অ্যাপোক্যালিপ্টো: মায়ানদের নিয়ে ছবি

saif_samir
Published : 22 June 2008, 09:06 AM
Updated : 22 June 2008, 09:06 AM


নরবলির জন্য ধরে আনা গ্রামবাসী

ছবির প্রথম মিনিট থেকেই গতিময় অ্যাপোক্যালিপ্টো (Apocalypto, 2006)। হলিউডের আর দশটা ছবির চেয়ে ভিন্ন এই ছবির প্লট। পুরো দুই ঘণ্টা ১৮ মিনিট সবকিছু ভুলে গিয়ে বসে থাকতে হয়। সাসপেন্স প্রতি মুহূর্তে।

ছয় শো বছর আগের মায়া সভ্যতার পটভূমিতে নির্মিত মেল গিবসনের (Mel Gibson, জন্ম. নিউইয়র্ক ১৯৫৬) অ্যাপোক্যালিপ্টো অনেক কারণেই


…….
কীভাবে পানি কেটে এগোতে হবে দেখাচ্ছেন মেল গিবসন
……
ইন্টারেস্টিং। প্রথমত, এটি মায়ান ভাষায় নির্মিত। ছবির প্রয়োজনে মায়ান ভাষা রপ্ত করে নিয়েছিলেন মেল গিবসন। ভাষা মায়ান হলেও ইংরেজি সাব টাইটেল থাকায় বুঝতে অসুবিধে হয় না। ভাষা মায়ান হওয়ায় বেস্ট ফিল্ম নট ইন দি ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ ক্যাটাগরিতে BAFTA অ্যাওয়ার্ডের জন্য নমিনেশন পেয়েছিল অ্যাপোক্যালিপ্টো। তাছাড়া ডিরেক্টর একজন মুভমেন্ট টিচারও নিয়োগ করেছিলেন যিনি সবার বডি ল্যাঙ্গুয়েজের দিকে নজর রাখতেন।

…….
জাগুয়ার প এবং স্ত্রী সেভেন
…….
ছবিতে স্প্যানিশ অভিযাত্রীরা পৌঁছানোর আগে মেক্সিকোর জঙ্গলে মায়ান জীবনযাপনের খণ্ডচিত্র দেখিয়েছেন গিবসন। শুটিংও হয়েছিল মেক্সিকোতে।

গোড়াপত্তনের পর ৮০০ শতকে মায়া সভ্যতা পূর্ণ বিকশিত হয়েছিল। কিন্তু ১০০০ শতকের কিছু আগে থেকে ক্রমাবনতি শুরু হয় এই সভ্যতার। অ্যাপোক্যালিপ্টোর কাহিনী ১৫০০ সালের। তখন মায়া সভ্যতা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। পুরোহিতরা ঘোষণা করেন টিকে থাকতে হলে আরও মন্দির তৈরি করতে হবে, দিতে হবে নরবলি। সে জন্যই রাজার অনুচররা জঙ্গলের এক ছোট্ট গ্রামে হামলা চালিয়ে ধরে আনে জাগুয়ার প (Rudy Youngblood, জন্ম. টেক্সাস ১৯৮২) ও তার সঙ্গীদের। তবে ধরা পড়ার আগে প তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সেভেন (Dalia Hernández, জন্ম. মেক্সিকো ১৯৮৫) ও ছোট ছেলেটিকে একটি গভীর গর্তে লুকিয়ে ফেলতে পেরেছিল। বন্দি প ও তার সঙ্গীরা দীর্ঘ ও যন্ত্রণাদায়ক যাত্রার পর শহরে পৌঁছে বুঝতে পারে তাদের বলি দেয়া হবে।


ছবির সেট

বলি দেয়া চলছিল আগে থেকেই। পিরামিডের শীর্ষদেশ থেকে জল্লাদের এক কোপে ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন একের পর এক মাথা অসংখ্য ধাপ পেরিয়ে জড়ো হচ্ছে পিরামিডের পাদদেশে। বিভৎস দৃশ্য! চোখের সামনে প-য়ের সঙ্গী এই দৃশ্যের চরিত্র হওয়ার পর এবার খোদ প-য়ের বলি হওয়ার পালা। মুভির ট্যাগ লাইন ফুটে ওঠে এখানে — হোয়েন দি এন্ড কামস, নট এভরিওয়ান ইজ রেডি টু গো। আশ্চর্যভাবে বেঁচে যায় জাগুয়ার প। তাকে যখন বলি দেয়া


নরবলির বেদীর সামনে পুরোহিত

হচ্ছিল ঠিক সেই সময় পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের জন্য চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। বিজ্ঞ পুরোহিত বলেন, নরবলিতে ঈশ্বর ইতিমধ্যে তুষ্ট হয়ে গেছেন। বন্দিদের ছেড়ে দেয়া যেতে পারে।

প ও তার সঙ্গীরা পালিয়ে যাবার সুযোগ পেলেও, প্রায় সবাই রাজার অনুচরদের তীর আর বল্লমের আঘাতে মারা যায়। কিন্তু প কোনোমতে পালাল, কারণ সে মরতে নারাজ। প্রায় ১৭০ ফুট উঁচু জলপ্রপাত থেকে ঝাঁপ দিল সে। রাজার অনুচররাও কম যায় না। তারাও প-য়ের পিছন পিছন ঝাপ দেয়। গভীর জঙ্গলে চলতে থাকে ধাওয়া আর লুকোচুরি। এরপর কীভাবে প বাঁচল, বৃষ্টির পানিতে টুইটম্বুর গর্ত থেকে সন্তান ও সদ্যপ্রসবা স্ত্রীকে উদ্ধার করল সেটা স্রেফ দেখার বিষয়।

ছবির কাস্ট ছিল অসাধারণ। বেশির ভাগ শিল্পী এই প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছেন। জাগুয়ার প-এর চরিত্রে রুডি ইয়াংব্লাডের অভিনয় মুগ্ধ করার মতো। ১৭০ ফিট জলপ্রপাত থেকে ঝাঁপ দেয়ার দৃশ্যে কোনো স্ট্যান্টম্যানের

……
জলপ্রপাতের নিচে জাগুয়ার প
…….
সাহায্য নেননি রুডি। প্রায় পনেরো তলা বাড়ি থেকে তিনি নিজেই ঝাঁপ দিয়েছিলেন। পরে সেই দৃশ্য জলপ্রপাতের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে। প-য়ের স্ত্রীর ভূমিকায় ডালিয়া হার্নানডেজের পানির নিচে জীবিত সন্তান জন্মদানের সম্ভাব্যতা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক আছে। অবশ্য মুভিতে হিস্টোরিকাল এলিমেন্ট ও টাইমলাইন না মানার কারণে মেল গিবসন এমনিতেই যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছেন। যেমন মুভির শেষ পাঁচ মিনিটে দেখানো হয়ে স্প্যানিশদের আগমন। অথচ স্প্যানিশরা এসেছিল আরও পরে। তাছাড়া সূর্যগ্রহণের দৃশ্যটিও বিজ্ঞানসম্মত ছিল না। সূর্যগ্রহণ হয় নতুন চাঁদ দিয়ে। অথচ দেখানো হয়েছে সূর্যগ্রহণ হয়েছে পূর্ণচন্দ্রে। সূর্যগ্রহণের সময়সীমাও ছিল বেখাপ্পা। কয়েক ঘণ্টার সূর্যগ্রহণ মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই ঘটিয়ে ফেলেছেন মেল গিবসন। মুভির শুরুতে এডিটিং-এ দুর্বলতা আছে। তবে পুরো মুভির ভিস্যুয়াল এফেক্ট ও স্কোরিং অনবদ্য। মিউজিকের দায়িত্বে ছিলেন জেমস হর্নার (James Horner, জন্ম. ক্যালিফোর্নিয়া ১৯৫৩)। স্ক্রিপ্ট লেখক মেল গিবসন ও সহ লেখক ফরহাদ সাফিনিয়া (Farhad Safinia, জন্ম. তেহরান ১৯৭৫) মায়াদের চালচিত্রকে মুভির প্লটের কেন্দ্রবিন্দু করেন নি। তাই এই মুভিকে একটি এক্সাইটিং চেজ মুভিও বলা যায়। সম্ভবত দি প্যাশন অফ দি ক্রাইস্ট খ্যাত ডিরেক্টর মেল গিবসন


গ্রাম আক্রমণের সময় রাজার অনুচরদের কবলে জাগুয়ার প

তাঁর ভায়োলেন্স-প্রিয়তা থেকে বের হতে পারছেন না। যদিও মেল গিবসন মায়ানদের শিকার পদ্ধতি, ঘর, জীবনযাত্রা, বিচিত্র পোশাক, চুলের স্টাইল, ট্যাটু, অস্ত্র, ধর্মীয় বিশ্বাস ইত্যাদি মুভিতে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। সব কিছু বিবেচনা করে বলা যায় অ্যাপোক্যালিপ্টো একটা 'মাস্ট সি' মুভি।

…….
পালাচ্ছে জাগুয়ার প
……..
২০০৬ সালের ৮ ডিসেম্বরে রিলিজ পাওয়া ডিরেক্টর মেল গিবসনের অ্যাপোক্যালিপ্টো ৪০,০০০,০০ ডলার ব্যয়ে নির্মিত। ছবিটি সারা বিশ্বে আয় করেছে ১২০,১৭৫,২০০ ডলার। অ্যাপোক্যালিপ্টো ২০০৭ সালের অস্কারে তিনটি ক্যাটেগরিতে নমিনেশন পেয়েছিল। ক্যাটেগরি তিনটি হচ্ছে, বেস্ট অ্যাচিভমেন্ট ইন মেকআপ, বেস্ট অ্যাচিভমেন্ট ইন সাউন্ড এডিটিং এবং বেস্ট অ্যাচিভমেন্ট ইন সাউন্ড মিক্সিং।

বন্ধুদের কাছে লেখাটি ইমেইল করতে নিচের tell a friend বাটন ক্লিক করুন: