সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ, যখন আমি… (কিস্তি ৬)

chanchal
Published : 6 Oct 2008, 09:46 AM
Updated : 6 Oct 2008, 09:46 AM

কিস্তি:

১৯৯৭ সালে, শীত আসি-আসি করছে এমন এক সন্ধ্যায় হুমায়ুন আজাদকে রিকশায় সেন্ট্রাল লাইব্রেরির উত্তর পাশের রাস্তা দিয়ে পুব দিকে যেতে দেখি। 'স্যার, স্যার' বলে চিৎকার করি। কেন যে! তিনি রিকশা থামালেন। 'শাহবাগ যাচ্ছি। যাবে?' বললাম, 'যাব।' উঠে বসলাম। লাইব্রেরির পেছনে বসে-থাকা জুটিবদ্ধ ছেলেমেয়েদের প্রসঙ্গ এনে তাঁকে বললাম, 'স্যার, এই-যে প্রেমের বা শারীরিক ঘনিষ্ঠতার দৃশ্য দেখা যায়, এতে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সাধারণ মানুষের ধারণা খুব খারাপ হয়ে গেছে।'
—————————————————————–
'দেখেছি ঈদ সংখ্যার অপদার্থ লেখক ও টিভির শোচনীয় নাটক, হুমায়ুন আহমেদের শরৎসমগ্র; দেখেছি কবির চেয়ে আবৃত্তিকারের সম্মান … বাস্তবিক, আর কিছু দেখেছি কি? দেখি নি কি তোষামোদে উড়ে আসে সব পুরস্কার?' পরের বছর, বইমেলায় হুমায়ুন আজাদ আমাকে দেখেই বললেন, 'তোমার দারুণ সাহসী একটা লেখা পড়লাম। আরও যা-যা দেখছ, সব লিখবে, তুমি পারবে। থেমো না।'
—————————————————————-
বললেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের এই অবস্থা দেখে আমার আনন্দ হয় আবার বেদনাও বোধ করি। তাদের শারীরিক আনন্দের কোনও ব্যবস্থা নেই। সেটা অবশ্য কোনও অবিবাহিতেরই নেই। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের যৌনানন্দের জন্যে, বিশেষ করে যারা অবিবাহিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত হলগুলোতে একটা ব্যবস্থা রাখা। কী বলো!'

বললাম, 'সাধারণ মানুষের ধারণার ব্যাপারটা?'

বললেন, 'সাধারণ মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের কী বোঝে? বিশ্ববিদ্যালয়কে তারা বড় মাপের মসজিদ-মাদ্রাসা-মক্তব হিসেবে দেখতে চায়, যদিও নারায়ণগঞ্জে এক ইমাম মসজিদের ভেতর নিয়ে গিয়ে এক নাবালিকাকে ধর্ষণ করেছে আর মাদ্রাসাগুলোতে কী হয় তা তো জানো।' যাদুঘরের উত্তর-পশ্চিম কোণে জ্যামে পড়ে রিকশা কিছুক্ষণের জন্যে থামে। তিনি বলেন, 'দ্বিতীয়ত, তারা ভাবতে চায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ে এবং পড়ায় তাদের রক্তমাংস বলে কিছু থাকতে নেই; তৃতীয়ত, যৌনানন্দ তাদের কাছে খুব খারাপ জিনিস, যদিও সুযোগ পেলে তাতে আপত্তি তাদের নেই। নিজের দৈহিক সুখ প্রত্যেকেই চায়; কিন্তু সেটা অন্য কেউ পেলে মাথা ঠিক থাকে না।' পাশের রিকশারোহী এক মহিলা আমাদের দিকে তাকালেন। জ্যাম কেটে গেলে সেই রিকশা গতি পায় আর আমাদের বহনকারী রিকশাটি ডানে বাঁক নিয়ে বাঁ-দিকে যায়, থামে আজিজ মার্কেটের সামনে। রিকশাভাড়া মিটিয়ে 'পাঠক সমাবেশে'র সামনে সিগারেট-দোকান থেকে এক প্যাকেট বেনসন কেনেন তিনি। কিনে মার্কেটের ভিতরে ঢুকে ডান দিকের প্যাসেজ ধরে হাঁটতে থাকলে, তাঁকে 'কেমন আছেন, স্যার?' বা, 'স্যার, ভালো আছেন?' — এই ধরনের প্রশ্ন অন্তত বিশ জন করেন এবং তিনি 'ভালো' বলতে বলতে 'বিদিত' নামের বইদোকানটিতে ঢোকেন। বাবুল তাঁকে বসার জন্যে একটা চেয়ার দেন। চায়ের ব্যবস্থাও করেন।

সেই সন্ধ্যায়, সেখানেই তাঁর সঙ্গে একরকম বিতণ্ডা হয় আমার। কিছুই না, সাধারণ একটা জিজ্ঞাসা থেকে অসাধারণ সেই বিতণ্ডার উৎপত্তি। জিজ্ঞাসাটি ছিল: স্যার, আপনার লেখালেখি কেমন চলছে?

'লিখছি। কিন্তু তুমি যেটা বললে, ওসব আমি করি না।'

'করেন না মানে! এই যে বললেন, লিখছি!'

'আমি লিখি। লেখালেখি করি না। ওটা হাতাহাতি অথবা ঠেলাঠেলির মতো ব্যাপার। যেমন একজন লিখলে তার বিরুদ্ধে যদি কেউ লেখে সেটাই লেখালেখি। বুঝেছ?'

'আপনি যা বোঝাচ্ছেন, তা আমি মানছি না স্যার। লেখালেখি সমাসবদ্ধ পদ হিসেবে হাতাহাতির মতোই, কিন্ত এর মানে লিখে-যাওয়া, একটা কিছু লিখলেন, তো আর-একটা কিছু লিখছেন।…'

'তুমি আমাকে শেখাচ্ছ?'

'তা কেন হবে! সবই তো আপনার জানা।'

'যা বলতে চাও বলো।'

'শব্দ সৃষ্টির কোনও কাজেই লাগে না প্রথাগত ব্যাকরণ, অর্থ সৃষ্টিতে তো প্রশ্নই ওঠে না। শব্দ সৃষ্টি করে মানুষ। অর্থও, আবার সেটা তারা বদলেও ফেলে। লেখালেখি শব্দটা মানুষ যে-অর্থ দিয়ে বোঝে, আপনি যদি সেটা বদলাতে চান, মানুষ গ্রহণ করলে আমার আপত্তি থাকবে কেন!'

তিনি রেগে গেলেন। বললেন, 'ব্যাকরণের কী জানো তুমি?'

বললাম, 'কোনও শিক্ষক যখন তার ছাত্রের জ্ঞান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন, তখন সেই শিক্ষকের জ্ঞান নিয়ে সন্দেহের সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যায়।'

'কী বলতে চাও?'

'স্যার, আমার ব্যাকরণজ্ঞান সম্পর্কে আপনার ভালো করে জানার কথা। কারণ আপনি আমার শিক্ষক।'

'তোমার অবস্থা কী-রকম জানো? তোমার অবস্থা হয়েছে প্রাচীন গ্রিসের জেনোর মতো, যার যুক্তিপদ্ধতিতে কুতর্কেরই বিকাশ ঘটেছে।' বলতে বলতে তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং দোকান থেকে বের হয়ে গেলেন।

পরে হিস্ট্রি অব ফিলোসফিসহ ইংরেজি ও বাংলা মিলিয়ে চার-পাঁচটি বই পড়ে দেখলাম যে, জেনোর যুক্তিপদ্ধতি আসলেই গোলমেলে; কিন্তু আমার ওই কথাটার সঙ্গে এর কোনও মিল বা সম্পর্ক নেই। তবে এতে আমার লাভই হয়েছিল। কিছু বই তো পড়া হল!

১৯৯৮ সালে বইমেলা চলাকালে বাংলা একাডেমীর তরুণ লেখক প্রকল্পের বইয়ের স্টল বরাদ্দ এবং তরুণ লেখক পুরস্কার নিয়ে দুর্ভাগ্যজনক যে-দু'টি ঘটনা ঘটে, তা না-বললে হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে আমার চিরসুখকর এক স্মৃতি বর্ণনার পথই খুলবে না। প্রথম ঘটনাটি সে-ক্ষেত্রে তেমন গুরুত্বপূর্ণ না-হলেও, দ্বিতীয় ঘটনার আগে যেহেতু তা ঘটেছে, অন্তত সেই কারণে সংক্ষেপে তার উল্লেখ জরুরি। প্রকল্প থেকে প্রকাশিত বই মেলায় বিক্রির জন্যে পুকুরের দক্ষিণ-পুব কোণে যে-স্টলটি বরাদ্দ করার কথা ছিল, তা থিয়েটারকে, মানে রামেন্দু মজুমদারকে দেয়া হয়। এতে প্রতিবাদ আমরা অল্প ক'জন করেছিলাম, কাজও হয়েছিল। (এর মধ্যে কিছু ঘটনা আছে, সে-সব পরে বলব। এই প্রকল্প নিয়ে স্মৃতিকথা তো আমি লিখবই!) আমাদের স্টলটি বর্ধমান হাউসের সামনের গাছটিকে ঘিরে গোলাকৃতি (শূন্যও গোলাকার!) করে বাংলা একাডেমীই বানিয়ে দেয়। শামসুর রাহমান স্টলটি উদ্বোধন করেন। প্রতিবাদস্থলে তরুণ লেখকদের উদ্দেশ্যে 'আমি পুলিশ দিয়ে তোমাদের মেলা থেকে বের করে দিতে পারি' — বাংলা একাডেমীর তখনকার মহাপরিচালক সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের এই উক্তির প্রতিবাদে উদ্বোধন-অনুষ্ঠানটি বর্জন করি। যারা পুরস্কারের লোভে বা প্রতিষ্ঠানটিতে চাকরির আশায় প্রতিবাদে অংশ নেন নি, তারাও মহাউৎসাহে নিজেদের বই নিয়ে হাজির অবশ্য হয়েছিলেন। আহমেদ মাওলা নামের এক লেখক নিজের বইয়ে 'বাংলা একাডেমী তরুণ লেখক পুরস্কারপ্রাপ্ত' লাল রঙে মুদ্রিত একটি কাগজ সেঁটে দেন। তখনও সেই পুরস্কার ঘোষণাই হয় নি! দু'দিন পরে তা ঘোষণা করা হলে তাতে ওই লেখকের নামও শোনা গেল। প্রকল্প থেকে প্রকাশিত যে-বিশটি বই পুরস্কৃত হল, সেগুলোর অন্তত এক ডজন ছিল প্রকাশের তো বটেই, পাঠেরও অযোগ্য। কবিতার জন্যে ফয়জুল আলম পাপ্পু, প্রবন্ধের জন্যে আহমেদ মাওলা, সৈয়দা আইরিন জামান এরকম আরও থোকা-থোকা নাম, যাদের বই পুরস্কৃত হওয়ার ঘটনায় অনেকের সঙ্গে আমিও স্তম্ভিত হয়ে যাই। সৈয়দা আইরিন জামানের বইটির কথাই একটু বলি। জীবনানন্দের বনলতা সেন/ কবিতার গদ্যভাষ্য ও অব্যয়ের ব্যবহার বইয়ে 'কমলালেবু' কবিতা নিয়ে তিনি লিখেছেন: 'আকৃতিগতভাবে পৃথিবী কমলালেবুর মতো। এই অর্থে পৃথিবী কমলালেবুর প্রতীক। কমলালেবু কবিতাটি ফিউচারিজমে আক্রান্ত একটি গদ্যকবিতা। ফিউচারিজমের অন্যতম লক্ষণ হলো যুগজ্বর।…'

আলোচক বোঝাতে চাইছেন, কবিতাটি ফিউচারিজম নামের একটা ব্যাধিতে 'আক্রান্ত' হয়েছে! বইয়ের শেষদিকে আবার পাই চার্টও করেছেন তিনি, বনলতা সেন-এ অব্যয়ের হিসাব দিতে গিয়ে! এত কিছু 'করেও' পুরস্কৃত না-হওয়াটা বাংলা একাডেমীর জন্যে খুব দুঃখের হতো নিশ্চয়। যা-ই হোক, পুরস্কার প্রদানের পর যখন শামসুর রাহমান সভাপতির ভাষণ শুরু করছেন, তখনই আমি স্টেজের সামনে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম: এই পুরস্কার মানি না! আমি এর প্রতিবাদ করছি, ধিক্কার জানাচ্ছি বাংলা একাডেমীকে, রাহমান ভাই, বক্তৃতা বন্ধ করুন, এই অপকর্মের সঙ্গে যে আপনি নাই সেটা প্রমাণ করুন!'

পুরস্কৃত মুজিব ইরম আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাকে তিনি থামানোর মৃদু চেষ্টা করলেন, কিন্তু হৈচৈ শুরু হয়ে গেলে আমি বেরিয়ে পড়লাম অডিটোরিয়াম থেকে। দরজা ঠেলে বের হওয়ার সময়, রাহমান ভাই বলছেন, শুনতে পাচ্ছিলাম, 'ওকে আমি চিনি, কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।…' মাইক বন্ধ হয়ে গেল। আর আমার সঙ্গে উপস্থিত তরুণ লেখকদের একটা অংশও বেরিয়ে এল। অডিটোরিয়ামের বাইরে সেলিনা হোসেন (তখন তিনি প্রকল্প পরিচালক) আমাকে একপাশে দেয়ালের কাছে নিয়ে বললেন, 'এই প্রকল্প থাকুক, তুমি চাও না?' বললাম, 'এইভাবে চাওয়া যায় না।' বললেন, 'পুরস্কার পাও নি, সে জন্যে মাথা খারাপ হয়ে গেছে!' বললাম, 'নিজের পুরস্কারের চিন্তা করলে স্টলটি যে কেড়ে নেয়া হয়েছিল, প্রকাশ্যে তার প্রতিবাদ করতাম না।' ততক্ষণে দু'তিন জন সাংবাদিক এসে কয়েকটা প্রশ্ন করে চলে গেলেন, আর শামসুর রাহমানের হাত ধরে বেরিয়ে এলেন সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। রাহমান ভাই কিছু যেন বলতে চাইলেন; কিন্তু তার আগেই আমাকে লক্ষ করে সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বললেন, 'রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত তাঁকে সমীহ করেন।' বললাম, 'তাতে কী!' একজন ভিড়ের ভেতর থেকে বলে উঠল, 'আপনি সাহিত্যের মধ্যে রাষ্ট্রপতিকে ঢোকাচ্ছেন কেন?' শামসুর রাহমানের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, 'দেখেছেন কী-রকম বেয়াদব!' তারপর আমাকে ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, 'তুমি তাঁকে যে-অপমান করেছ, তার জবাব অবশ্যই পাবে।' (জবাব তিনি কীভাবে দিয়েছিলেন, তা এক সময় লিখব) বলে, চোখ রাঙিয়ে চলে গেলেন। ঠিক করলাম, ব্যাপারটা এখানেই শেষ হতে দেয়া যায় না। আর-একটু প্রসারতা দরকার।

বঞ্চিতদের, বিশেষ করে পুরস্কার পাবেন বলে যারা আশা করেছিলেন এবং যোগ্যও ছিলেন — এই ধরনের মুহূর্তে মিলিত হওয়াটাই সাধারণ বাস্তবতা। ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন এতে গৌণ, তারা যে পান নি, সেটাই তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে। এই না-পাওয়ার দল, যাদের অধিকাংশই স্টল-ঘটনার প্রতিবাদে সশরীরে থাকা দূরের কথা, প্রতিবাদপত্রে স্বাক্ষরই করে নি বা আমাদের দেখেই অন্য দিকে সরে গেছে, অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর, আমার সঙ্গে থাকলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই আর দেখা যায় না। শুরু থেকে, মানে প্রথম ঘটনা থেকে প্রতিবাদী কয়েকজন আমার সঙ্গে বাংলা একাডেমীর বাইরে দেয়ালের পাশে চা-দোকানে এসে তাদের অন্তত সেদিনের সমস্ত ক্ষোভ নিষ্কাশন করে চলে যান। বুঝতে পারি, বঞ্চিতদের খুব বড় অংশটির আর-একটা আশা আছে, সেটি বাংলা একাডেমীতে তাদের চাকরি। এটা আমার তখনকার ধারণা; সবার ক্ষেত্রে তা সমানভাবে সত্য না-ও হতে পারে।

বিকেলে আমি প্রকল্প থেকে প্রকাশিত নিজের বইটির সমস্ত কপি পোড়ানোর জন্যে শূন্যাকৃতির সেই স্টলটির সামনে দাঁড়ালাম। অনেকেই আমাকে কাজটি না-করার অনুরোধ জানালেন। দু'একজন শুধু এক কপি পুড়িয়ে 'প্রতীকী প্রতিবাদ' জানানোর পরামর্শ দিলেন। কিন্তু তাতে কান না-দিয়ে যখনই দেশলাই বের করেছি পকেট থেকে, তখন হুমায়ুন আজাদ হাজির; সঙ্গে একদল ছেলেমেয়ে। বই পোড়ানোর কারণ, মনে হল, ইতোমধ্যেই তিনি জেনেছেন। বললেন, 'এই বাংলা একাডেমী পুড়িয়ে দিতে পারো না? এই বই তো তোমার সন্তান। সন্তানের গায়ে কেউ আগুন দেয়?' বর্ধমান হাউসের দিকে আঙুল তুলে আরও বললেন, 'পারলে এই ভবন জ্বালিয়ে দাও। তোমার বই এই ভবন থেকে অনেক বেশি মূল্যবান। এখানে যারা বছরের পর বছর মুলো ধ্বংস করছে, তাদের জীবনের চেয়ে তোমার বই অনেক বেশি মূল্যবান। সেলিনা হোসেন জীবনভর যা লিখেছে, তার যোগফল তোমার একটা কবিতার সমান হবে? তোমাকে আমি বই পোড়াতে দেব না। বরং তুমি, নাও, সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করো।' বলে, প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে দিলেন; নিজেও নিলেন এবং অগ্নিসংযোগ করলেন। মুক্তকণ্ঠের এক ফটোসাংবাদিক এলে হুমায়ুন আজাদ আমার কাঁধে হাত দিয়ে ছবি তুললেন। আমাদের হাতে সিগারেট। আরও কয়েকজন সাংবাদিক এলে হুমায়ুন আজাদ তাঁদের উদ্দেশ্যে বললেন, 'চঞ্চল আশরাফ আমার ছাত্র, সে বাংলা একাডেমীর অপকর্মের প্রতিবাদে নিজের বই পোড়াতে চেয়েছে। আমি তাকে তা করতে দিই নি।' বাকি কথা আপনারা ওর কাছ থেকে জেনে নেবেন। বলে তিনি স্থানত্যাগ করলেন।

১৯৯৯ সালে, সম্ভবত নভেম্বরের কোনও এক সন্ধ্যায় হোটেল সোনারগাঁওয়ে আমার বড় ভাইয়ের শ্বশুরপক্ষের এক নিমন্ত্রণে (ওটা ছিল ভাবির কানাডাপ্রবাসী এক জ্যাঠাতো ভাইয়ের বিয়েরই অনুষ্ঠান) সপরিবারে যাই। সেখানে দেখি হুমায়ুন আজাদ বরের বাবার (তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ২২ নম্বর আসামি মাহফুজুল বারী, সে-সময় পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের অফিসার ছিলেন) সঙ্গে কথা বলছেন দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে তিনি ডাকলেন এবং হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন! পাশে আমার স্ত্রী ঝুমু ছিল। ওকেও পরিচয় করিয়ে দিলে হুমায়ুন আজাদ আমাকে লক্ষ করে বললেন, 'তুমি আবার বিয়ে করেছ?' ইঙ্গিতটা খুব পরিষ্কার। এসব জায়গায়, বা, কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে এই ধরনের কথা যিনি বলতে পারেন, তাঁর সঙ্গে প্রত্যুত্তরে যাওয়ার ফল কী, আমার জানা হয়ত ছিল না; কিন্তু যা আমার স্বভাববিরুদ্ধ, আমি তা-ই করলাম; মানে, মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলাম, 'স্যার, ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না পড়ে আমারও ঘুম হয় নাই।' তিনি বললেন, 'এখনও সেই শোক কাটে নি দেখছি!' কাছাকাছি বসেছিলেন আমার বাবা, মা, ভাই আর ভাবি। ভাগ্য ভালোই বলতে হয়, তখন সেখানে তাঁরা ছিলেন না। যা-ই হোক, আমি আর ঝুমু সেখানে গিয়ে বসলাম।

পরের বছর অর্থাৎ ২০০০ সালে বেরোয় তাঁর উপন্যাস নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধুপ্রথম আলোর সাময়িকীতে সমালোচনার জন্যে বইটি আমাকে দেন ব্রাত্য রাইসু। দেয়ার সময়, তিনি হাসতে হাসতেই বলেন, 'আপনার গুরুর বই, শিষ্যত্ব বাদ দিয়া আলোচনা করবেন।'

বইটি পড়তে দুই রাত লাগল। পঞ্চাশের দশকে কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ জীবনের পটভূমিতে জলকদর নামে এক শিশুর বেড়ে-ওঠা এবং তার যৌবনপ্রাপ্তির (ফ্রয়েডীয়) ব্যাখ্যা হাজির করা হয়েছিল উপন্যাসটিতে।

প্রথম আলোর সাময়িকীতে 'কেবল ভাষা যখন উপন্যাসের সম্বল' শিরোনামে সেই উপন্যাসটির সমালোচনা প্রকাশিত হলে তার একটি প্রতিক্রিয়াও ছাপা হয়। আমি সম্ভবত পরের সংখ্যায় এর জবাব দিই। দিলে কী হবে, ২০০২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বেলা এগারোটার দিকে, বইমেলায়, বাংলা একাডেমীর অগ্রণী ব্যাংকের সামনে হুমায়ুন আজাদকে দেখে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে যখন বললাম 'কেমন আছেন স্যার?' তিনি বললেন, 'তুমি কে? তোমাকে আমি চিনি না।'

বললাম, 'চেনেন ঠিকই স্যার। হয়ত কোথাও গোলমাল হয়ে গেছে।'

ঝুমু ছিল আমার সঙ্গে। তার চেহারার দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, সে কষ্ট পেয়েছে। আমার হাত ধরে বলল, 'চলো, এখানে আর দাঁড়ানো যাচ্ছে না।' আমরা তাঁর সামনে থেকে সরে 'দ্রৌপদী' নামের স্টলটির দিকে গেলাম। সেখানকার কয়েকজন তরুণ (অশোক দাশগুপ্তর কথা মনে পড়ছে) ব্যাপারটা লক্ষ করেছিলেন। আমার সঙ্গে কথা বলে চলে গেলেন তাঁরা এবং কিছুক্ষণ পরে ফিরে এলেন। বললেন, 'স্যার, মানে হুমায়ুন আজাদ আপনাকে যেতে বলেছেন।' কিছু বলতে যাব, এমন সময় ঝুমু আমাকে বলল, 'না চঞ্চল তুমি যাবে না।'

একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বলে আমি পরবর্তী কিস্তির জন্যে দম নেব। ১৯৯৮-র ডিসেম্বরে গদ্য নামের একটি ছোটকাগজে 'আত্মজীবনীর কয়েকটি পাতা' লিখি। তাতে একটা অনুচ্ছেদ ছিল — 'কী দেখিতে চাই আর? দেখেছি ঈদ সংখ্যার অপদার্থ লেখক ও টিভির শোচনীয় নাটক, হুমায়ুন আহমেদের শরৎসমগ্র; দেখেছি কবির চেয়ে আবৃত্তিকারের সম্মান, সৈয়দ মুজতবা আলীর জীবন-বৃত্তান্ত ও উপন্যাসের কাহিনী লিখে অধ্যাপকের ডি লিট অর্জন; বাস্তবিক, আর কিছু দেখেছি কি? দেখি নি কি তোষামোদে উড়ে আসে সব পুরস্কার?' পরের বছর, বইমেলায় হুমায়ুন আজাদ আমাকে দেখেই বললেন, 'তোমার দারুণ সাহসী একটা লেখা পড়লাম। আরও যা-যা দেখছ, সব লিখবে, তুমি পারবে। থেমো না।' নিজের লেখা নিয়ে আমার সব সময় সন্দেহ; প্রকাশের পরও, বেশির ভাগ সময় লেখার ত্রুটি খুঁজতে থাকি। কারও প্রশংসাও তাতে কোনও ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না। কিন্তু হুমায়ুন আজাদের সেই কথা শুনে কী-যে ভালো লেগেছিল আমার, চোখে পানি এসেছিল; প্রিয় পাঠক, এই-যে এখন লিখছি, আমার চোখ ভিজে আসছে।…

মনিপুরী পাড়া, ঢাকা ১/১০/৮

লেখকের আর্টস প্রোফাইল: চঞ্চল আশরাফ
ইমেইল: chanchalashraf1969@yahoo.com


ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts