পোশাকশিল্পের মালিকরা নিজেদের ভিলেন ভাবেন কেন?

বেবী মওদুদ
Published : 21 July 2010, 03:41 PM
Updated : 21 July 2010, 03:41 PM

সম্প্রতি গার্মেন্টস মালিকদের সঙ্গে সম্পাদকদের একটি গোলটেবিল বৈঠকে আমার অংশ নেবার সুযোগ হয়েছিল। শেরাটন হোটেলের বলরুমে এ আলোচনা শেষ হয় দুপুরের আহারসহ।

আমি যতক্ষণ ছিলাম, শুধু ভাবছিলাম যে-শিল্পে শতকরা আশি ভাগ নারী শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন, সেখানে কোন নারীকে তো মালিক হিসেবে আজ দেখলাম না। গার্মেন্টস মালিক সমিতির বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ এবং বড় মালিকরাই উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে প্রথমে সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম মোর্শেদীসহ কয়েকজন বড় কারখানা মালিক বক্তব্য রাখলেন এ শিল্পের বর্তমান অবস্থা নিয়ে। তাদের কথা হলো, এই শিল্প দেশের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক অর্জনকারী খাত। এই খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৪০৬০০ কোটি টাকা। ২০০৮-২০০৯ অর্থ বছরে চট্টগ্রাম বন্দর এ খাত থেকে রাজস্ব আদায় করেছে ৫৩৬ কোটি টাকা, প্রাইভেট ব্যাংকিং খাত ২০০৯ সালে ৩৯০০ কোটি টাকা মুনাফা করে পোষাক বপ্তানি বাণিজ্য থেকে। দেশের অভ্যন্তরীণ পরিবহন খাত পোশাক শিল্প থেকে ৫২০ কোটি আয় করে। পোশাক শিল্পে প্রায় ৫০০০ কোটি টাকার প্রিন্টিং সামগ্রী ব্যবহৃত হয়। এ শিল্পে কর্মরত শ্রমিকগণ বছরে প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার করে ২০০ কোটি টাকার। এসব তথ্য পোশাক মালিকদের দেয়া।

২০০৮ সালে ডিপার্টমেন্ট অব টেক্সটাইল এর সৌজন্যে সম্পাদিত বস্ত্র খাতের উপর একটি সমীক্ষা রিপোর্টে এসব তথ্যের উল্লেখ আছে। হয়তো আরও অনেক তথ্য ছিল, কিন্তু সেগুলো তারা আমাদের জানাতে চান নি।

কিন্তু আমাদের জানালে ভালো হতো। এ শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি কেমন, বোনাস ও ওভারটাইম কত। সেসব পরিশোধ হয় কি না ? অপরিশোধের কারণ কী ? শ্রমিকদের নিয়োগ পত্র ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয় কি না ? তাদের খাবারের জন্য ক্যান্টিন আছে কি না ? সেখানে মালিকপক্ষ সাবসিডি দেন কি না ? প্রতিটি কারখানার চিকিৎসা সুবিধা আছে কি না ? শ্রমিকদের বাসস্থানের কোন ব্যবস্থা আছে কি না। কী পরিমাণ শ্রমিক ছাটাই হয়। ছাটাইয়ের কারণ কী ? অগ্নিকা- এবং দালান ধ্বসে কত শ্রমিক নিহত হয়েছেন। ইত্যাদি অনেক কথা আমাদেরও জানতে ইচ্ছে করে। সরকার ও অন্যরা কে কেমন আয় করে জানলাম, কিন্তু মালিকরা কেমন আয় করেন সেটাও জানলে স্বস্থি পেতাম।

সভাপতি সাহেব ও মালিকরা পোশাক শিল্পের বর্তমান অবস্থান নিয়ে অনেক কথা বললেন। অনেকে কারখানা বিক্রি করে দিচ্ছেন। এ শিল্প থেকে অনেকে সরে যেতে চাইছেন। বিদ্যুত ও গ্যাসের সমস্যা রয়েছে। সহজ শর্তে ব্যাংকে ঋণের ব্যাবস্থা নেই। চীন, শ্রীলংকা ও ভারত যে পরিমান সরকারি সহযোগিতা পায় আমাদের এখানে তেমন পাওয়া যায় না। শ্রমিক ও বহিরাগতরা ধর্মঘটের নামে ভাংচুর করে, মহিলা শ্রমিকরা চুল ধরে মারপিট করে এবং কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক খুলে নিয়ে যায়। যেখানে সাত তারিখে নিয়মিত বেতন হয়, সেখানে পাঁচ তারিখে বেতনের দাবিতে আন্দোলন করে।

এসব ছাড়াও শ্রমিকদের আন্দোলন ও হরতালের সময় পুলিশের লাঠিচার্জের ছবি বিদেশে পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়ায় বাংলাদেশের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে। ফলে বিদেশে বাজার হারাবার সংকট দেখা দিচ্ছে। এদিকে শ্রীলংকার পোশাক মালিকরা এসব খবরে চাঙ্গা হচ্ছে। বাংলাদেশের বাজার দখলের জন্য শ্রীলংকা, ভারত খুব উদগ্রীব। এসব দেশে সরকার অনেক সুবিধা দিয়ে থাকে– এ কথাও জানালেন। এ মাসেই সরকার শ্রমিকদের মজুরি ঘোষণা করবেন – সুতরাং মালিকরা প্রত্যাশা করেন শ্রমিকরা তার আগে ধর্মঘটে যাবে না।

তারা অবশ্য একটি খুব উল্লেখযোগ্য কথা বললেন, পোষাক শিল্পের মালিকরা ভিলেন বা খলনায়ক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠছেন। আমার মনে হলো এতে তারা কষ্ট পেয়েছেন। দুঃখবোধ থেকেই একথা উচ্চারণ করলেন। কিন্তু এই পরিচিতি গড়ে তুলেছেন তারা নিজেরাই।

সম্পাদকরাও কথা বললেন। এ শিল্প যদি দেশের প্রধান শিল্প হয় এবং বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে তাহলে এ শিল্পে অস্থিরতা কেন ? কেনইবা আশুলিয়া ও সাভারের কারখানায় এতো ধর্মঘট, আন্দোলন হয় ? মালিবাগ, রামপুরা, মীরপুরেও তো কারখানা আছে। সেখানে বেতন কম, অনিয়মিত, ওভারটাইম ও বোনাসও সবাইকে দেয়া হয় না, ছাঁটাই আছে – তারপরও তো সেখানে কোনও ধর্মঘট এবং ভাংচুরের খবর পাওয়া যায় না। কেউ কেউ বললেন, পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা উন্নত নয়। ফলে অগ্নিকান্ড, দালান ধ্বসে যে শ্রমিক নিহত হয় যা অত্যন্ত দূর্ভাগ্যজনক। শ্রমিকদের বেতন ও মজুরি অত্যন্ত কম কেন ? দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছে আমাদের পোশাক শিল্প। সরকার মজুরী নির্ধারণ করে দিলেও অধিকাংশ মালিকই সেটা মানেন না। মালিকদের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটে কিন্তু শ্রমিকদের দারিদ্র ঘোচে না।

আমাদের দেশে পোশাক শিল্প গড়ে উঠতে শুরু করে আশির দশকে। তখন আমরা দেখেছি ছোট্ট ছোট্ট দমবন্ধ ঘরে কাজ শুরু হয়। ধীরে ধীরে এ শিল্প ভালো-মন্দ পরিবেশের মধ্য দিয়ে বর্তমানে একটা অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। বড় বড় কারখানার নিজস্ব ভবন হয়েছে কাজের পরিধি বেড়েছে। উজ্জ্বল আলো, ফ্যানের ব্যবস্থা হয়েছে, মেশিনপত্র আসছে, কাপড়-সুতো-বোতাম ইত্যাদির কোন অভাব নেই। বেশ ঝকঝকে চকমকে হয়ে পোশাক শিল্প দেশের প্রধান শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে। মালিকরা বাড়ি-গাড়ি-এসি ব্যবহার, বিদেশ সফর নিয়ে ব্যস্ত। তাদের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটেছে। ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়ে। কিন্তু আমাদের শ্রমিকদের ভাগ্যাহত জীবন সেই ভাগ্যহীনই রয়ে গেছে। তাদের সেই শুটকি ভর্তা ও মোটা চালের ভাতই একমাত্র সম্বল। এটুকু যেন ছুটে না যায় সেজন্য মুখ বুজে পরিশ্রম করে যায়। কখন ছাঁটাই হতে হয়, বেতন বন্ধ হয়ে যায় ইত্যাদি নানা অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে কাটাতে হয়।

তাদের সামান্য বেতনের ওপর নির্ভরশীল গ্রামে বসবাসরত মা-বাবা-ভাইবোন অথবা স্বামী-সন্তান। ঢাকা শহরে বস্তিতে মানবেতর জীবন-যাপন করতে হয়, কাজে যাতায়াতকালে অপহরণ-ধর্ষণ-প্রতারণার শঙ্কা থাকে। শোনা যাচ্ছে, নতুন মজুরি কমিনে শ্রমিকদের বেতন সর্বনিম্ন ২৮০০ অথবা ৩০০০টাকা হতে পারে। বর্তমানে সর্বনিম্ন বেতন হচ্ছে ১৪০০ থেকে ২০০০ টাকা। যারা এটা নির্ধারণ করেন তারা কি একবার বিবেচনা করে দেখেছেন এই টাকায় একজন শ্রমিকের খাওয়া-পরার অভাব ঘুচবে কিনা? অথচ সরকারি অফিসের পিয়ন, মালি, দারোয়ান এবং সুইপারদের মূল বেতন হচ্ছে ৪১০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত ভাতাসহ সব মিলিয়ে প্রায় ৭৭৪৫ টাকা । এখানে শ্রমিকদের দাবি হচ্ছে সর্বনিম্ন বেতন ৫০০০ টাকা দেয়া হোক।

পোশাক মালিকরা কি সত্যিই পারেন না এদের উপযুক্ত মজুরি সময়মত মিটিয়ে দিতে ? ন্যায্য পাওনা থেকে কেন তাদের বঞ্চিত করা হবে? তাদের উন্নত জীবনযাপনের জন্য নূন্যতম সুবিধাগুলো দিতে কী সমস্যা মালিকদের ? শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক কেন দৃঢ় সহযোগিতাসম্পন্ন হবে না ? কেন তাদের মধ্যে এতো দূরত্ব থাকে? নিজ নিজ কারখানার মালিক কেন তার শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখবেন না? তাহলে তো মালিকরা শুধু নায়ক নয়, মহানায়কও হয়ে উঠতে পারেন। খলনায়কের কলঙ্ক ঘোচাতে হলে আগে নিজেদের শুদ্ধ হতে হবে, শ্রমিক কল্যাণ সবার আগে ভাবতে হবে। এবং এটাই একমাত্র সত্য কথা।