একটি ক্ষুদ্র পুরাতন দীর্ঘশ্বাস

shagufta_tania
Published : 26 June 2008, 05:36 AM
Updated : 26 June 2008, 05:36 AM


সুন্দরবনের চুনকুড়ি নদী পার হয়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়া বাঘ। তিনজন মানুষ হত্যার পরে গ্রামবাসী বাঘটিকে পিটিয়ে মেরেছে। বাঘটি আশ্রয় নিয়েছিল শ্যামনগরের কদমতলার রণজিৎ মণ্ডলের রান্নাঘরে। ছবি দৈনিক প্রথম আলোর সৌজন্যে।

গত বড়দিনে লন্ডনে আমি একজন সদ্য বিধবা আইরিশ মহিলার কাছ থেকে একটি চলচ্চিত্রের কপি উপহার পেয়েছিলাম — অ্যান আনফিনিশ্ড লাইফ (২০০৫)। মৃত এবং মুমূর্ষুকে ঘিরে জীবনের ওঠাপড়া। ওয়াইয়োমিংয়ের এক আধবুড়ো মিচ ব্র্যাডলী (মর্গান ফ্রিম্যান) — তাকে মর্মান্তিক ভাবে আহত করে একটা বুনো ভাল্লুক। ভাগ্যচক্রে একসময় ভাল্লুকটা লোকালয়ে আসে আবার। ধরা পড়ে। স্থানীয় চিড়িয়াখানার ক্ষুদে খাঁচা তার জন্যে বরাদ্দ হয়। অসুস্থ মর্গান ফ্রিম্যান তাকে দেখতে আসে, পশুর অনিকেত অদম্য স্পৃহার সেই খাঁচার চৌখুপীতে যে অসম্ভব অবদমন — যা পৃথিবীর মতো, রিপুর মতো পুরাতন — তাকে তিলে তিলে মরতে দেখে মর্গান ফ্রিম্যান-এর চোখে যে গভীর বিদ্ধ বেদনা, তার তুলনা হয় না। ফ্রিম্যান-এর সানুনয় অনুরোধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আইনার (রবার্ট রেডফোর্ড) ভাল্লুকটাকে চিড়িয়াখানা থেকে ছেড়ে দেয়। কাকতালীয়ভাবে ভাল্লুকটার সাথে মর্গান ফ্রিম্যান-এর আবার দেখা হয়, এইবার হয়তো নিশ্চিত মৃত্যু। কিন্তু অপেক্ষমান মৃত্যুপথযাত্রীকে তেমন কিছু না বলে একটা হ্রস্ব হুঙ্কার ছেড়ে ভাল্লুক চলে যায়।

রেডফোর্ডের দূরবীনে ধরা পড়ে পাহাড়ের চড়াই ভেঙে গহীন অরণ্যের দিকে ফিরে যাচ্ছে ভাল্লুক, প্রকাণ্ড মা-পৃথিবীর কোলে তার বিপুলকায় বালক ফিরে যাচ্ছে।

সিনেমার দুনিয়াতে পশুর ভাগ্য ভাল বলতে হবে। বাস্তবের দুনিয়াতে পশু লোকালয়ে আসে। নরহত্যা করে। নরহত্যার শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড (যদি না সে সরকারী দল করে), অতএব রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারটিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। বনবিভাগের তত্ত্বাবধানে না অনবধানে, সেই তর্ক অর্থহীন। অন্ততঃ বাংলাদেশে এই তর্কের কোনো মানে নেই।

যেহেতু বাঘের কোনো বাবা মা আহাজারি করে না, বাঘের কোনো ভাই প্রশাসনকে প্রশ্ন করবার — সাংবাদিক সম্মেলন করবার বুদ্ধিবৃত্তিক জোর রাখে না, সেহেতু এই বাঘটাকে কেউ মনে রাখবে না। রণজিৎ মণ্ডলের রান্নাঘরের খড়ের চালে আয়েশ করে বসে থাকা জুলজুলে চোখের এই বাঘটা যাত্রা করবে আরও দশটা বাঘ (সাতক্ষীরায় পিটিয়ে মারা বাঘগুলি) যেখানে গেছে সেই দিকে। বিস্মরণের দেশে। সেখানে আমাদের ভুলে যাওয়া গানের কলি, ম্যাট্রিকের রেজিস্ট্রেশন নম্বর, পুরনো ছাঁটের কামিজের ছাপা কাপড়ের সাথে ভুলে যাওয়া এই বাঘগুলিও গুটিসুটি মেরে বসে থাকবে। 'আছে কিন্তু নেই' হয়ে।

বন বিভাগকে আমাদের কিছু বলার নেই। যে দেশে মানুষ মারলে বিচার হয় না সে দেশে প্রাণী (!) নিয়ে ভাবালুতার অবকাশ নেই। ৩২টা চড়ুই পাখি আস্ত মচমচে ভাজা করে বিক্রি হলে কিছু বলার নেই। এলিফ্যান্ট রোডে 'শিকার-অ্যাশ্‌শিকার' বলে পোচার্ড-ম্যালার্ড ইত্যাকার অপূর্ব পাখি ভোজনার্থে বিক্রি হলে কিছু বলার নেই। চিড়িয়াখানার বাঁদরটা ঝিমাতে ঝিমাতে বারবার খাদ্যের বাটিটা উল্টে ঠক্ ঠক্ শব্দ করে খাবার চাইলে কিছু বলার নেই। রানী মাছ কিংবা খল্‌সে মাছ নদীতে আর না থাকলে কিছু বলার নেই। নেড়ি কুকুরের লেজ পরিহাসছলে কেটে দিলে কিছু বলার নেই। পাড়াতুতো বিড়ালটাকে গরম ভাতের মাড় ছুঁড়ে জীবন্ত দগ্ধ করলেও কিচ্ছু বলার নেই।

আচ্ছা আবার আমরা সুন্দরবনে ফিরে যাই। বনবিভাগের সহায়তায় আর কয়েক বছরের মধ্যেই আমরা সুন্দরবনকে হিংস্র শ্বাপদ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ! তারপর আমরা নির্ভয়ে জ্বালানি কাঠ এবং আসবাবপত্রের জন্যে জঙ্গল সাফ্ করবো, যতটা এদ্দিন এইসব বেহুদা বাঘের জন্যে করা সম্ভব হয়নি। ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা রেইন ফরেস্ট নাকি একবার উজাড় হয়ে গেলে আর দ্বিতীয়বার বনায়ন সম্ভব হয় না? কে বলেছে? আমাদের আছে ইপিল-ইপিল, আমাদের আছে ইউক্যালিপ্টাস। অতএব বাঘের পিছনে পিছনে সুন্দরী-কেওড়া-গোলপাতা-কাঠবেড়ালী-বাঁদর-কুমীর-গাঙশুশুক-কোলাব্যাঙ মৌনমিছিল করে চলে যাবে — ঐ আবার সেই বিস্মরণের দেশে।

গোধূলি বিকীর্ণ জলাভূমি আমরা ভালো ভরাট করতে জানি, বাসাবো-সবুজবাগ-খিলগাঁও-আশুলিয়া… আমাদের তালিকা দীর্ঘ।

অতএব, সুন্দরবনকেও আমরা সমান করে ফেলবো। তারপর সুন্দরবন হাউজিং করবো। সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতাল। বিশ্ববিদ্যালয়। ইকো পার্ক (বানানটা eco-park না হয়ে echo-park হতে পারে, খালি জায়গা তো, বিরান স্থানে প্রতিধ্বনি ভালো খেলতে পারে)।

গোটা দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যাবে। জোয়ারের উচ্চতা অবশ্য কখনো ১০০-১৫০ ফুট হতেও পারে, কেননা দুর্যোগের শক-অ্যাবজর্বার হিসেবে সুন্দরবন আর নেই। দুর্যোগ হলে একদিক থেকে ভালোই তো, আমরা কতো রিলিফ পাবো, পৃথিবীর মানুষ দেখবে বাংলাদেশ 'জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।'

ঠিক কবে আমরা মাথা নিচু করবো নিদারুণ লজ্জায় আর বেদনায়? কবে আমরা আমাদের নিলর্জ্জতা আমাদের সর্বগ্রাসী পশুত্ব সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হবো?

একসময় আমাদের আব্বা আমাদের ভোররাতে তুলে দিতেন পরিযায়ী পাখি দেখবার জন্যে। পশ্চিম আকাশে ছাড়া ছাড়া মেঘের মতো, তীব্র তপ্ত ধাতুর অণুর মতো কাঁপতে কাঁপতে পাখিরা চলেছে, দূরায়ত মঞ্জীর তাদের গলার আওয়াজ।

আমার ভূমিষ্ঠ হবার জন্যে অপেক্ষমান ভাইপো কিংবা ভাইঝি, আমার 'হলেও হতে পারতো' পুত্র কিংবা কন্যা — তোমাদের জন্যে আমরা প্রজাপতি-ধানশালিক-বেজী-গোসাপ-বাবুই পাখি-জলফড়িং এইসব কিছু রেখে যাবো না। তোমাদের জন্যে শুধু থাকবে পাথরের চোখ দিয়ে তাকিয়ে থাকা ট্যাক্সিডার্মিস্ট-এর যত্নে গড়া স্টাফ্‌ড টয়। আর অপরিকল্পিত দুর্নিবার লুব্ধ শহরগুলিতে যাবজ্জীবন কারাবাস। আমাদের মতোই।

তোমরাও হয়তো পড়বে আফিমগ্রস্ত কোলরিজ্-এর বিখ্যাত লাইন: He prayeth best who loveth best…

কেবল পরীক্ষার পড়া হিসেবে।

আমাদের মতোই।

ঢাকা ২৩/৬/২০০৮

বন্ধুদের কাছে লেখাটি ইমেইল করতে নিচের tell a friend বাটন ক্লিক করুন: