এবাদুর রহমান এবং তাঁর দাস ক্যাপিটাল

seuty
Published : 25 June 2008, 05:32 PM
Updated : 25 June 2008, 05:32 PM

এবাদুর রহমানের লেখা প্রথম পড়ি কাউন্টার ফটো পত্রিকায়, বন্ধু মানস চৌধুরীর উছিলায়। পরবর্তীতে ওঁর উপন্যাস দাস ক্যাপিটাল-এর কথা বন্ধু মানস এবং সুমন রহমান জানান গত বছরের শেষ দিকে। বইটি প্রকাশ

…….
এবাদুর রহমান প্রণীত দাস ক্যাপিটাল । প্রকাশক: অস্ট্রিক আর্যু, বাঙলায়ন, রুমি মার্কেট ৬৮-৬৯ প্যারীদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১০০০, ই মেইল: banglayan@ yahoo.com । প্রথম প্রকাশ: ফাল্গুন ১৪১২, ফেব্রুয়ারি ২০০৬। স্বত্ব: বেরেনিস গাজ্যে । প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: এবাদুর রহমান । বহি পরিকল্পনা: মুসতাইন জহির । মূল্য: ২৯০ টাকা ।
…….
করেছে বাঙলায়ন। বই হাতে পেয়ে পড়তে পড়তে বছর গড়ায়। এবং পড়া মাত্র বইটি নিয়ে লিখবার তাগিদ অনুভব করি। তাগিদটা খানিক এসেছে ওঁর দুর্দান্ত ভাষা ব্যবহার দেখে — সেই ভাষার ছত্রে ছত্রে ওর 'নিজ'-বিনির্মাণ প্রক্রিয়া দেখে। প্রক্রিয়াটার কামিয়াবি বা নাকামিয়াবি বিচার করা আমার লক্ষ্য নয়। এমনকি আমার ইরাদা এবাদের কাজের সাহিত্যগুণ বিচার করাও নয়। বরং আমার বাসনা বইটি যে সামাজিক-ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে সেটা নিয়ে দু'চার কথা বলা। এবাদ-ভাষা রাজ্যে প্রবেশ করা। আরো খোলাসা করে বললে, আমার আগ্রহ বইটা যে আলোচনায় পাঠককে শামিল করতে চেয়েছে তার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করা।

…….
এবাদুর রহমান
…….
এবাদের উপন্যাসের বিন্যাস ভীষণরকম কৌতূহলোদ্দীপক। বঙ্গভাষা মানচিত্রে ওঁর কাবিল অবস্থানকে ওঁ স্পষ্ট করেন বঙ্গভাষী বিখ্যাত লেখকদের তাঁর সম্পর্কে লেখা প্রশংসানামা বিজ্ঞপ্তি আকারে পাঠক-মেহফিলে পেশ করে। এবাদ পাঠককে উপন্যাসটি পড়বার সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে ওয়াকিফ করান। এবাদ ভূমিকাতে ওঁর সময়ে, রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় 'নিজ'-এর অবস্থিতি স্পষ্ট করেন — সচেতন ভাবে নিজ অবয়ব নির্মাণ করেন। ওঁর বসতি, গোত্র পরিচয়, ওঁর বেড়ে ওঠা, যাপন পদ্ধতি, রাষ্ট্র নিয়ে বোঝাপড়া প্রতিটা ব্যক্তিক অনুভূতিকে ভাষিক রাজনীতির উপাচারে রূপান্তরিত করতে সচেষ্ট হন। ভূমিকাটি মূলত ওঁর উপন্যাসে আপাত বিচ্ছিন্ন গদ্য, প্রবন্ধ এবং সাক্ষাৎকারগুলোর মূল সুর নির্ধারণ করেছে।

এবাদের উপন্যাসের মূল আখ্যানগুলো রচিত হয়েছে ঢাকাই এলিট কওমের নেটওয়ার্ক, এদের অস্তিত্বের সংকট এবং এদের যৌন সংলাপ নিয়ে। এই কওমের সম্পর্কের প্রত্নতত্ত্ব, বংশগতি পরতে পরতে উন্মোচন করতে করতে এবাদ এক নয়া সময়ের মেনিফেস্টো রচনা করেছেন। উপন্যাসের শুরুটা কোনো বিন্যাস মেনে হয়নি। ফলে ঘটনার পারম্পর্য নেই কোনো, নেই কোনো রৈখিক বিবরণী। কিছু গল্প, আত্মকথন, প্রবন্ধ, চিঠি মিলে দাস বাবু-বিবিদের খণ্ডিত এক মহাবয়ান রচনা করতে চেয়েছেন এবাদ। এই বয়ানের শুরুয়াত হয় ওঁর আত্মকথন দিয়ে। ও পাঠককে ওঁর শৈশবে নিয়ে যায়। ওঁর প্রথম ইওরোপ যাত্রা, পারিবারিক সংকট, ওর দাদুভাইর ত্রাতা হিসেবে নাযেল হওয়া, ওঁর জেঠু মনির আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে সম্পর্ক আবিষ্কারের মতো ঘটনাগুলো ক্রমাগত ঘটতে থাকে। সেকালের মনোভঙ্গি ওঁর পরবর্তী জীবনপ্রবাহের ইঙ্গিত বহন করে। এই অংশে এসে এবাদ পাঠককে উপন্যাসের পাত্রী হিসেবে প্রোথিত করতে সচেষ্ট হন। পুরো বই জুড়ে পাঠকের সঙ্গে কথোপকথনের ঢঙে একটা সিনেম্যাটিক রিয়েলিটি রচনা করতে চান লেখক।

'দ্রুত মোশন পিকচার কার্মা'য় মূল চরিত্র নূর। নূরের পারিবারিক সংকট — বাবা-মার বিচ্ছেদ, বাবার নতুন সংসার পাতা, মায়ের পুরুষ বন্ধু ও তাদের সঙ্গে জটিল সম্পর্ক নিয়ে ঘটনা ঘনীভূত হয়। নূরের বয়োসন্ধিতে যৌন অস্তিত্ব নিয়ে সংকট এবং বন্ধু নেটওয়ার্ক ঘিরে এই আখ্যানের বিস্তৃতি ঘটে। এবাদ এই আখ্যানের অংশ হিসেবে নূরের মায়ের বন্ধু তাসনিম মুর্তজার ঠিকুজি পেশ করেন। লেখক মুর্তজা সাহেবের বাবার দেশী-বিদেশী নেটওয়ার্কের গুণে মুসলিম লীগ আমলে ব্যবসায়ে ব্যাপক সুবিধা ভোগ করেছেন বলে পাঠককে জানান। পরবর্তীতে মন্ত্রী পরিষদের সদস্য হওয়া, সরকারি তহবিল তসরুফ করে কোটি টাকার সাম্রাজ্য স্থাপন করা ছিল সময়োচিত পদক্ষেপ। তাসনিম মুর্তজা এই সাম্রাজ্যের যোগ্য উত্তরাধিকারী মাত্র। একই ভাবে এবাদ নূর ও তার বন্ধু বুশরার রাষ্ট্র্রদূত বাবা আর প্রভাবশালী মায়ের কুকীর্তির খতিয়ান পেশ করে। সমান্তরালে আমরা নূর বা ফিনির চরিত্রটাকে বেড়ে উঠতে দেখি। নিজ যৌনতা নিয়ে বিভ্রম থেকে নার্ভাস ব্রেকডাউন, মনোসমীক্ষকের চিকিৎসাধীন থাকা, নয়া সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনে নিজেকে অভ্যস্ত করা এবং পরিশেষে নূরের ফিনি হিসেবে, একজন কিশোরী হিসেবে আত্মপ্রকাশ — এই অংশকে টানটান করে রেখেছে।

'পুং-কান্নার কাফে'-তে নূর আর ফিনি আবার ফিরে আসে। নূরের খণ্ডকালীন ঢাকাই জীবন নিয়ে রচিত হয়েছে এই আখ্যান। এই কাহিনীর শুরুতে নূর আর তার বোন আমেরিকা থেকে দেশে ফেরে বাবা ও দ্বিতীয় মায়ের ঘরে। নূর আর ফিনির পরিবারের সঙ্গে, ঢাকাই বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন তথা খোদ ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের গল্পের সাথে পাঠক সম্পৃক্ত হন। নূরের প্রগাঢ় অনুভূতিমালা নিয়ে পৌরুষের এক অদ্ভুত যাত্রাপথ রচনা করেছেন এবাদ। পরিবার বা বন্ধুত্ব নিয়ে সে যেমন উদাসীন, ঠিক ততটাই ত্রস্ত এবং স্থানবিশেষে ভঙ্গুর প্রেমানুভূতি নিয়ে, ছোটমায়ের প্রতি মমত্ব নিয়ে। কাহিনীর কাল এগিয়ে যায় কয়েক বছর। নূরের দ্বিতীয় মার সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ ভীষণ বিষণ্ন আবহ তৈরি করে। নিজের এবং পরিজনদের নানা ঘটনায় উদ্ভূত অনুভূতিমালা সামাল দিতে দিতে নূরের কান্নাগুলো জমে এক গাঢ় নৈর্লিপ্তির জন্ম দেয়।

ন্যান গোল্ডিনকে নিয়ে এবাদের প্রবন্ধটি ছাপা হয় প্রথমে কাউন্টার ফটো পত্রিকায়। প্রবন্ধটি এক কথায় অনবদ্য। রচনাটিতে ন্যানের আলোকচিত্রী সত্তাকে উন্মোচন করতে গিয়ে ওঁর বেড়ে ওঠা, ওঁর যাপিত জীবন, ওঁর সংগ্রাম, বিশ্ববীক্ষার খতিয়ান পেশ করেন এবাদ। দেরিতে হলেও ফটোগ্রাফি নিয়ে বাংলাদেশে লেখালেখি শুরু হয়েছে। এবাদের ন্যানকে নিয়ে লেখাটা রিপ্রেজেন্টেশনের যে চলমান রাজনীতি এবং ধারাগুলো প্রচলিত আছে তার একটি শক্ত উদাহরণ। ন্যানের সংবেদী জীবন আর ওঁর ছবিতে কোনো ফাঁক ছিল না কোনো কালে। ওঁর জটিল পারিবারিক জীবন, সমকামী-ড্র্যাগকুইন-ট্রান্সভেস্টাইট-ক্রসড্রেসার-মাদকসেবী প্রমুখ সাবকালচারে নিজেকে সমর্পণ, 'সত্য কমিউনিটি স্কুল' আশ্রয়, বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়, আন্ডারগ্রাউন্ডে জীবন্ত-কিংবদন্তী হয়ে ওঠা সকলই ওঁর অবস্থিতির অংশ। ওঁর ছবিয়াল জীবনের অনুষঙ্গ। ন্যান স্রেফ নিকটজনের সঙ্গে ওর দৈনন্দিন উদ্যাপনের কালগুলো ছবিতে ধরে রাখতে চেয়েছেন। ওঁর সমকামী, ড্র্যাগকুইন, ট্রান্সভেস্টাইট সঙ্গীকুলকেই ন্যান তার পরিবার জেনে এসেছেন। যারা সামাজিক পরিভাষায় সুস্থ নন। ফলতঃ রিপ্রেজেন্টশনের প্রচলিত ভাষাভঙ্গিকে নিজ প্রয়োজনে বদলাতেই হয়েছে ন্যানের। সমাজ, রাষ্ট্র প্রণীত সকল নিয়ম বা প্রচলিত বোধগম্য সকল সীমারেখা লঙ্ঘন করে প্রতিইতিহাস রচনা করেছেন তিনি। ন্যানের ছবিকে উছিলা করে এবাদ নয়া বিপ্লবের পাল্টা আধিপত্যের ভাষা খুঁজতে সচেষ্ট হয়েছেন মিশেল ফুকো, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, র‌্যলা বার্থ, সুস্যান সনট্যাগ এবং বদ্রিলার্ডের তত্ত্বে। এবং নিজের পর্নোগ্রাফি নিয়ে এ্যনার্কো-লিবার্টাইন অবস্থান স্পষ্ট করেছেন।

'ডেজা-লু' নানা ঘটনার কোলাজ। এবাদের বন্ধু এবং সম্পর্কিতদের ডায়েরি, চিঠি থেকে এই আখ্যান রচিত। মূলতঃ বয়ঃসন্ধিকালের তাদের নিয়ত পরিবর্তিত মনোজগতের, দৈনন্দিন কারনামা। তাদের সম্পর্ক ভাবনা, টানা বিষণ্নতা আর ইফ্ফাতের 'মোরা মোরা টাউনশিপে'র নানা পার্টির গল্প। এর পরের অংশে এবাদের বড়বেলার সাহিত্য-বন্ধু, ওঁর বাবা, সোহা, মুনা প্রমুখের সঙ্গে চিঠি যোগাযোগগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এই যোগাযোগগুলোতে এবাদ পাঠককে খুব নিয়ন্ত্রিতভাবে তার লেখালেখি নিয়ে মনোভাবের হদিস দেন। নানা যোগাযোগের মধ্যে কর্নেল শওকত মোমিন খান মজলিশ এবং তার প্রতিবন্ধী পুত্রের নার্স মিনতি গোমেজের সঙ্গে যোগাযোগ তুলে ধরা হয়। এ যোগাযোগে কর্নেল শওকতের নার্স মিনতির প্রতি নির্ভরতা, তার বৈচিত্র্যময় যৌন প্রবণতাসমূহ মূর্ত হয়। এমনকি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে নৈকট্য এবং নেপথ্যে রাষ্ট্র্রের গুপ্তচর হিসেবে দায়িত্ব পালনের মত গূঢ় তথ্য এই চিঠিগুলো থেকে বেরিয়ে আসে।

পুস্তক সমালোচনা 'ক্যাবারে ভলটেয়ার'-এ ইতোপূর্বে প্রকাশিত ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদের আলো অন্ধকারে আলো অন্ধকারের যাত্রা বইটির সমালোচনা করেছেন এবাদ। বইটা যে অহেতু মিডিয়ার সুনজর লাভ করেছে এবাদ সেটা তার আলোচনায় নিশ্চিত করেছেন। এবং নির্মমভাবে বইটির পোস্টমর্টেম করেছেন। বইটি আর যাই হোক এবাদের ভাষ্য অনুসারে বাংলা সাহিত্যে নতুন কিছু সংযোজনে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এই বিবেচনার পরে ডাডা আন্দোলনের পূণ্যভূমি ক্যাবারে ভলটেয়ার নামে এই পুস্তক সমালোচনার নামকরণের শানেনযুল বোধগম্য হয় না।

গল্প 'হো নীল ঘোড়েকা আসোয়ার' দৈনিক প্রথম আলোতে ছাপা হয়। এই গল্পের মূল চরিত্র সোহা হাদিদ এবং তার বৈচিত্র্যময় যৌনভাবনা। এবাদের অন্যান্য গল্পের চরিত্রগুলোর মতো সোহার বেড়ে ওঠার ইতিহাস সম্পর্কে পাঠক ওয়াকিফ হন। ওর যৌনতার মেনিফেস্টো, প্রগাঢ় কামনা-রাজ্যে সম্রাজ্ঞীর মতো অধিষ্ঠান, প্রত্যাখ্যান-লাঞ্ছনার অভিজ্ঞতা এই স্পর্শকাতর আখ্যানের উৎস। সোহার আটপৌরে জীবনের সঙ্গে সংযুক্তি-বিযুক্তি এবং কামনার টানে সেই নিপীড়নকারীর কাছেই ফিরে যাবার জটিল আবর্তন এবাদের ভাবনায় নয়া মোড় দেয়। এবাদ যোনি-শিশ্ন ইতিহাস নিয়ে বরাবর মনোযোগী। সকল দুবিধা ত্যাগ করে যখন মানব দ্বৈরথে লিপ্ত হয়, সেই স্ফূরণের আভায় জগৎকে দেখতে চেয়েছেন লেখক। ফলে সোহার যাপন পদ্ধতির প্রতি লেখকের আস্থা অটুট থাকে।

'ভ্যানিলা কৌমের স্মৃতি'তে নূর চরিত্রটি আবার ফিরে আসে। গল্পটা নূর, নূরের সখী ফাইজুন ও তার পার্টনার মুনাব্বরকে নিয়ে শুরু হয়। এটি নূরের প্রতি ফাইজুন প্রগাঢ় কামনার আখ্যান, যা মুনাব্বরকে ছাড়া পূর্ণ হয় না। নূরের সঙ্গে ফাইজুনের শেষ সাক্ষাৎ দিয়ে গল্প শুরু, সেখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু ফাইজুনের মৃত্যুর পরে মুনাব্বার এবং নূরের অদ্ভুত এক যৌথতা শুরু হয়। মুনাব্বারের গাড়িতে ওদের এ্যাকসিডেন্টটা ঘটে। ফ্ল্যাশব্যাকে পাঠক নূরের ডারিয়ার প্রতি আকর্ষণ, ওর প্রস্তাবে ন্যুড মডেল হওয়া, S&M যজ্ঞে মুনাব্বার সমেত নিজেকে সমর্পণের মতন সুর‌্যরিয়াল কাহিনীর অংশ হয়ে ওঠে। ফাইজুনের মৃত্যুর পরে নূরের লন্ডন ভ্রমনের টিকেট প্রাপ্তি, সাস-ফিতে ডারিয়ার সঙ্গে মিলনের ব্যাকুলতা ও প্রস্তুতি, ফোনে নূরের নিজ এ্যাকসিডেন্টের সংবাদ জানার মতো ঘটনাবলীর মাধ্যমে এবাদ স্থান এবং কালের একরৈখিকতা ভেঙে অদ্ভুত অনুভব-বাস্তবতা রচনা করেছেন। একদম আচমকা ফিনির কিছু ডায়েরির পাতা এই কাহিনীতে জুড়ে দেয়া হয়েছে, যা কাহিনীর গতিকে ব্যাহত করেছে।

অদিতি ফাল্গুনীর লেখা নিয়ে উচ্ছ্বসিত রিভিউ করেছেন এবাদ। এডওয়ার্ড সাঈদ এবং ইকবাল আহমেদের উপরে একটি প্রবন্ধ এতে সংযোজিত হয়েছে। যুক্ত হয়েছে ভারতী মুখার্জি, পি জোনস্রে সঙ্গে এবাদের সাক্ষাৎকার। অদিতি ফাল্গুনীর নেয়া এবাদের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার 'পূর্ব বাঙলার ভাষা: নাখোজাবাদের নোম্যাডোলজি বা যাযাবর-তত্ত্ব' নিয়ে খানিক না বললেই নয়। এই সাক্ষাৎকারে এবাদ নতুন ভাষা-ভূগোল-দর্শন হাজির করেছেন। পুরাতন ভাষা যা ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত/নির্র্দেশিত তা ভেঙে বেরিয়ে নয়া বাস্তবতা রচনার খোয়াব দেখেছেন এবাদ। নতুন ভাবধারার রচয়িতাগণ নতুন ভাষায় যাপনের রাজনীতিকে মূর্ত করবেন এবং মতাদর্শিক নেতৃত্ব দেবেন –এই এবাদের কাঙ্ক্ষা। এই কাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে এবাদ বিপ্লবীদের মাঝে নিরন্তর সঙ্গী খুঁজেছেন। পূর্ব বাঙলার ভাষা জগতের সম্ভাব্য সঙ্গীদের গুরুত্বপূর্ণ ভাবনাগুলোকে তিনি সংকলিত করেছেন।

এপিলোগে এবাদ তাঁর সকল প্রিয়পাত্রদের পুনরায় হাজির করেছেন। আখ্যানের শুরুয়াত হয় এবাদ এবং বেরেনিসের বিয়ের দিন থেকে। ক্রমে কাহিনী জট পাকাতে শুরু করে। পাঠক ফ্ল্যাশব্যাকে বেরেনিসের সঙ্গে এবাদের জাপানে বসতকাল, তারও আগে আটলান্টিকের তীরে নূর, তনুকা, শফি, বেরেনিস সমেত কাটানো কাল, তারো আগে এবাদের বুশরার সাথে প্রথম দ্বৈরথের স্মৃতি রোমন্থন করতে দেখে। এবাদের মায়ের অসুস্থতা, মধুচন্দ্রিমায় বালিতে এবাদকে ফেলে বেরেনিসের একা প্যারিস যাত্রা বায়োস্কোপের মত ঘটতে থাকে। প্যারিসে এয়ারপোর্টে বোমা বিস্ফোরণ ডেজা-ভুর মতো ফিরে ফিরে আসে। বেরেনিসকে প্রথম চুম্বন এঁকে দিয়ে এবাদ এপিলোগ শেষ করেন।

এবাদের উপন্যাসের চরিত্রগুলো ম্যরাল শাসিত নয় বলেই এদের আমরা বেড়ে উঠতে দেখি মুক্ত বাতাবরণে। এদের বেড়ে ওঠার কাহিনীগুলোর অবধারিত অংশ হয়ে আসে আপাতঃ অপ্রয়োজনীয় স্কুলের গল্প, পার্টির গল্প। একদম হালকা চালে চরিত্রগুলোর বুননের পরতে পরতে উঠে আসে যৌন অস্তিত্ব নিয়ে তীব্র সংকট, সংসারে ভাঙন, শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ, যৌনতা উদ্যাপনের মতো জটিল প্রসঙ্গসমূহ। জীবন যাপনের উচ্ছ্বাস আর প্রগাঢ়তাকে ছুঁতে গিয়ে এবাদ পাঠককে দাঁড় করান এক অপ্রিয় রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক বাস্তবতায়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবাদ পাঠককে তাঁর কওমের পূর্বসূরীদের এবং সমসাময়িকদের সঙ্গে মুলাকাতের বন্দোবস্ত করেন। এদের সম্পদ, সম্পত্তি, সম্পর্কের নেটওয়ার্ক আর মিথোজীবিতার খতিয়ান নাঙ্গা করেন — রাজনীতিতে এদের গতায়াত স্পষ্ট করেন।

আমার আগ্রহের জায়গা মূলত এবাদ-বর্ণিত গোত্রের খতিয়ান এবং এদের কসমোপলিটান অস্তিত্ব। গত তিরিশ বছরে ঢাকাই সম্পন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ, এলিটিকরণ প্রক্রিয়া, দেশে-বিদেশে এদের স্বচ্ছন্দ বিচরণ, যাপনে কসমোপলিটান কাক্সক্ষা এবাদ চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন। বলা বাহুল্য নয় যে ক্ষেত্রবিশেষে লেখকের আগ্রহ যাপনের অনুষঙ্গগুলোর অনুপুঙ্খ বিবরণী তৈরি করা। দাস ক্যাপিটালে দাসবাবু-বিবিদের ব্র্যান্ড দাসত্ব জাহির করা। উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীদের রিপ্রেজেন্টশনে কসমোপলিটান গুণপনা সমুন্নত রাখা এই উপন্যাসে লেখকের অন্যতম শক্তির জায়গা। সম্ভবতঃ একারণেই চরিত্রগুলোকে বড় অপ্রোথিত লাগে। বাঙ্গাল পাঠকের জন্য হার্মেসের স্কার্ফ, মালোনো ব্লাহনিক হিল, প্রাদা স্যুট এক নয়া ভোগজগতের ইত্তেলা দেয় যা বঙ্গদেশে শুধু অধরাই নয়, অসম্ভবই বটে। এই জবানি একটি নির্দিষ্ট বিশ্ববীক্ষার (আমি যাকে কসমোপলিটান বীক্ষা বলছি) গ্রাহক হলেই কেবল বোধগম্য হওয়া সম্ভব। স্থানবিশেষে কিছু বিবরণী ভীষণ পৌনঃপুনিক লাগে এবং তাতে, অবাক নয় যে, বইয়ের বপুও অহেতু বিশাল মনে হয় (৩৭৬ পৃষ্ঠা)।

এবাদ উপন্যাসে শরীর, যৌনতা নিয়ে নানা মত হাজির করেছেন। লেখক নিজ কওমের বর্ণিল একই সঙ্গে ভীষণ ভারি যৌন প্রবণতাগুলো উন্মোচনে ব্রতী হয়েছেন। ক্ষমতার নয়া ভরকেন্দ্র খুঁজতে বারবার এবাদ শরীরী অনুভবে সওয়ার হয়েছেন। ওঁর ভাষায় "সুরম্য ও হিংস্র যাপন ও সেই যাপন থেইকা উইঠা আসা মণীষা"য় ওর 'পক্ষপাত', 'আকর্ষণ' এবং 'প্রেম' আছে (এবাদ ২০০৬: পৃ ২১০ দেখুন)। কিন্তু নিজ কওমের কাঠামোতে সীমাহীন যৌন নিপীড়নের যে ইতিহাস সেটা ওঁর উদযাপনের ভাষার আড়ালে চাপা পড়ে যায়। লেখক নয়া সমাজের যে খোয়াব দেখেন সেখানে যেন ধরেই নেয়া হয় প্রতিটা বাসিন্দার এজেন্সি আছে এবং তাদের ক্ষমতাকাঠামো সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান আছে। শরীরী প্রজ্ঞার ভাষা তাদের অধিগত। কেবল এই ভাষাকে বিপ্লবের ভাষায় এরা অনুদিত করলেই কেল্লা ফতেহ্ হবে।

ওঁর বিবরণী ভীষণ সাবজেক্টিভ, ফলতঃ স্বশ্রেণী ইতিহাস রচনায় ওঁর উপন্যাস বঙ্গভাষা-ভূগোলে নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু এটুকু বলা জরুরি ওর জবানিতে যে মেনিফেস্টো এবাদ রচনা করেছেন তাতে পাঠকের ভুল বোঝাবুঝির অজস্র পকেট রয়েছে। ভাষা বাস্তবতা নির্মাণের রসদ তা নিয়ে আমার এবাদের সঙ্গে কোনো বিবাদ নেই। সমাজ বদলের জন্য ভাষা বদল জরুরি — এ কথা আমার মতো আনাড়িও বোঝে। ভাষার সয়ম্ভূ কোনো সত্তা বা সজ্ঞা নাই, ফলে নয়া যাপনের ভাষাই যে সমাজ বদলের ভাষা হবে সেটাও বোধগম্য। কিন্তু এসকল কথায় যা বোধগম্য হয় না তা হলো এবাদ কাদের যাপন নিয়ে বলছেন। আমজনতার যাপন নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নাই সেটা নিশ্চিত। যদি এবাদ বর্ণিত 'যাপন' খাস জনতার হয় তাহলে ওর মনজিল এবং ইরাদা দুই পাক্কা। এবাদ তাহলে সুনির্দিষ্ট রুচিসম্পন্ন নিজ কওম-বাসিন্দাদের জীবন যাপন পদ্ধতি বদলের কথা বলছেন। আমার সীমিত জ্ঞানে সেটা বেশ ভয়ঙ্কর প্রপঞ্চ। এবাদের আমজনতা এড়িয়ে ভাবনা নয়া রুচিহীন বা খ্যাত 'অন্য' সৃষ্টি করবে। যারা হাই-এন্ড ব্র্যান্ড নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয় বরং ব্রেড এবং বাটার ইস্যুতে আটকে গেছেন। এই 'অন্য'রা নয়া যাপনের ভাষায় নয়া 'সিম্বলিক ভায়োলেন্সে'র গন্ধ পেতেই পারেন (বোর্দ্যুর সরল পাঠ করলে বলা যায় 'সিম্বলিক ভায়োলেন্স' হলো অক্ষম শ্রেণীর প্রতি ক্ষমতাধিকারী শ্রেণীর নানা প্রকার আনদেখা নির্যাতন যা কোনো বলপ্রয়োগ ব্যাতিরেকে কায়েম থাকে — যা অদৃশ্য, অনোপলব্ধ, স্বনির্বাচিত। যা বিশ্বাস, আনুগত্য, সঙ্ঘ ভাবনা, কর্তব্য পালনের মতো কাজগুলোর মধ্য দিয়ে ব্যক্তির অভ্যাসে পরিণত হয়। বিস্তারিত জানতে পিয়ের বোর্দ্যু দি লজিক অফ প্র্যাকটিস বইটি দেখতে পাঠককে অনুরোধ জানাই)।

এবাদের যাপনের রাজনীতিতে নয়া নিপীড়নের রাস্তা উন্মুক্ত হবার আশঙ্কা আছে। ফলে নব্য রুচিবানরা, যারা মতাদর্শিক নেতৃত্বের পুরোভাগে থাকবেন তারা নতুন ধরনের অসমতা সৃষ্টির সম্ভাবনাকে জিইয়ে রাখছেন। সেক্ষেত্রে নয়া বিপ্লব অন্তঃশ্রেণী বিপ্লবে পরিণত হওয়াটাই কি এবাদের কাম্য?

ঢাকা, ১/১২/২০০৭