পুষ্পের মঞ্জিল

shagufta_tania
Published : 3 Feb 2008, 08:01 AM
Updated : 3 Feb 2008, 08:01 AM

বেলা পড়ে আসবার এই সময়টাতে একদিন আঙিনায় এসে দাঁড়িয়েছিল মেরুন শাল-বাসন্তী শাড়ি। ফৈরোজ আন্দালিব মুর্শীদ। মুখটা অল্প লাল, শেষ বিকেলের রাঙা রোদ আর পিপুলগাছের ছায়ায় ডোরা কাটা-কুটি।

পিঠময় একঢাল মিশমিশে চুল। আনিসা বেগম একঝলক দেখে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ছিলেন, কেন না ফৈরোজের ঐ দাঁড়িয়ে থাকার ভিতর কী যেন একটা ব্যাপার ছিল: মৌলিক সংখ্যার মত–কেবল নিজেকে দিয়ে বিভাজ্য। সেটা আঘাত করেছিল তাঁকে। অপ্রস্তুতও একটু।

আনিসা বেগম হয়তো প্রস্তুত ছিলেন–কানিজ ফাতেমা কিংবা আফরোজা সুলতানার জন্যে। সেখানে ফৈরোজ আন্দালিব অভাবনীয় নয়? একেবারে ঘোর গেরুয়া-মেরুনে মাখামাখি, চোখের তলায় মইয়ের মতো তীর্যক ঠেস দেয়া লালচে রৌদ্র…।

একটা শ্বাস ফেললেন আনিসা। তারপর স্মৃতির খেরোকাপড়ে বাঁধাই খাতাটা বন্ধ করলেন। বিকালবেলা তাঁর ছেলেমেয়েরা খেলতে যেতো। আদিগন্ত খড়-রঙা ঘাসের মাঠে। তারপর ফিরে আসতো ছোট্ট পেয়ালার সুজির হালুয়া কিংবা খাস্তা পুরির কাছে, ঠিক যেন হাঁসেদের মতো–চৈ চৈ চৈ ডাক শুনে ফেরত আসতো তারা। জুবায়ের, টুলু, শম্পা, সালমা। নানীর বোনা গোলাপী কার্ডিগ্যান, মায়ের বেঁধে দেয়া কলাবেণী। আনিসা বেগমের নিঃশব্দ হৃদয় অবিরাম ডেকে যায় চৈ চৈ চৈ। খোঁয়াড় শূন্য। হাঁসপুকুর শূন্য।

ফৈরোজ আন্দালিব
আমরা মুখোমুখি খেতে বসেছি। আমি আর জুবায়ের-এর আম্মা। উনি আমার সামনে ঘোমটা দেন কেন আমি জানি না। আমার মনে আছে প্রথমবার খেতে বসে এই টেবিলে আমি কী খেয়েছিলাম। মিষ্টিকুমড়া শাক, পিপুলপাতা দিয়ে ছোটমাছের চচ্চড়ি আর ফুলবড়ি। আমার জন্যে এর সবই অভিনব। জুবায়ের-এর আম্মা খুব ভাল রাঁধেন। আমার জন্যে তড়িঘড়ি একটা ডিম ভেজে এনেছিলেন।

আজকে রান্না হয়েছে তেলাপিয়া মাছ। এই মাছ আমার খুব অপছন্দ। আমার জন্যে আজকেও একটা ছোট প্লেটে সলজ্জ ডিমভাজি।

সবকটা বাসন মেলামাইনের। আগে ছিল কাঁসা আর স্টিল। জুবায়ের-এর আম্মাকে কে যেন বলেছে ধাতব পাত্রে খেলে অ্যালঝাইমার্স ডিজিজ হয়। জুবায়ের-এর আব্বার অ্যালঝাইমার্স ডিজিজ আছে। বড় কষ্ট। ভরপেট খেয়েদেয়ে খেয়েছেন ভুলে যান, টুলু-শম্পার বয়স গুলিয়ে ফেলেন প্রায়ই, শোবার ঘরে ঢুকে নিজের স্ত্রীকে দেখে সরি-সরি বলে বের হয়ে আসেন।

জুবায়ের-এর আম্মার একটা অতীত আছে। ওঁর আসল নাম ছিল তপতীরানী। জুবায়ের বলেছিল একদিন রাতে। আমার একটা নাম ছিল জুবায়ের-এর দেয়া। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের 'পিয়ানোর গান' থেকে নেয়া।

জুবায়ের-এর আম্মা অনুচ্চ স্বরে কী যেন জিজ্ঞেস করলেন। বোধহয় ওলকচুতে আমার গলা ধরে কিনা। আমি মাথা নাড়লাম। আমার আর গলা ধরে আসে না। কোনো কিছুতেই।

আমি পাত আগিয়ে দিয়ে মুসুরির ডাল নিই। কী সুবাস–মৌরীর আর কালি জিরার। ছিন্ন শাপলার পাঁপড়ীর মতো ভাসছে রসুন। একটা ছোট্ট পেয়ালায় কাগজী লেবু আর কাঁচামরিচ। দুটোই গাছের।


আনিসা বেগম

আমার গাছের শখ ছোটবেলা থেকেই। আমাদের ছোট্ট আঙিনায় আমি লাগিয়েছি সজিনা, হরীতকী আর পিপুল। (আমার হিজলগাছটা মরে গেছে।) কাগজী লেবু আর পেয়ারাগাছ ছাদে। আমার বড় ছেলে জুবায়ের বলতো–ডেঙ্গু হবে। 'ডেঙ্গু হবে। গাছ-গাছালি সাফা করো।' আমি বলতাম, 'হ্যাঁরে, তোর নিজের একটা বাড়ি হলে আমাকে একটা পাখিঘর করতে দিবি?'

'এর পরের ধাপ কী আম্মা? হাঁসমুরগী ও গরু-পালন?' সালমা আর টুলু দুইজনই সেবার অংকে ফেল করেছিল, জুবায়ের হেসে বলতো, 'আম্মার গরু-পালন অধ্যায় শুরু হয়ে গেছে।' 'দাদাভাই, নিজের বোনকে গরু বলছো!' সালমা বিষম রাগ করতো।

ছোটবেলায় জুবায়েরকে আমি রজত ডাকতাম, লুকিয়ে লুকিয়ে। কী রকম ঝকঝকে শাদা ছিল তার দুধদাঁত। কী রকম আলো-ঝলমলে চুল।

মাঝেমাঝে বড়ি কিংবা বেলশুঁঠ রৌদ্রে দিতে ছাদে যাই। কী শুনসান। শুধু অনেক দূরের চিলের ডাক। আচ্ছা, আমার বোধহয় রাশি রাশি পাপ জমা আছে, নয়তো আমার জীবন এমন কেন?

ফৈরোজ আন্দালিব
এই ঘরটায় প্রথম শুতে এসে আমি রাতে শচীন দেব বর্মণের গান শুনেছিলাম। জুবায়ের বাজিয়েছিল ওদের ছোট্ট লাল টু-ইন-ওয়ান-এ। আমি পরেছিলাম আমার গহীন বাসন্তী শাড়িটা। শীত করছিল বলে শালটা ছিল গায়ে। আমার গলায় ছিল পাথরের মালা–দারুচিনি-জাফরান-এলাচ-জৈত্রী রঙের–নানান আকারের পুঁতি-পাথরের জটাটাকে টান দিয়ে আমাকে কাছে টেনে নিয়েছিল সে, গলা মিলিয়েছিল–'দূর কোন্ পরবাসে তুমি চলে যাইবা হে–'

চিত্ হয়ে শুয়ে হাত পা ছড়িয়ে জুবায়ের শৈশবের গল্প করেছিল–'শম্পা-সালমা রান্নাবাটি খেলতো, আমার খেলতে এতো লোভ হতো–ওরা আমাকে বানাতো কাজের ছেলে।'

আমি আজ রাতে শুয়ে শুয়ে সিলিং-এ রাতের আলোছায়ার দেয়ালা দেখি। মেঘের মহাদেশ ছাড়িয়ে চাঁদ চলেছে পশ্চিমে। হাঃ 'কালের যাত্রার ধ্বনি।' জুবায়েরের গায়ের গন্ধ মনে করতে চেষ্টা করি। সদ্য কাটা ঘাসের মাঠে দীর্ঘক্ষণ রোদপোহানো বিড়ালের গায়ের ঘ্রাণ ছিল তার গায়ে। এটা কী রকম উপমান হলো? জানি না। আসলে অনেক কিছু জড়িত ছিল সেই গন্ধে। একটা বিড়ালের রোমশ শরীরে পাঁচ আঙুল লুপ্ত করে দেয়ার স্পর্শসুখ…বিকেলের মাঠে রৌদ্রের ওম্, এমনকি একরকম স্বাদও ছিল সেই শারীরিক সুবাসের। পল ম্যাকার্টনির গলার আওয়াজ শুনলেই আমার মনে হতো সকালের ইস্কুলে যাওয়ার মতো রৌদ্র উঠেছে, কর্ন অয়েলের মতো তার রঙ…ব্যাপারটা সেরকম। সিলিং-এ ছায়া-বলাকা উড়ে যায় রাতের বাতাসে। মেঝেতে কাঁথাকাপড় পেতে শুয়ে ছিল সবেদা। সে ঘুম-ঘুম মাথা তুলে বললো, 'ভাবি, কাইন্দেন না।'

(সবেদা প্রায় একশো মাইল পথ বাসে করে এসেছে শুধু আমাকে দেখবে বলে। যখন আমি প্রথম এসেছিলাম, ওর বিয়ে হয়নি তখন। নোলক বেঁধা পানপাতা মুখ কিশোরী সে।)

আনিসা বেগম
উত্তরের বাতাস শুরু হয়ে গেছে। বৌমার ঘরে, আমি মোটা কাঁথাটা রেখে আসি নাই। সম্সুন্নাহারকে দিয়ে পাঠাবো? শেষ রাতে শীত করবে নয়তো। ওর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আমার হঠাৎ একটা কথা মনে হলো। ফৈরোজকে আমি কখনো বৌমা ডাকি নাই। নাম ধরেও ডাকি নাই। কী সব কথা মনে হয় রাতদুপুরে। দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে লাভ কী? নিজের ঘরে ফিরে জবাব পেয়ে গেলাম আমি। মাইলকে মাইল দূরের লোককে কেউ ডাক দিতে পারে নাকি? (তার ওপর আমি কিনা মুসলমান ঘরের বউ।)

আঙিনার কাঁঠালগাছটা জোস্নায় চক্ চক্ করছে। আজব গাছটা, কাঁঠাল ফলতো গুঁড়ির কাছা-কাছি…এমনকি মাটির নিচেও। আমাদের মধ্যে জুবায়েরই কাঁঠাল খেতে ভালবাসতো।

ফৈরোজ আন্দালিব
ছোটবেলা থেকেই আমার পালানোর রোগ। প্রথমে, শুরু হয়েছিল সামান্য থেকেই, বড় ভাই ব্যবহারিক পরীক্ষার জন্যে ব্যাঙ আঁকা মক্শো করছে…আমি পালিয়ে আছি পায়ের কাছে টেবিলের নিচে। এরপর দেরাজের পেছনে, আলনা-দরজা-কার্নিশ…কিছুই বাদ রাখিনি। আস্তে আস্তে বাড়ির বাইরে। আমার আব্বা ওস্তাদ গোলাম মুর্শীদকে লোকে একনামে চিনতো। ফলে নানান লোকে নানান সময় আমাকে বাড়িতে এনে দিতো। এলেই ধুন্ধুমার মার দিতেন আম্মা, কেবল বলতেন–বাপকা বেটী!

সুরকার-গীতিকার-সেতারবাজিয়ে গোলাম মুর্শীদ ততদিনে এক চিত্রনায়িকার (একসময় তিব্বত স্নো-এর বিজ্ঞাপনে তাকে দেখা যেতো) সাথে কোলকাতা পালিয়ে গেছেন। আর আম্মা আমাদের ভাইবোনদের উপর তার জের তুলছেন। থাক, এই গল্প আর ভাল লাগছে না।

খুব অল্প বয়েসে আব্বা আমাকে পড়তে পাঠিয়ে দেন। এক্কেবারে বিলেত। হাড়কাঁপানো ধূসর বৃষ্টি। ইদুঁররঙা পিচ্ছিল সড়ক। আর মগজ ছিদ্র করে ক্রমাগত ঢুকতে থাকা একাকীত্ব।

ধীরে ধীরে আমার ভাল লাগতে থাকে বেঁটে বেঁটে টিউডর আমলের সাদাকালো, ডুরে ঘর-বন্ধকী দোকান-শুঁড়িখানা-দীঘল ধূসর কাণ্ডের সরল গাছ-বাতাসে হাজার রকম রেণু-ষাটের দশকের বেখাপ্পা কাউন্সিল ফ্ল্যাটের বারান্দায় মেলে দেয়া ধোয়া কাপড় আর সকালের রোদে তার উদ্দাম হাসি। প্রত্যেক দেশের বুকের ভেতর থাকে তার শীতকালীন রূপকথা-দাদিমার মেঠাই। সহজে সে তার হৃদয় খুলে দেয় না। আমার ছিল সোনার কাঠি–তার রঙ লালচে। তার চোখ নীল আর চুল বাদামী।

গোলাকার আকাশের নিচে ঢালু অনন্ত মাঠ। গভীর সবুজ পার্ক। মাটিতে শুয়ে কান পাতলে শুনতে পাবে পাতাল রেল চলেছে ঘাসের নিচ দিয়ে আমার কানের পাশে পাঁজরে ঢাকা নবীন হৃদপিণ্ড (কলিন্ বেজায় রোগা ছিল) ধুক্ পুক্ করছে। রাত ভোর হবার নীলচে অন্ধকারে দূরায়ত গাঙচিলের ডাক শুনতে শুনতে আমি ওকে আঁকড়ে ধরি–এইবার আমি আর পালাতে চাই না। ধরা দিতে চাই।

কতকাল আগের কথা। পুরনো বইয়ের মতো, শালর্ক হোম্‌স্‌-আগাথা ক্রিস্টি-ব্রন্টি সিস্টার্সদের সঙ্গে আরেকটা পুরনো বইয়ের মতো মিশে আছে কলিন মারফি। যেন সেও আদতে একটা গল্প, 'কখনো ঘটেনি' গল্প।

আনিসা বেগম
জুবায়ের-এর আব্বা ঘুম ভেঙে জেগে উঠে বিড় বিড় করেন প্রায়ই। আমি কান পেতে শুনতে চেষ্টা করলাম। উনি বলছেন ওঁর এক পূর্বপুরুষ ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান। এ তল্লাটের জাগ্রত কালীর চারটা মুক্তোর হাত গড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি, আর কালীর সোনার ভ্রু।

আমার মুখে একটু হাসি ফুটি-ফুটি করছে কি? এই গল্প আমার জানা। এটা উনার গল্প নয়। তপতীরানীর গল্প। জুবায়ের-এর দাদা মহকুমা অফিসে কাজ করতেন–পঞ্চাশের দশকে জলের দরে এই বাড়িটা উনি কিনে নেন এক সম্পন্ন হিন্দু ভদ্রলোকের কাছ থেকে। …কড়িকাঠে ছুরি দিয়ে একটা নাম লেখা আছে–শ্রীহরিদাস মিস্ত্রী।

উত্তরের ঘরে বৌমা শুয়েছে। ঘরটা গুমোট আর স্যাঁতসেঁতে। এই মেয়েটা কেন আমার জুবায়েরকে বিয়ে করেছিল, কেন এসেছিল আমাদের জীবনে…আবার চলেও গেল, কিছুই জানতে পারলাম না। জুবায়ের-এর সাথে আমি তেমন সোজা-সাপ্টা করে মিশতে পারি নাই। পারলে হয়তো জেনে নিতাম। জুবায়ের খুন হবার পর পুলিশ যখন আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল, তখন এই মেয়েটা আমার পিঠে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিল। পুলিশের কত প্রশ্ন–খুন হওয়ার রাতে আপনি কী রান্না করছিলেন?

বাড়ির দরজায় এত বড় শব্দ হলো…আপনি তো স্বাস্থ্যবতী মহিলা, আপনার ঘুম ভাঙলো না? আমার বুকটা বোধহয় পাষাণে গড়া, আমি এক এক করে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম।

হ্যাঁ আমি ইব্নুলকে চিনি, সে প্রায়ই জিমখানা থেকে এই বাড়িতে আসতো। হ্যাঁ আমি সেই রাতে রান্না করেছিলাম ছোলার ডাল আর খাসীর তেলের বড়া।

ফৈরোজ আমার পাশ থেকে নড়ে নাই।

থাক্ ওর ভাল হোক।

পাঁচটা বছর বড় কম সময় না, এর মধ্যে কত জখম সেরে যায়। মেয়েটা ওর এক সহকর্মীকে বিয়ে করবে এ মাসে। তারপর চলে যাবে আবুধাবি। আর কবে দেখা হয় না হয়, তাই আমাদের দেখতে এসেছে। টুলুর একটা চাকরীর ব্যবস্থাও করেছে সে। এতদিন এই মেয়ে নিয়মিত টাকা-কড়ি পাঠাতো। আমার বড় ছেলে যে আর নাই–এ কথা আমাদের সে বুঝতে দেয় নাই।

মৃত মানুষের জীবন থেমে যায়। জীবিতের জীবন থেমে থাকে না। আহা, ওর ভালো হোক।

ফৈরোজ আন্দালিব
একটা বেইজ্ রঙের ছোট্ট ঘর। রুম হিটার চলছে। আমার সামনে যে ডাক্তার মহিলা বসা, তাঁর মাথায় খড়কুটো রঙা চুল, ঠোঁটে নাতিশীতোষ্ণ হাসি।

'তুমি নিশ্চিত তুমি যা করতে চাইছো তাই তুমি করছো। তুমি নিশ্চয় জানো এটি অফেরতযোগ্য প্রক্রিয়া?'

আমি মাথা নাড়লাম। আমার নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। আমি কোনওমতে জিজ্ঞেস করলাম, 'ওটা কি যমজ?'

'হ্যাঁ সার্জারির পর তুমি টয়লেটে যাবে। কেমন? শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া ঠিকমতো শুরু হয়েছে কিনা সেটা দেখবার জন্যে এটা জরুরী।

 আচ্ছা।

 তোমাকে কিছু খেতে আর পান করতে দেয়া হবে। হালকা স্যান্ডুইচ আর জুস। অরেঞ্জ না পাইন্যাপল?

 অরেঞ্জ।

 সাদা রুটি না কালো রুটি?

 সাদা।

 মাখন?

 হ্যাঁ।

 হামোজ না এগ মেয়োনিজ না হ্যাম্?

 হামোজ।

 স্যালাড থাকবে ভেতরে নাকি থাকবে না ?

 থাকবে। ওটা কি মেয়ে না ছেলে?

 পেশাগত কারণে আমি বলতে বাধ্য নই। তবে এত দ্রুত লিঙ্গ বোঝা সম্ভব নয়। তুমি গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে না। তোমাকে পৌঁছে দেবার জন্য কেউ এসেছে?

এইবার আমার চোখে জল আসে। আমাকে পৌঁছে দেবার জন্যে সবসময়ই কেউ না কেউ থাকে।

হ্যাঁ। আমার পার্টনার। কলিন র্মাফি। ওয়েটিং রুমে পাংশু মুখে বসে আছে।

আনিসা বেগম
আমি খুব আবেগপ্রবণ নই। কিন্তু আজকে সকালে এদের প্রিয় নাস্তা লুচি-মাংস পাক করতে গিয়ে বারবার আমার চোখ ভিজে আসছিল।

যেন এইবার আমার বড়ছেলের শেষ চিহ্নটাও মুছে যাচ্ছে।

সালমা ওর আব্বাকে ডান পায়ের চপ্পল ডান পায়ে পরতে সাহায্য করছিল। উনি হঠাৎ মুখ তুলে বললেন, 'জুবায়ের আসবে তুমি জানো, আমাকে বলো নাই কেন? শম্পা-সালমার ইস্কুলের বেতনটা নিয়ে আসতে বলতাম।'

ফৈরোজ লুচি ছিঁড়তে ছিঁড়তে সালমার দিকে চেয়ে হাসলো। সালমা সম্মান শেষ বর্ষের ছাত্রী কিনা। আমি ঘোমটা টানতে টানতে টিফিন কেরিয়ারটা এনে হাজির করলাম মিন মিন করে বললাম, 'আশুগঞ্জ জংশনে ট্রেন অনেকক্ষণ দাঁড়াবে। তুমি দুপুরের খাবার খেয়ো।'

হরিন-বাদামী একটা শাড়ি পরেছে মেয়েটা, মেরুন মখমলের স্যান্ডেল। সে যে কী সুন্দর!

ফৈরোজ আন্দলিব
ঝিল্‌মিল্‌/ঝিক্‌মিক্‌/ঝিক্‌মিক্‌/ঝিল্‌মিল
তার তন্ তার দিল্/পুষ্পের মঞ্জিল।

জুবায়ের বলতো–আমি হচ্ছি পুষ্পের মঞ্জিল।

সত্যিই কি লোকে তাই দেখে? ঝিল্‌মিল্‌/ঝিক্‌মিক্‌?

গুণাঢ্য কন্যা। উপচীকির্ষু পুত্রবধূ।

জংশনে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে থাকবার সময় আমি খুব উপভোগ করে লুচি মাংস খাই। এই যে মাংসের টুকরোর ভেতর ঢুকে যাওয়া একরকম চাট্ মশলার স্বাদ, এটা গোটা পৃথিবীতে এক জুবায়ের-এর আম্মা ছাড়া আর কেউ আনতে পারে না–আমি নিশ্চিত। আঙুলে জড়িয়ে যাওয়া সুরুয়া-ধনেপাতা চুষে খেতে খেতে আমার মনে পড়লো–হয়তো এই স্বাদ আমার আর গ্রহণ করা হবে না। দূর কোন্ পরবাসে–।

জুবায়েরও কেমন কেমন করে একটা পুরনো বই হয়ে গেল। সেইসব ছেলেরা–জিলা স্কুলের ছাত্র, যারা বন্দে আলী মিয়ার ছড়া পড়তো, যারা রাতের ট্রেন-এ বাড়ি ফিরে একটা খুশীর খাটো শোরগোল তুলে দিতো, 'আমার মায়ের সোনার নোলক' ছাড়া ঘরকে যেতো না, যারা পাত পরিষ্কার করে চেটেপুটে খেয়ে উঠতো। যে অবিকল বলে উঠতো পারতো–'হ গীত না তর মাথা।' (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়)। একটুও বেমানান হতো না। জুবায়ের-এর আম্মা পিপুলগাছটার নিচে দাঁড়িয়েছিলেন আমাকে বিদায় দেবার জন্যে। হৃদয়হীন প্রশ্নের দেশে আমার মিতা। কেউ জানে না।

(বিরতির পর ট্রেন আবার চলতে শুরু করলো। ঝিল্‌মিল্‌/ ঝিক্‌মিক্‌/ ঝিক্‌মিক্‌/ঝিল্‌মিল্‌…)

লন্ডন, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০০৭