সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ, যখন আমি… (কিস্তি ৩)

chanchal
Published : 1 June 2008, 03:57 AM
Updated : 1 June 2008, 03:57 AM

কিস্তি:


অশ্বারোহী হুমায়ুন আজাদ, হস্তে তরবারী

এটা সত্য, যে-কোনও বিষয় ও প্রশ্নের তাৎক্ষণিক বক্তব্য ও জবাব দেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল হুমায়ুন আজাদের; মনে হতো, তাঁর মস্তিষ্ক সব সময় চিন্তা ও জ্ঞানকেন্দ্রিক যে-কোনও পরিস্থিতির জন্যে প্রস্তুত হয়ে থাকে। সুচিন্তিত, লক্ষ্যভেদী, সহজ কিন্তু চাতুর্যপূর্ণ বক্তব্য বা কোনও প্রশ্নের জবাব তাঁর মতো আর কেউ দিতে পারতেন কি-না, আমার আজও জানা নেই। তাঁর কথায় থাকত শ্লেষ, বিদ্রূপ, বক্রোক্তি, চিন্তা-জাগানো রসিকতা বা কৌতুক; আর এ-সবের অন্তর্গত প্রতিটি শব্দের প্রয়োগ সুস্পষ্ট-রকমের হুমায়ুন আজাদীয়। এতে বেশ ক'জন তরুণ লেখককে প্রভাবিত হতে দেখেছি। এখন বলতে দ্বিধা নেই, সাহিত্যচর্চার শুরুতে আমিও কিছুটা হয়েছি। আটের দশকের মেধাবী তরুণ সৈয়দ তারিক (কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক) তাঁর কথা বলার ভঙ্গিটি পর্যন্ত অনুকরণ করতেন।

হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে প্রথম বিতর্কটি ওঠে খুব সম্ভবত ১৯৮৮ সালে, কাজী নজরুল ইসলামকে 'প্রতিক্রিয়াশীল' বলার মধ্য দিয়ে; কিন্তু তা কিছুদিনের মধ্যে স্তিমিত হয়ে যায়। আমার ধারণা, এর বিপরীতে নজরুলকে প্রগতিশীল প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট রসদ নজরুল-অনুরাগী গবেষক-বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীদের হাতে ছিল না বলে বিতর্কটা মুখ থুবড়ে পড়ে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ছোটকাগজ অরুণিমায় (এর সম্পাদক ছিলেন সালাম সালেহ উদদীন, তিনটি সংখ্যা প্রকাশের পর এটি বন্ধ হয়ে যায়) প্রকাশিত তাঁর প্রবচনগুচ্ছ সেই সময়, বলতে গেলে, একটা বিস্ফোরণতুল্য ঘটনা, যার প্রতিক্রিয়া ঘটেছিল মধ্যবিত্ত সমাজে; সেলিব্রিটিদের মধ্যেও এটি আলোড়ন তুলেছিল। ঘটকালিটি করেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। তিনি সংবাদ সাময়িকীর হৃৎকলমের টানে কলামে প্রবচনগুচ্ছর সমালোচনা করেন এবং এর মধ্য দিয়েই বিতর্ক শুরু হয়। বিশেষত 'আগে কাননবালারা আসতো পতিতালয় থেকে, এখন আসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে' — এই প্রবচনটি নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায়। হৃৎকলমের টানে কলামে এই প্রবচনটির প্রতিক্রিয়া ছিল লক্ষ করার মতো। এর প্রভাবে মধ্যবিত্ত সমাজ, বিশেষত সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে হুমায়ুন আজাদের প্রতি নিন্দাধ্বনি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সুবর্ণা মুস্তাফা সহ অনেকেই তাঁর প্রবচনটি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তরুণদের কেউ-কেউ পক্ষে যুক্তি ও ব্যাখ্যা দিলেও আজাদবিরোধী পরিবেশে তা কোনও আবেদন সৃষ্টি করতে পারে নি। বলতে পারি, এ-সময় তাঁর পাশে পরিপূর্ণ সক্রিয়তা নিয়ে দাঁড়ান সরকার আমিন ও সৈয়দ তারিক। সাপ্তাহিক বিশ্বদর্পণে (পত্রিকাটি এখন নেই; সম্ভবত ১৯৯১ সালে এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়) সরকার আমিন তাঁর যে-সাক্ষাৎকারটি নেন, তা ছিল প্রবচনগুচ্ছ সম্পর্কে ও হৃৎকলমের টানের সেই প্রতিক্রিয়ার জবাবে হুমায়ুন আজাদ কী বলেন, তা হাজির করার জন্যেই। সাক্ষাৎকারে তিনি সৈয়দ শামসুল হককে আখ্যায়িত করেন 'কপট' বলে। আর বলেন, 'সৈয়দ হকের মগজ এত নিষ্ক্রিয়, আমার তা জানা ছিল না।' কথাটি পত্রিকাটির প্রচ্ছদজুড়ে হুমায়ুন আজাদের ছবির সঙ্গে ছাপা হয়।

যদি আমার স্মৃতিশক্তি খুব খারাপ না-হয়ে থাকে, তখন থেকেই সৈয়দ তারিকের সঙ্গে সরকার আমিনের এবং উভয়ের সঙ্গে হুমায়ুন আজাদের সখ্য লক্ষ করি। ছাত্রাবস্থাতেই তখন সরকার আমিন উস প্রেসের (এফ রহমান হলের পাশে অবস্থিত ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সার্ভিস প্রেস) ব্যবস্থাপক। সেখানে দু'জন প্রায়ই আড্ডা দিতেন। কখনও-কখনও আমিও থাকতাম। দেখতে না-দেখতেই হুমায়ুন আজাদের উচ্চারণ ও কথা বলার ভঙ্গি পুরোপুরি রপ্ত করে ফেলেন সৈয়দ তারিক; প্রয়োগও করতে থাকেন সর্বত্র। তো, একদিন, দীর্ঘক্ষণ ধরে এই স্টাইলে কথা বলে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উস প্রেস থেকে বের হয়ে গেলেন তিনি। সরকার আমিনের একটা গুণ — খুব বিরক্ত হলেও তিনি চেপে রাখতে পারেন, তাঁর কাছে বিরক্তিকর ব্যক্তির সঙ্গে সহাস্য বাক্য-বিনিময় করতে পারেন। সৈয়দ তারিকের প্রস্থানের পর, তাঁর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। বললেন, 'দেখেছ, হুবহু স্যারকে নকল করে কথা বললেন! কারও চিন্তা-চেতনা ভালো লাগলে তা অনুকরণ করতেই হবে, এমন কোনও কথা নাই। অনুকরণ করলেও অসুবিধা নাই। কিন্তু এর বেশি না।'

সে-সময়, একদিন আমি লেকচার থিয়েটারে হুমায়ুন আজাদের রুমের সামনে পৌঁছেই একই ভঙ্গিতে কথা বলছে এমন দু'টি কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। ঢোকার অনুমতি চাওয়ার জন্যে দরজা ফাঁক করতেই দেখি, সৈয়দ তারিক বসে; হুমায়ুন আজাদ কথা বলার সময় যেভাবে দু'হাতের ব্যবহার করেন, ঠিক সেভাবে তিনি হাত সঞ্চালন করছেন। সৈয়দ শামসুল হকের খেলারাম খেলে যা নিয়ে কথা বলছিলেন তাঁরা, মনে পড়ে। আমি ঢোকার পর সৈয়দ তারিক বললেন, 'স্যার আমি আপনাকে আমার একটা গ্রন্থ উৎসর্গ করতে চাই। সেটা কবিতার বই হতে পারে, প্রবন্ধের কিংবা অনুবাদেরও হতে পারে।'

চেয়ারে হেলান দিয়ে বেশ আয়েশি কায়দায় সিগারেটে টান দিলেন হুমায়ুন আজাদ। বললেন, 'তোমার অনুবাদ ভালো।' বলার সময় এবং পরও কিছুক্ষণের জন্য তাঁর মুখ থেকে ধোঁয়া বের হল।

'কেন, আমার কবিতা? প্রবন্ধ?'

'প্রবন্ধও ভালো। ওই যে একটা লিখেছিলে ম্যাথিউ আর্নল্ডের সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে, ভালো।'

'স্যার, কবিতা?'

'আমি তো বললাম তোমার অনুবাদ ভালো, প্রবন্ধও ভালো। আপাতত এতেই সন্তুষ্ট থাকো।'

সৈয়দ তারিক ব্যাগ থেকে একটা কবিতা বের করে বললেন, 'তা হলে একটা কবিতা শোনাই, স্যার। আশা করি এরপর আমার কবিতা সম্পর্কে আপনার ধারণার পরিবর্তন ঘটবে।'

সেই কবিতার নাম এ-মুহূর্তে আমি মনে আনতে পারছি না। তবে প্রথম তিনটি লাইন আমার মনে আছে —

'স্রবিত রক্তের নীচে উদ্ভাসিত হয়েছিল উজ্জ্বল সুন্দর।
মুগ্ধ চোখে দেখেছিল,
মুগ্ধ চোখে দেখেছিল মধ্যরাতে…'

বাকিটুকু কেন মনে নেই, জানি না। কবিতার বাকি অংশে আমার মনোযোগহীনতা এর একটা কারণ হতে পারে। আমি জানালার দিকে তাকিয়েছিলাম: আকাশ ধূসর হয়ে আসছিল। অন্যমনস্ক ছিলাম কি? কিন্তু এটা তো শুনেছি মন দিয়ে যে, হুমায়ুন আজাদ কবিতাটির প্রথম লাইনের খানিকটা প্রশংসা করে 'স্রবিত' শব্দটির প্রয়োগ নিয়ে বলেছিলেন, এ-ধরনের শব্দকেন্দ্রিক রচনা মালার্মেপন্থি কবিরাই করে থাকে এবং তা এমনভাবে করা হয় যাতে পাঠকের দৃষ্টি শুরুতেই বিশেষ কিছু শব্দের ওপর পড়ে। কবিতা সম্পর্কে পাঠককে মনোযোগী করার এটা হল একটা কৌশল; 'কিন্তু তুমি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ, কারণ ওই শব্দ ছাড়া কবিতাটিতে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের মতো কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না।'

তাঁর মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমি আবার কয়েক মুহূর্তের জন্যে জানালায় তাকালাম। আকাশ অন্ধকার হয়ে আসছিল। সৈয়দ তারিক কী যেন বলতে চাইলেন; তার আগেই হুমায়ুন আজাদ বললেন, 'সমস্যা নেই, পৃথিবীতে এভাবে হাজার-হাজার কবিতা লেখা হয়ে আসছে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ্ব থেকে; কিন্তু বেশির ভাগই ব্যর্থ।'

এতক্ষণ আমি খুব মনোযোগের সঙ্গে তাঁর দিকে তাকিয়েই কথাগুলো শুনছিলাম। এখন আমি তাকালাম সৈয়দ তারিকের দিকে। তিনিও আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, 'উঠি চঞ্চল। তুমি যাবে আমার সঙ্গে? হাকিমের দোকানে চা খাব।' এবার দাঁড়ালেন। হুমায়ুন আজাদকে লক্ষ করে বললেন, 'আসি স্যার।' সৈয়দ তারিকের পিছু-পিছু আমি যখন বের হচ্ছি, তিনি আমাকে 'এ্যাই, দাঁড়াও' বললে আমি দাঁড়ালাম এবং তিনি জানতে চাইলেন আমি তাঁর রুমে কেন এসেছি। 'আর একদিন আসব স্যার' বলে আমি বেরিয়ে এলাম।

হাকিমের দোকানে যেতে যেতে সৈয়দ তারিক বললেন, 'যে-কবিতাটা পড়লাম, তুমি বলো, কেমন লেগেছে? স্যার তো নিজের আর সুধীন্দ্রনাথ দত্তর কবিতা ছাড়া আর কারও কবিতা যে ভালো হতে পারে, তা ভাবতেই পারেন না।' তখন দুপুর, কিন্তু মেঘাচ্ছন্ন আকাশের কারণে বোঝা যাচ্ছিল না। বড়-বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হল আর্টস ক্যাফেটেরিয়া পার হওয়ার আগেই। জোরে পা চালিয়ে আমরা সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনের শেডে দাঁড়ালাম।

"বুদ্ধদেব বসুর কবিতাও উনি পছন্দ করেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতাও। 'রাত তিনটের সনেট, মৃত্যুর আগে' তাঁর খুব প্রিয়।"

রুমালে প্রথমে চুল, পরে চশমা মুছতে মুছতে তিনি বললেন, 'শোনো চঞ্চল, হুমায়ুন আজাদ সত্তরের দশকের কবি। এই দশকে বাংলা ভাষায় কোনও উৎকৃষ্ট কবিতা রচিত হয় নি।'

আমি বলি, 'স্যারকে আপনার কবিতার বইটা উৎসর্গ করে দেখতে পারেন।'
তিনি আমার দিকে বিরক্তিভরা চোখে তাকালেন। মনে হল, স্থানত্যাগ করতে চান। কিন্তু বৃষ্টি প্রবল হওয়ায় সেটি সম্ভব হচ্ছে না।

বেশ ক'বার সৈয়দ তারিকের অনুবাদের প্রশংসা করেছেন হুমায়ুন আজাদ। ভাষা ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে সমকালীন সাহিত্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে আগা-গোড়া নেতিবাচক বক্তব্যের মধ্যে কেবল তাঁর অনুবাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। তাঁর-করা ম্যাথিউ আর্নল্ডের 'ডোভার বিচ' কবিতার অনুবাদ সম্পর্কে দু'টি বিশেষণ ব্যবহার তিনি করেছিলেন: মেধাবী ও সৃষ্টিশীল। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৮ সালে, খোন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত একবিংশ পত্রিকায়। যখন প্রকাশ্যে ও জনসমক্ষে এর প্রশংসা করেন হুমায়ুন আজাদ, তখন এটি প্রকাশের সম্ভবত সাত বছর পার হয়ে গেছে। কবিতাটি তাঁর চিন্তায় যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল, বলা যায়। এর দু'বছর পর, অর্থাৎ ১৯৯৭ সালে বেরোয় তাঁর আমার অবিশ্বাস। বইটির নাম-অধ্যায়ে ব্যবহৃত হয় কবিতাটি, 'ডোভার সৈকত' নামে। সৈয়দ তারিকের অনুবাদটি তিনি নেন নি; নিজেই এর অনুবাদ করেন। বিশ্বাসের অবসানের রূপক হিসেবে তিনি ওই প্রবন্ধে কবিতাটি ব্যবহার করেন।

কিন্তু হুমায়ুন আজাদকে কোনও বই উৎসর্গ করা হয়ে ওঠে নি সৈয়দ তারিকের। আর, তাঁর ১ ফাল্গুন ১৪০২-এ প্রকাশিত ছুরিহাতে অশ্ব ছুটে যায় (হুমায়ুন আজাদ কেন, কাউকেই এই বই তিনি উৎসর্গ করেন নি) ছাড়া কোনও বই, আমি যতদূর জানি, বেরোয় নি। এটা নিশ্চিত, অমরতার সমস্ত রসদ রেখে হুমায়ুন আজাদ চলে গেছেন (নইলে, আমিই-বা কেন তাঁকে নিয়ে লিখছি স্মৃতিকথা!) আর সৈয়দ তারিক কোথায় আছেন কী করছেন জানি না। নীল জিন্স, নীল শার্ট আর উপবৃত্তাকার চশমা-পরা এই মানুষকে কত দিন দেখি না! হায়, খুঁজিও না! হস্তরেখায় তাঁর আস্থা ছিল না মোটে; তবু বলতেন কাজের সঙ্গে বদলে যায় হাতের রেখা; 'একটা ভালো বা খারাপ কাজ করে আমাকে হাত দেখিও, আমি বলে দিতে পারব — কী করেছ তুমি।' মনে পড়ে, হাকিমের চা-দোকানে বসে আমার হাত দেখে বলেছিলেন, 'তোমার খ্যাতি কিছু হবে, টাকা হবে না। লোকে তোমাকে মিসইন্টারপ্রিট করবে, তোমার বন্ধুরাও বুঝবে না তোমাকে।' জানি, এই ভবিষ্যদ্বাণীর জন্যে হাত দেখা লাগে না; কাউকে কিছুদিন লক্ষ করলেই কাজটি সম্ভব। তবু বলি, 'আপনার পরামর্শ কী?'

'ধারণ করো নিজেকে; ধীরস্থির হও; নিজের ক্ষমতা জায়গামতো কাজে লাগাও।'

যা-ই হোক, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় আসার বছরখানেকের মধ্যে মতিউর রহমান নিজামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢোকে এবং রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে ভিসির রুমে লাঞ্ছিত হয়। শোনা যায়, ছাত্ররা তাকে লাথিও মারেন এবং শেরওয়ানির দু'একটি বোতাম ছিঁড়ে ফেলেন। এতে হুমায়ুন আজাদ অত্যন্ত আনন্দিত হন। সেই সময় দৈনিক সংগ্রাম, মিল্লাত আর ইনকিলাবের লেখক সালাউদ্দীন নিজামী তার নাম বদলে ফেলেন। তিনি হয়ে যান সালাউদ্দীন আইয়ুব। কিছুধ্বনিতে হুমায়ুন আজাদের সেই সাক্ষাৎকার প্রকাশের আগে, এডওয়ার্ড সাইদের দ্য ওয়ার্ল্ড দ্য টেক্সট এ্যান্ড দ্য ক্রিটিক বইটি সালাউদ্দীন আইয়ুবের কাছ থেকে নিয়ে তাঁকে পড়তে দিই। সেটি ফেরত চাইলে হুমায়ুন আজাদকে আমি বলি যে বইটি সালাউদ্দীন আইয়ুব চেয়েছেন। তখন প্রায় দুপুর, ডিপার্টমেন্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি; জিজ্ঞাসা করলেন, 'সালাউদ্দীন আইয়ুব কে?'

বলি, 'স্যার, চিনতে পারলেন না!'

'ওই নামে কাউকে আমি চিনি না।' বলে হাঁটা। চার-পাঁচ পা এগুলেই চেয়ারম্যানের রুমের দরজা। সেখানে তিনি দাঁড়ালেন।

আমি বললাম, 'চেনেন স্যার, সালাউদ্দীন নিজামীকে তো চেনেন।'

'নাম পাল্টালো কেন?'

'ঠিক বলতে পারব না, মনে হয় নিজামী মার খাওয়ার পর তিনি নিরাপত্তাহীনতা থেকে কাজটা করেছেন।'

'কিন্তু এখন যে আইয়ুব খান হয়ে গেল!' বলেই তিনি চেয়ারম্যানের রুমে ঢুকলেন।

কিছু বিষয়, যেমন পাকিস্তান, বোরকা, রাজাকার, ধর্মবিশ্বাস, সেনাবাহিনী, আমলা সম্পর্কে তাঁর সন্দেহ, বিরক্তি ও ঘৃণা ছিল। কখনোই তাঁকে জুতা পরতে দেখি নি; প্যান্টের মধ্যে শার্ট ঢোকাতেও না; স্যুট-টাই পরতে তো নয়ই — এমন কি, পাজামা-পাঞ্জাবিও পরতেন না তিনি। এসব নিয়ে একদিন তাঁকে প্রশ্ন করলে তিনি জানান যে, জুতা তাঁর ভালো লাগে না, এর শব্দ একাত্তরের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কথা মনে করিয়ে দেয়; প্যান্টের মধ্যে শার্ট ঢুকিয়ে টাই আর স্যুট পরে আমলারা; এখন অবশ্য মূর্খ কেরানি, বীমার দালাল, টাউট সবাই পরে। পাজামা-পাঞ্জাবি হচ্ছে ভান ধরার পোশাক — গুরুগম্ভীর ও বিদ্বান অধ্যাপকের ভান, এর সঙ্গে কাঁধে ঝোলা নিলে কবির ভান, সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগের ভান — এইসব তাঁর পছন্দ নয়। একদিন তিনি নিজের রুমে টেবিলের উপর পা তুলে হাসতে হাসতে বলেন, 'আহা, আমি যদি নিয়মিত ঢোলা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ঘুরে বেড়াতাম, তাহলে বহু আগেই কবি বা পণ্ডিত হতে পারতাম!'

এখন বুঝতে পারি, 'ডোভার বিচ' কবিতাটি কেন তাঁর প্রিয় ছিল; তাতে বিশ্বাসের সমুদ্রে ভাটা আর মূর্খ সেনাবাহিনীর উল্লেখ তাঁকে বিশেষভাবে প্রীত-আন্দোলিত করেছিল। প্রায়ই তিনি বলতেন, ধর্মবিশ্বাস সবসময় পরিবার থেকে পাওয়া; কিন্তু এর কোনও ভিত্তি নেই। শৈশব থেকেই আমাদের শেখানো হয় আল্লা সর্বশক্তিমান, স্কুলে ইংরেজিতে কথাটির অনুবাদও শেখানো হয়। উদ্দেশ্য, মানুষকে ভীতির মধ্যে রাখা। কিন্তু সর্বশক্তিমানে বিশ্বাস করা গেলেও তাকে বিশ্বাস করা নির্বুদ্ধিতা, কারণ সর্বশক্তিমান যে-কোনও সময় যে কোনও বিপজ্জনক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতে পারে। অথচ লোকে কথায়-কথায় বলে 'আল্লা ভরসা'।

একটা খুব স্মরণযোগ্য ঘটনার কথা বলি। 'শিক্ষক হুমায়ুন আজাদ, যখন আমি তাঁর ছাত্র' অংশে ঘটনাটি বলা যেত। যেহেতু তা যায় নি এবং প্রসঙ্গের সমর্থন এখন বরং আরও প্রবল বলে মনে হয়, ঘটনাটি বলা যেতে পারে। তা এই: বিয়ের পর আমার এক সহপাঠিনী বোরকা পরতে শুরু করে। সে তাঁর রুমে ঢুকলে, তিনি এই পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলেন। সে বলল, 'আমার স্বামী চায় না বোরকা ছাড়া বাইরে যাই।'

'কিন্তু তুমি যে সবাইকে দেখে বেড়াচ্ছ, তোমার স্বামীর তাতে আপত্তি নেই?'

মাথা নিচু করে সে বসে রইল।

তিনি বললেন, 'তুমি কার জীবন যাপন করো, তোমার স্বামীর, না নিজের?'

নীরবতা।

'তোমাদেরকে নিয়ে, মানে নারী নিয়ে আমি একটা বই লিখছি। আচ্ছা, প্রতিদিনই কি তোমরা শারীরিকভাবে মিলিত হও?'

হঠাৎ এই প্রশ্নে হতভম্ব হয়ে গেলাম। শোঁ-শোঁ শব্দে ফ্যান ঘুরছে। তার না-ঠাণ্ডা না-গরম হাওয়ায়, রুমে আমরা তিনজন। কিন্তু আমি যে বসে আছি তাঁর সামনে, সেটা কি তিনি খেয়াল করছেন না? সহপাঠিনীর দিকে তাকালাম। তার নড়াচড়াতেই বেশ বোঝা গেল প্রশ্নটির জন্যে সে প্রস্তুত ছিল না এবং লজ্জা পেয়েছে। তবু বলতে পারল, 'প্রতিদিনই না, তবে প্রায়ই। এসব প্রশ্ন আর করবেন না স্যার।'

একটা সিগারেট ধরিয়ে তিনি বললেন, 'একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তুমি আমাকে খুব সাহায্য করেছ। এটা যখন পেরেছ, আর একটা প্রশ্নের উত্তর তুমি দিতে পারবে।' সে কী-যেন বলতে চাইল, কিন্তু তাকে হাত তুলে থামিয়ে তিনি বললেন, 'অর্গ্যাজম হয়েছে কখনও?'

সে বলল, 'অর্গ্যাজম কী স্যার?'

তিনি বললেন, 'আমি আজ আর তোমাকে কোনও প্রশ্ন করবো না। এখন বলো, কেন এসেছিলে?'

'একটা টিউটোরিয়াল পরীক্ষা আমি দিতে পারি নাই স্যার।'

'কেন?'

'বিয়ের কারণে।'

'তোমার?'

'জি, স্যার।'

এ্যাশট্রেতে ছাই ফেলে তিনি বললেন, 'এখন তো তুমি স্বামীর জীবন যাপন করছ। ভাষাতত্ত্ব তার কোনও কাজেই আসবে না। তা হলে পরীক্ষা দিতে চাও কেন?'

সে নিরুত্তর।

তিনি বললেন, 'ঠিক আছে, পরীক্ষাটা নেব। তোমার মতো আরও কয়েকজন দিতে পারে নি, তাদের সঙ্গে পরীক্ষাটা তুমি দিতে পারবে। তারিখ জানানো হবে। আর কোনও কথা?'

'না স্যার। যাই।'

১৯৯৩ সালে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ চোখ নেই দৃশ্য নেই প্রকাশিত হয়। সে-বছরই, মার্চের কোনও এক দুপুরে হুমায়ুন আজাদকে বইটি আমি দিই। তাঁর রুমে তখন আধুনিক বাঙলা কবিতা বিষয়ে বিকল্প কোর্সের টিউটোরিয়াল ক্লাস শেষ হয়েছে। চার-পাঁচজন ছাত্রছাত্রী বসে আছে। একটু আগে একজনের 'কবিতা কেন বুঝতে পারি না, স্যার' প্রশ্নের উত্তর তিনি দিয়েছেন: কবিতা বোঝার জিনিস নয়, অনুভবের, উপলব্ধির জিনিস। কোনও কবিতা সম্পর্কে যদি কেউ বলে যে সেটি সে বুঝতে পেরেছে এবং তার বুঝতে পারার সঙ্গে অন্যরা একমত হচ্ছে, ধরে নিতে হবে কবিতাটি ব্যর্থ। পাঠ্যপুস্তকে এ-ধরনের কবিতা স্থান পেয়ে থাকে।' আমি বললাম, 'তাহলে কবিতার যে-ব্যাখ্যা এবং তার পদ্ধতিগুলো কেন?'

'এসব হল এক ধরনের ব্যবসা। কবিতার ব্যাখ্যা নিয়ে বই বের হয় বাণিজ্যিক কারণে। ব্যাখ্যা করে বহু বাজে কবিতা এই বাঙলায় বেশি করে পড়ার প্ররোচনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু কবিতা ব্যাখ্যার নয়, সৌন্দর্যের, উপলব্ধির।'

তো, বইটি মৃদু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তিনি টেবিলের একপাশে সরিয়ে রাখলেন। বললেন, 'আমি বাঙলা ভাষায় বিশটি শ্রেষ্ঠ কবিতা লিখেছি।' নিজের বইটির প্রতি অবজ্ঞা দেখে ও তাঁর এই কথা শুনে আমার কষ্ট ও রাগ হল। বললাম, 'আপনার কথাই ঠিক, স্যার। কিন্তু সেজন্যে পাঁচটি বই আপনাকে বের করতে হয়েছে। প্রতিটি বইয়ে গড়ে আপনি চারটি শ্রেষ্ঠ কবিতা লিখেছেন। আর আমার প্রথম এবং একমাত্র বইয়ে অন্তত তেইশটি শ্রেষ্ঠ কবিতা লেখা হয়ে গেছে।'

এতক্ষণ হেলান দিয়ে-বসা হুমায়ুন আজাদ টেবিলের কাছে নিজের বুক এগিয়ে নিয়ে বইটি ধরলেন এবং আগের চেয়েও তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আমার দিকে বইটি প্রায়-ছুঁড়ে দিলেন। টেবিলের একেবারে সামনের প্রান্তে এসে পড়ল বইটি; কিন্তু আমি ধরলাম না। বললেন, 'ব্যাখ্যা করে দেখাও, কোন তেইশটি কবিতা বাঙলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ!'

অপমানে, রাগে, আমার কান গরম হয়ে উঠল। তবু নিজেকে যতটা সম্ভব সামলে নিয়ে বললাম, 'স্যার, একটু আগে আপনি বলেছেন কবিতা ব্যাখ্যার নয়, উপলব্ধির। আমার উপলব্ধি, তেইশটি শ্রেষ্ঠ কবিতা এই বইয়ে আছে। ব্যাপারটা তো ব্যক্তিনির্দিষ্ট, আপনিই ঠিক করুন বইটির কোন তেইশটি কবিতা শ্রেষ্ঠ।'

এর পর কবিতা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আর কখনও, কোনও কথা হয় নি।

মনিপুরী পাড়া, ঢাকা ২৮/৫/৮

লেখকের আর্টস প্রোফাইল: চঞ্চল আশরাফ
ইমেইল: chanchalashraf1969@yahoo.com


ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts