নীরবতার শিল্পীর সঙ্গে কিছুক্ষণপার্থ প্রতীম মজুমদার-এর সাক্ষাৎকার

আশীষ চক্রবর্ত্তী
Published : 1 March 2008, 09:40 AM
Updated : 1 March 2008, 09:40 AM


ফ্রান্সে নেপোলিয়নের সমাধির সামনে মুকাভিনয়রত শিল্পী পার্থ প্রতীম মজুমদার

তখন ইন্টারভিউয়ে তাঁর মৃদু অনীহা। অনুরোধ এড়াতে বললেন, 'আমার শুধু মরার সময়টা হাতে আছে, তুমি ভাই তখন এসো।' তাঁকে হাসতে হাসতে


……
পার্থ প্রতীম মজুমদার
…….
বলতে হলো, 'তার আগেই আসতে চাই। ব্যস্ততায় স্বস্তি দিয়ে আপনাকে উদ্ধার করতে। কখন আসতে পারি?' অগত্যা ফোনালাপে সময় জেনে নেয়ার বিনীত অনুরোধ। বিনীতভাবেই তা রেখে, দু ঘাট ঘুরে তাঁকে নিয়েই অবশেষে পৌঁছালাম তার বন্ধু জানেসার ওসমানের বাসায়। সেখানেই সাড়ে তিন ঘণ্টায় মিনিট ত্রিশেকের কথাবার্তা। বাকি সময় কেটেছে সাড়ে তিন বছর পর দেশে আসা সুপরিচিত মুকাভিনেতার ব্যস্ততার সাক্ষী হয়ে। অতিথিসেবা, মুঠোফোনে হাই-হ্যালো, নিমন্ত্রণ গ্রহন-প্রত্যাখ্যানের ফাঁকে ফাঁকেই চলল পার্থ প্রতীম মজুমদারের কথা। শুরুতে ঝটপট প্রশ্ন করার তাগিদ দিয়েছিলেন। প্রশ্নকর্তার মনে তখন এক টিভি চ্যানেলে ক'দিন আগেই প্রচারিত টক শো'র অতি টক স্মৃতির উঁকি। সেখানে পার্থ প্রতীম মজুমদার ছিলেন প্রায় নীরব শ্রোতা আর সঞ্চালকসহ বাকিরা মুখর বক্তা। ১১ ফেব্রুয়ারির এই আলাপচারিতাকে উল্টো পথে চালানো হয়েছিল বলে-কয়েই…।

●●●

আশীষ চক্রবর্ত্তী : সে আমলে মুকাভিনয় তো এ দেশে অপ্রচলিত একটা শিল্প ছিল। এমন বিষয়ে কেন, কীভাবে এসেছিলেন তা একটু বলবেন?

পার্থ প্রতীম মজুমদার : আমি মুকাভিনয় শুরু করি চুয়াত্তর সালে। তখন এসব শেখা খুব কঠিন ছিল। আমি তখন গান গাই। মিউজিক কলেজে পড়ি। এর আগে ষাটের দশকে কলকাতায় গিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। থাকতাম ফরাসী কলোনি চন্দন নগরে। ওখানে যোগেশ দত্ত নামে একজন মুকাভিনয় চর্চা সবে শুরু করেছেন। এমনিতে উনি কমিক করতেন। ব্রিটেন থেকে এসে কে যেন তাকে বলেছে, বিবিসিতে তিনি দেখেছেন মার্সেল মার্সো নামে এক ভদ্রলোক 'মাইম' করেন। কথা না বলে, অঙ্গভঙ্গি, এক্সপ্রেশন দিয়ে দারুণ পারফর্ম করেন। তা শুনেই মুকাভিনয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েন তিনি। তো ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের কাছে উনি যে বাড়িতে থাকতেন সেখানে আমার এক আত্মীয়ও থাকতেন। সেইসূত্রে আমারও সেখানে যাতায়াত ছিল। ওপর তলায় দেবদুলাল (বন্দ্যোপাধ্যায়), নিচে উনি আর পাশে অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়।

আমারও ইচ্ছে হলো মুকাভিনয়টা একটু শিখি। কিন্ত ভদ্রলোক কিছুতেই শেখাবেন না, কারণ, এটা করে ভাত জোটে না। তারপরও অল্প কিছু শিখে দেশে ফিরলাম। এর মধ্যে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমি মিউজিক কলেজে ভর্তি হলাম।

আশীষ : মিউজিক কলেজে তো আপনি এর প্রতিষ্ঠাতা বারীণ মজুমদারকে পেয়েছিলেন। শিক্ষক-ছাত্রের বাইরে তাঁর সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা…?

পার্থ : আমার নাম ছিল প্রেমাংশু কুমার বিশ্বাস। ডাক নাম ভীম। বাবার নাম বাবার নাম হিমাংশু কুমার বিশ্বাস। বারীণ মজুমদার তাঁর দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। পাবনার জমিদার। মুক্তিযুদ্ধের সময় বারীণ মজুমদারের মেয়েটি হারিয়ে যায়। তখন তাঁর একমাত্র ছেলে পার্থসারথি খুব ছোট। দলছুটের বাপ্পা তো হয়েছে স্বাধীনতার পরে। ও আমাদেরই কোলে-পিঠে মানুষ। যা হোক, তখন মেয়ে-হারানো বারীণ মজুমদার আমার বাবাকে বলেন, 'তোমার তো চার ছেলে। একে আমায় দিয়ে দাও, আমি পেলেপুষে মানুষ করি।' তারপর থেকে আমি ওনার ২৮ নম্বর সেগুনবাগিচার বাসায় থাকতাম। তখন থেকেই আমি পার্থ প্রতীম মজুমদার। মিউজিক কলেজে পড়তাম আর কলেজের সব কর্মকাণ্ডে অংশ নিতাম। ১৯৭৬ পর্যন্ত সেখানে ছিলাম। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর যত ভাষণ তার আগে মিউজিক কলেজ আর উদিচী শিল্পী গোষ্ঠী গাইতো। আমি মিউজিক কলেজকে লিড করতাম। রেসকোর্স, পল্টন, ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, প্রেস ক্লাব–সব জায়গায় গাইতাম।

আশীষ : কী গাইতেন?

পার্থ : সব ধরনের গান গাইতাম। মান্না দে, কিশোর কুমার, ভূপেন হাজারিকার গান শুনে তাঁদের মতো শিল্পী হবার স্বপ্ন দেখতাম। রেডিয়োতে গানের প্রোগ্রাম করতাম। টিভিতেও মিউজিক কলেজের হয়ে প্রোগ্রাম করেছি। শেষ পর্যন্ত সঙ্গীত সাধনা অবশ্য ব্যাচেলর অব মিউজিক ডিগ্রির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।

আশীষ : এবার সঙ্গীতসাধক থেকে পেশাদার মুকাভিনেতা হতে পাবনার ছেলের প্যারিসে পাড়ি দেয়ার গল্পটা বলুন।

পার্থ : কোলকাতা থেকে ফেরার পর মিউজিক কলেজেই আমি মাইম প্র্যাকটিস করতাম। আমাদের ফ্ল্যাটের পাশে দোতলায় ইনডোর যে থিয়েটারটা ছিল সেখানে প্র্যাকটিস করতাম। মিউজিক কলেজ চলতো দুপুর দুটো পর্যন্ত। তারপর কলেজ ফাঁকা। তখনই প্যাকটিস করতাম। মিউজিক কলেজের টিচার বা বন্ধুবান্ধব আড্ডা মারতে এসে জানতে চাইতেন, কী এটা? তাদের বলতাম, এটা হচ্ছে মাইম মানে মুকাভিনয়, এ দিয়ে কথা না বলে, অঙ্গভঙ্গি, এক্সপ্রেশন দিয়ে মানুষের সুখ-দুঃখের অনুভূতি তুলে ধরা যায়। তখন তারা প্রশ্ন করতো, তাহলে কেন স্টেজে, টিভিতে করো না?

চুয়াত্তরে লালকুঠিতে একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেখানে ছোট্ট একটা পার্ট করেছিলাম। সেটা মানুষের খুব পছন্দ হয়েছিল। পচাত্তর ছিয়াত্তরের দিকে বেলাল বেগ বিটিভিতে শিক্ষাঙ্গন নামে একটা অনুষ্ঠান করতেন। রিয়াজ উদ্দিন বাদশা আর আলী ইমাম ছিলেন সেই অনুষ্ঠানের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। সেখানে মিউজিক কলেজ একটা অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেলো। আধ ঘন্টার অনুষ্ঠানের পনের মিনিট গান। আমিও গাইলাম। বাকি পনের মিনিট মুকাভিনয়। সেটা হিট হলো। আবার দৈনিক বাংলার হেদায়েত হোসেন মোর্শেদ করতেন রংধনু। সেখানে পারফর্ম করলাম, সেটাও জনপ্রিয় হলো। এর মধ্যে ফজলে লোহানী শুরু করলেন বিটিভির ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান যদি কিছু মনে না করেন। শুরুর আগে একদিন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, 'এর টাইটেলটা তুই কর।' বাচ্চু ভাইয়ের জন্য এমন জনপ্রিয় একটা অনুষ্ঠানের টাইটেল করার সুযোগ পেলাম। পরে সমাজ জীবনের নানা ঘটনা নিয়ে একটা সেগমেন্ট করার সুযোগ পেতাম। কাজটা বেশ মজার ছিল। স্টেডিয়ামে তখন প্রায়ই ফুটবল ম্যাচ নিয়ে মারামারি হতো। তা নিয়ে অনুষ্ঠান করেছি। আবার পানিসঙ্কট নিয়ে করেছি। ধরুন এক লোক গোসল করতে ঢুকেছেন। গায়ে সাবান মেখেছেন। তারপর শাওয়ার ছেড়ে দেখলেন পানি নেই। সেই বিড়ম্বনা ফুটিয়ে তুলতাম মুকাভিনয়ে। এছাড়া বাসযাত্রীর বিড়ম্বনা,পরীক্ষায় নকল, ঘুড়ি ওড়ানোসহ অনেক বিষয় নিয়েই যদি কিছু মনে না করেন অনুষ্ঠানে পারফর্ম করেছি। এরপর আপনপ্রিয়, বলাবাহুল্য ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানেও কাজ করেছি। এভাবে বিটিভির বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমার বেশ জনপ্রিয়তা হলো। আমাকে নিয়ে লেখালেখিও শুরু হলো পত্রপত্রিকায়। টিএসসিতে ছাত্রদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বঙ্গভবনের অনুষ্ঠানেও আমার কাজ করার সুযোগ হলো। মনে পড়ে, উদিচী আমাকে বরগুনা নিয়ে গিয়েছিল। ব্যান্ড বাজিয়ে আমাকে লঞ্চ থেকে নামানো হয়েছিল। শিল্পকলার তরফ থেকে যশোর, ঝিনাইদহে নিয়ে গিয়েছিল।

তখন আমি মাঝে মাঝে কলকাতায় যোগেশ দত্তর ইনস্টিটিউটে যাই। নিজে শিখি, শেখাইও। সব মিলিয়ে আমি তখন ভীষণ ব্যস্ত। হঠাৎ একদিন আলিয়াস ফ্রসেজ থেকে ডেকে পাঠালো। সেখানকার কালচারাল সেন্টারের

…..
১৯৮১ সালে মুকাভিনেতা যোগেশ দত্তের সঙ্গে
…..
ডিরেক্টরের মাধ্যমে ডেকে নিয়ে ফরাসী রাষ্ট্রদূত বললেন, এখানে তুমি ওয়ার্কশপ করো,অনুষ্ঠান করো। টানা তিনটে অনুষ্ঠান করলাম সেখানে। রাষ্ট্রদূত মাঝে মাঝে তার বাড়িতে ডেকে নিতেন। একদিন বললেন, তুমি যে পর্যায়ের শিল্পী তাতে তুমি কিন্তু স্কলারশিপ নিয়ে প্যারিসে যেতে পারো। যেতে চাও? শুধু তোমাদের সরকারের কাছ থেকে একটা 'নো অবজেকশন সার্টিফিকেট' আনো যাতে বলা হবে তোমাকে প্যারিসে নিলে তাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। শুনে মনে হয়েছিল কাজটা খুব সহজ হবে, আসলে কিন্তু সেটা ছিল আমার জীবনের কঠিনতম কাজ।

আশীষ : কেন?

পার্থ : ফ্রেঞ্চ অ্যাম্বাসেডরের কথামতো আমি সরকারের এনওসি পাওয়ার আশায় খুব তাড়াতাড়ি কাগজপত্র জমা দিলাম সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে। তখন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ছিল পাবলিক লাইব্রেরিতে। কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর এক বছর হয়ে গেলেও সেখানে কোনো তৎপরতা দেখা গেল না। পরে অনেক বলে-কয়ে এইটুকু লাভ হলো–ফাইল পাঠানো হলো এক্সটার্নেল মিনিস্ট্রিতে। সেখান থেকে ফাইল একেবারে গায়েব। আবার ডুপ্লিকেট কপিগুলো দিয়ে নতুন করে ফাইল জমা দিলাম। তারপরও খবর নেই। এভাবে আড়াই বছর কেটে গেল। আমি হতাশ, ফ্রেঞ্চ অ্যাম্বাসেডর বললেন, আমি বদলি হয়ে গেলে তুমি আর যেতে পারবে না। একদিন নাট্যব্যক্তিত্ব আতাউর রহমানকে মোটর সাইকেলের পেছনে বসিয়ে এক্সটারন্যাল মিনিস্ট্রিতে তাঁর এক আত্মীয় ছিলেন তার বাসায় গেলাম। খোঁজখবর নিয়ে উনি জানালেন, যার কাছে ছিল উনি ড্রয়ারে সেই ফাইল তালা মেরে রেখে স্কলারশিপ নিয়ে চলে গেছেন বিদেশে। নিজেকে তখন খুব দুর্ভাগা মনে হয়েছিল। নিজের তো মিনিস্ট্রিতে কোনো লোক নেই, বারীণ মজুমদারও এমন লোক ছিলেন না যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমার জন্য সুপারিশ করবেন। আমাদের দেশে অনেক বড় বড় প্রতিভা নষ্ট হয়ে যায় স্রেফ তদ্বিরের লোক নেই বলে। শেষ বিচারে আমাকে অবশ্য ভাগ্যবানই বলতে হবে, কেননা, শত প্রতিকূলতার পরও আমি তো আটকাই নি।


প্যারিসে নিজের বাড়িতে (২০০৪)।

আশীষ : বাংলাদেশে মুকাভিনয়ের কথা উঠলে শুধু আপনার নামটাই উঠে আসে। কেন? এতদিনেও তেমন কেউ আর উঠে এলো না কেন?

পার্থ: আগে এখানে টিভি চ্যানেল ছিল একটা, এখন হয়েছে এগারোটা, আগামীতে হয়তো ২০টা হবে। সেই অনুপাতে কিন্তু শিল্পী তৈরি হচ্ছে না। মাইমের ক্ষেত্রে সমস্যা হলো, এটা খুব শারীরিক সক্ষমতা দাবি করে। শরীরে শক্তি থাকতে হয়। মেধা আর আগ্রহ থাকতে হয়। আমি যে খুব মেধাবী তা বলবো না। তবে আমি ঘষটেছি। ঘষটে ঘষটে ঘষটে ঘষটে একটা পর্যায়ে এসেছি। কোনোদিন ফাঁকি দেইনি। প্রচুর খেটেছি। আমাদের একটা স্টেপ বা একটা মুভমেন্ট দেখিয়ে টিচার বসে থাকতেন, কিংবা অন্য কাজে যেতেন। দু ঘণ্টা পর এসে দেখতেন আমরা কতটা উন্নতি করলাম। এখানে আমি যখন ৩/৪ ঘন্টার ক্লাস নেই আমাকে কিন্তু একটানা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, একই কথা একশবার বলতে হয়। একই জিনিস একশবার শেখানোর অর্থ হলো, যাদেরকে শেখাই দে আর নট ট্যালেন্টেড। অথচ তারা সবকিছুর মাঝে আছে। মুকাভিনয় যে কত বড় আর্ট, এটা যে বড় একটা প্ল্যাটফর্ম সে সম্পর্কে ধারণাই নেই তাদের। এ অবস্থায় তারা শিখবে কী?

আমরা আসলে খাটতে চাই না। ৭৪ থেকে ৮১ পর্যন্ত আমি এখানে ছিলাম। প্রতিদিন প্র্যাকটিস করতাম। কোনো জায়গায় পারফর্ম করার আগে প্রচুর খাটতাম। সারাটা দিন কাটাতাম স্টেজ-এর পেছনে। লাইটিং কে করল, মিউজিক কী হবে এসব নিয়ে ভাবতাম। মিউজিক এখানে পাচ্ছি না তো সংগ্রহ করতে চলে যেতাম কোলকাতা। এখন তো সারা পৃথিবীর সব ধরনের মিউজিকই এখানে পাওয়া যায়।

আমি চলে যাওয়ার পর আমি যা যা করতাম সেগুলো একটু মেক আপ নিয়ে কেউ কেউ করে দেখিয়ে ভাব ধরতো যেন পার্থ প্রতীম মজুমদার। কিন্তু শেখার চেষ্টা করেনি। সাধনা করেনি। তারা মাইম করত, নাটক করত, কবিতা আবৃত্তি করত…। এভাবে সব কাজ একসাথে তো হয়ই না, আমার মনে হয় কোনোটাই ভালোভাবে হয় না। তাই মাইমে আসার পর আমি গান ছেড়ে দিয়েছিলাম। সেই থেকে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের অনুরোধে ঘরোয়াভাবে কখনো কখনো গাই, কিন্তু পাবলিকলি একেবারেই না। গান আর সেভাবে গাই না, কারণ, গানের জন্য অত সময় তো আমি দিচ্ছি না। গানটাকে আমি নিজের জন্য রেখেছি। শখের বশে রাখা। সিরিয়াসলি শুধু মাইমই চর্চা করছি। সেজন্য আমাকে স্টিক ফাইটিং, প্যান্টোমাইম, করপোরাল মাইম–কত কী শিখতে হয়েছে! এর বাইরে ব্যালে ড্যান্স, মডার্ন ড্যান্সও শিখতে হয়েছে। প্রচণ্ড পরিশ্রম করতাম। মাটির চারতলা নিচে সকাল সাড়ে আটটায় ঢুকতাম, রাত আটটা পর্যন্ত চলত ক্লাস। দুপুরে এক ঘণ্টা লাঞ্চ ব্রেক। মার্সোর সঙ্গে ট্যুর থাকলে রাত আটটার পর আবার তার সঙ্গে প্র্যাকটিস করতে হতো রাত ১২ টা অব্দি। আজ পার্থ যেটুকু হয়েছে তা পরিশ্রম করে, বিদেশী ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। কেউ ফাঁকি দিলে সফল হতে পারবে না, এটাই তো স্বাভাবিক।

আশীষ : কিন্তু মুকাভিনয়ের চর্চাও তো নেই। আপনার কিছু অনুসারী থাকার কথা, এই শিল্পের কিছুটা প্রসার হওয়ার কথা–তা কি হয়েছে?

পার্থ : এখানে আমি যেহেতু থাকি না, আপনি বলবেন, আমার কিছু দায়িত্ব ছিল। এবার আমি বলি, ওখানে যারা মার্সোর স্কুলে চান্স পেতো তাদেরকে তাদের সরকার তিন কি ছয় মাস পরেই ফেরত নিয়ে যেতো নিজের দেশে কাজে লাগাতে। মার্সোর স্কুলে চান্স পাওয়াটাই ছিল একটা ক্যাপিটাল। ধরে নেয়া হতো হি ইজ কোয়ালিফায়েড। আমাকে এত বছরেও কিন্তু সরকার সে রকম কোনো অফার দেয়নি। আমি যে দুতিন বছর পর পর এসে পারফর্ম করি সেটা আমার নিজের কানেকশনে, নিজের চেষ্টায়।

এই যে আমি একমাস ধরে দেশে আছি, কই শিল্পকলা অ্যাকাডেমি তো আমার খোঁজই নেয় নি। মিডিয়া আমার সঙ্গে কথা বলছে, সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। গ্রুপ থিয়েটার আমাকে দিয়ে সন্ধ্যা থেকে রাত নটা-দশটা পর্যন্ত ক্লাস করাচ্ছে। আবার মডেলিং অ্যাসোসিয়েশন দেশব্যাপী প্রচার চালিয়ে ১৫-২০ জন ছেলেমেয়েকে নিয়ে দশদিন ক্লাস করালো। শিল্পকলা অ্যাকাডেমি বা কালচারাল মিনিস্ট্রিও তো ডেকে বলতে পারে, পার্থ, আপনাকে যদি আমাদের শিল্পীদের নিয়ে প্রতি বছর একটা করে ওয়ার্কশপ করতে বলি বা এখানে যদি একটা প্রোডাকশন করতে বলি, সেটা কীভাবে সম্ভব? আপনি বলবেন, আমার দেশ আমি কেন করছি না। আমি যখন এখান থেকে প্যারিস যাই তখন একা ছিলাম। এখন আমার এক ছেলে এক মেয়ে। ওরা এখনো হাই স্কুল ডিঙ্গোয়নি। তাই ওখানে আমার বিশাল খরচ। ওই দেশে সারভাইভ করা কঠিন। প্রতি রাতে তো আর শো থাকে না, তাই আমার ফিল্মে কাজ করতে হয়, মডেলিংয়ের কাজ করতে হয়, টিভির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাতের শ্যাডো, ভয়েস–এগুলো দিতে হয়। আমাকে বাঁচতে হয় ওখানে।

আশীষ : চুয়াত্তরে শুরু করেছিলেন। সেই হিসেবে মুকাভিনয়ে আপনার তেত্রিশ বছর কেটে গেল। আপনি কি তৃপ্ত?

পার্থ : নিজেকে বড় কিছু মনে করি না। তবে বিশ্বপর্যায়ে কাজ করতে পেরেছি, মুকাভিনয়ে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মার্সেলো মার্সোর সঙ্গে কাজ করতে পেরেছি আর তার গ্র"পের সঙ্গে কাজ করার সূত্রে অনেক জায়গায় যেতে পেরেছি বলে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। মার্সোর সঙ্গে যে পিতা-পুত্রের মতো সম্পর্ক ছিল সে কথা ভাবলে নিজেকে ধন্য মনে হয়। মুকাভিনয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। 'মাস্টার অব মাইম' অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি সাউথ ইস্ট এশিয়ার একমাত্র মাইম ইনস্টিটিউট থেকে। মালয়েশিয়ার মিডিয়া আমাকে দিয়েছে 'মাস্টার অব দ্য ওয়ার্ল্ড'। ইংল্যান্ডে 'মিলেনিয়াম অ্যাওয়ার্ড' পেয়েছি। 'ফোবানা অ্যাওয়ার্ড ' পেয়েছি ২০০০ সালে। ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে আমার বিরাট শো হয়েছিল। নাইনটি ওয়ানে বাংলাদেশের দুর্গতদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে ফ্রান্সের যেসব শহরে শো করতে গিয়েছি সেখানকার মেয়ররা আমাকে পুরষ্কৃত করেছেন। তবে বাংলাদেশের কোনো সরকারই আমাকে কোনো স্বীকৃতি দেয়নি। একুশে পদকের জন্য তিনবার সিলেকশন কমিটি আমার নাম পাঠিয়েছে। কিন্তু প্রাইম মিনিস্টার তাতে সই করেন নি। এটা আমার জন্য, আমার শিল্পের জন্য দুর্ভাগ্য। আমাদের দেশে তেল মারতে হয়। মানুষের তেল আছে তেল মারতে পারে, টেবিলের সামনে গিয়ে বসে থাকতে পারে। আমি ভাই পরিশ্রম করে নিজেকে দাঁড় করিয়েছি। আমার সময় নেই কাউকে তেল মারার। ইচ্ছাও নেই।

মার্সো বলে গেছেন–'পার্থ ইজ দ্য ব্রিজ অব কম্যুনিকেশন বিটুইন ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট।' এর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে? মার্সোর ওপরে তো আর কেউ কথা বলতে পারে না। আমি ওইটুকু যে পেয়েছি তাতেই খুশি।

আরেকটা ব্যাপার। বাংলাদেশ সবসময় সম্মানিত করে তাদের, যারা মৃত। মৃত মানেই কিন্তু শহীদ নয়। মৃত মানেই মহান নয়। অবশ্যই মৃৃত ব্যক্তিদের আমরা শ্রদ্ধা করবো, তাদের গুণগুলো নেবো, খারাপগুলো ভুলে যাবো। তার মানে তো এই না যে, মৃত হলেই একটা মানুষ অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার যোগ্য হবে। যখন মানুষের ক্ষমতা থাকে, তখন সম্মানিত করলে সে আরো কিছু দিতে পারে। ইনস্পিরেশন হয়। আমি অবশ্য সেটা পাওয়ার আশা করি না আর তা পাওয়ার জন্য কাজও করি না। আমার যেদিন ক্ষমতা হবে নিজের পয়সায় স্কুল করে এ দেশের ছেলেমেয়েদের শিখিয়ে যাবো যাতে আমি মরে যাবার পরও মাইম শিল্প বেঁচে থাকে।

২. শেষের পরের শেষ
মুঠোফোনের উৎপাত আর পার্থ প্রতীম মজুমদারের সুহৃদদের আগমন আলাপচারিতায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছে বেশ কয়েকবার। তাতে একটা সুবিধেও হয়েছে। পরিকল্পনার বাইরের কিছু প্রশ্ন ঢুকে পড়েছে, আবার কাক্সিক্ষত কথার ভিড়ে অনেক সময়ই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে এসে পড়েছে জানতে না-চাওয়া অথচ আবেগ ছুঁয়ে যাওয়া নানা কথা। পার্থ প্রতীম বলেছেন তার শৈশবের কথা; পালা-পার্বণে, চৈত্রসংক্রান্তির গাজনের মেলায়, দাদু বাড়ির কোণে কোণে ফেলে আসা অতীতের কথা। বাড়িতে মায়ের শাড়ি খাটে জড়িয়ে মঞ্চ, সেই মঞ্চে স্ব-রচিত নাটকের স্ব-অভিনীত মঞ্চায়ন। সিনেমা হলে গিয়ে অপারেটরের টুলে বসে ঘুলঘুলি দিয়ে ছবি দেখা। এসব দূরের স্মৃতি ফিরে এসে পার্থ প্রতীমের সমস্ত অবয়বে ছড়ায় মুগ্ধতা। দেশ নিয়েও তাঁর একই অনুভূতি। '৯৮-র ফুটবল বিশ্বকাপের সময় মুখে রং মেখে ছোট্ট ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গ্যালারিতে বাংলাদেশের পতাকা হাতে নাচানাচি, বাপ-ছেলের কাণ্ড দেখে ভারতীয়দের টিটকিরি, তার জবাব–সবই সগর্বে বলে যান। কিন্তু প্রসঙ্গান্তরে বিষণ্নতা, অসম্মানবোধ আর সেই সঙ্গে এক ধরনের ক্ষোভও কাতর করে তাঁকে। সেরকমই এক মুহূর্তে বলছিলেন, 'ইদানীং বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর অ্যাম্বাসেডরদের ভাবসাব দেখে দুঃখ লাগে। মনে হয় আমরা দূরে থাকলেই বোধহয় তারা খুশি হন। তাদের অনেককেই আমরা সেকেন্ড সেক্রেটারি বা থার্ড সেক্রেটারি হিসেবে দেখেছি। এখন অ্যাম্বাসেডর হয়ে তারা আমাকে বলেন, 'আপনারা দেশে যান না, আপনাদের দেশপ্রেম নেই।'

….
মুকাভিনেতা মার্সেলো মার্সোর সঙ্গে
……
ভাবি, তারাও তো সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ান, তাদের কি দেশপ্রেম নেই? কিছুদিন আগে এক অ্যাম্বাসেডর আমাকে ডেকে বললেন, নর্থ অব ফ্রান্সে নাকি বাংলাদেশের এক্সপোর্ট একজিভিশন না কী একটা মেলা হবে, সেখানে প্যান্ডেলটা নাকি বিনে পয়সায় ওখানকার মেয়র দিয়েছেন, সেখানে আমাকে মাইম করতে হবে। আমি বললাম, আমার প্রোগ্রামের জন্য তো একটা স্টেজ লাগে, লাইট লাগে, মিউজিক লাগে–এসব ছাড়া শো করি কীভাবে? ভদ্রলোক বলে উঠলেন, 'আপনার কোনো দেশপ্রেম নেই?' এই হচ্ছে তার ভাষা। উনি যখন সেকেন্ড সেক্রেটারি ছিলেন তখন আমাকে ডাকতেন 'পার্থদা', এখন অ্যাম্বাসেডর হয়ে ডাকেন, 'পার্থ'। আমি যদি উপযুক্ত জবাব দিয়ে আসতাম, তাহলে সরকারকে জানাতেন, পার্থ প্রতীম মজুমদার এত বড় মাইম আর্টিস্ট হয়ে গেছে যে আমাকে অপমান করে চলে গেল। বাইরে সম্মান পেলেও দেশের কোনো কোনো মানুষের কাছে আমি এ আচরণ পাই।"

বাংলাদেশে মুকাভিনয়ের সম্ভাবনা শেষ কিনা জানতে চাওয়ায় হঠাৎ অসহিষ্ণু হয়ে পার্থ প্রতীম মজুমদার বলে ওঠেন, "সম্ভাবনা কোনোদিন মরে না, মরবেও না। তবে আমি মরে যাবো। এই 'সম্ভাবনা মরে গেল' কথাটা শুনতে খুব খারাপ লাগে। আপনারা কী করেছেন এখানে? এক পার্থ প্রতীম মজুমদার প্যারিসে থাকে, তাকে ধমকায় অ্যাম্বাসেডর–আপনারা দেশপ্রেমবিহীন, আপনারা প্যারিসে থাকেন! আরে, প্যারিসে থাকি পেটের তাগিদে।"

—-
ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts