বাংলা ভাষা, হিন্দি ভূত এবং কিছু প্রসঙ্গ

adnan_syed
Published : 23 Feb 2008, 09:19 AM
Updated : 23 Feb 2008, 09:19 AM


বইমেলায় নিজ গালে শহীদ মিনার আঁকিয়ে নিচ্ছে এক শিশু

ফারাবীর বয়স আট, পড়ছে একটি ইংরেজী মিডিয়ামে। বেশ প্রাণচঞ্চল আর প্রচণ্ড মেধার অধিকারী এই ছোট্ট শিশুটির চোখে-মুখে অনেক আশাবাদী স্বপ্নের ছোঁয়া লেগে আছে। ফারাবী বাংলা-ইংরেজী মিশিয়ে ওর মা-বাবা আর চারপাশের চেনা-পরিচিতদের সাথে ভাষাগত যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছে। কিন্তু গত পরশু একটা ছোট্ট ঘটনা ওর পরিবারের সবাইকে একটা বিপদে ফেলে দিল। ফারাবী কম্পিউটারে ভিডিও গেম খেলছে আর অনর্গল হিন্দিতে নিজের সাথেই কথা বলে যাচ্ছে। অবাক কাণ্ড! বিশুদ্ধ হিন্দি জবান এই আট বছরের শিশুর মুখে!! সবাই খুব অবাক হলেও ওর মা কিন্তু মোটেও ততটা অবাক হলেন না। ওর মার দাবি এর জন্য দায়ী টিভি মিডিয়া অর্থাৎ হিন্দি চ্যানেল। বাচ্চাগুলো কার্টুন নেটওয়ার্ক-এর ওপর প্রায় সারাক্ষণই হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকে। আর এই কার্টুনগুলো ইংরেজী ভাষা থেকে হিন্দিতে রূপান্তরিত। বোঝা গেল এই কচি কণ্ঠে বিশুদ্ধ হিন্দির জায়গা করে নেওয়ার পেছনের রহস্যটা কী? এবার সত্যি ভয় পেতে হল! বাংলা ভাষাটা অদূর ভবিষ্যতে বাংলা ভাষাতে থাকবে তো? যে ভাষার জন্য আমাদের এত প্রাণ, এত রক্তক্ষয় সেই প্রিয় ভাষাটি ধীরে ধীরে হিন্দি-ইংরেজি সংমিশ্রণে এক কিম্ভূতকিমাকার ভাষায় পরিণত হয়ে যাবে এটা ভাবতেই গা শিউরে উঠল। শুধু ভাবছিলাম, বুদ্ধদেব বসু যে অর্থে আধুনিক নগর সভ্যতাকে ‌`সভ্যতার চণ্ডলাবৃত্তি' বলে গাল দিয়েছিলেন, মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদের ভাষার বারোটা বাজানোর জন্য আমরা কি এই প্রক্রিয়াকে `মিডিয়ার চণ্ডলাবৃত্তি' বলতে পারি না? কার্টুনগুলো বাংলায় রূপান্তর করে আমাদের জাতীয় চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে সহজ বাংলায় শিশুদের পাতে তুলে দেওয়া হয়তো প্রাথমিক ভাবে খুব ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার, কিন্তু চেষ্টাটা করতে অসুবিধা কোথায়? বলার অপেক্ষা রাখে না যে এক্ষেত্রে সরকারের নীতিগত অবস্থান একটা অতি জরুরী বিষয়। যেসব টিভি চ্যানেলগুলো আমাদের নতুন প্রজন্মদের বাংলা ভাষা ও শিল্প-সংস্কৃতির পথে অন্তরায় সেসব চ্যানেলগুলোকে কি ঝেটিয়ে বিদায় করা যায় না? তাতে কিন্তু উপকার হত আমাদের নতুন প্রজন্মদের যারা তিল তিল করে তাদের ছোট্ট ধমণীতে লালন করছে তাদের প্রিয় ভাষা আর হাজার বছরের গর্বিত ঐতিহ্য।

জাতিগত কারণেই বাংলা ভাষার উপযুক্ত চাষবাষ এবং রক্ষণাবেক্ষণ-এর জন্য বাংলাদেশী বাঙালিদের একটা বাড়তি সুবিধা আছে। বাংলাদেশ একটা স্বাধীন দেশ আর সে দেশের মানুষের ভাষা হল বাংলা। কিন্তু সত্যিই কি আমাদের সবার ভাষা বাংলা? যদি তাই হয় তাহলে আমাদের আদিবাসীদের যে ভাষা আছে তার অস্তিত্বটা কোথায়? যে সাওতাল অথবা কোচ শিশুটি ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে সেই শিশুটি রক্তে তার নিজস্ব সংস্কৃতির শেকড়টি কতটুকুনই বা গাঁথতে পেরেছে! এক্ষেত্রে বাংলার পাশাপাশি অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির সব ভাষাকে জাতীয় ভাষার মর্যাদা দিয়ে এদের রক্ষণাবেক্ষণে সরকারী উদ্যোগ নেওয়াটা খুবই জরুরী। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জাতিগোষ্ঠির ভাষা একটি বিষয় হিসেবে রাখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ছাত্রদের বিষয় নির্বাচনে একটা স্বাধীনতা থাকতে পারে। ভারত বিভিন্ন ভাষাভাষীর দেশ বলেই হয়তো লোকসভার এক বক্তৃতায় নেহরু বলেছিলেন, 'There is no question of any one language being more a national language than the other; Bengali or Tamil or any other regional language is as much the Indian national language as Hindi'।

একটা রাষ্ট্রে বিভিন্ন ভাষা থাকতেই পারে। বাংলা আমাদের প্রধানতম ভাষা। কিন্তু বাংলার পাশাপাশি অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর ভাষার অস্তিত্বও এই ছোট্ট ভূখণ্ডে জায়গা করে নেওয়া উচিত। আমেরিকার প্রধান ভাষা ইংরেজি। কিন্তু ইংরেজির পাশাপাশি জনসংখ্যানুপাতে স্প্যানিশ, চাইনিজ, হিন্দি, ফরাসি ইত্যাদি সমানভাবেই আদৃত। কোনো আমেরিকান যদি মনে করেন তিনি ইংরেজি ভাষার পরিবর্তে স্প্যানিশ অথবা হিন্দি ভাষায় কথা বলে তাঁর জীবন কাটাবেন, তাতে কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। আমেরিকার যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করতে হলেও কোনো একটি বিদেশী ভাষার উপর অল্প-বিস্তর দখল থাকা চাই। আমাদের জাতীয় ভাষাগুলো সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। রাষ্ট্রের প্রতিটি সচেতন নাগরিক এই ভূখণ্ডের অন্যান্য ভাষাভাষীদের ভাষা নিয়েও সমানভাবে চিন্তা করবে, ভাববে এমনটাই কি স্বাভাবিক নয়?

শেষ কথা হল, বাংলা ভাষা কোনো রকম হুমকি ছাড়াই আমাদের নতুন প্রজন্মদের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াক এটাই আমাদের প্রাণের দাবি। আর সে কারণেই আমরা দৃঢ়ভাবে চাই যে আমাদের ভাষা মিডিয়ার ডাকাতদের কালো হাত থেকে রক্ষা পাক। আজ যে কারণে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে সেই দায় থেকেই দেশের অন্যান্য ভাষাভাষীদের মুখের ভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় নত হতে হবে। আর এই মহৎ কাজটি করার মানেই হল প্রকারান্তরে আমাদের ভাষা আর সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, ভালোবাসায় নত হওয়া।