বর্ষায়, বাদাবনে

মীর ওয়ালীউজ্জামান
Published : 1 Oct 2008, 04:23 AM
Updated : 1 Oct 2008, 04:23 AM

ওয়ার্ল্ড কনসার্ভেশ্যন ইউনিয়ন অর্থাৎ আইইউসিএন-বাংলাদেশ অফিসে আমরা ক'জন অর্থাৎ রাকিব, রকিব, ফারজানা, হাসিব, মনির, শুভ, শাহ্‌জিয়া,

……
কটকা ওয়াচ টাওয়ার
…….
ডমিনিকা এবং আমি কাজ করি তখন। শুক্‌কুর-শনিবার ছুটি হলেও আমি এবং আমার নিকট সহকারী রাকিব, মনির, হাসিব — আমরা ঢালাও ছুটি কাটাতে পারি না। কান্ট্রি অফিসের রেপ্রিজেন্টেটিভ ডঃ আইনুন নিশাত প্রায়ই বিদেশে যান নানা কাজে। প্রতিষ্ঠানের প্রোগ্র্যাম এবং দৈনন্দিন যোগাযোগ রক্ষা, সভা-সমিতির কাজ পরিচালনা আমার করার কথা। আমার সৌভাগ্য, সহকর্মীরা আমাকে ভালবাসত, তাই সকল কাজের দায়ভার ওরাও সক্রিয়ভাবে বইত।


কটকা সৈকতে

সহকর্মীদের উৎসাহ যোগানোর উদ্দেশ্যে এবং নিজেকে চাঙ্গা রাখতে আমি বিকেলের দিকে গরম-গরম আলুপুরি বা মোগলাই পরটা আনিয়ে কফি-চা সহযোগে সেগুলোর সদ্ব্যবহার করতে করতে এদিক-সেদিক বেড়াতে যাবার প্রস্তাব দিতাম। বলাই বাহুল্য, এরকম গোঁফখেজুরে আলাপে বাঙালি অতি সরস। তক্ষুনি নিখুঁত পরিকল্পনা ছকে ফেলা হত। সবাই আমরা প্রোগ্র্যাম কর্মকর্তা, কাজেই নোটপ্যাড-কলম সামনেই থাকত সবার। সঙ্গে সঙ্গে গন্তব্য, লজিস্টিক্‌স, যানবাহন, অর্থসংস্থান, চাঁদার হার — সব নির্ধারণ করা হত। আধঘণ্টাটাক পরে যখন সবাই যার যার পিসি-র সামনে অসম্পূর্ণ দাপ্তরিক কাজ এগিয়ে নিতে ব্রতী হত আবার, তখন একটু আগের ছুটির আমেজ কোথায় মিলিয়ে যেত।


'ছুটি' লঞ্চে

তো ওইরকম এক বিকেলে, আমাদের নিয়মিত টি-ব্রেইকে সুন্দরবন বিষয়ে আলাপ চলছিল। সেদিন দুপুরে আমাদের বন্ধু খসরু চৌধুরী সুন্দরবনের ওপর বেশ কিছু তথ্য এবং ছবি আমার টেবিলে রেখে গিয়েছিল। আগে কথা হয়েছিল, খসরুর যেহেতু সুন্দরবনে যাওয়া আসা পড়ে মাঝে মধ্যেই, নানা দেশি-বিদেশি বিজ্ঞানী-পর্যটকদলের গাইড হিসেবে — বইটা সেই লিখবে। পাণ্ডুলিপির বদলে সে যখন ওই তথ্যের পাঁজা এবং ছবির সংগ্রহ জমা দিয়ে গেল, নিশাত ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, বই আমি লিখব। অতঃপর ডঃ নিশাত, খসরু এবং আরো দু'য়েকজন সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ রিভিউ করার পরই বই ছাপা হবে। রাকিব, শুভ প্রস্তাব দিল, বই লিখতে লিখতেই আমার সুন্দরবন ঘুরে আসা দরকার একদফা। অতি সমীচীন কথা। আমি সায় দিতে আমাদের মানসভ্রমণের আয়োজন দানা বাঁধতে লাগল। ঘরের দেয়ালে ঝোলানো হোয়াইট বোর্ডে চলে গেল মনির। বটে? আজ আর নোটবইতে শানাচ্ছে না! আমি মুচকি হেসে ওদের পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত করতে বলে উঠে পাশের ঘরে গেলাম। ফোনে পাওয়া গেল গাইড ট্যূরের হাসান ভাইকে। ওদের নৌযান ভাড়া করে আইইউসিএন মাঝে-মাঝে বিশেষজ্ঞদল সুন্দরবনে পাঠিয়ে থাকে। পরস্পরের কুশল জানার ফাঁকে হাসান ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, উনি আমাদের অর্থাৎ আইইউসিএন-এর কর্মীদের সপরিবারে একবার সুন্দরবনে বেড়াবার সুযোগ করে দিতে ইচ্ছুক কিনা। হাসানভাই সাগ্রহে রাজি। লোভনীয় প্রস্তাব দিলেন।

আমার ঘরে ঢুকে বোমাটা ফাটালাম। হাসান ভাইয়ের প্রস্তাব শুনে সবাই হৈ হৈ করে উঠলো। এরি মধ্যে নিশাত ভাই দোতলা থেকে তিনতলায় উঠে এসেছেন কোন ফাঁকে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে খানিকটা শুনেই ভেতরে এসে বললেন, 'মনির, রাকিব — আই নো ইউ অল হ্যাভ বিন ওয়র্কিং ভেরি হার্ড অল অ্যালাং। ওয়ালী উইল লিড ইউ অল টু দ্য সুন্দরবান্‌স। সামনের উইকএন্ডের আগে বা পরে দু'তিনদিন জুড়ে নিয়ে তোমরা ঘুরে এস। শুভ কফির মগ এনে নিশাত ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিল। হাসিমুখে কফিতে লম্বা চুমুক দিয়ে উনি বললেন, কয়েকদিন আমি জহির-ডমিনিকাকে নিয়ে কাজ চালিয়ে নেব। তোমরা ফিরলে আমি গ্রেইট ব্যারিয়ার রীফে যাব। কুইনস্‌ল্যান্ড থেকে চিঠি দিয়েছে না, ওয়ালী?'

'হ্যাঁ, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ, নিশাত ভাই। আমি অবশ্য ওখানেও অফিস করব, দৈনিক অন্তঃত আট ঘণ্টা সুন্দরবন বই লেখার কাজ এগিয়ে নেবার ইচ্ছে,' আমার সিনসেয়ার উচ্চারণ।

'লেখাটা এখানে এসেই হবে, আমি জানি, ওখানে বড়জোর কিছু নোট্স আপডেট করতে পারেন। আচ্ছা, আমি যাচ্ছি। বঁ ভইয়াজ।' ফরাসিতে শুভেচ্ছা ঝেড়ে দিয়ে ডঃ নিশাত বাড়িমুখো হলেন। একটু বাদেই নিচে সদর খোলার ঘড়ঘড় শব্দ শোনা গেল।

সেবারের বেড়ানো-বেড়ানো খেলা সত্যিই বাস্তবায়িত হতে দেরি হল না। গাইড ট্যূরের ছোট লঞ্চ 'ছুটি' আমাদের নিয়ে যাবে সুন্দরবন, ঠিক হয়েছে। শুভ আর রাকিব প্রস্তুতিতে মাতল। অনেকেই যাবে বলছে, কিন্তু 'ছুটি'-তে বার্থ হল গোটা বাইশেক। তাই রাকিবকে বললাম, যারা জেনুইনলি আগ্রহী, তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার আদায় করে তালিকা চূড়ান্ত করতে। বাড়িতে বললাম, সুন্দরবন যাবে তোমরা? রুবি, আমার স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, তোমরা ক'জন যাচ্ছ? সব ছেলেরাই যাচ্ছে? নাকি মেয়েরাও? হেসে বলি, সপরিবার ভ্রমণ হবে এবার — রিপা, ফারহাত, অপর্ণা, শিউলি — আরও যেন কে কে যাচ্ছে। তাহলে আমি আর আম্মুও — আব্বু, অলীন যেতে পারে কি আমাদের সঙ্গে? রুবাই হাসিমুখে আবদার করে। ঠিক আছে, আমি বলি, আমাদের বাড়ি থেকে তাহলে চারজন হল। অফিসের বাইরে থেকে আমরা খসরু চৌধুরী, ওর স্ত্রী শিউলি, আমাদের এক প্রকাশক বন্ধু ফরিদ আর তার স্ত্রীকে যাত্রাসঙ্গী করলাম।

আমাদের যাত্রা শুরু হল বুধবার রাতে রাপা প্লাজার পাশে আইইউসিএন অফিসের সামনে দাঁড়ানো বাসে ওঠার পর। সবাইকে রাতের খাবার খেয়ে আসতে বলা হয়েছিল। বাস ছেড়ে দিল ন'টায়। রুবি-রুবাই সামনের দিকে টু-সিটারে বসে গল্প শুরু করেছে। আমরা পেছনে। ধূমপায়ীদের কর্নার। আড্ডা, গান চলেছে অবারিত। খসরু হেসে বলল, সারাদিন অফিসে কাজ করার পরও আপনাদের ছেলেগুলো কী দুর্দান্ত আড্ডা দিচ্ছে! এই তো, আরিচা পৌঁছতে-পৌঁছতেই ঝিমোবে, দেখবেন, আমি বলি। শিউলি ধূমপায়ী হবার সুবাদে আমাদের সঙ্গে বসেছে। ও গান ধরল, আমরা-আ-আ… দূর আকাশের নেশায় মাতাল… গলা মেলালাম। আমার দেখাদেখি শুভ। শুভাশীষ প্রিয় বড়ুয়া। চট্টগ্রামের ছেলে। পরিবারের সবাই অস্ট্রেলিয়ায় বসতি গেঁড়েছে। কেবল ও এখানে। প্রাণবন্ত, আড্ডাবাজ ছেলে। ভাল ইংরেজি লেখে। রাকিব মৃত্তিকা বিজ্ঞানী। সম্প্রতি বিয়ে করেছে রিপাকে। রিপা চারুকলার শেষ বর্ষের ছাত্রী। ছবি আঁকার সঙ্গে পোশাক ডিজাইন করে। গত ঈদে রুবি, রুবাই, আমি রিপার 'কর্ণ-সুবর্ণ' ব্র্যান্ডের পোশাক পরেছি।

আরিচা পৌঁছে গেলাম। আমরা ক'জন বাস থেকে নেমে হেঁটে গিয়ে ফেরিতে উঠলাম। চা খেতে খেতে ওপারে পৌঁছে গেলাম। দৌলতদিয়া ঘাট থেকেই আমাদের সঙ্গীতচর্চা ঝিমিয়ে পড়ল। যে-যার মত ছোট ছোট ঘুম সেরে নিতে লাগলাম। যশোরে মধুর দোকানের সামনে দাঁড়ালে নেমে গিয়ে চা খেলাম। বাসে উঠে আরেকটি ছোট্ট ঘুম। খুলনা ফেরিঘাটে গিয়ে বাস পৌঁছল ভোরবেলা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মাঝেই 'ছুটি'র ক্যাপ্টেন বাচ্চু আমাদের রিসিভ করে সাদরে ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ লঞ্চে তুলে নিয়ে নোঙর তুলল। আমরা ঘুমচোখে ওপরে ডাইনিং এনক্লোজারে ঢুকেই চমকিত, খুশি। ফুটন্ত পানি, চা, কফি আর নোন্তা-মিষ্টি বিস্কিট সাজানো। গাইড ট্যূরের লোগো বাঘের মাথা আঁকা সেরামিকের মগ সাজিয়ে রেখেছে এককুড়ি। ঝক্ঝকে, তকতকে। আকাশে মেঘ আর বৃষ্টি পড়ার মাঝে সবাই রুচিমত চা-কফির মগ হাতে বাইরের দিকে মুখ করে অপসৃয়মান খুলনা নদীবন্দরের পরিচিত দৃশ্যাবলী দেখতে লাগলাম।

আগেরদিন ভোরে ঢাকার বাসায় ঘুম থেকে উঠে এইসময় ব্যায়াম করছিলাম। আর চব্বিশ ঘণ্টা না যেতে কি অপার স্বস্তির মাঝে নিপতিত। চা খেয়ে অনেকে নিচে যার যার ক্যাবিনে আবার একটু ঘুমোতে গেল। বাচ্চু এল। ওয়ালী ভাই, আপনার জন্য ১, ২ — দু'টো ডাবল ক্যাবিন রেখেছি। কোনো অসুবিধে হলে বলবেন। অবশ্যই, আমি বললাম, ক্যাবিনে তো আমাদের ব্যাগগুলোই থাকবে। আমরা বসবাস করব আপনাদের 'ছুটি'-র শাখা প্রশাখায় আগামি চারদিন তিনরাত। তাই ত? অবশ্যই। বলে বাচ্চু হাততালি দিয়ে উপস্থিত সবার মনোযোগ কাড়তে চেষ্টা করে, আইইউসিএন-এর মেহ্‌মানেরা, সাতটায় এখানে আপনাদের নাশতা পরিবেশন করা হবে। নাশতার পর ওয়ালী ভাই এবং গাইড ট্যূরের পক্ষ থেকে আমি বাচ্চু আপনাদের সফরকালে কাজে লাগতে পারে, এরকম দু'টো কথা বলব। আমি যাই, নাশতার যোগাড় দেখি গিয়ে। স্মার্ট বয়, শুভ বলে, বাচ্চুর ন্যাড়ামাথার পেছনটা দেখতে দেখতে, নাহলে এই সুন্দরবনে আমাদের মত ট্যূরিস্টদের বায়না সামলাতে পারবে কেউ — দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। আর বিদেশিগুলোর মাঝে কেউ-কেউ দিনরাত খ্যাচরম্যাচর করে দেখেছি — এটা নেই কেন, পোকা কামড়ায় কেন, মশা নেই তো, হরেক প্রশ্ন আর আরামের চাহিদা কেবল। আমি বলি, আরে বাবা, এটা হল সুন্দরবন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অবিচ্ছিন্ন বাদাবন, বেঙ্গল টাইগার, কুমির আর কিং কোবরার আবাস — পৈতৃক ধন প্রাণটি নিয়ে ফিরতে পারলেই পূজো দিতে হয়, মিলাদ পড়াতে হয় মৌলবি ডেকে, হুঁ। বলে মুচকি হেসে আমি সিগ্রেট ধরাই।

……..
লঞ্চের বারান্দায়
……..
এগারটার দিকে মংলা বন্দরের ওপারে যেখানে সুন্দরবনের শুরু, ঢাইংমারি ফরেস্ট অফিসের ঘাটে আমাদের 'ছুটি' দাঁড়াল। পাস নিতে হবে। বাচ্চু নেমে গেল কাগজপত্র নিয়ে। জিজ্ঞেস করে গেল, কারো সিগ্রেট বা অন্য কিছু লাগবে কিনা। আমি কিছু হালকা পানীয় আনতে বললাম। 'ছুটি' সুন্দরবনে ঘুরবার পারমিট অর্থাৎ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে একটানা সফর শুরু করল। আমরা পূর্ব সুন্দরবন থেকে আড়াআড়ি ক্রমশঃ দক্ষিণপশ্চিম মুখো যেতে থাকব। সুন্দরবনের সবচেয়ে উঁচু সুন্দরী গাছগুলো পূর্বের জোনে। বনের ভেতরে আমরা যত পশ্চিমে যাব, গাছের আকার-উচ্চতা খর্ব হতে থাকবে। এবারে আমরা মাঝামাঝি অবস্থান কটকা চ্যানেলের মুখ পর্যন্ত যাব, ঠিক হয়েছে। সকালের ব্রিফিং-এর পর দলের সবাই সুন্দরবনে অবস্থানকালে যা যা করা নিরাপদ এবং যা করা যাবে না — এরকম দু'টি কাজ-অকাজের তালিকা সম্পর্কে অবহিত হয়েছে।

নৌযান বড় নদী থেকে মাঝারি, সেখানে থেকে ছোট নদীতে ঢুকে পড়ছে, আবার সেখান থেকে মস্ত চওড়া নদীতে পড়ছে, তখন পাড়ের জঙ্গল প্রায় ছুঁয়ে যাচ্ছে, দেদার ছবি তোলা হচ্ছে। এরিমধ্যে নারকেল-মুড়ি আর চা-কফি পরিবেশন করেছে বাচ্চুর শেফ। সবাই লঞ্চটাকে বেশ বাড়ির মত ভাবতে শুরু করেছে। রুবি-রুবাই, ভাগ্নে অলীনকে নিয়ে আমি একবার পুরো লঞ্চবাড়ি ঘুরে এলাম। একবারে নিচে রান্নাঘর, ইঞ্জিনঘর, কনফারেন্স রুম, কনভিনিয়েন্স স্টোর, আরেকপাশে ক্যাপেটনের কেবিন, নাবিকদের ফোক্‌সাল (Fox-hole)। উঠে এসে দ্বিতীয় স্তরে দু'দিকে দু'সারি টয়লেট, শাওয়ার স্টল, ওয়াশ বেসিন। ওখান থেকে উঠে এলে মাঝে করিডোর, দু'ধারে ডবল বার্থ গেস্ট কেবিন — চার বার্থেরও রয়েছে দু'টি। ওপরে খাবার জায়গা একপাশে, বাকিটা খোলা ডেক, বড় বড় ওয়াটারপ্রুফ ম্যাট্রেস রেলিং-এ হেলান দিয়ে রাখা, যার যখন ইচ্ছে নিচে পেতে শুয়ে, বসে আরাম করছে, আড্ডা হচ্ছে। ওপরে ত্রিপল রয়েছে গোটানো, বৃষ্টিতে টেনে ছাদ তৈরি করে নেয়া যায় প্রয়োজনমত। আমি দেশ পত্রিকা আর এক ক্যান হালকা পানীয় নিয়ে ডাইনিং স্পেসের জানালার ধারে বসলাম। শুভ, রাকিব, শিউলি, মনির, হাসিব, অপর্ণা, রিপা, রুবি, রুবাই — ওরা খোলা ছাদে আড্ডায় বসেছে। মোটের ওপর, সবাই জম্পেশ করে ছুটি উপভোগ করছে 'ছুটি'তে চেপে বেড়াতে বেড়াতে। মাঝে-মাঝে বৃষ্টি পড়ছে, বৃষ্টি থামতেই ওরা ওপরের টারপলিন সরিয়ে দিচ্ছে।

…….
লঞ্চের খোলা ডেক-এ
…….
স্নান সেরে এসে আমিও ওদের সঙ্গে কোরাসে গান গাইলাম কিছুক্ষণ। কয়েকজন করে নিচে গিয়ে দু'তিন দফায় সবার স্নান সারা হল। একটায় লাঞ্চ দিয়ে দিল। নদীর বাতাস, সবুজের সমারোহ দেখতে দেখতে সবাই প্লেটে খাবার নিয়ে যার যেখানে ইচ্ছে বসে খেতে লাগল। আমি দুপুরে অফিসে দু'টো হাতরুটি, তরকারি, ফল খাই। সুন্দরবনের অবারিত পরিবেশে সমুদ্রের মাছ, ভাত, সবজি, ডাল আর স্যালাড একটু বেশিই পেট ভরে খেলাম। এবারে একটু গড়াব ভেবে নিচে কেবিনে গিয়ে দরজার দিকে মাথা দিয়ে কাত হতেই ঘুম।

চিট্পিটে গরমে ঘেমে নেয়ে ঘুম ভেঙেছে। এত গরম লাগছে কেন? বাইরে এসে বুঝলাম, এপাশে রোদ লাগছে এবং বাতাস পেতে এখন ওপাশে যেতে হবে। লঞ্চ একটা মস্ত বাঁক ঘুরছে। গোলপাতার বীথি জল ছুঁইছুঁই। তার পেছনে ফাঁকায় ক্যাওড়ার বন। 'ওই যে একপাল হরিণ!' কেউ একজন বলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সবার চোখ, বাইনোকুলার, ক্যামেরা সেদিকে ঘুরল। 'কট্কা চল, হরিণ তোমার হাত থেকেই ক্যাওড়াপাতা খাবে,' খসরু আশ্বস্ত করল কাউকে।

বিকেলের চা খেতে খেতে আমরা কট্কা পৌঁছে গেলাম। সামনে সমুদ্র। বঙ্গোপসাগর ধূ ধূ করছে। ডানদিকে ফরেস্ট অফিস। উঁচু জেটি থেকে কাঠের তৈরি কজওয়ে ডাঙার সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করেছে। 'ছুটি' বাঁদিকের খালপথে একটু ভেতরে গিয়ে ওয়াচ টাওয়ারের ঘাটে নোঙর ফেলল। আমি আর বাচ্চু আমাদের ছোট বোট নিয়ে কট্কা চ্যানেল পেরিয়ে ফরেস্ট অফিসে গিয়ে আমাদের উপস্থিতি জানিয়ে এলাম। রাতে দু'জন রাইফেলম্যান পাঠিয়ে দেবেন বিট অফিসার, কথা হল। ওরা আগামী দু'দিন আমাদের সঙ্গে থাকবে, প্রহরার দায়িত্ব তাদের। ফিরে এসে বাচ্চু জানাল, রাতের খাবার খেয়ে ছোট বোটে আমরা রাতের সুন্দরবনে ঘুরে আসতে পারি। অনেকেই আগ্রহ দেখাল। জেনারেটর চালিয়ে আলো জ্বেলে রান্নাবান্না সারা হচ্ছে। ছোট ছোট দলে সবাই আড্ডা দিচ্ছে। কেউ টিমটিমে আলোয় পড়ার চেষ্টা করছে।


কটকা জেটি

ডিনারের পর ছোটরা ছোট বোটে উঠে জঙ্গল দেখতে গেল। আমরা ডেকে বসে রইলাম ওদের ফেরা এবং জেনারেটর বন্ধ হবার অপেক্ষায়। রুবাই আর অলীন রাকিবদের সঙ্গে গিয়েছে। 'ছাতাফাতা নিয়েছে তো ওরা?' বৃষ্টি শুরু হওয়াতে আমি জিজ্ঞেস করলাম। 'হ্যাঁ, তোমার মেয়ে বর্ষাকালে ছাতা না নিয়ে বাড়ির বাইরে যায় না। মনে নেই, সেবার দার্জিলিং-এ তুমি আমাদের ছাতা ধরিয়ে দিলে,' বলে রুবি আমার জন্য পানীয় আনতে নিচে গেল। 'টর্চটাও এনো, আমার ব্যাগের সাইড পকেটে রয়েছে,' বলে আমি আরামে, নিশ্চিন্তে সিগ্রেট ধরালাম।

ঘণ্টাদুই পর ওরা ফিরল। বৃষ্টি থেমেছে। মেঘ কেটে গিয়ে ময়লা জ্যোৎস্না এই জলজঙ্গুলে পরিবেশকে আরো রহস্যময় করে তুলেছে। বাচ্চু নিচে যাবার আগে বলে গেল, ভোর পাঁচটায় চা-বিস্কিট দিয়ে দেয়া হবে। ছ'টা নাগাদ বোটে চড়ে আবার সুন্দরবনের ভেতরে পাখি দেখতে যাওয়া হবে। কিছুক্ষণ গান গাওয়া হল। শিউলির নাম দেয়া হল 'গ্র্যামোফোন'। যে কোনো গানের, বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, হিন্দি — যাই হোক — এক লাইন গাইলেই শিউলি সেটা ধরে নিয়ে সুরেলা কণ্ঠে মোটামুটি নির্ভুল সুরে গাইতে পারঙ্গম। সকালে উঠব, এই অঙ্গীকার করে আমি উঠে নিচে গেলাম ঘুমোতে। টর্চ হাতে। কারণ, ইতোমধ্যে জেনারেটর বন্ধ হয়েছে। ঘরে ঘরে অবশ্য সোলার অ্যানার্জিপ্রসূত জরুরি আলো জ্বালাবার একটা বিকল্প ব্যবস্থাও রয়েছে।

ভোরে উঠে চা খেয়ে তৈরি হয়ে বোটে উঠলাম। বৃষ্টি পড়ছে। গোটা দশেক ছাতা মিলে ভালই একটা বৃষ্টি নিবারক ব্যবস্থা হল। নেহাৎ ঘুমকাতুরে যারা, তারা আসেনি। রুবাই এখনো ঘুমোচ্ছে। দু'জন মাল্লা বৈঠা আর লগির সাহায্যে যথাসম্ভব নিঃশব্দে নৌকা বেয়ে সুন্দরবনের ভেতরে নিয়ে চলল আমাদের। এসব জলপথে কেবল জোয়ারের সময় স্বচ্ছন্দে ছোট নৌকায় চলা সম্ভব। ভাঁটার সময় অগভীর চ্যানেলে সামান্য জল থাকে। ভাঁটা লেগেছে বলে আমরা দু'পাশের ঢালু কাদায় বন্যপ্রাণীর পায়ে ছাপ ফুটে উঠেছে দেখতে পেলাম। খসরু ওগুলো কোন্ কোন্ প্রাণীর পায়ের ছাপ, তা বলে দিতে লাগল। বড় বড় ছাপ দেখলেই সেগুলো বেঙ্গল টাইগারের ভেবে নিয়ে রোমাঞ্চিত হতে পারি আমরা, সেটাও বলল। আমি যেহেতু সুন্দরবন বিষয়ে গবেষণারত, খসরু সেহেতু এক-একটি বিশেষজ্ঞসুলভ মত ঝেড়ে দিয়েই আমার দিকে তাকিয়ে সমর্থন চাইছিল। আমি মাঝে মাঝে 'অশ্বত্থামা হত, ইতি গজ' ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাচ্ছিলাম। একসময় নৌকার তলা কাদায় আটকে গেল। সিদ্ধান্ত হল, নৌকা ঘুরিয়ে ভাঁটার টানে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসা হবে। আসার পথে গাছের ডালে বসে থাকা দু'তিন প্রজাতির মাছরাঙা, সিন্ধু ঈগল, বানর দম্পতির উকুন খুঁটে খাওয়া, হরিণ শাবকের ইতি-উতি তাকানো দেখতে দেখতে ফিরলাম। লঞ্চে উঠে সোজা খাবার জায়গায় চলে আসা হল। ব্রেকফাস্ট খেয়ে আবার কটকা সৈকতে যাবার কথা।

ন'টায় সবাই ডাঙায় নেমে ওয়াচ টাওয়ারের নিচে গেলাম। পাঁচজন করে টাওয়ারে উঠতে হবে, এর বেশি ওঠা নিষেধ। বনপ্রহরীদের কথা মেনে নিয়ে ওপরে উঠে চারদিকের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করা হল। বিস্তর ছবি তোলা হল।

সৈকতের দিকে বহুদূর অর্থাৎ কিলোমিটার তিনেক খোলা প্রান্তর — টাইগার ফার্ন, সানগ্রাস অঢেল — তার ফাঁকে ফাঁকে শ'য়ে শ'য়ে হরিণ চরছে। আমরা ওই প্রান্তরের মধ্য দিয়ে সিঙ্গল ফাইলে, সামনে-পেছনে রাইফেল ম্যান নিয়ে হেঁটে সৈকতে যাব। নতুন যারা এসেছে, শুনেই থ্রিল্‌ড। ওই হরিণগুলোর মাঝে হাঁটব, কী মজা! রিপার মন্তব্য শুনে রাকিব হেসে ফেলল। তোমাদের কলকাকলি আর পায়ের আওয়াজ পেলেই ওরা নিমেষে উধাও হবে, চকিত পায়ে। এবার চল, রোদ চড়ছে। আমি তাড়া দিলাম।

সবাইকে বলা হয়েছিল, চড়া লাল-হলুদ রঙের চক্চকে পোশাক না পরে গেরুয়া ম্যাট্‌মেটে, ঝ্যালঝেলে পুরনো কাপড়চোপর পরবে, যাতে বাঘমামা এবং তার প্রজাসকল চমকিত বা বিরক্ত না হন কোনোক্রমে। তারপরও মেয়েরা কেউ কেউ চড়া লাল টিশার্ট, সালোয়ার কামিজ পরে এসেছে। তাদের যথারীতি ভয় দেখিয়ে, নট নড়ন-চড়ন অবস্থায় উপনীত করে, রাইফেলম্যানের পেছনে কিউতে আটকে দিয়ে, নিঃশব্দে হেঁটে যেতে লাগলাম সৈকতপানে। ঘাস প্রান্তরের মাঝে পৌঁছে পুরনো ঝাঁকড়া একটি গাছের নিচে বসে জলপান, বিশ্রাম হল। হরিণের পাল কোথায় অদৃশ্য হয়েছে। রয়েছে আশে পাশেই আমাদের, মানুষ সমান সানগ্রাস বা চারতলা উঁচু টাইগার ফার্নের আড়ালেই হয়তো, আর তাদের পেছনেই হয়তো ব্যাঘ্রমামা ব্যগ্রভাবে হামা দিচ্ছেন — রোমহর্ষক কল্পনার ঘোড়া ওরকম পরিবেশে অনায়াসেই ছোটানো চলে। তবে তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলে বাস্তবিক বিপদের শঙ্কাও রয়েছে। বনরক্ষীদের তাড়ায় উঠে, লাইন করে হেঁটে অবশেষে আর একদফা শুকনো বাদাবনের একটা বেষ্টনি পার হতেই সামনে বঙ্গোসাগর !

ঝক্ঝকে রোদে ঝিক্ঝিক্ করছে ঢেউয়ের চূড়োগুলো প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে। সবাই বনের ধার ঘেঁষে শুকনো, শাদা বালুর ওপর কাপড় ছেড়ে সুইমিং ট্রাঙ্ক, শর্ট্স সম্বল করে এক দৌড়ে সমুদ্রে নামল। আমি, খসরু, হাসিব আর বাচ্চু কাপড়ের পাঁজার পাশেই বালুতে ধেবড়ে বসে আড্ডা দিতে লাগলাম। হাসিব, বাচ্চুও গেল একসময়। আমরা ঘড়ি ধরে বসে রইলাম, ওদের তুলে নিয়ে ফিরতে হবে তো! আসিফ নজরুলের ঝাঁপাঝাঁপি দেখে মনে হচ্ছিল, আইনের ভারিক্কি অধ্যাপক তার ছাত্রত্ব ফিরে পেয়েছে। তরুণতর রিপা, রাকিব, মনির, ফারহাত, অপর্ণা, রুবাই — সবাই অত বড় বিস্তৃত সৈকত নিজস্ব ভেবে নিয়ে প্রাণভ'রে চেঁচামেচি, জলছেটানো, জাপটাজাপটি চালিয়ে একসময় ফিরে আসতে লাগল। সবাইকে বিস্কিট আর জল দেয়া হল। শক্তিসঞ্চয় শেষে আবার মার্চ করে লঞ্চে ফেরা হল। রাতে বার্বিকিউ ডিনার সার্ভ করবে 'ছুটি'র শেফ। ঘোষণা শুনে সকলেই উত্তরোত্তর খুশি।


কটকা বিচে

সবাইকে সামুদ্রিক জোয়ারের দুলুনির স্বাদ একটুখানি পাইয়ে দেবার ইচ্ছেয় আমি বাচ্চুকে বলেছিলাম আমাদের লঞ্চটিকে খাল থেকে বাইরে এনে কটকা চ্যানেলে একপাশে রাখতে। ছাদে জোছনায় বসে কাবাব আর বিরিয়ানি খেয়ে কিছুক্ষণ গানবাজনা হল। ডিমের চর, পক্ষীর চরে গবেষণারত রিমন আর সান্‌জানা আমাদের সঙ্গে ডিনারে যোগ দিয়েছিল। আড্ডাশেষে বাতি নিবিয়ে শুতে যাবার পরই হঠাৎ বেদম দুলুনিতে ঝিমুনি কেটে গেল। উঠে গিয়ে বাচ্চুকে বললাম, জোয়ার স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি প্রবল বোধ হচ্ছে, ভয় পেয়ে ওরা হৈ চৈ করে ওঠার আগেই ভেতরে দিয়ে আগের জায়গায় লঞ্চ বাঁধা যুক্তিযুক্ত হবে। তাই করা হল।

…….
লঞ্চের ছাদে রাতে বার্বিকিউ ভোজ
…….
সকালে ঘুম ভেঙে সবাই দেখল, আমরা ডিমের চরের পথে চলেছি। এগারটা নাগাদ ওখানে পৌঁছে ফরেস্ট অফিসের জেটিতে লঞ্চ বেঁধে ছোট নৌকায় আমরা ডিমের চর, পক্ষীর চর দেখতে গেলাম। ডিম্বাকার বলেই বোধহয় ওরকম নামকরণ। মানুষজন নেই, শীতকালে জেলেরা সাময়িকভাবে আড্ডা গেঁড়ে মাছ শুকায়। বাদাবন দানা বাঁধছে ওই দুই চরেও। রিমন আর সান্‌জানা ওখানে জরিপ চালাচ্ছে প্রাণী আর বৃক্ষসম্পদের।

ফিরে এসে শেষ দুপুরে লাঞ্চ খেয়ে আমরা ফেরতযাত্রা শুরু করলাম। ডিনার হল সন্ধেবেলা যথারীতি। প্রত্যেকে নিজ নিজ ভাললাগা, মন্দলাগা বিষয়ে কথা বলল। আমি বাচ্চুকে সেই বাক্সটা আনতে বললাম। সঙ্গীদের বললাম, আপনাদের যার যেমন ইচ্ছে, অ্যাজ আ টোকেন অব অ্যাপ্রিসিয়েশ্যন, ঐ বাক্সের ছিদ্র দিয়ে গলিয়ে দিন। পুরো কালেকশ্যন আমি সারেংকে ডেকে তার হাতে দিয়ে বললাম, আপনি লঞ্চের সব কর্মীর মাঝে এই সামান্য উপহার সমানভাবে বেঁটে দেবেন। সকলেই উপস্থিত ছিল। সবাই মিলে জোর করতালি আর করমর্দন, ধন্যবাদ জ্ঞাপন হল। রাত এগারটায় মংলা পৌঁছে ঘুম চোখে আমরা বাসে উঠেছিলাম সেবার।

সোহাগের বাস ড্রাইভারটা একটু পাগলাটে গোছের ছিল। ভাল রাস্তা পেলেই সে টিকিয়া উড়ান্ অর্থাৎ হেল ড্রাইভিং-এর নমুনা পেশ করে সামনে বসা খসরুদের পিলে চমকে দিচ্ছিল। খসরু একবার বোধহয় মিন্‌মিন্ করে 'মেয়েরা ভয় পেতে পারে', এরকম কিছু বলেছিল। আর যায় কোথা। ছেলেটি সোজা তাকিয়ে ননস্টপ বেদম চালিয়ে একেবারে দৌলতদিয়া ঘাটে থেমেছিল। আমি মাঝে মাঝে চোখ মেলার চেষ্টা করলেও বেশির ভাগ সময় চোখ বুঁজে, হেডরেস্টে মাথা লাগিয়ে বিশ্রাম করছিলাম। পদ্মা পার হয়ে আরিচা থেকে বাস ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিটে কলাবাগান পৌঁছেছিল। নিচে নেমে ড্রাইভার আমাকে বলেছিল, 'স্যরেরা জানে না ড্রাইভারগো ধমকাইতে নাই।' আমি ওর সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করে ধন্যবাদ দিয়ে বলেছিলাম, গুড ড্রাইভিং!

বন্ধুদের কাছে লেখাটি ইমেইল করতে নিচের tell a friend বাটন ক্লিক করুন: