একটি গল্প বা স্মৃতিকথানূহের নৌকায় শহীদুল জহির (১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৩ – ২৩ মার্চ, ২০০৮)

Nasima_Selim_aulic
Published : 28 March 2008, 11:04 PM
Updated : 28 March 2008, 11:04 PM

…….
কক্সবাজারে, ১৯৮৬ সালে
……..
ঢাকা শহর থেকে দূরে থাকলে বোঝা যায় একটি হাইজ্যাকার অধ্যূষিত, কাকের-সংখ্যা-বেড়ে-যাওয়া ও কবির-সংখ্যা-কমে-যাওয়া নগরীর মায়া কাটানো কেন কঠিন। বা, প্রায় অসম্ভব। বর্তমানে অন্য একটি মহানগরে থাকতে হয় বিধায় আমি ঢাকার আওয়াজ অদৃশ্যে শুনতে পাই, এবং সেই ধুনেই 'পূর্ব' বাংলার গান গাই। নানা খবর বাতাসে কানাকানি করে। শুধু ঢাকা নয়, ঢাকা সহ গোটা বাংলাদেশ বিষয়ে কিছু স্বদেশী আর কয়েকটা বিদেশী কাগজ পড়ে জানতে পারি মানে জানাই ছিল; হঠাৎ আল-গোরের 'একটি অস্বস্তিকর সত্যি কথা' শুনে আবারও মনে পড়ে–বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক এলাকা আগামী কুড়ি বছরে ডুবে যেতে পারে, এবং এটা নাকি প্রায় সম্ভব। তাহলে আমরা যারা বিদেশে যেতে পারি নাই বা চাই নাই, তারা কোথায় যাব। এমন কি হতে পারে যে আমরা এই দেশেই কোনোমতে ঠাঁই খুঁজে নেব বা কেউ কেউ অধিক হারে উদ্বাস্তু হব ভারত বা অধিকতর 'উন্নত' কোনো দেশে আমাদের রিফ্যুজি কলোনি হবে? এই বিরাট ভরাডুবির ফলে দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল সংখ্যক জনগণ উত্তর-পূর্ব-পশ্চিমাঞ্চলের অপরের কাছে জমির ভাগ চাইবে, নতুন করে বাসা বাঁধবে সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? সেক্ষেত্রে আমার একটা জরুরি প্রশ্ন আছে: যদি এমন ঘটে এবং তখনও আমাকে বেঁচে থাকতে হয় এই দেশে বা অন্য কোথাও, তবে আমি সঙ্গে কী নেব? কী ফেলে যাব, আর কী রাখব মনে–জীবনে? সেই বিষয়ে আজকে ভাবনা করতে চাই।

২৩শে মার্চ দুপুর বেলা বন্ধু প্রকাশক ঢাকা থেকে ফোন করে মৃদু স্বরে একবার বলেছিলেন: শহীদুল জহির ভোর রাতে মারা গেছেন। তারপর দুবার বা তিনবার তিনি আরও বিস্তারিত কী বললেন। আমি শুধু বুঝতে পারলাম, বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক ডুবে গেলে যদি কোথাও চলে যেতে হয়, শহীদুল জহির সমগ্রটাই নিতে হবে সঙ্গে। আর কেউ বা আর কিছু থাকুক বা না থাকুক, শহীদুল জহিরের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত পুস্তকের অস্তিত্ব জরুরি। কিন্তু দেশ ডুবলে বইগুলিও তো ডুববে, প্রকাশনা সংস্থা দেউলিয়া হবে, পাঠক পড়া ছাড়বে, লেখক হারাবে তার লেখার কলম-কম্প্যুটার অথবা লেখার সময়। মহাবিপদসংকেত জারী হলে নূহ নবী কি আর ফিরে আসবেন আমাদের প্রাণ বাঁচাতে? সেটা আমরা জানি না। তবে সেইসব মহান দুর্যোগের দিনে রূপক ও বাস্তব দুই অর্থেই নূহ নবীর নৌকা ছাড়া উপায় কী? এবং বইয়ের পাতা পানিতে ভাসলে সমকালীন বাংলাদেশী সাহিত্য থেকে যদি কিছু কিছু রক্ষা করতেই হয়, তো তাদের মধ্যে শহীদুল জহিরের গ্রন্থগুলি থাকবে–এই আমার দাবি (বা আবদার)। আশা করি আরও কয়েকজন পাঠক আমার লাইনেই বলবেন। ধারণা করি, যেহেতু জহির সদ্যমৃত তাই তার সম্মানার্থে যারা তাঁর লেখা অপছন্দ করতেন, তারাও এই নিয়ে খুব ঝগড়া করবেন না। অতএব আমি ফাঁদতেই পারি আজকের কাহিনী: নূহের নৌকায় শহীদুল জহির।

যারা শহীদুল জহিরের লেখা ভালোবাসত, তারা অন্যদের বোঝাবে কেন তাঁর লেখা ভালো। তাঁর লেখা সব গল্প বা উপন্যাস পড়তে মজা নাও লাগতে পারে, কিন্তু তিনি খারাপ লিখতেন একথা তাঁর শত্র"রাও বলবে না। আর তাঁর বন্ধুরা আপত্তি করবে, কেন তিনি এত তাড়াতাড়ি চলে গেলেন (বা, চলে যেতে বাধ্য হলেন)। তারা অনুযোগ করবে: হৃদযন্ত্রের আরেকটু যত্ন নিলে পারতেন। যদি ঠিক করে ওষুধ খেতেন, আরও কয়েক বছর বাঁচতেন যদি, যদি আরও ভালো লিখতেন! পঞ্চান্ন বছর বয়স কি খুব বেশি বেঁচে থাকার জন্য? ১৯৫৩ সালের পর থেকে সিরাজগঞ্জ আর তারপর ঢাকায় নারিন্দার ভূতের গলির সঙ্গে যার ঘনিষ্ঠ যোগ, আমরা বলছি না তিনি ইস্কাটন গার্ডেনে তাঁর সরকারী বাসভবনে, তারপর অবসর নিয়ে আর কোথাও, হয়তো নারিন্দার ভূতের গলিতেই নিরানব্বই বছর বেঁচে থাকুন, অথবা চলৎশক্তিরহিত হয়ে পড়ে থাকুন শুধু। কারণ, আমরা যারা তাঁর পাঠক বন্ধু, আমরা তাঁর দৈনন্দিন জীবনের সাথে যুক্ত নই, হতে চাই নি, হতামও না। আমাদের আগ্রহ ছিল এবং আছে তাঁর লেখার যাদুতে। অতএব, যখন–২০০৬ সালে মাওলা ব্রাদার্স ছাপায় তাঁর শেষ উপন্যাস মুখের দিকে দেখি, আর তার পরের বছর বইমেলায় পাঠক 'সমাবেশ' প্রকাশ করে শহীদুল জহির নির্বাচিত উপন্যাস এবং শহীদুল জহির নির্বাচিত গল্প–আমরা তাকিয়ে ছিলাম, অন্তত আরও আট-দশ-পনের বছর তিনি লিখবেন ও ছাপাবেন। এই আগ্রহের বড় কারণ জহির লিখতেন কম, ছাপাতেন আরও কম। অথচ লিখতেন ভালো। কোনো কোনো লেখা খুব ভালো।

যারা শহীদুল জহিরের লেখা ভালোবাসত আর যারা-ভালোবাসত-না তারা পরস্পরকে বুঝিয়ে বলুক কেন তাঁর লেখা ভালো অথবা ভালো না, বা, ভালো লাগার মত না। আমি শুধু লিখতে চাই মহান দুর্যোগের দিনে নূহ নবীর নৌকায় আমি শহীদুল জহিরের কোন কোন লেখা পড়তে চাই এবং কেন।

চার বছর আগের কোনো এক সন্ধ্যায়, আমাদের ইস্কুলে যিনি একসময় বাংলা পড়াতেন তাঁর বাড়িতে আমার বিদ্রোহী তারুণ্য ঘোষণা দিয়েছিল, বাংলাদেশে ভালো গল্প লেখা হচ্ছে না। ধুউর…শুনে আমার শিক্ষক হাসলেন এবং বললেন, এই বইটা পড়ো দেখি। তখনই ডলু নদীর হাওয়া বইল আর আমার বাংলাদেশী হীনম্মন্যতা উড়িয়ে নিয়ে গেল কোথাও একটা। জহিরের তৃতীয় গল্পগ্রন্থ, ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প, ২০০৪ সালে যেটা মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশ করেছিল বইমেলায়, আর ২০০৫-এ যেটা তাঁর জন্য এনেছিল একটি কাগজ সাহিত্য পুরস্কার। বইটার একটি কপি আমি হাতে পেলাম, তার প্রথম গল্প ‌‌'কোথায় পাব তারে' (লেখা হয়েছিল ১৯৯৯ সালে)। গল্প শুরু হয়েছিল জহিরের পুরান ঢাকায়, বেকার আব্দুল করিমের ডালপুরি খাওয়া প্রসঙ্গে এলাকার লোকের ভাবনার জোড়াতালি দিয়ে:

দক্ষিণ মৈশুন্দি, ভূতের গলির লোকেরা পুনরায় এক জটিলতার ভেতর পড়ে এবং জোড়পুল ও পদ্মনিধি লেনের, ওয়ারি ও বনগ্রামের, নারিন্দা ও দয়াগঞ্জের লোকেরা তাদের এই সঙ্কটের কথা শুনতে পায়; তারা, ভূতের গলির লোকেরা বলে: "আমরা পুনরায় আব্দুল করিমের কথায় ফিরে যেতে চাই, কারণ কয়েকদিন থেকে আমরা মহল্লায় শুনতে পাচ্ছিলাম যে, সে ময়মনসিং যাচ্ছে; কিন্তু আমরা তার এই কথাকে গুরুত্ব না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। তখন একদিন বৃহস্পতিবার বিকালে আমাদের মহল্লা, ভূতের গলির ৬৪ নম্বর বাড়ির মালিক আব্দুল আজিজ ব্যাপারি ঠোঙ্গায় করে গরম ডালপুরি কিনে ফেরার পথে আব্দুল করিমের সঙ্গে তার দেখা হয় এবং সে বলে, আহো মিঞা, ডাইলপুরি খায়া যাও।" (জহির ২০০৪: পৃ. ৯)

প্রথম জহির পাঠে শুধু বিরক্তি ছিল কয়েক মিনিট। ধুউর…কীসের ডালপুরি, কীসের ভূতের গলি, কে আব্দুল করিম আর কী করতে হালায় যাবে ময়মনসিং? একই বাক্যের পুনরাবৃত্তি মেজাজ খারাপ করতে না করতেই টের পাই আমি শহীদুল জহিরের সযত্নে বোনা ফাঁদে পড়ে গেছি। পুরাতন বাক্যের বারবার ফিরে আসা দিয়ে তিনি জেনেশুনে রচনা করেছেন আব্দুল করিমের মনোজগত, তার সঙ্গে জগত-পিতা-ডালপুরিওয়ালার কথোপকথনে ফিরে আসে সেই একই ধরন–যা এক আশ্চর্য রকম লুপ এবং গিঁট। ঠিক যে মুহূর্তে আমি সিদ্ধান্ত নিতে চাই যে এই গল্প পড়ার কোনো মানে হয় না, তখনই আব্দুল করিমের বন্দু শেপালির আবির্ভাব আর, কোথাও যাবে আব্দুল করিম, কিন্তু যে ঠিকানা আছে তার কাছে সে বড় অদ্ভুত। তার মানে করতে পারে না পাড়ার লোক ও পাঠক। যেমন, "নদী পার হয়া ব্রিজ পিছন দিয়া খাড়াইলে দুপুর বেলা যেদিকে ছেওয়া পড়ে তার উল্টা দিকে, ছেওয়া না থাকলে, যেদিকে হাঁটলে পায়ের তলায় আরাম লাগে সেই দিকে নদীর পাড় বরাবর… …আগাইলে চাইর দিকে ধান ক্ষেত, পায়ে হাঁটা আইলের রাস্তা দূরে চাইর দিকে আরো গ্রাম ক্ষেতে পাকা ধান যেদিকে কাইত হয়া আছে, সেই দিকে, অথবা, যদি ধানের দিন না হয়, যেদিকে বাতাস বয় সেই দিকে গেলে পাঁচটা বাড়ির ভিটা দেখা যাইব, তিনটা ভিটা সামনে দুইটা পিছনে, পিছনের দুইটা বাড়ির ডালিম গাছওয়ালা বাড়ি।" (জহির ২০০৪: পৃ. ২০-২১)

আব্দুল করিমের চালাকচতুরকুতুহলী সঙ্গী (যেমন ছিল দন কিহোতির সাগরেদ সাঙ্কো পাঞ্জা) দুলাল মিঞার সাথে আমিও প্রায় একমত হই আর আব্দুল করিমকে বলতে চাই: তুমার মত এমুন ভোদাই তো হালায় আমি জিন্দেগীতে দেখিনিকা! (প্রাগুক্ত, পৃ.১৯)। তবু আব্দুল করিম খুঁজতে যায় শেপালিকে, আর ফিরে আসে পুরোটা না গিয়েই। সাঁকোর কাঠের পাটাতনের উপর এক পায়ের উপর বসে থেকে দুলাল মিঞার মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলে, ল দুলাইলা, যাইগা (প্রাগুক্ত, পৃ.২২)। দুলাল মিঞার সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও মেজাজ খারাপ হয়। আব্দুল করিম কেন যে এমন উতলা হয়ে খুঁজেছিল শেপালিকে আর কেনইবা হাল ছেড়ে দিল হঠাৎ তার উত্তর মেলে না। শহীদুল জহির পারেন এই অস্বস্তিটা তৈরি করতে। অন্যদিকে ভূতের গলির লোকেদের আগ্রহ কমে যায়, করিম আবার ডালপুরি খায়, এবং উষ্মা প্রকাশ করে বলে, হালারা আলু দিয়া ডাইলপুরি বানায়! (প্রাগুক্ত, পৃ.২৩)। তখন আরও আরও পড়তে ইচ্ছা হয়। মনে হয়, শহীদুল জহির কে? তিনি লিখছেন কেন? সেই সময় এক ধরনের গুজব রটে যায় ঢাকা শহরে। শহীদুল জহির যাকে ভালোবাসতেন সেই মেয়েটি নাকি হারিয়ে গিয়েছিল। জহির তাকে অনেক খুঁজেছেন। কোথাও পাওয়া যায়নি। লোকে বলে, সেই হারিয়ে যাওয়া শেপালির (বা অন্য কোনো নাম) খোঁজ না পেয়ে তিনি চিরকুমার, মানে, বিয়ে করেননি। আর কেউ কেউ বলে, বউ ছিল না বলেই জহিরের যত্ন হয়নি। অকালে মরলেন। হয়তো শেপালি বেঁচে থাকলে এবং লেখকের জীবনে দাম্পত্য থাকলে আরও বাঁচতেন, আরও ভালো লিখতেন। অথবা ঘটত এর উল্টোটা। তিনি এত সুখী হতেন, যে লেখালেখি ছেড়ে অবসর কাটাতেন, শেপালির আশেপাশে ঘুরঘুর করতেন, বলতেন: কই, চা-টা দাও, একটু খবরের কাগজ পড়ি। বা হয়তো অন্য রকম হতো। এতটাই অসুখী হতেন যে লিখতেন সব ধূসর গদ্য ও পদ্য। সন্তানের ও সংসারের ভারে বিষণ্ন, বা হয়তো ঘুষ খেতে কোনো একদিন রাজি হয়ে যেতেন। আমরা জানি না। আর জানতেও পারব না। জহির তাঁর গোপন কথাটি কাউকে বলে গিয়েছিলেন?

মস্ত বড় সরকারী আমলা ছিলেন তিনি। সরকারী বাসভবনেই থাকতেন বলে জানি। যখন প্রথম তাঁর সঙ্গে যেচে দেখা করি, সেটা ২০০৪-ই। বেইলি রোডের কলোনিতে তাঁর বাসা কোথায় বলেছিল হয় বিজু ভাই নয়তো কবি আলতাফ হোসেন (তিনিও সেই এলাকায় থাকতেন তখন, তার বয়সও প্রায় জহিরের মতন)। মোবাইল দূরে থাক, বাড়ির টেলিফোনেই জহিরকে পাওয়া যায়নি অনেক দিন। সভা সমিতি বক্তৃতা যতটা সম্ভব এড়িয়ে গেছেন তিনি। কথা বলতে গিয়ে টের পাওয়া গেল লিখতেই তিনি ভালোবেসেছেন, বলতে ততটা না। যে কথা বলতে চায় না, যত বড় লেখকই হোক, তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে যাওয়াটা একটা দ্বিপাক্ষিক অস্বস্তি ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। বেশি সময় না নিয়ে সেই বিকেলে তাই ফিরে যেতে হলো। খানিকটা আশা ভাঙল। প্রশংসা শুনে তিনি খুশি হন কিন্তু তার উত্তরে কিছু বলতে চান না। বা নিন্দা নিয়েও যার বিশেষ মাথাব্যথা নাই, যে মার্কেজ খুব ভালোবাসেন, ইলিয়াস পছন্দ জানালেন, তার পর আর কিছুই বললেন না। নৈঃশব্দ ঝুলে থাকল ছাদের ঝুলে, আর বিকালের সঙ্গে সঙ্গে সেটাও লম্বা হতে থাকলে আমি বুঝে নিলাম, এর চেয়ে ভালো জহিরের বই পড়া। আগেই আমাকে সাবধান করা হয়েছিল। আর জহির নিজেই যেন বললেন আবারও, কথার চেয়ে ভালো আমার বই পড়া।

ফিরে গিয়ে আমি পড়ি ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প গ্রন্থের শেষ পঙ্ক্তি আমাদের কুটিরশিল্পের ইতিহাস। ঊনিশ পৃষ্ঠায় মাত্র একটি বাক্যে জহির গোটা গল্পটা লিখেছিলেন প্রকাশিত হওয়ার নয় বছর আগে। আর জহিরই খোলাসা করে দুবার বোঝালেন: গল্পটি একটিমাত্র অনুচ্ছেদে রচিত, অন্তিমে পূর্ণচ্ছেদসূচক-যতিচিহ্ন বিহীন এবং উন্মুক্ত বা খোলা।…এটাই শুদ্ধ পাঠ (প্রাগুক্ত:পৃ.১৩২)। এক নিঃশ্বাসে পড়া যায় কিন্তু আসলে পড়া যায় না এই লেখা একটানা। যদি কেউ চায়, আবিষ্ট হওয়ার উপাদান যথেষ্ট আছে জহিরের এই একটি দীর্ঘ, বড় দীর্ঘ বাক্যে। আবারও দক্ষিণ মৈশুন্দি এবং আবারও শেফালি। শেফালি ফুল না গাছ এই দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে হাঁটা একটি কৈশোর শেষে বেড়ে ওঠা, তরমুজ সম্পর্কে সচেতনতা, আর তারপর কী করে একটা পাড়া, একটা মেয়ে, আর অনেক কিশোর জীবন বদলে বদলে তবু শেফালি বদলায় না, শুধু হারিয়ে যায়। আর, মহল্লার খালি জমিতে হাজি রইসুদ্দিনের ফ্যাক্টরি অর্থাৎ দক্ষিণ মৈশুন্দির শিল্পায়নের ইতিহাস। কী বিষয়ে কী বিষয়ের প্রস্তাবনায়, জহিরের লেখার ধরনে এই নিজস্বতা বা চমক শুধু না (সেটা আরও অনেক লেখকের আছে বা থাকতে পারে); আরও কিছু ছিল।

কেউ বলেন তিনি মার্কেজ আর ইলিয়াস প্রভাবিত ছিলেন। অবশ্য তাঁর সময়কালে, যাদুবাস্তবতার ছাপ আশি-নব্বইয়ের দশকে লাতিন আমেরিকা থেকে উত্তর পশ্চিম হয়ে, মার্কেজের নোবেল প্রাইজের পরে আরও জোরদার হওয়ার পেছনে আমি শুধু সাহিত্যের রাজনীতি দেখতে পাই না। যদিও রাজনীতি ও ক্ষমতা থাকেন সর্বত্র (ফুকো ও তার আগে নীট্শে আরও জোরে বলেছিলেন); তবু এই সময়ের কথা এই সময়ের ভাষায় বলার চেষ্টায় কোনো এক গোপন মহত্ত থাকলেও থাকতে পারে। সর্বগ ক্ষমতার ছকে এ-ও এক অপর ক্ষমতা-ই। জহির ছিলেন বাক্যের বাজিগর, শব্দের না। কোনো কোনো লেখক ধ্বনির প্ররোচনায় শুধু শব্দে শব্দে ঠোঁকাঠুঁকি ভালোবাসেন, তাতে আর কোনও অর্থ জায়গা করে নিতে পারে না। আওয়াজের মজায় আজান শোনা যায় না। জহির সেই জাতের লেখক না। তাঁর শব্দ সাধারণ, কিন্তু তাঁর বাক্য অসামান্য। কীর্তন বা জিকিরের মতন ক্রমশ তুরীয় আনন্দের দিকে ধেয়ে যায় তাঁর সারি সারি বাক্য। অন্তত তাঁর শ্রেষ্ঠ গল্পগুলি, যেমন 'কোথায় পাব তারে' এবং 'আমাদের কুটিরশিল্পের ইতিহাস' পাঠ করাটা একটা বিশেষ ট্রিপ যা নেশা ধরায়। অবশ্য, যে এই নেশা করতে আগ্রহী সেই এক্ষেত্রে জহুরি হতে পারে। মানে, যে মুমীন (মানে, মুসলমান না হলেও চলবে; তবে, কোনো না কোনো মানবিক বিশ্বাসে আগ্রহী), তার জন্য কোনো না কোনো মায়াজাল জেলে জহির নির্ঘাত বিছাতে পারেন বলে আমি মনে করি।

শহীদুল জহিরের সাক্ষাত আমি আরও একবার পাই ২০০৭ সালে। বড় আশা ছিল সমাবেশ প্রকাশিতব্য আমার প্রথম (এবং এখন অবধি একমাত্র) গল্পগ্রন্থের ভূমিকা তিনি লিখবেন। তিনি প্রতিষ্ঠিত ও প্রশংসিত লেখক, তাঁর ভালো-মন্দ কথার ভারে আমার বইও লোকে পড়বে আর বিক্রি বাড়বে। সম্ভবত খানিকটা সেই উদ্দেশ্যেও আমি বেশ কিছুদিন তাঁর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করি। আর প্রকাশকও আমার হয়ে অনুরোধ করেছিলেন তাঁকে। পাণ্ডুলিপি পড়তে দিলে তিনি খুব ভদ্রলোক হয়ে বললেন–পড়বেন। তবে আরও বললেন: আমি পড়ব অলীক, কিন্তু ভূমিকা টুমিকা আমি লিখতে পারব না। তখনও আমার ক্ষীণ আশা ছিল। নবীন লেখকদের যেমন থাকে। আর যেহেতু আমিও কম লিখি (প্রথম গল্প লেখার দশ বছর পরে বই) ভেবেছিলাম তিনি নিশ্চয়ই স্নেহবশত একটা ভূমিকা টুমিকা লিখে দেবেন। অথচ একই বইমেলায় সমাবেশ থেকেই তাঁর নির্বাচিত সংকলন বেরুল, আর আমার বেরুল ভূমিকাহীন গ্রন্থ। মন খারাপ হল। যতবার এই নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছি, জহির আশ্বস্ত করতেন: লিখে যদি আনন্দ পান, সেটাই পাবেন। বই আর কে পড়ে! তখনও ভেবেছিলাম, খ্যাতি বড় লোভনীয়, কী এক মজা যেন, যদি লোকে চেনে। তা না হলে জানপ্রাণ দিয়ে একা একা লেখা আধো অন্ধকার ঘরে স্বপ্ন-বাস্তব-যাদুর টানাটানির পরে আর পাওনা কী? জহির ও কি এমনটাই ভাবতেন? বোধ হয়, না। তা হলে তিনি কি মহান? বোধ হয়, না। লোকে লেখা পড়–ক নিশ্চয়ই তিনি চাইতেন। নয়তো ছাপাতেন কেন? আর সভা সমিতি করতেন না সে তাঁর ঝামেলা এড়ানো স্বভাব। একা থাকতে ভালোবাসতেন বলেই একা থাকতেন, মাঝেমাঝে বন্ধুদের সঙ্গেও। আমি বলি না, জহির মহৎ মানুষ। শহিদুল জহির মানুষটা কে? আমি জানি না। ব্যক্তিগত পরিচয় বলতে একজন লেখকের সঙ্গে আরেকজন লেখক-হতে-চাওয়া-ব্যক্তির যা হয় তার মাঝখান থেকে আমি শুধু মনে করতে পারি তাঁর কয়েকটি কথা। তিনি বলতেন তাঁর অধিকাংশ বন্ধুই লেখক নয়। কী কারণে এড়িয়ে চলতেন লেখক সমাজ, সেই তথ্য কেউ কেউ জানে। আমি আর না-ই বলি আজকের দিনে। বরং মনে করি, শহীদুল জহির আর লিখবেন না। আর কোনো দিন তিনি ফিরিয়ে দেবেন না কোন নবীন লেখকের অনুরোধ এমন হৃদ্যতায়। তিনি বলবেন না–আব্দুল করিমেরা কেন যায়, কেন ফিরে আসে, আর শেপালিরা কেন শুধুই হারায়।

ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প ছিল শহিদুল জহিরের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ (প্রথম গল্পগ্রন্থ ১৯৮৫ সালে পারাপার ; প্রকাশ করেছিল মুক্তধারা)। ১৯৯৯ সালে, শিল্পতরু প্রকাশনীর এই বইটা বের হয় যখন, জহির তার আগে লিখেছেন দুটি উপন্যাস, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা (১৯৮৮) এবং সে রাতে পূর্ণিমা ছিল (১৯৯৫)। তিনি উপন্যাস লিখেছিলেন প্রথমে, আর প্রকাশিত গল্পগুলি তার পর থেকে। প্রথম গল্পের বইয়ে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ অবধি সর্বসাকুল্যে আটটা গল্প। তাঁর মধ্যে এই সময় নিয়ে হয় ফুলকুমার নামের ছবি, আর 'চতুর্থ মাত্রা' নিয়ে আরেকটা ছবি করেন নূরুল আলম আতিক। সুতরাং তাঁর গল্পের মজা লোকে পেয়েছিল আর তাঁর গল্পের শ্রোতা তৈরি হতে শুরু করেছিল তাঁর গল্প-উপন্যাস ছাপা হওয়ার পর থেকেই। আমি জহিরকে আবিষ্কার করার অনেক আগে থেকেই জহির পড়েছেন অনেকেই। আর নীরব মানুষ/সরব লেখকের নিজস্ব স্বরে, নিজেকে জাহির-না-করতে-চাওয়া জহির তখনই প্রশংসা ও ঈর্ষা পেয়েছেন বোধ হয়। 'ডুমুর খেকো মানুষ' পড়লে নতুন ও খারাপ লেখকদের একপ্রকার হিংসা হতে বাধ্য। যাদু ও বাস্তব এবং স্বপ্ন আর অস্বস্তি শুধু না, জহির তাঁর গল্পে এক ধীরগতির সন্ত্রাসকেও জায়গা দিয়েছেন। বইটির চার নম্বর গল্প, 'মনোজগতের কাঁটা' (লেখা হয়েছিল ১৯৯৫ সালে) আবারও ভূতের গলির লোকদের জীবনে একটি সঙ্কট। যা ঘটেছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন অন্ধকার ও দিবালোকে, তার কিছু পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম ৮০-র দশকের আগেই এবং তার পরে দ্বিতীয় সামরিক শাসনের কালে। মহল্লার একমাত্র হিন্দু সুবোধচন্দ্রকে রাজাকারের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে মহল্লার লোকই প্রাণভয়ে ঠেলে ফেলে দেয় কুয়ায়–স্ত্রী স্বপ্না স্বামীর অনুগামী হয়, তারপর সুবোধচন্দ্র ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না ফিরে ফিরে আসে। ১৯৯২ সালে অযোধ্যার মসজিদ ভাঙার খবর পেয়ে কেউ প্রচার করে, সুবোধ-স্বপ্না মিষ্টি কিনে খেয়েছে। তাই আরও একবার কুয়ায় তাঁদের মৃত পাওয়া যায়। এমনি করে নাগরিক সন্ত্রাস, যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বগুলোকে আত্মসাৎ করে। সাধারণ প্রতিবেশীর কাছে এইসব ধর্মীয় পরিচয় বড় হয় স্বাভাবিক আত্মরক্ষার তাগিদে বা কেন হিন্দুরা বাবরী মসজিদ ভাঙল অতএব বাংলাদেশের হিন্দুদের মারো একটি সরল সমীকরণই তাদের বোধগম্য। জহিরের গল্পে কোনো মহামানব আসেন না, কিন্তু মানবিক বোধে যে মহল্লা সুবোধদের রক্ষা করতে চায়, পরিস্থিতির চাপ আছে তাঁদেরও, মানবিকতার সীমা বেঁধে দেওয়া আছে। অতএব পাশবিকতাও মানুষেরই স্বভাব–জহিরের কাছে। ভালো ও মন্দ, পাপ এবং পুণ্য, মানবিক ও পাশবিক এই যাবতীয় দ্বৈততা ছাড়িয়েই যেন জীবন। যার সমীকরণ সমীচীন নয় হয়তো। তবু নৃশংসতার রেশ থাকে ভুক্তভোগী ও সন্ত্রাসী দুইয়ের মনেই, কোনো কোনো কাজ যুদ্ধকালে স্বাভাবিক হয়ে গেলেও পরবর্তীতে মনোজগতের কাঁটা হয়ে বিষ ছড়ায়, আর মহল্লার আনন্দ নষ্ট হয়ে যায়। জহির তাই মনে করেছেন, লিখে গেছেন : "এই বিভ্রান্তির ভেতর তাদের এরকম মনে হয় যে, তারা হয়তো কোনো এক জায়গায় কোনো এক স্বপ্নের ভেতর আটকা পড়ে আছে এবং এই স্বপ্নের ভেতর তারা অতীত থেকে ভবিষ্যতে অথবা ভবিষ্যৎ থেকে অতীতে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে; এবং তাদের মনে হয় যে, সুবোধ ও স্বপ্নার বিষয়টি হয়তো সত্য নয়, স্বপ্ন; কিন্তু তখন তাদের আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়ির প্রাঙ্গণে লাগানো স্বপ্নার তুলসী গাছটির কথা মনে পড়ে, তারা আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে যায় এবং দেয়ালের কিনারায় মৃদু বাতাসের ভেতর তুলসী গাছটিকে দেখে; এবং তখন তাদের কুয়োটির কথা মনে পড়ে।" (জহির ১৯৯৯: পৃ.৭৮)

তিনি কয়েকটি চরিত্রকেও বিশেষ ও বিশদ করে গেছেন। আমরা শেপালি/শেফালি আর আব্দুল করিমের কথা কিছু বলেছি। শহীদুল জহিরের আরও একজন নির্মাণ আকালু। আব্দুল করিম পুরান ঢাকার বেকার নায়ক, 'কোথায় পাব তারে' আর 'চতুর্থ মাত্রা'য় তাকে পড়েছি আমরা। কিন্তু আকালু গ্রামের ছেলে, গ্রাম থেকে শহরে পাড়ি দেওয়া নায়ক। যার সাফল্য ও ব্যর্থতা অন্তহীন। 'কাঠুরে ও দাঁড়কাক' (লেখা হয়েছিল ১৯৯২ সালে) গল্পে সে সিরাজগঞ্জে বৈকুণ্ঠপুর গ্রামের ভূমিহীন গরিব লোক। তার বউ টেপি। আকালু কাঠুরে। সকলেই তাকে ঠকায়। গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েও সে পাছায় লাথি খায় পুলিশের। প্রচুর টাকা নিয়ে জ্যোতিষ তাকে রত্ন দেয়, আবার সেই রত্নচুরির অভিযোগে আকালুকেই পুলিশ গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায়। আকালু তাঁর সকল ব্যর্থতার দায় চাপায় দাঁড়কাকের ঘাড়ে। যখনই কোনো কাক বসে ধারেকাছে, আকালু বলে, কাউয়া আইসা গেছে। এবং আরও কোনো বড় দুর্ঘটনার অপেক্ষা করে। অথচ জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর এই দাঁড়কাকের দলই ঘিরে থাকে আকালু-টেপি দম্পতিকে। নতুন ঢাকা শহরের মগবাজারের কাছে নয়াটোলায় কোনো খালি জায়গায় বাসা বাঁধে মানুষ ও কাক। আকালু দিনমজুর এবং টেপি বাসায় ঝি-এর কাজ করে। বাকি সময় এই দম্পতি দাঁড়কাকদের কুড়িয়ে পাওয়া জিনিসপাতি নিয়ে ব্যবসা করে। গল্পের শেষে মহল্লার লোকের তাড়া খেয়ে আকালু ও টেপি কাকেদের সঙ্গে উড়ে যায়: "এই ঘটনার পর ঢাকা কাক শূন্য হয়ে পড়ে … … একই সঙ্গে রাস্তায় অপরিষ্কৃত আবর্জনার স্তূপ জমে যেতে থাকে এবং শহরের আকাশ পাখিহীন একঘেয়ে হয়ে ওঠে। এভাবে বহুদিন কেটে যায়, তারপর আশেপাশের মফস্বল থেকে কিছু কাক আসে এই শহরে এবং মফস্বলের এই কাকেরা নূতন প্রজন্মের কাকের জন্ম দিয়ে শহরের আকাশ পুনরায় ভরে তোলে।" (প্রাগুক্ত: পৃ. ৩৫)

শহর ও মফস্বল, মফস্বল ও গ্রাম এবং গ্রাম থেকে মফস্বল হয়ে শহর অবধি এই অনবরত চলাচল, প্রায় যাযাবর জীবন যাপন, মানুষ যেন কাক আর কাকেরাও মানুষ। শহরের আবর্জনা সাফ করে মফস্বল বা গ্রামের লোক। একজন অদৃশ্য হলেও জায়গা খুব বেশি সময় খালি থাকে না, ভরে ওঠে অনর্গল অপর পরিযায়ী মানুষে। তারা আকালু, তারা টেপি, তারা সারি সারি দাঁড়কাক। শহীদুল জহিরের কলম তাদের দৈনন্দিন বাঁচা-মরাকে কি এক আলো-অন্ধকারে সাদা কাগজের কালো কালিতে আরেক প্রকার অস্তিত্ব উপহার দিয়ে থাকেন। শহুরে বড়লোকি করুণা বা সরকারী-আন্তর্জাতিক দাতা-দাক্ষিণ্যের গরিবি হটাও প্ররোচনার বাইরে গিয়ে কোথাও জহির জেগে থাকা ক্লান্তি ও স্মৃতিমেদুর চোখে চেয়ে চেয়ে দেখেছেন এইসব। বিস্ময়ে আমরাও দেখি তাঁর চোখ, মন ও বিবেচনা দিয়ে।

শহীদুল জহিরের ব্যক্তিগত জীবন ১৯৫৩ থেকে ২০০৮ অবধি আর ১৯৮৫ থেকে জহিরের প্রকাশিত লেখাগুলোর শুরুয়াৎ। তারপর, গত পঞ্চান্ন (জহিরের জৈবিক বয়স) ও বাইশ বছরে (জহিরের প্রকাশ্য লেখক জীবনকাল) বাংলাদেশী বাঙালীর জীবনে কী কী ঘটেছে? স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, একটা যুদ্ধ, স্বাধীন দেশে দুবার সরাসরি ও তৃতীয়বার ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে সামরিক শাসন, গণতন্ত্রের মৃত্যু ও পচন, ধর্ম হয়েছে রাজনৈতিক-সামাজিক-আন্তর্জাতিক পণ্য, নারী-পুরুষ-গরীব সকলেই টার্গেট পপুলেশন, ইসলামী উগ্রপন্থা আর মার্কিনি বোমাবাজি-জারিজুরির মাঝখানে আমরা সকলে মূষিকভব: আর জহির তার কতটা থেকে মুখ ফিরিয়েছেন আর কিয়দংশে কোন্ কোন্ ঘটনা তাঁকে ভাবিত করেছে তার আভাস ও প্রমাণ দুই-ই তাঁর গল্প জুড়ে থাকে। আর ব্যক্তি জহির জন্ম নেন, এবং মারা যান: সিরাজগঞ্জের বাড়ি থেকে পুরান ঢাকা, মুক্তিযুদ্ধ, শেফালিকে হারানো, ঢাকা-চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ-এর বিভিন্ন স্কুল, ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়াশিংটন ডিসির দি আমেরিকান ইউনিভার্সিটি, এবং বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া, বিয়ে না করা, সরকারী চাকরি, একা থাকা, কিছু বন্ধুবান্ধব, লিখতে থাকা, অপেক্ষাকৃত কম কিন্তু ভালো লিখতেই থাকা, বেইলী রোডের কলোনী থেকে প্রমোশন নিয়ে ইস্কাটন গার্ডেনের সরকারী বাসা–ইত্যাদির বুনটে একটা জমাট জীবন বোঝা জরুরি কিন্তু সেটা বোধ হয় আর সম্ভব না। এবং তাঁর লেখা বোঝার জন্য অপরিহার্যও না। যদি দেখি তাঁর জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি ঐতিহাসিক ঘটনাবলির ছায়ায়-অপচ্ছায়ায় তাঁর প্রকাশ্য সাহিত্য-কর্ম ও প্রণালী। লেখকের নিজের জীবন তো লেখারই রসদ, কিন্তু আজকের দিনে আমাদের এই ব্যক্তিগত কৌতূহল পরিহার করা যায় কেননা জহির তো সর্ব অর্থেই নিভৃতচারী ছিলেন। তিনি-ই কি চাইবেন আমরা তাঁকে নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করি। বরং, এত কথার চেয়ে ভালো–শহীদুল জহিরের বই পড়া।

এত কথার চেয়ে ভালো–ফিরে যাওয়া নূহের নৌকায়। কুড়ি বছর বাদে বাংলাদেশ তখন ডুবছে। আমি ভুল করে জহিরের উপন্যাস সঙ্গে আনিনি। বা ইচ্ছা করেই। মহান দুর্যোগের দিনে একমাত্র তাই পবিত্র ও সঙ্গে রাখা যায় যা সব চাইতে ভালো লাগে বলে জানি। শহীদুল জহিরের গল্পগুলো দামী। তাঁর উপন্যাস (দীর্ঘ দীর্ঘ অনেকগুলি গল্পসমষ্টি) তিনটির চেয়ে তাঁর গল্পের বই দুটিতেই বেশি মজা, অধিক জীবনমৃত্যু, স্বপ্ন ও যাদু। ভালো, কিন্তু অত ভালো লাগে না উপন্যাস (ব্যক্তিগত রুচি) যতটা লাগে তাঁর ছোট ছোট গল্পের স্বাদ। বা হয়তো, আমি নিজে উপন্যাসের চেয়ে গল্প পক্ষপাতী (হতে পারে)। এখন বেশ হাওয়া দিচ্ছে বাইরে, মাঝি দাঁড় বাইছে, বাংলার গান গাইছে। নূহ নবীর নৌকায় কিছু বিচ্ছু পোলাপান উঠে পড়েছে। তাঁরা কেউ কেউ শহীদুল জহিরের (যেমন অন্য কোনো কোনো লেখকের) একান্ত ব্যক্তিগত জীবনযাত্রার কিস্সার দিকে মনোযোগী। কিন্তু জহির কি কোথাও আছেন? ইহকাল বা পরকালে? ঐ দেখা যায় তাঁর ডুমুর খেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প, এই তাঁর ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প। বাংলাদেশ একদিন অনেকখানি ডুবে যাবে, কিন্তু সেদিন পোলাপানরা বেঁচে থাকবে, তারা পড়বে নূহের নৌকায় শহীদুল জহির। আমি ভরসা রাখি।

ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। শহীদুল জহির (১৯৫৩-২০০৮) যেখানেই থাকুন বা না থাকুন।

বি.দ্র. শহীদুল জহির প্রকাশিত গ্রন্থাবলি (আমার জানামতে):

১. পারাপার (গল্পগ্রন্থ, ১৯৮৫, মুক্তধারা)
২. জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা (উপন্যাস, ১৯৮৮, প্রকাশক জানি না)
৩. সে রাতে পূর্ণিমা ছিল (উপন্যাস, ১৯৯৫, প্রকাশক জানি না)
৪. ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প (গল্পগ্রন্থ, ১৯৯৯, শিল্পতরু প্রকাশনী)
৫. ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প (গল্পগ্রন্থ, ২০০৪, মাওলা ব্রাদার্স)
৬. মুখের দিকে দেখি (উপন্যাস, ২০০৬, মাওলা ব্রাদার্স)
৭. শহীদুল জহির: নির্বাচিত উপন্যাস (২০০৭, সমাবেশ)
৮. শহীদুল জহির: নির্বাচিত উপন্যাস (২০০৭, সমাবেশ)

কোলকাতা, ২৪/৩/৮