ভাষার সফর, পৃথিবীর সীমানা

alfred_khokon
Published : 7 March 2008, 06:21 PM
Updated : 7 March 2008, 06:21 PM


ভুবনেশ্বরের উদয়গিরি মন্দির


ডান থেকে আলফ্রেড খোকন, মন্দাক্রান্তা সেন, শুভ্রাংশু পনডে, অংশুমান কর, সেবন্তী ঘোষ ও শামীম রেজা; পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা ও বাংলাদেশের কবি

ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের রাজধানী ভুবনেশ্বরে অনুষ্ঠিত সর্বপ্রথম তরুণ কবিদের সার্ক কবিতা উৎসব ২০০৮-এ বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেই ২১ ফেব্রুয়ারি। এই প্রথমবার মাতৃভূমি থেকে বাইরে একটি একুশ সত্যিই আমাকে বাস্তবের নিরিখে টের পাইয়ে দিল বাহান্নর ভাষা আন্দোলন। নানান ভাষার কবিরা এসেছিলেন। তাদের অনেকেই মাতৃভাষার বাইরে অন্যভাষায় পারদর্শী নন। ফলে ভাষার ব্যবহারের চেয়ে আকার ইঙ্গিতের ভাষাই আমাদের মনোভাব প্রকাশে ভূমিকা রাখছিল বেশি। 'আমার ভাষার সীমানা হচ্ছে আমার পৃথিবীর সীমানা'–এখানে এসে ভাষার দার্শনিক অস্ট্রিয়ার লুডবিগ হ্বিট গেনস্টাইনের এই কথটি চোখের সামনেই প্রমাণিত হল।

ঢাকা থেকে কলকাতা হয়ে ভুবনেশ্বরে যখন পৌঁছুই তখন ২১ ফেব্রুয়ারির রাত ন'টা বাজে। আমার থাকার জায়গা উড়িষ্যায় নিখিল ভারতের আকাশবাণী ও দূরদর্শন আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের হোস্টেল। হোস্টেলের সামনে এসে প্রথমে খানিকটা বিভ্রান্ত হলাম, পরে হোস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নেপালের কবি মানু মঞ্জিল, অনুবাদক ও গদ্যকার কুমুদ অধিকারীর আন্দাজ আমাকে হোস্টেলের অভ্যর্থনা কক্ষ পর্যন্ত পৌঁছে দিল। কিছুক্ষণ যেতেই অভ্যর্থনাকারী কৈলাস-কে খুঁজে পেতে কৈলাশ পর্যন্ত যেতে হবে ভেবেছিলাম, কিন্তু শেষাবধি আধঘণ্টা পরে তার কল্যাণে হোস্টেলের ১৭ নম্বর কক্ষে আমার অস্থায়ী উড়িষ্যা-আবাসের ব্যবস্থা হল। ১৭ নম্বর কক্ষে ঢুকেই উড়িষ্যার অন্ধকার ও বেশকিছু বুভুক্ষ মশার সম্ভাষণ আমাকে উৎসাহী করে তুলল। বাতাসে ভেসে আসা একধরনের ম্লান গন্ধে আটজাতির সৌহার্দ্যর কথা বিস্মৃত হতে পারলাম না–এসবই উপঢৌকন হয়তো। অভ্যর্থনাকারী তরুণ কৈলাস-এর আনমনা ভাবটা আমার বেশ লাগল। তবুও সে আমাকে দক্ষিণের খোলা একটা বারান্দা উপহার দিতে কার্পণ্য করল না। ঘুমিয়ে পরার আগে নিজেকে একটু বিদেশী বিদেশী মনে হলেও ঘুম আমাকে স্বদেশী করে তুলল।

পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি। নিখিল ভারতের আকাশবাণী ও দূরদর্শন আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সামনে একটি বাস অপেক্ষা করছিল। স্থানীয় একটি হোটেলে ভুবনেশ্বরের গভর্নর কর্তৃক রাষ্ট্রীয় এ অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনে আগত কবিদের বয়ে নিয়ে যাবে হোটেল কক্ষে। আমরা যথারীতি বাসে উঠে যথাস্থানে (!) পৌঁছলাম।


ভুবনেশ্বরে কবিতা উৎসবের উদ্বোধন করছেন উড়িষ্যার গভর্নর চন্দ্রকান্ত বন্দেরে

আনুষ্ঠানিকতা শুরু হল। বক্তৃতা ও কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে তা শেষ হল। মাঝখানে ঘাড় বাঁকা করে প্রতিবাদ জানাল কলকাতার কবি ও ঔপন্যাসিক মন্দাক্রান্ত সেন। মঞ্চে উঠে সে তার স্বভাবজাত প্রতিবাদের স্বরে নানাবিধ অসঙ্গতি ও অসৌজন্যমূলক ব্যবহার নির্দেশ করে তীব্র প্রতিবাদ জানাল। রাষ্ট্রীয় মর্যাদার এই অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের ক্ষেত্রে কোলের-পিঠের আচরণ, কিছুটা দীনহীন ব্যবস্থার প্রতি সরবে নিন্দা জানাল। অবশ্য পাকিস্তানী কবিবন্ধুদের জন্য তারা বিশেষ ব্যবস্থা করেছিল। বাইরে এসে আয়োজকদের সাথে সাধারণ আলাপের ফাঁকে আমি জানিয়ে দিলাম যে, পাকিস্তানের সাথে ভারতের স্পর্শকাতর সম্পর্কটা এখানে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।


নেপালের তিন কবির সাথে লেখক

অনুষ্ঠানের উদ্বোধন শেষে একটি প্রশ্ন ক্রমশ আমার মনে প্রশ্নকর্তা হতে চাইছিল। এ ধরনের অনুষ্ঠানে কারা নিমন্ত্রণ পান, নিমন্ত্রণ পাওয়ার যোগ্যতা কী? একটি দেশের প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে সমস্ত রকমের দুর্বলতা ভুলে দেশ ও জাতির মানসম্মানের বিষয়টি যদি প্রধান না হয়, তবে তো কেমন হয়! কারণ আমার জানাশোনার মধ্যে উপস্থিতির তালিকায় বিভিন্ন দেশেরই উল্লেখযোগ্য তরুণ কবিদের কম উপস্থিতি ছিল। এবং অবস্থাদৃষ্টে এটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না যে, উপস্থিতির এ তালিকা অস্বাভাবিক। ফলে বেশ ক'জন গুরুত্বপূর্ণ তরুণ কবির ঠোঁেটই এ প্রশ্নটা ভিড় করছিল। যেমন করছিল আমারও। যেমন আমার দেশ থেকে একজন কবির উপস্থিতি আমাকে এতটা বিস্মিত করেছিল যে, আমার সমকাল কিংবা সমসাময়িকতা নিয়ে আমারই প্রশ্ন জাগল। আমার সময়ে একজন গুরুত্বপূর্ণ তরুণ কবির নাম আমি জানব না, এটা কী করে হয়! আন্তর্জাতিক বা সার্কভুক্ত দেশগুলির

……
উদয়গিরি মন্দিরে এক চিরকুমার ভক্ত
……
মাননীয় নির্বাচক মণ্ডলীকে একটা অনুরোধ রাখতে চাই, নিজ দেশের প্রতিনিধি নির্বাচন অন্তত সততার সাথে করুন। নইলে দেশের মানহানি হয়। এই উৎসবে মি: পাটনায়েককে যখন প্রতিনিধিদের মান নিয়ে আমি প্রশ্ন তুলেছিলাম তখন তার সাফ জবাব, 'আমি তোমার দেশে আহ্বান করেছি, কে আসবে আর কে আসবে না এটা তাদের নির্বাচন। আমি কী করে জানব যে কার মান কী?' আমি তাকে আর কিছু বলতে পারিনি।

যাই হোক 'সাইট সিইং' মানে উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শনে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল উদয়গিরি। সেখানকার পরিদর্শনে আমার সবচেয়ে যে দৃশ্যটি মনে গেঁথে রইল তা মণিপুরী এক তরুণ কবির কাঁধে বানর নাচ। নিজেকে অনেকটা বানর-নাচ দৃশ্যের দর্শক ভেবে মজাও পেলাম। ইতোমধ্যে আরও কয়েকজন কবি এসে পৌঁছলেন। বিলম্বে আসা কবিদের মধ্যে বাংলাদেশের শামীম রেজাও ছিলেন।

সন্ধ্যায় কবিতা পাঠের আসর। ক্ষোভে উদভ্রান্ত ভুবনেশ্বরের তরুণ কবি শুভ্রাংশ পনডের মোটর বাইকে চড়ে আমি রওনা হলাম ভুবনেশ্বর বইমেলায়। পথে অনতি দূরের একটি রেস্তরাঁর বাইরে তখন প্রতীক্ষা করছিল তরুণ কবির প্রেমিকা রিনা। রিনার সাথে পরিচয়ের পরে জানতে পারলাম আগামী মাসে তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে একজন সেকেন্ড লেফটেন্যান্টের সঙ্গে। রিনা সেই সেনা সদস্যর ছবিও তার ব্যক্তিগত পার্স থেকে বের করে দেখাল। এই তরুণ-তরুণীর প্রেমময় চোখের দিকে চেয়ে যদিও আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না মধ্যকার এই একটি মাত্র পাসপোর্ট সাইজের ছবি তাদের এক দীর্ঘ ইতিহাসের যবনিকা পতন ঘটাবে। মেয়েটি আমাকে নিশ্চিত করে বলল, অবশ্যই তারা প্রেমিক-প্রেমিকা। কিন্তু ওই সেনাসদস্যের সাথে তার বিয়ে হচ্ছে এটাও সত্যি। শুভ্রাংশুও সে কথা আমাকে নিশ্চিত করল। তখন আমার মনে পড়ল এমন এক বাস্তবতা যেখানে আমার দেশেও একজন তরুণীর প্রথম নিয়তি এমনই। যদিও কয়েক বছর আগে ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার ছিল মধ্যবিত্তের ফার্স্ট চয়েস। এখন আবার পছন্দ বদলাচ্ছে।

২৩ ফেব্রুয়ারি ভোর জাগল। ওইদিন কোর্নাক মন্দির দেখে পুরীতে হবে কবিতার তৃতীয় আয়োজন অথবা কবিতাপাঠ। এই ধরনের আসরে কবিতা পাঠের জন্য কিছু হাততালিময় কবিতা লিখতে হয়। স্বভাবতই সে রকম কবিতা আমার ছিল না বলে নিজে নিজেই কষ্ট পেলাম! সকালে বাসের জন্য মূল সড়কে আমরা পায়ে হেঁটে পৌঁছলাম। বাসের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত কবি সেবন্তী ঘোষ ও অংশুমান কর এবং কৃত্তিবাস-আনন্দ পুরস্কার বিজয়ী কবি ও ঔপন্যাসিক মন্দক্রান্তা সেনসহ পাকিস্তানী তিন কবি ও আফগানিস্তানের দুই তরুণতম কবি, যাদের কণ্ঠে কবিতার চেয়ে 'মহব্বত' আর 'বহুত আচ্চা' শব্দদ্বয়ই আমার বেশ লাগল। তো বাসের কাছে আসতেই প্রায় দুই দিন পর এই প্রথম মন্দাক্রান্তা সেন হাত বাড়িয়ে করমর্দন করল আমার এবং বলল, 'হেই কবি আলফ্রেড খোকন, আমি মন্দাক্রান্তা সেন। আপনার চে'র টি শার্টটি দারুণ সুন্দর।' দেশের কেউ এভাবে বললে আমার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলতাম, 'খুলে দেব?' আমি বললাম, 'হ্যা মন্দাক্রান্ত, আপনার কিছু কবিতা পড়েছি।' ও বলল, 'মন্দাক্রান্ত নয়, মন্দাক্রান্তা।' তবুও তার কবিতা পড়েছি, পাঠকের কাছে কবির এই উপঢৌকনে মন্দা তার সারল্যভর্তি হাসি দিয়ে আমাকে সম্ভাষণ জানাল। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা সেবন্তী ঘোষ জানাল, 'নমস্কার।' অংশুমান কর বলল, 'আমি অংশুমান।' পরক্ষণেই সেবন্তী বলল, 'আপনি বাংলাদেশ থেকে এয়েচেন, ওখানকার কবি…কে (নাম উলে¬খ করতে চাই না) চিনেন?' আমি বললাম, 'উনি তো প্রধানত একজন ভাল ব্যবসায়ী।' আমি আবার বললাম, 'তোমাদের ওখানকার শঙ্খ ঘোষকে চেন?' সেবন্তী ঘোষ তখন বলল, 'না, মানে ও আমার বন্ধু। আমি কবি হিসেবে বলিনি।'

বাসে উঠে আমরা কোনার্কের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পথের মধ্যে হঠাৎ কে বা কাহারা হিন্দি গান ছেড়ে দিল। সকালের নাস্তার জন্য পথের মধ্যে একটা বাসস্ট্যান্ডে বাস থামাল আমাদের তরুণ সমন্বয়ক পুরীর অধিবাসী গদাধর। শুভ্রাংশুকে নিয়ে আমি উড়িষ্যার সবচেয়ে জনপ্রিয় গান ও ভিখারি বলে'র ভজন কিনলাম। বাসে উঠে সবাইকে বলা হল, উড়িষ্যায় হিন্দি নয়, উড়িয়া গান বাজবে। তাই হল। আমরা দুপুরের আগেই কোনার্কের মন্দিরের সামনে নেমে পড়লাম।


কোনার্ক মন্দিরের সামনে

বহুযুগ আগের ভাস্করদের দ্বারা নির্মিত কোনার্ক মন্দির অনেক আগেই পৃথিবীখ্যাত হয়ে আছে। এই মন্দিরের (!) দিকে তাকালে, সে সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক-দার্শনিক কিংবা মানুষের যৌনজীবনের নানান পৃষ্ঠা সহজেই পাঠ করা যাবে। কোনার্ক মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী দর্শকদের চোখে চোখ রাখলে একটু অভিনেনিবেশী সময়পাঠক খুব সহজেই বুঝতে পারবেন যে, তাদের প্রত্যেকের জীবনেরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে এই মন্দির। যৌন সম্ভোগের হাজার আয়োজনে আন্দোলিত হবে দেহ ও মনের বসন্ত। এই মন্দিরের গায়ে সেইসব নাম না জানা শিল্পীরা চিরকালীন বসন্ত বর্ণনা করে গেছেন যা আজও এই তথাকথিত সভ্য মানুষের কাছে বিস্ময়ের ঘোর এনে দেবে। ভাবতে হবে, ভাবিয়ে ছাড়বে। এখানে এসে কেউ খুঁজছেন পড়ন্ত ইতিহাস, কেউ খুঁজছেন অবাক বিস্ময়, কেউ খুঁজছেন তার অপ্রাপ্তির গাঢ় কারণ, কেউ খুঁজছেন নন্দনতত্ত্ব, কেউ খুঁজছেন ধর্মতত্ত্ব, কেউ খুঁজছেন পাওয়া, কেউ না পাওয়া। কেউ খুঁজছেন, কেউ ভিজছেন বৃষ্টিছাড়াই! খুঁজতে খুঁজতে দুপুর গড়াবে। দেশ-বিদেশের নানান ভাষার মানুষের মত ক্রমশ অব্যক্ত থেকে ব্যক্ত হতে চাইবে আপনার বাগেন্দ্রিয়। কারণ এখানে আগত নানান ভাষার পর্যটকরা আমার কাছে ওই ভাস্কর্যের মতই মূক। ভাষার ব্যবধানে পরস্পর শুধু পরস্পরের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে, কেউ কাউকে কিছুই বলে না। অথচ ভাষার সম্পর্ক থাকলে কত কথা বলা যেত! বিস্ময় আর ঘোরলাগা এইসব দৃশ্যের বন্ধন থেকে দৃশ্যত মুক্তি নিয়ে আমরা চলে এলাম পুরীতে। আমার মনে পড়ল উৎপল বসুর পুরী সিরিজ। কবিতার শক্তি এখানেই। কয়েকবছর আগে কবি উৎপল কুমার বসুর পুরী সিরিজের কয়েকটি কবিতা পড়েছিলাম, যদিও তার পঙ্ক্তি মনে করতে পারব না। তবুও সেই কবিতার গোপন অভিনিবেশ আমাকে স্পর্শ করল। পুরীতে তরুণ কবিরা তাদের কবিতা পড়ল। কেউ অসমি, কেউ হিন্দি, কেউ মারাঠী, কেউ বা উর্দু ভাষায়। বাংলায় কবিতা পড়ল কবি সেবন্তী ঘোষ ও শামীম রেজা। সেবন্তি ঘোষের কবিতায় একটি শব্দ 'সমকাম' ব্যবহারের ফলে সেখানকার বয়স্কদের মধ্যে হৈচৈ পড়ে গেল। এক বুড়ো প্রফেসর এই তরুণ কবিকে পারে তো কবিতা লেখা শেখায়! ওই পৃষ্ঠা-পড়া প্রফেসর, কোর্নাক থেকে সামান্য দূরেই তার বাস। কোর্নাক মন্দিরের কাম-আকাম-সমকাম-সঙ্গম, আরোহন-অবরোহনের সমস্ত ভাস্কর্য দেখেও তিনি 'সমকাম' শব্দটাকে সেবন্তীর কবিতায় মেনে নিতে নারাজ। এই ভোগবাদী পুরুষ শাসিত সমাজে শিক্ষিত প্রফেসরের কাছে মাফ চেয়ে নেয়াই বেশ স্বাস্থ্যকর।

পুরী সিরিজের পর সমন্বয়কারী মিঃ পাটনায়েক একঘণ্টা বরাদ্দ করলেন সমুদ্রদর্শনে। তার এই ধার্যকরা সময়ের আগেই আমি ও বন্ধু শামীম মিলে ঝাঁপ দিলাম সমুদ্রে। আট দেশের আগতদের মধ্যে সাত দেশের কবিরা সমুদ্র পাড়ে দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে আমাদের সমুদ্রসঙ্গম দেখল, আফসোসও পুষে রাখল কেউ কেউ। অংশুমান কর ও মন্দাক্রান্তা সেন একের পর এক ছবি তুলল। আমরা ভিজলাম সমুদ্রের জলে, পাড়ের লোকগুলোকে ভেজাল সমুদ্রের ঢেউ। পুরীর সমুদ্রে অর্থাৎ বঙ্গোপসাগরে সূর্য ডুবল, সন্ধ্যার আবছায়া ঘিরে ফেলল আমাদের প্রতিবেশ। আমরা রওনা হলাম ভুবনেশ্বরের উদ্দেশ্যে।

পরদিন, অর্থাৎ সার্ক কবিতা উৎসবের শেষদিন ২৪ ফেব্রুয়ারির সকালে রওনা হলাম ভুবনেশ্বরের কটকে অবস্থিত বিখ্যাত রাভীনেশ্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতা পাঠ ও সমাপনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সকালের নাস্তা তখনও পেটে পড়েনি। পেটের ক্রিমিরা অসহযোগিতা শুরু করল। মন্দাক্রান্তা সেন এবার অতিথিদের পক্ষে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দিল। টেলিভিশন ও পত্রিকার স্থানীয় সাংবাদিকগণ এই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করল, কেউ নোট নিল। স্থানীয় অগ্রজদের অনুরোধে আমরা আবার সিদ্ধান্ত পাল্টালাম। তাছাড়া এত বড় আয়োজনে এমন কিছু না ঘটলে কি মনে রাখার মত কিছু সৃষ্টি হবে? নাম ঘোষণা করা সত্ত্বেও এযাবত আমি কবিতা পড়া থেকে বিরত ছিলাম। পরে, বন্ধু শামীম এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী, সাংবাদিক ও কবিবন্ধুসহ আরও বেশ কয়েকজনের অনুরোধে আমিও কবিতা পড়লাম।

এরপর ভুবনেশ্বর থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা। কেউ কেউ সুবিধামত ঐ রাতেই ভুবনেশ্বর থেকে পা বাড়াল নিজ দেশে বা প্রদেশে। আমরা কেউ কেউ রয়ে গেলাম। মন্দাক্রান্তা সেন কলকাতার মেয়ে। বর্ধমানে থাকে অংশুমান কর, শিলিগুঁড়িতে সেবন্তী ঘোষ। ওরা দু'জন মিলে আমাকে মন্দাক্রান্তার সঙ্গে কোলকাতা পর্যন্ত যাওয়ার অনুরোধ জানাল। শামীম গোয়াগামী, কারণ সে তার উৎস খুঁজে ফিরছে। গোয়াতেই উপমহাদেশে উপদংশ বা ফেরেঙ্গব্যাধি বিস্তারী ভাস্কো দা গামা প্রথম পা রেখেছিলেন, গোয়ানিজদের সাথে শামীমের চেহারার কোনো সাদৃশ্য-রহস্য উন্মোচিত হয় কিনা সেই আবিষ্কারের নেশায় সে, এমন কি বন্ধুসঙ্গ ত্যাগে ব্রতী হল। শামীম তাই এই প্রস্তাব মেনে নেয়া আমার জন্য সঠিক হবে বলে ওর শিক্ষক চরিত্র অনুযায়ী রাজির পক্ষেই টিকচিহ্ন দিল। অংশুমান ও সেবন্তি সে রাতেই চলে গেল।

২৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে আমি ও মন্দাক্রান্তা মিলে কলকাতার উদ্দেশ্যে ভুবনেশ্বর রেল স্টেশনে পৌঁছলাম। শামীম ও শুভ্রাংশু আমাদের বিদায় জানাল। বিদায়ের চোখে জল। আমি উদ্বিগ্ন ট্রেনের টিকিটহীনতার কারণে। ওরা বলল, চিন্তা কোরো না, পেয়ে যাবে। কীভাবে টিকিট ম্যানেজ হয় তাও শেখাল। সাতটার ট্রেন এল সাড়ে ন'টায়। আমি উঠে পড়লাম মন্দার কামরায়। কিছুক্ষণের মধ্যে টিটির হস্তক্ষেপে টিকিট পাওয়া গেল। আমরা নিশ্চিন্ত হলাম। শুরু হল বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলা সম্পর্ক। জনপ্রিয় কবি ও কথাসাহিত্যিক হিসেবে মন্দা আমার কাছে বরাবরই সম্পর্কের কম নম্বর পেয়ে আসছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আনন্দবাজার পুরস্কৃত এই তরুণ কীভাবে আনন্দবাজারের সাম্প্রদায়িক ও বাজারীয় রাজনীতির বিরোধিতা করছে, কেন করছে তার যথাযথ কারণ নির্দেশ করায় আমি খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে বললাম, 'আগে বলতাম চেয়ার উল্টে দাও। এখন বলছি চেয়ারে বসে তারপর চেয়ার উল্টে দাও। তাতে আরও বেশি যোগ্যতা, আরও বেশি প্রমাণ। তুই দ্বিতীয়টা করতে পেরেছিস, এজন্যে তোকে অভিবাদন।' মন্দাক্রান্তা উজ্জ্বল হল। মন্দাকে বললাম, 'আচ্ছা আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দে তো দেখি। তোর দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখক প্রায়শই আমার দেশের কোনো কোনো ব্যবসায়ীর নাম বলে জিজ্ঞেস করে, আমরা তাদের চিনি কিনা। কিন্তু আমরা নির্দ্বিধায় একজন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, একজন বিনয় মজুমদার, একজন শঙ্খ ঘোষ, একজন মনীন্দ্র গুপ্ত, একজন উৎপল বসু, একজন রনজিৎ দাশের নাম বলতে পারি। এমন কি তোদের মত অনেক উজ্জ্বল তরুণদেরও লেখা জানি, কিন্তু তোর দেশের লেখকেরা আমার দেশের একজন আরজ আলী মাতুব্বর, একজন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, একজন আহমদ ছফা, একজন আবুল হাসান, একজন হাসান আজিজুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, সৈয়দ শামসুল হকের নাম বলতে হোঁচট খান, আমার সময়ের উজ্জ্বল বন্ধুদের নাম তো দূরের কথা–এর কারণ কী?' অপ্রস্তুত করে দেবার মত এমন প্রশ্নে ও সম্ভবত একটু বিব্রত হয়েই থাকবে। ও বলল, 'আমরা সেই জায়গাটা ভাঙবো। তোরা সহায়তা করবি। পারবি না?' বললাম, 'আমাদের হাত খোলা। তবে জানিস তো খোলা হাতকে ধরতে অন্যপক্ষের হাতটি খুলে বাড়াতে হয়?'


ট্রেনের কামরায় মন্দাক্রান্তা সেন

ট্রেনের কামড়ায় দুই দেশের এই আন্তঃআড্ডার সময় ফুরিয়ে এল। ট্রেন হাওড়া স্টেশনে পৌঁছল। আমি মন্দাক্রান্তাকে বললাম, 'বন্ধু, হিন্দিতে একটা ট্যাক্সি ডেকে দিস, আমি হিন্দি জানি না। ইংরেজি বললে ওরা ফরেইনার ভেবে দাম হাঁকায়।' ও মুচকি হাসল। বলল, 'এত ভাবছিস কেন, আমি তোর বন্ধু না!' প্লাটফরম থেকে সড়কে এসে দাঁড়ালাম। দেখি 'কেপি' লেখা একটি অ্যাম্বাসেডর এবং একটি জিপ। ভাবলাম, মন্দা অনেক জনপ্রিয় লেখক তাই হয়তো এ ব্যবস্থা। ততক্ষণে আমার চোখ অনতিদূরে ট্যাক্সি ড্রাইভারদের খুঁজছে। মুহূর্তেই জিপ থেকে নেমে এল দুজন কলকাতার পুলিশ। সাধারণ পোশাকে নেমে এল এক তরুণ। মন্দাক্রান্তা বলল, 'ওঠ।' তৎক্ষাণাৎ একটি অ্যাম্বাসাডারের দু'টি দরজা খুলে গেল। সাধারণ পোশাকের সেই তরুণ পুলিশ অফিসার বৃহদাকৃতির একটি ফুলের তোড়া আমার দিকে এগিয়ে ধরে বলল, 'কলকাতায় আপনাকে স্বাগতম! আমি কলকাতা পুলিশ এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অরিনিন্দম মুখোপাধ্যায়, ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চে কাজ করি। আমি ও মন্দা মিলে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করি, নাম বৃষ্টিদিন। আমি বিস্মিত, মন্দার চোখে তাকাতেই ওর স্বভাবসুলভ হাসি। মন্দা বলল, 'চল।' আমি বললাম, 'কোথায়?' ও বলল, 'তোকে ভাবতে হবে না।' আমাকে সম্ভাষণ জানিয়ে এবং প্রায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা দিয়ে গাড়ি বয়ে নিয়ে চলল পার্ক স্ট্রিটের দিকে। মন্দাকে বললাম, 'তোরা মনে হয় ভুল করছিস, আমি অত গুরুত্বপূর্ণ কেউ নই। পরে আমিও বিব্রত হব, তুইও।' মন্দার শান্ত জবাব, 'এটা কবির প্রাপ্তি।' আমি আর কথা বাড়ালাম না। তখন মনে পড়তে থাকল অনেক কিছু, তার মধ্যে ইতিহাসের সত্য যেমন ছিল, ছিলো বাস্তবের বিস্ময়।

ঢাকায় এসে বন্ধু আজফার হোসেন, রাজীব নূর, আহসান কবির ও রেজা ঘটক যখন কৌতূহল নিয়ে শুনছিল আমার ভারতভ্রমণের কথা, হঠাৎ আহসান কবির অগ্রজ কবি রফিক আজাদকে মনে করে বলল, 'কবিকে সেল্যুট করবে পুলিশ।'

আমার মনে হল কবিই সকলকে সাম্যের সেল্যুট করতে শেখায়।

ঢাকা, ২৯/২/২০০৮