা দৃষ্টিসীমায় নিয়ে আসতে হলে আমাদের হদিশ করতে হবে অনেকগুলো মানুষের, দেখতে হবে তাঁদের কাজের বিচিত্র ধারা, এবং বিবেচনায় নিতে হবে সেই সময় যখন ক্রমে পরাক্রমী হয়ে উঠছিল রাষ্ট্রশক্তি এবং তার বিপরীতে জেগে উঠছিল সমাজের ও সংস্কৃতির আরেক জোর। রাষ্ট্রের পরাক্রমী হয়ে ওঠার আয়োজন আমাদের চোখে পড়ে, সমাজের ভেতরে ভিন্নতর স্পন্দন ততোটা দৃশ্যগোচর নয়। তবে পরে, বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে গেলে, আরো নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত মিলিয়ে আমরা শনাক্ত করতে পারি সমাজের পালাবদলের চিহ্নগুলো, তারপরও সেই চেনার বাইরে রয়ে যায় অনেক বিস্তার, অভ্যস্ত চোখে আমরা তা উপেক্ষা করে চলি এবং তাতে ঘাটতি তৈরি হয় নিজেদের উপলব্ধিতেই। যেমন আমরা একটি

……..
দেবদাস চক্রবর্তী
……..
মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করি ১৯৪৮ সালে ঢাকায় শিল্পশিক্ষার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ঘটনা। এর পুরোহিত অবশ্যই জয়নুল আবেদিন, শিল্পাচার্য হিসেবে তিনি বরিত হয়েছেন, তাঁর সঙ্গে যোগ্য শিক্ষকমণ্ডলীতে ছিলেন কামরুল হাসান, শফিউদ্দিন আহমদ প্রমুখ। একথা ঠিক দেশভাগ-পরবর্তী ঢাকার প্রায় মফঃস্বলী আবহে শিল্পশিক্ষার কেন্দ্র গড়বার প্রয়াস নিঃসন্দেহে গুরুত্ববহ, তবে নিছক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই কাক্সিক্ষত সফলতা বয়ে আনে না, এর পেছনে রয়েছে আরো বহু কার্যকারণ ও বহুজনের ভূমিকা। তা না হলে নবগঠিত পাকিস্তানে শিল্প-আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করতো লাহোর, কেননা কলকাতা আর্ট স্কুল ও লাহোরের মেয়ো কলেজ অব আর্ট ছিল উপমহাদেশের দুই প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান।


সাদা কালো ২

অবশ্য এটাও স্মর্তব্য যে, লাহোরের প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হিসেবে বেশির ভাগ সময়ে কাজ করেছেন কলকাতার বাঙালি শিল্পশিক্ষকরা এবং মুকুল দে-অবন ঠাকুরদের বেঙ্গল স্কুলের বড় একটি প্রভাব লাহোরেও ছিল। কিন্তু দেশভাগের পর সব ছাপিয়ে দেখতে দেখতে ঢাকা যে অমন উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠলো এবং ষাটের দশকে সর্ব-পাকিস্তান শিল্পবৃত্তে আপন অবস্থান নিরঙ্কুশ করে তুললো তার পেছনে রয়েছে ঢাকার আর্ট কলেজ থেকে উত্তীর্ণ প্রথম দিককার এক ঝাঁক প্রতিভাদীপ্ত শিক্ষার্থী এবং তাঁদের পরিমণ্ডল ও শিল্পপ্রয়াস। এখানে আমরা একগুচ্ছ নাম করতে পারি, তাঁরা প্রত্যেকে জ্যোতির্ময় নক্ষত্র, তবে সবারই আলাদা দ্যুতি, আর এমনি এক ব্যতিক্রমী জ্যোতিষ্ক দেবদাস চক্রবর্তী।

দেবদাস চক্রবর্তীর ভিন্নতা একেবারেই অন্য ধাঁচের। ফরিদপুরের অভিজাত ভূস্বামী পরিবারের এই সন্তান (জন্ম. ১৯৩৩) দেশভাগের পীড়ন দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং তাঁর পরিবার দেশান্তরী হতে কালবিলম্ব করেন নি। কলকাতায় এসে দেবদাস চক্রবর্তী ভর্তি হলেন আর্ট কলেজে, সেই সাথে জড়িয়ে পড়লেন বামপন্থী আন্দোলনে। সদ্য স্বাধীন ভারতে বিপুল শক্তিমান বামপন্থা তখন উগ্র হঠকারী নীতি গ্রহণ করে বহু তরুণকে সশস্ত্র বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটাবার পথে প্ররোচিত করেছে। 'ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়' স্লোগান তুলে চলেছে সংঘাতমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড। শোষণবাদী বুর্জোয়া শাসনব্যবস্থার প্রতীক রাজ্যপালের আর্ট কলেজ পরিদর্শন ঠেকাতে যে বিপ্লবী তরুণরা মরীয়া হয়ে উঠেছিল দেবদাস চক্রবর্তী ছিলেন তাঁদের একজন, পরিণামে সোমনাথ হোর, গীতা সেন, বিজন চৌধুরীসহ তিনিও বহিষ্কৃত হন কলেজ থেকে।

কলকাতা থেকে বিতাড়িত ঢাকার বিজন ও ফরিদপুরের দেবদাস পূর্ববঙ্গে এসে নতুন শিল্পশিক্ষালয়ে জয়নুল আবেদিনের আশ্রয় লাভ করেন। ইতিমধ্যে পাকিস্তানেও শুরু হয়েছে বামপন্থী পীড়ন, কারাগার ভরে উঠছিল প্রগতিশীল বন্দিদের দ্বারা, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক কূপমণ্ডুক মতাদর্শ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছিল।

পাকিস্তানের পশ্চাৎমুখী ধর্মান্ধ আবহে ঢাকার নবীন শিক্ষার্থীদের শিল্পী হওয়ার যে সাধনা সেই অনুশীলনে অভিঘাত বয়ে এসেছিল বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন। যে শিল্পদীক্ষা গ্রহণে দেবদাস চক্রবর্তী ব্যাপৃত ছিলেন সেখানে ভাষা আন্দোলনের ঢেউ আঘাত হানলো বড়ভাবে, ঐ দিনই ছিল ঢাকা আর্ট গ্রুপের দ্বিতীয় বার্ষিক প্রদর্শনী এবং প্রথম বর্ষের ছাত্র হিসেবে দেবদাস চক্রবর্তীও ছ'টি ছাত্রসুলভ কাজ নিয়ে শরিক ছিলেন গোষ্ঠী প্রদর্শনীতে। ছাত্রদের ওপর গুলি চালনার প্রতিবাদে প্রদর্শনী বাতিল হয়ে যায়, পরে যদিও তা পুনরায় আয়োজিত হয়েছিল, কিন্তু সেই ঘটনার অভিঘাত তো মুছে যাওয়ার নয়। আর্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা সদলে জড়িত ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে এবং আন্দোলনের সাংস্কৃতিক চারিত্র্য দ্বারা যেমন প্রভাবিত হয়েছেন তেমনি আন্দোলনকেও যুগিয়েছেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক মাত্রা।

পূর্ববঙ্গের এই বিশেষ পরিস্থিতি নবীন শিল্পী ও সাহিত্যিকদের মধ্যে একটি সেতুবন্ধনও রচনা করেছিল। ঢাকার ছাত্র-তরুণদের মিলনক্ষেত্র ছিল বিভিন্নভাবে সক্রিয়, এর ফলে শিল্পের ও সাহিত্যের চর্চায় নিবেদিত তরুণদের মধ্যে ভাববিনিময়ের মাধ্যমে ছিল এক ধরনের নিবিড় সংযোগ। এই তরুণেরাই ক্রমে ক্রমে শিল্প ও সাহিত্য ক্ষেত্রে নেতৃভূমিকা গ্রহণ করতে থাকেন এবং পাকিস্তানি তমসা ঘুচিয়ে দেন স্ব-স্ব সৃজনসাধনা দ্বারা। চিত্রশিল্পী ও সাহিত্যিকরা পরস্পরের চিন্তাচেতনা প্রভাবিত করে এক আধুনিক মননশীলতা নিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করেন এবং এর সুফল নানাভাবে পরিস্ফূট হতে থাকে। এই পরিবৃত্তে বোহেমিয়ান উদ্দামতা ও প্রগতিভাবনা তাড়িত দেবদাস চক্রবর্তী যোগ করেন চিত্তাকর্ষক উজ্জ্বলতা। ১৯৫৭ সালে, কলেজের শিক্ষা সমাপন করে তিনি আরমানিটোলা স্কুলে শিল্পশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং কিছুকাল পরে নবগঠিত কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরে ডিজাইনার পদ গ্রহণ করেন। দেবদাস চক্রবর্তীর সুবাদে হাসান হাফিজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে সিকানদার আবু জাফরের এবং আত্মপ্রকাশ করে সাহিত্য পত্রিকা সমকাল, আধুনিক শিল্পরুচি সমাজে সুপ্রতিষ্ঠ করতে যে-পত্রিকার ভূমিকা ছিল অতুলনীয়।

ভাষা আন্দোলন ও চুয়ান্ন সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় যে উদার আবহ বয়ে এনেছিল তা' বিশেষ স্থায়ী হয় নি, ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন পাকিস্তানকে বর্বর স্বৈরশাসনের যাঁতাকলে আবদ্ধ করলো। সব ধরনের-বাক স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল। গণতান্ত্রিক উদারমনা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কারারুদ্ধ হলেন, কেবল সশ্রম কারাদণ্ড নয়, তাঁদের কাউকে কাউকে বেত্রদণ্ডও দেয়া হলো, ময়মনসিংহের ন্যাপ নেতা আবদুল বারী এমনি বেত্রাঘাতে বধির হয়ে পড়েছিলেন। একের পর এক বাজেয়াপ্ত হয়েছিল গ্রন্থ, সংবাদপত্রের ওপর আরোপ ছিল সেন্সর তদারকি, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল নিষিদ্ধ। এই সময়টি ছিল দেবদাস চক্রবর্তীসহ পূর্ববঙ্গের জায়মান শিল্পীদের উত্থানকাল এবং আপন শিল্প দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা সংবৃত করে আত্মপ্রকাশের পথ খুঁজতে হয়েছে তাঁদের। ফলে দেখা গেছে, ষাটের এই দশক বাংলাদেশের শিল্পচর্চায় বলবান এক বিমূর্ত ধারা জন্ম দিয়েছে।

ষাটের দশকে দেবদাস চক্রবর্তী ও তাঁর সতীর্থরা যখন শিক্ষাক্রম সমাপ্ত করে পেশাদারি জীবনে স্থিত হয়েছেন, কিছুটা আগে ও পরে, আপন শিল্প-তাগিদ থেকে ক্যানভাস রাঙিয়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, তখন তাঁরা প্রায় সকলে এক উদারবাদী বিশ্ববীক্ষণ থেকে শিল্পরস আহরণ করে নিজেদের শিল্প দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলছিলেন। তাঁরা কেউই পাকিস্তানি দ্বিজাতিতত্ত্ব-প্রাণিত কূপমণ্ডুক চিন্তায় আচ্ছন্ন হন নি। তেমনটা ঘটেছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পীদের ক্ষেত্রে, প্রাচ্য-শিল্পরীতিতে অমন দক্ষতা সত্ত্বেও তার বিকাশ সাধন থেকে বিরত হয়ে প্রবীণ শিল্পী আবদুর রহমান চুঘতাই আবদ্ধ হলেন পুনরাবৃত্তিতে, কেননা তার ছবির বাদশাহী মেজাজ পাকশাসকগোষ্ঠীর খুবই মনপসন্দ্ ছিল। সাদেকিনের মতো প্রতিভাবান শিল্পী, প্যারিসে শিল্পশিক্ষা শেষে, মন দিলেন ক্যালিওগ্রাফিতে, যেন এভাবেই সেবক হবেন ইসলামী ঐতিহ্যের। প্রতি-তুলনায় পূর্ববাংলার নবীন চিত্রকররা হয়ে উঠলেন বিশ্ব শিল্পধারার উত্তরাধিকার আত্মস্থ করে নতুন পথের অভিযাত্রী। কিন্তু সামরিক শাসন একটি সীমানাও টেনে দিচ্ছিল, শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি সকল ক্ষেত্রে, এবং গণ্ডি অমান্য করবার সাধ্য শিল্পী-সাহিত্যিক তো বটেই, রাজনীতিবিদদেরও ছিল না। তারপরও তাঁরা সক্রিয় হয়েছেন নানাভাবে, এজন্য অনেক ক্ষেত্রে প্রতীক অথবা রূপক হয়ে উঠছিল তাদের অবলম্বন, কিন্তু সর্বক্ষেত্রেই দক্ষতা ও মাধ্যমের ওপর কর্তৃত্ব ছিল তাঁদের শক্তি। যেমন শওকত ওসমান লিখলেন উপন্যাস ক্রীতদাসের হাসি, খলিফা হারুন-উর রশীদের শাসনকালের কাহিনী ও আরবি-ফার্সি শব্দের প্রভূত ব্যবহারে বর্ণিল, ফলে শাসকগোষ্ঠী একে ইসলামী ধারার সাহিত্য হিসেবে গণ্য করতে কসুর করে নি, আদমজি পুরস্কার মিলেছিল এই উপন্যাসের। চিত্রশিল্পীদের ক্ষেত্রে গণ্ডি ছিল আরো সঙ্কীর্ণ, কেননা শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল কর্তৃত্ববান শ্রেণীর হাতে এবং ন্যূনতম পোষকতা ব্যতীত শিল্পীর জন্য দাঁড়াবার বিকল্প জায়গা আর বিশেষ ছিল না। একদিকে রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু শাসন, অপরদিকে কর্তৃত্ববান ও ধনবানদের বিশেষ পক্ষপাত, এই দুইয়ের মধ্যে আপন সৃষ্টিশীলতা নিয়ে খেলবার উপায় হিসেবে বিমূর্ত রীতি বিশেষভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল, শিল্পীদের জন্য এ-ছিল ক্রীতদাসভূমিতে হাসি-আনন্দে জীবনের জয়গান গাইবার মাধ্যম।

ষাটের দশকে বিভিন্ন দলগত কিংবা যৌথ প্রদর্শনীতে দেবদাস চক্রবর্তী তাঁর কাজ নিয়ে শরিক হতে থাকেন। ১৯৬১ সালের ডিসেম্বরে বাংলা একাডেমীর বর্ধমান হাউজের তিন তলার মিলনায়তনে সৈয়দ আলী আহসানের উদ্যোগে আয়োজিত চিত্র প্রদর্শনীতে তিনি পাঁচটি শিল্পকর্ম নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। এর পরপর লাহোর ও রাওয়ালপিণ্ডিতে পূর্ব পাকিস্তানের সমকালীন শিল্পীদের যৌথ প্রদর্শনীতে তিনি অংশ নেন। ঢাকায় ফরিদা হাসানের আর্টস এন্সেম্বলের যাত্রা সূচিত হলে এর সঙ্গে দেবদাস চক্রবর্তীর ঘনিষ্ঠ যোগ স্থাপিত হয়। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত পাঁচটি যৌথ প্রদর্শনীতে দেবদাস চক্রবর্তী অংশী হন। এই পর্যায়ে এসে অনুষ্ঠিত হয় দেবদাস চক্রবর্তীর প্রথম একক প্রদর্শনী। তাঁর বিভিন্ন সময়ের কাজ এখানে প্রদর্শিত হয় এবং কালি ও কলম, জলরঙ, গুয়াশ, তৈলচিত্র ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যমের কাজের পরিচয় মেলে ধরা হয়েছিল। প্রদর্শনীর একটি তৈলচিত্র 'রাজবন্দির স্বপ্ন' শিল্প-সমালোচক সন্তোষ গুপ্ত-র বিশেষ মনোযোগ পেয়েছিল। শিল্পীর হালফিল কাজে আধা-বির্মূত ও বির্মূত ধারার ছবির প্রাধান্য ছিল চোখে পড়ার মতো। এর পর থেকে দেবদাস চক্রবর্তীর ছবিতে বিমূর্ত রীতি মুখ্য হয়ে ওঠে, তবে বস্তুকে অস্বীকার করে চললেও একটি সারবস্তু ছবিতে অননুকরণীয়ভাবে ফুটে উঠছিল যা থেকে দেবদাস চক্রবর্তীর নিজস্বতাকে শনাক্ত করা চলে। তিনি প্রধানত এঁকেছেন তেলরঙের ছবি, তুলির মোটা টানে ক্যানভাসের সমতলকে বিভাজিত করে নিয়েছেন। রঙের ঔজ্জ্বল্য তাঁর বিশেষ পছন্দ ছিল না, প্রাথমিক রঙকেও কিছুটা অনুজ্জ্বলতা দেয়ার প্রতি ছিল পক্ষপাত, মনে হবে দৃঢ় সংস্থিতি সত্ত্বেও এ-যেন প্রদোষকালের ছবি। বোধ করি এভাবেই তিনি তাঁর সময়ের প্রতিরূপ ফুটিয়ে তুলতে চাইছিলেন ক্যানভাসে। ছবি আঁকার পাশাপাশি নানাবিধ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ছিল তাঁর সম্পৃক্তি। সমকাল পত্রিকার প্রচ্ছদ একেছেন বিমূর্ত রীতিতে, একের পর এক, এবং এভাবে শিল্পরসগ্রহণে এক আধুনিক বোধ প্রসারে রেখেছেন বিশেষ অবদান। বইয়ের প্রচ্ছদ অঙ্কনেও তিনি এই আধুনিক চেতনা সঞ্চার করেছেন, হাসান হাফিজুর রহমানের আধুনিক কবি ও কবিতা এবং সত্যেন সেনের অভিশপ্ত নগরী গ্রন্থের প্রচ্ছদ ঝকঝকে আধুনিকতার বাহক হিসেবে হয়ে আছে উজ্জ্বল।

১৯৭০ সালে সৈয়দ আলী আহসানের আমন্ত্রণে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নবগঠিত চারুকলা বিভাগে শিক্ষকতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৮০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে অবস্থান করে নতুন এই শিল্পকেন্দ্রকে জোরদার করে তোলেন। এর আগে ঢাকার জীবনে শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর যেমন ছিল নিবিড় যোগ চট্টগ্রামেও তা অব্যাহত থাকে। তবে ইতিমধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতায় গোটা দেশ আলোড়িত হয়ে উঠতে শুরু করেছে এবং একাত্তরের মার্চে মূলত দেবদাস চক্রবর্তী ও রশীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে চট্টগ্রামের শিল্পীরাও নানাভাবে শরিক হয় অসহযোগ আন্দোলনে, 'বাংলার বিদ্রোহ' শিরোনামে বিশাল ব্যানার এঁকে তাঁরা আয়োজন করে উন্মুক্ত প্রদর্শনীর। মুক্তিযুদ্ধকালে দেবদাস চক্রবর্তী কলকাতায় প্রবাসী সরকারের বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত হন এবং মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিপ্রকাশক পোস্টার এঁকে তিনি পালন করেছেন ঐতিহাসিক দায়িত্ব।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দেবদাস চক্রবর্তী কাজের স্বাধীনতা ফিরে পান এবং বিমূর্ত রীতির ধারায় মূর্ত ছবি আঁকার ঘরানা তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধা ও বীর জনগোষ্ঠীর চিত্র ফুটিয়ে তোলেন। যে বিমূর্ত রীতিতে তিনি স্বচ্ছন্দ বোধ করছিলেন তা যেন এই নতুন ভাব প্রকাশের জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠছিল না। ফলে অচিরেই তিনি ফিরে যান সম্পূর্ণ বিমূর্ত চিত্রে এবং নিজের জন্য এক অনুপম প্রকাশ রীতি খুঁজে নেন, যার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে তাঁর বৃষ্টি সিরিজের ছবিতে। দেবদাস চক্রবর্তী বিমূর্ত রীতিতে জীবন ও জগৎকে ধারণ করবার যে প্রয়াস নিয়ে চলছিলেন তা' বিশেষ সার্থকতা পায় এই সিরিজে। বিশাল ক্যানভাসে তিনি বৃষ্টির নানা রূপের নির্যাস ধারণ করেছেন। বারিসম্পাতের মতো ক্যানভাসে রঙ ও ফর্ম যেন নেমে আসে উপরিতল থেকে নিচে। রঙের বৈচিত্র্যে তিনি যেমন বর্ষণের বহুরূপত্ব প্রকাশ করেছেন, তেমনি ফর্মের বিন্যাসে শ্রাবণের অঝোর ধারা কিংবা শরতের ঝিরঝির বৃষ্টি রূপায়িত করেছেন। বিশাল ক্যানভাসে তাঁর চিরাচরিত বিশিষ্টতা নিয়ে তিনি প্রবল বর্ষণকে বিম্বিত করেছেন তার নানা রূপ ও ছন্দে, মনে হয় এ-যেন পদ্মাতীরের মানুষের চিরন্তন বৃষ্টিবন্দনা, যে কাদামাটি ও জল-হাওয়া থেকে উঠে এসেছেন শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী।

আমাদের দুর্ভাগ্য এই সিরিজ আঁকার পরই দেবদাস চক্রবর্তী পীড়িত হলেন কঠিন রোগে, হারালেন তুলি ধরবার ক্ষমতা, বাক ও চলৎশক্তি রহিত হয়ে পড়লেন। এরপর দীর্ঘকাল রোগশয্যায় থেকে অবশেষে তিনি চিরকালের জন্য বিদায় নিলেন আমাদের মধ্য থেকে, রেখে গেলেন অনুপম শিল্পকর্ম ও জীবনকৃতি, আধুনিকতাকে যাঁরা আলিঙ্গন করেছিল স্বদেশের বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে, বির্মূত চিত্রধারায় যোগ করেছিল ভিন্নতর অর্থময়তা, তিনি তাঁদের মধ্যে অগ্রণী, বৃষ্টিবন্দনার সূত্রে গেয়েছেন দেশের মাটি ও প্রকৃতির গান, যে অনুরণন সবসময়ে জেগে থাকবে আমাদের শিল্পের ভুবনে।