ধর্মনিরপেক্ষ ধর্মব্যবস্থা

রিফাত হাসান
Published : 29 Oct 2010, 04:36 PM
Updated : 29 Oct 2010, 04:36 PM

রাষ্ট্র নিজেই এক ধর্মব্যবস্থা প্রস্তাব করে এবং ধর্মব্যবস্থা হিসেবে সক্রিয় থাকে। পরকালীন শাস্তি ও মোক্ষের বদলে ইহ-জগতেই শাস্তি ও মোক্ষলাভের আইন-কানুন-আদালত প্রতিষ্ঠাপূর্বক অপরাধ, শাস্তি ও পুরস্কারের যজ্ঞ এই ধর্মব্যবস্থার বিভিন্ন প্রকাশ। ভূখণ্ড, নাগরিকের শরীর ও ইচ্ছের উপর অবাধ সার্বভৌমত্বের ঘোষণা এই ধর্মব্যবস্থার ভিত্তি। এ এমনই এক সার্বভৌমত্ব যে, ব্যক্তির নিজের শরীরের উপর নিজের অধিকারের বদলে রাষ্ট্রের দেয়া মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। এই সার্বভৌমত্বের প্রশ্নহীন আনুগত্য রাষ্ট্রের ভিতরে বসবাসকারীদের উপর ফরজ। যারা অস্বীকারকারী বা ঈমান আনবে না তাদের দ্রোহিতার জন্য কারাগার, শাস্তি, মৃত্যুদণ্ড বা নির্বাসন আছে। আছে রাষ্ট্রবন্দনার বিবিধ তরিকা—যথা: লেফট রাইট, জাতীয় সঙ্গীত, শহীদ মিনার, আইন-আদালত, সংসদ এবং মহাপবিত্র গ্রন্থ সংবিধান—যার প্রতিটা ছত্র আসমানি কেতাবের আদলেই পরাকাষ্ঠা ঘোষণা করে রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রের হয়ে নিজের। এমনকি এই কেতাবেই লেখা থাকে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব কখন প্রয়োজনে নিজের গ্রহণ করা সংবিধান নামের সেই মহাকেতাবও রদ করার ক্ষমতা রাখে। যেমন জরুরী অবস্থা। এইসবই রাষ্ট্র নামের যে ধর্মব্যবস্থা বিদ্যমান তাকে তার চিহ্নব্যবস্থাসহ বোঝার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।

রাষ্ট্র যেহেতু এক ধর্মব্যবস্থাই, রাষ্ট্রের আরো বহুবিধ এবং বিশুদ্ধতর ধর্মাকাঙ্ক্ষা আছে। ফলত সুযোগ পেলেই এটি আরো বিশুদ্ধ ধর্ম হয়ে ওঠার যাবতীয় কর্মসূচি গ্রহণ করে। রাষ্ট্রের এই বিশুদ্ধ ধর্ম হয়ে ওঠার চূড়ান্ত স্তর ধর্মনিরপেক্ষতা। যে অবস্থা বিশুদ্ধতর ধর্মাবস্থা। ফলত এই পর্যায়ে রাষ্ট্র ধর্মের অবস্থান গ্রহণ করে এবং নিজেকে মহাক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান বা পাপাসি ঘোষণা করে। রাষ্ট্রের এই সেক্যুলার ধর্মভাব ও বাসনা বোঝার জন্য বিগত এক-এগারো রেজিমের ট্রুথ কমিশন গঠন, নাগরিকের কনফেশন ও আনুগত্য আদায়ের কাঙ্ক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। একটি টোটালিটারিয়ান পরিস্থিতি, যেখানে রাষ্ট্রই চূড়ান্ত বিধিদাতা, বর্তমান দমন-নিপীড়ন এবং নো টলারেন্স নীতি ইত্যকার প্রপঞ্চগুলো রাষ্ট্রের এই বাসনার দলিল।

২.
'সেক্যুলারিজম' যার বাংলা মানে করা হয় 'ধর্মনিরপেক্ষতা', মোটা দাগে তার মূল বয়ান হলো ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক অবস্থানে, নিরাপদ দূরত্বে রাখা। রাষ্ট্রে যাতে এসে তাল না পাকায় ধর্ম। কারণ, রাষ্ট্র নিজেই এক ধর্মব্যবস্থা, যা নিজের প্রভুত্বে বা সার্বভৌমত্বে অন্য কোন ধর্মব্যবস্থার খবরদারি বরদাশত করে না। অন্য যে কোন পরিচয়, চিহ্ন বা ধর্মব্যবস্থাকে স্রেফ নাগরিক পরিচয়ের সাধারণীকরণে নিজের মধ্যে লীন দেখতে চায়।

পণ্ডিত তালাল আসাদের মতে, ধর্ম রাষ্ট্র থেকে পৃথক থাকবে, এই অর্থে কোন সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রায় অসম্ভবই (…the state is not that separate. Paradoxically, modern politics cannot really be separated from religion as the vulgar version of secularism argues it should be)। তাঁর বয়ানে সেক্যুলার রাষ্ট্রের একটা ফাঁকি ধরা পড়ে। সেটি হল, সেক্যুলারিজম বলতে 'আদর্শ' কোন কিছু নেই। তার বিভিন্ন প্রকাশ আছে যাতে কোন সংজ্ঞার্থ নির্মাণ হয় না। সেটি কীভাবে সমাজে, বিভিন্ন ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলোতে ফাংশন করে, নিজস্ব অর্থ তৈরি করে, তাই আলোচনা করা যায় শুধু। যেমন, সেক্যুলারিজমের বর্তমান মাথাব্যথার কারণ 'ধর্মীয় চিহ্ন' প্রজাতন্ত্রের এক নতুন খেলার তরিকা, মানে ফাঁকি। এই ফাঁকি এবং লুকোচুরির ভিতরই আধুনিক রাষ্ট্র নিজেকে জারি রাখে। 'রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা বিশুদ্ধ ধর্মব্যবস্থার 'অন্য' আরেকটি রূপ, তাই এটি ধর্মের বেড়ে ওঠার সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত হয়। ধর্ম রাষ্ট্র থেকে আলাদা থাকবে—সেটি করতে গিয়ে কোন কোন বিষয়গুলি মূলত ধর্মীয় বা ধর্মসম্পর্কিত—রাষ্ট্র কর্তা হয়ে সেইসব ধর্মীয় চিহ্ন নির্ধারণ ও সংজ্ঞায়ন করতে যায় এবং ধর্মে বুদ হয়ে যায়' (Secularism as a political doctrine I see as being very closely connected to the formation of religion itself, as the "other" of a religious order. It is precisely in a secular state—which is supposed to be totally separated from religion—that it is essential for state law to define, again and again, what genuine religion is, and where its boundaries should properly be.)। ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক এখানে অসমান থাকে শেষমেশ। ধর্ম যদিও রাষ্ট্রকে ঘাঁটায় না, পক্ষান্তরে রাষ্ট্রের দিক থেকে ব্যাপারটা ঠিক তার বিপরীত। রাষ্ট্র অপরাপর ধর্মীয় চিহ্নের নির্ণায়ক হয়ে ওঠে। নির্ণায়ক এবং নিয়ন্তা। এই নিয়ন্তা সত্তাটিরে সার্বভৌম ক্ষমতা নাম দেয়া যায়, যেখানে মতভিন্নতা বা অন্যের প্রতি সহিষ্ণুতা নয়, বরং সার্বভৌমত্বের কর্তাসত্তাই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মনিরপেক্ষতা তাই শেষমেশ অন্য ধর্মের প্রতি এবং ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা জারি রাখে।

দেখা যায়, পোপ বা কাঠমোল্লার চেয়েও প্রখর ধর্মানুভূতির ভণ্ডামি চলে সেক্যুলার হতে চাওয়া বাংলাদেশে। আবার একই সাথে চলে ধর্মের চিহ্নায়ন ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে নাগরিকদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার ইত্যাদি চলে। আবার বিপরীতে ধর্মীয় পোশাক বোরকা সীমিতকরণ বা ফতওয়া নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কিত আদালতের রায়ও হয়। দেখা যায়, স্থানীয় ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের সংবিধান প্রস্তাবনায় 'আল্লাহর উপর অগাধ বিশ্বাস', 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম' অটুট থাকবে। সেক্যুলার সরকারের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করবেন। মন্ত্রী-মিনিস্টারগণ পুজোর অনুষ্ঠানে গিয়ে আরো অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথা বলবেন। এইসব স্রেফ চিহ্নায়নের প্রয়োজনেই কি? বোঝা যায়, সেক্যুলার রাষ্ট্র ধর্মানুভূতির ভণ্ডামি এবং ব্যবসা চালাতে পছন্দ করে। এখানে মূলত ধর্মই বারবার বিষয় হিসেবে হাজির হয়, ক্ষমতার প্রয়োজনে সুবিধামত ব্যবহার এবং নিয়ন্ত্রণের বিষয় হিসেবে।

তবে, ধর্ম রাষ্ট্র থেকে পৃথক থাকবে, এই অর্থে কোন সেক্যুলার রাষ্ট্র যেমন অসম্ভব, তেমনি আলাদাভাবে কোন ধর্মরাষ্ট্রও প্রায় অসম্ভব। কারণ রাষ্ট্র নিজেই এক ধর্মব্যবস্থা প্রস্তাব করে, আগেই বলেছি, এবং নিজের পরিসরে অন্য কোন বিশুদ্ধ ধর্মকে বরদাশত করে না চরিত্রগতভাবেই। এর কারণ হল ওখানে গেলে ধর্ম বা রাষ্ট্র একটি অপরের মধ্যে লীন বা ফানা হয়ে যাওয়া ছাড়া কোরোই টিকে থাকার সম্ভাবনা নেই।

৩.
ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কর্তৃক স্যার খেতাবপ্রাপ্ত যদুনাথ সরকার, হাল আমলের আব্দুল করিম, মুঈন-উদ-দীন আহমদ খান এবং অন্য কিছু ইতিহাস-গবেষক মোগল আমলের বয়ানে এক অভূতপূর্ব ধর্মীয় সহিষ্ণুতার তথ্য দেন। যার কারণে একরকম সৌভ্রাতৃত্ববোধ এবং ন্যায়বিচারিক সমাজের অস্তিত্ব ছিল। এ বিষয়ে অন্য একটা জনপ্রিয় মত হল, বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যের মধ্যেই একটি উদারনৈতিক ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সৌভ্রাতৃত্ববোধ ছিল। মূলত এই ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সৌভ্রাতৃত্ববোধই বাঙালী জাতীয়তাবাদের আদি-ধারকদের কথিত ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রধারণার উৎসস্থল। যার নাম দেয়া হয়েছে ধর্ম-নিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রধারণা নিয়ে, সাবেকি ঘরানার আওয়ামী লীগ নেতা ও তাত্ত্বিকগণ যথা আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখ এই সরল ভাবভঙ্গিই পোষণ করতেন। তা হল ইসলাম বা ধর্ম ঠিক রেখেও রাষ্ট্রে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সৌভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখা। এই ভাব এতটাই সরল ও অপ্রতিক্রিয়াশীল যে, আবুল মনসুর আহমদ সেক্যুলারিজমকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তিরও ঘোর বিরোধী ছিলেন। যদিও, সে সময় তার মতামত ছিলো, "আধুনিক যুগে সব রাষ্ট্রকেই সেক্যুলার ডেমোক্রেটিক নেশন স্টেট হতে হবে।" আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর বইতে আবুল মনসুর আহমদ ৭২-এর সংবিধানে ঠুটো জগন্নাথ২ চার মূলনীতির অন্তর্ভুক্তির ঘোর বিরোধীতা করে বলছেন "জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এইসব আওয়ামী লীগের দলীয় বা সরকারী মূলনীতি, কিন্তু রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে স্রেফ গণতন্ত্র থাকতে পারে।" কারণ তাঁর মতে, গণতন্ত্রই ধর্ম বা সেক্যুলারিজম বা অন্য যে কোন গণ-ইচ্ছার গ্যারান্টি হবে। সেক্যুলারিজম বা অন্য কিছু গণতন্ত্রের গ্যারান্টি দিতে পারে না।

হাল আমলে আবার সেক্যুলারিজম বা সেক্যুলার রাষ্ট্র নামে একটি জিনিস বেশ আলোচনায় এসেছে, বিশ্বরাজনীতিতে এবং বাংলাদেশে। এটি একটি নতুন ডিসকোর্স, যার উৎপত্তি দুই হাজার এক সালের নাইন ইলেভেন-এর পরে, 'সন্ত্রাসবাদে'র বিরুদ্ধে আমেরিকার অনন্ত যুদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে। বিবিধ পরিভাষা এবং নাম নিয়ে বিভিন্ন বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এটি বর্তমানে হাজির আছে। ইরাকে এর নাম 'গণতন্ত্র', আফগানিস্তানে এর নাম হল 'নারী মুক্তি'। বিপরীতে আমেরিকার এই সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্পের বিরুদ্ধে যারা দাঁড়াবে তাদের সম্মিলিত নাম 'সন্ত্রাসী', 'জঙ্গি', 'মৌলবাদী', 'বর্বর'। এরই পরিপ্রেক্ষিতে, আমেরিকায় 'মডারেট ইসলাম' নামে একটি বিষয় স্টেট ডিপার্টমেন্ট নাজিল করেছে তাদের বিবিধ বয়ানে। বর্তমান বাংলাদেশে উচ্চারিত সেক্যুলারিজম বা 'ধর্মনিরপেক্ষতা'ও মূলত সেই উৎসের আলো-হাওয়ায় গড়ে ওঠা ডিসকোর্স। এই বিষয়ে আলোচনায় যাবার আগে আমেরিকান জর্নাল অব ইসলামিক সোশাল সায়েন্সেস-এর 'ডিবেটিং মডারেট ইসলাম' সংখ্যায় প্রকাশিত সিআইএর ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এবং র‌্যাণ্ড কর্পোরেশন পণ্ডিত গ্রাহাম ই. ফুলার এর সাক্ষাৎকার-নিবন্ধের যথা অংশ পাঠ্য। ফুলার এর চিহ্নায়নে, "মডারেট মুসলিম হল সেই যে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, পরমতসহিষ্ণু, রাজনীতিতে ভায়োলেন্স করে না এবং সামাজিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সমান অধিকারে বিশ্বাস করে। মডারেট মুসলিম হওয়ার জন্য বর্তমানে আমেরিকান সরকারের দেয়া আরো গুরুত্বপূর্ণ বিধিমালার মধ্যে রয়েছে: একজন মডারেট মুসলিম কখনো রাষ্ট্রের নীতিগত এবং ভৌগোলিক রাজনৈতিক বাসনায় হস্তক্ষেপ করবে না। বিশ্বব্যবস্থায় আমেরিকার ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা-বাসনা এবং স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে। বিশ্বাস করবে—রাজনীতিতে ইসলামের কোন কাজ নেই। এবং ইজরাঈলের সাথে যে কোন রকম রাজনৈতিক বিরোধকে এড়িয়ে চলবে। (..anyone who believes in democracy, tolerance, a non-violent approach to politics, and equitable treatment of woman at the legal and social levels. Today, the American government functionally adds several more criteria: A moderate muslim is one who does not oppose the country's strategic and geo-political ambitions in the world, who accepts American interests and preferences within the world order, who believes that Islam has no role in politics, and who avoids any confrontation- even political- with Israel.৩)'

লক্ষণীয় হলো, ধর্ম বিষয়ে বঙ্গদেশের হাল আমলের সেক্যুলারবাদীদের প্রজেক্টও একই। তা হল, ধর্ম রাষ্ট্রে ঝামেলা করতে আসবে না। এর সাথে উপরে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী বাসনাগুলোর আশ্চর্য মিল। মূলত নয়া সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার পোপ আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টই নতুন অর্থ দিয়ে এইসব পুরাতন পরিভাষা হাজির করে। যার অধীনে বিশ্বের তেলসমৃদ্ধ 'অসভ্য' মুসলিম দেশসমূহকে 'আলোকায়নে'র দায়িত্ব ঘোষণা করে এবং সেনা অভিযানে নেমে পড়ে। একই সাথে বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতি দম্ভভরে ঘোষণা দেয়, যারা আমাদের সাথে এই অনন্ত যুদ্ধে যোগ দেবে না তারা আমাদের শত্রু। এইভাবে বীজগণিতীয় নিয়মে অনির্দিষ্ট শত্রুর বিরুদ্ধে আমেরিকার 'আলো জ্বালাতনি' বোমা পড়তে থাকে ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন এবং আরো অনির্দিষ্ট সংখ্যক লক্ষ্যবস্তুতে। সেইসব লক্ষ্যবস্তু, যারা আমেরিকা এবং ইজরায়েল-অক্ষের দুনিয়াব্যাপী বে-ইনসাফির সম্ভাব্য প্রতিবাদী। তাই, আমেরিকান ফরেন পলিসির স্বার্থের সাথে মিলিয়ে বর্তমানে যে সেক্যুলার রাষ্ট্রের কথা বাংলাদেশের আদালত-অঙ্গন, আওয়ামী লীগ নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের কথা-বার্তায় উঠে আসছে—সাবেকি আওয়ামী লীগের সেকুলারিজম-ভাবনা তাগিদ বাস্তবতার থেকে সঙ্গত কারণেই তাকে আলাদা করে পাঠ করা দরকার।

বাংলাদেশের এই নতুন ধর্মনিরপেক্ষতার চরিত্র হল এখানে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা অনুপস্থিত। পরিবর্তে ধর্মের চিহ্নায়ন ও নিয়ন্ত্রণ করতে তৎপর রাষ্ট্র। ফলত ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতা প্রখর। ঠিক যেরকম আমেরিকা কর্তৃক বিশ্বরাজনীতিতে নাইন ইলেভেনের পর ইসলাম নিয়ে একটা হিসটিরিয়া এবং ইনটলারেন্সির জন্ম দেয়া হয়েছিল—তার ধারাবাহিকতা। লক্ষণীয় বিষয়, সেক্যুলার ফ্রান্সে মুসলিম নারীদের ধর্মীয় পোশাক বোরকা বিষয়ে আদালতের রায় এবং সংসদে পাশকৃত আইনে বোরকাকে ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রান্সের মূলনীতির সাথে চরম বিরুদ্ধভাবাপন্ন বলল। একই সময়ে বাংলাদেশের স্থানীয় আদালত ফ্রান্সের এই মুখস্ত কথাটাই বলেছে বোরকা বিষয়ক রায়ে—বাংলাদেশকে একটি নতুন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যা দিয়ে।

মূলত এই ধর্মনিরপেক্ষতা হল আগ্রাসী রাষ্ট্রের সেই চূড়ান্ত ধর্মব্যবস্থা। যে ব্যবস্থা অপরাপর ধর্ম বা এমনকি তার অধীনতা অস্বীকারকারী রাষ্ট্রগুলোর সাথেও সহিষ্ণুতা দিয়ে পাশাপাশি থাকতে ইচ্ছুক নয়। বরং সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের ঘোষণা দেয়। দেখা যায়, বর্তমান বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলনেওয়ালীরা কথায় বার্তায় সেইসব পরিভাষাই ব্যবহার করছেন, যা আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্ট করে থাকে। যেন এইসব নিজের ভাষা, এবং এই সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধটা বেশ নিজের—আমাদের—আওয়ামী লীগেরই—বা বাংলাদেশেরই।

বরাতসমূহ
১. . Nermenn Shaikh, THE PERSENT AS HISTORY: CRITICAL PERSPECTIVES POWER, Columbia Uiversity Press, New York, 2007, pp. 205-225. ডাউনলোড লিঙ্ক: : http://www.fmk.singidunum.ac.rs/pdf/talal_intervju_eng.pdf, নারমীন শাইখের সাথে তালাল আসাদের এই সাক্ষাৎকারটি সামহোয়ারইন ব্লগে দুইপর্বে অনুবাদ করেছেন ব্লগার ননাই- এবং মানস চৌধুরীও একবার অনুবাদ করেছেন এই সাক্ষাৎকারটি- যা সমাজ নিরীক্ষণ পত্রিকায় ছাপানো হয়।
২. ৭২ এর সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদে FUNDAMENTAL PRINCIPLES অংশটির শেষে লেখা আছে: …but shall not be judicially enforceable. মানে আদালতের রায়ে এই মূলনীতি বাস্তবায়নযোগ্য নয়। তাই এটিরে ঠুটো জগন্নাথ বলেছি- এবং মজার ব্যাপার হলো এই ঠুটো জগন্নাথ নিয়েই বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের চিন্তা-ভাবনার সর্বকেন্দ্র।
৩. Graham E. Fuller, Freedom and Security: Necessary Conditions for Moderation, Published at American Journal of Islamic Social Sciences: Debating Moderate Islam Issue, Vollume 22, summer 2005, number 3, pp. 21-28

রিফাত হাসান:
আইন, ধর্ম, রাষ্ট্র ইত্যাদি নিয়ে লেখালেখি করেন।