বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০১০: চাই সচেতনতা ও সমন্বিত সেবা

জিল্লুর রহমান রতন
Published : 10 Oct 2010, 12:21 PM
Updated : 10 Oct 2010, 12:21 PM

ঢাকায় বসবাসরত একজন মহিলার কথা লিখার শুরুতেই মনে পড়লো। তিনি তার স্বামীর মানসিক রোগের চিকিৎসার ব্যাপারে পরামর্শের জন্য এসেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের মানসিক রোগ বিভাগে।  তার স্বামী স্বাভাবিক কর্মদক্ষতা হারিয়ে দীর্ঘকাল সমাজবিচ্ছিন্ন।  তিনি তার স্ত্রীর প্রতি অমূলক সন্দেহ পোষণ করেন, শারীরিক নির্যাতন এমনকি হত্যার হুমকি পর্যন্ত দিচ্ছিলেন। সমস্যা শুনে আমি তাকে মানসিক রোগবিভাগে নিয়ে আসার ও প্রয়োজনে ভর্তির পরামর্শ দিই। কিন্তু, আমি অবাক হই যখন তিনি জানালেন যে, তার স্বামীর উচ্চশিক্ষিত পরিবারের সদস্যগণ (একজন সমাজে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও খুব পরিচিত মুখ) এ ব্যাপারে তাকে কোন সহযোগিতা করতে রাজী নয়। রাজধানীতে বসবাসকারী একজন  শিক্ষিত নাগরিকের যখন এ অবস্থা তখন সারাদেশের বিশেষত গ্রামাঞ্চলের অবস্থা কীরকম তা সহজেই অনুমেয়। অথচ সরকারী  পর্যায়ে মানসিক রোগের চিকিৎসা সেবা রয়েছে হাতের নাগালের মধ্যেই। আসলে মূল সমস্যা মানসিক রোগ চিকিৎসায় নেতিবাচক র্দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক সচেতনতার অভাব ।

প্রতিবছরের মত এবছর সারা বিশ্বে ও আমাদের দেশে ১০ অক্টোবর ১৮তম বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস  পালিত হচ্ছে। এবারের এ দিবসের প্রতিপাদ্য "মানসিক স্বাস্থ্য ও দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক অসুস্থতা ঃ প্রয়োজন ধারাবাহিক ও সমন্বিত সেবা"। শারীরিক সমস্যা যেমন, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ও শ্বাসতন্ত্রের সমস্যাসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক অসুখে ডিপ্রেশন, উদ্বেগ, ভয়ভীতি, মানিয়ে চলার সমস্যা প্রভৃতি মানসিক রোগ হওয়ার ঝুঁকি বহুলাংশে বেড়ে যায়। অনুরূপভাবে, দীর্ঘমেয়াদী মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের মতো বিভিন্ন ধরনের শারীরিক রোগ হবার ঝুঁকি বেশী। এজন্য শারীরিক ও মানসিক রোগের সমন্বিত সেবা প্রয়োজন যাতে একজন রোগী দুধরনের সমস্যার চিকিৎসা একই স্বাস্থ্য কেন্দ্র হতে  পেতে পারেন। এ বিষয়টি গুরত্ব  প্রদান করেই এবারের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারন করা হয়েছে।

মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাতিত যে স্বাস্থ্য অসম্পূর্ণ এ বিষয়টি প্রায়ই আমাদের চেতনার বাইরে রয়ে যায়। সমস্যার শুরু রেনে দেকার্তের শরীর-মন দ্বৈতবাদ নামক দার্শনিক মতবাদ থেকে যার প্রভাব পরবর্তীতে পাশ্চাত্যের চিকিৎসা    বিজ্ঞানে  পড়েছিল। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে পৃথকভাবে দেখার প্রবণতা তৈরী  হয়েছিল । পরবর্তী অর্ধশতাব্দীর গবেষণায়  এটি প্রমাণিত যে, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য একটি সমন্বিত বিষয়; একটিকে বাদ দিলে আরেকটি অর্থহীন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে বিষয়টি ১৯৪৮ সালের স্বাস্থ্যের সজ্ঞায় স্পষ্ট করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আমাদের দেশে স্বাস্থ্যের অপরিহার্য অক্সগ মানসিক স্বাস্থ্য শারীরিক স্বাস্থ্যের মত সমান গুরুত্ব পেল না আজও। এছাড়া মানসিক রোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমাদের সামাজে  রয়েছে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, চিকিৎসা গ্রহণে লোক লজ্জা, কুসংস্কার ও সামাজিক ভীতি।

ওর্য়াল্ড ফেডারেশন অব মেন্টাল হেলথ্ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালনের মাধ্যমে বিশ্ব্যব্যাপী মানসিক স্ব্যাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা কর্মসূচী  চালিয়ে যাচ্ছে ১৯৯২ সাল থেকে। কারণ, মানসিক রোগ চিকিৎসার সবচেয়ে বড় বাধা অসচেতনতা ও নেতিবাচক সমাজিক মনোভাব। আমাদের শিক্ষিত সমাজ এখনও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানীর পার্থক্য বোঝেন না(প্রথমজন চিকিৎসক দ্বিতীয়জন নয়)।  আমজনতার কথা বাদই দিলাম। সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয় সাধারণ চিকিৎসকদের মধ্যেও মানসিক রোগ চিকিৎসা সর্ম্পকে রয়েছে নানারকম বিভ্রান্তি। মানসিক রোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত ঔষধের ব্যপারে রয়েছে নেতিবাচক প্রচারণা।  কিন্তু এই ঔষধ জীবন রক্ষাকারী অন্যান্য ঔষধের মত বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিভিন্ন ধাপ অনুসরণের পর  বাজারে ছাড়ার অনুমতি দেয়া হয়। বেশীরভাগ মানসিকরোগ চিকিৎসায় এ ঔষধের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু মনোসামাাজিক সহায়তাও মানসিক রোগ চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভ'মিকা পালন করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার  মতে, বিশ্বে ৬০ ভাগ মানুষ মারা যায় হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ও শাসতন্ত্রের রোগে। দুই দশকের গবেষণায় দেখা যায়, এ ধরণের দীর্ঘ মেয়াদী শারীরিক অসুখে বিষণœতা ও উদ্বেগ নামক মানসিক রোগের প্রকোপ বেশী হয়। যেমন, বিষণœতার হার ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে শতকরা ২০ ভাগ এবং যেকোন ধরনের ক্যান্সারে শতকরা ২৫-৩৯ ভাগ যা সাধারণের তুলনায় অনেক বেশী । অনেকক্ষেত্রে, এ ধরনের শারীরিক রোগে মানসিক রোগের উপস্থিতি শারীরিক রোগের চিকিৎসাকে জটিল ও ব্যয়বহুল করে তোলে। এদের বেশীর ভাগই মানসিক রোগের চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত। একজন ডায়াবেটিস রোগী যখন বিষণœতায় ভোগেন তখন তার দৈনন্দিন নিষ্ক্রিয়তা ও সবকিছুর প্রতি অনীহা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণকে বাধাগ্রস্ত করে। আবার,  দীর্ঘমেয়াদী মানসিক  রোগে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক রোগ হবার ঝুঁকি বেড়ে যায়। 

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, বিষণœতারোগ হৃদরোগের ঝুকি হিসেবে কাজ করে ও হৃদরোগের কারণে মৃত্যুর হার অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। এজন্য আমেরিকান হার্ট এসোসিয়শন প্রত্যেক রোগীর জন্য বিষণœতা নিরূপণ বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দিয়েছে।  এ দ্বৈত সমস্যার উপস্থিতি উভয়রোগের চিকিৎসাকে জটিল, ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ করে তোলে । ফলশ্রুতিতে কর্মদক্ষতা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও জীবন উপভোগের ক্ষমতা  হ্রাস পায় । এজন্য মানসিক ও শারীরিক রোগের সমন্বিত চিকিৎসা প্রয়োজন । মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচীতে অর্ন্তভ'ক্ত করতে পারলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। এতে জনগণের মানসিক রোগ চিকিৎসা নেয়া  সহজ হবে ও মানসিক রোগ সর্ম্পকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজভীতি ও কুসংস্কার কমে আসবে। এর ফলে মানসিক রোগীর মানবাধিকার বেশী সুরক্ষিত হবে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে দেখা যায়, আমাদের দেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার শতকরা ১৬.১ ভাগ যেকোন ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত। এ বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য প্রতি ১ লাখ জনসংখ্যার জন্য ০.০৭ জন মানসিক রোগবিশেষজ্ঞ  রয়েছে যা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য।  উন্নত দেশে এ অনুপাত  প্রতি ১ লাখ জনসংখ্যার জন্য ১০ জন, মধ্যআয়ের দেশে ২.৭ জন অনুন্নত দেশে ০.০৫! বর্তমান হারে জনবল বৃদ্ধি পেতে থাকলে  আগামী ১০০  বছরেও এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এজন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচীতে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা অর্ন্তভ'ক্তকরণ এখন সময়ের দাবী। এ লক্ষ্য অর্জনে সাধারণ চিকিৎসকদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার উপর প্রশিক্ষণ প্রদান (এখন পর্যন্ত ৪৫০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে), মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থায় মানসিকরোগ চিকিৎসার কারিকুলাম সম্প্রসারণ ও স্কুল পর্যাযের পাঠ্যসূচীতে বিষয়টির অর্ন্তভ'ক্তকরণ জরুরী। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে উপজেলা, জেলা পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বস্তরে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচীতে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। এ বিষয়ে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্টমিডিয়ার সক্রিয়  ও গঠনমূলক সহযোগিতা প্রয়োজন ।

সম্প্রতি বাংলাদেশ মিলেনিয়াম ডেভালপমেন্ট গোল  কর্মসূচীতে  স্বাস্থ্যক্ষেত্রে শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার জন্য জাতিসংঘ পুরস্কারে ভ'ষিত হয়েছে যা আমাদের দেশের জন্য গৌরবের বিষয়।  কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যকে অবহেলা করে জনগণের স্বাস্থের মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। উন্নয়ন কর্মসূচীতে সাফল্য লাভের অন্যতম শর্ত হচ্ছে জনগণের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন। এজন্য প্রয়োজন মানসিক স্বাস্থসেবা কর্মসূচীতে স্বাস্থ্যবাজেটের বরাদ্দ বৃদ্ধি; অথচ সরকারী স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র শতকরা ০.৪ ভাগ মানসিক স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত। এমডিজি অর্জনের সাফল্য ধরে রাখতে হলে এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ প্রয়োজন (স্বাস্থ্য বাজেটের কমপক্ষে শতকরা ৫ ভাগ)।

মানসিক স্বাস্থ্যকে বাদ দিয়ে জনগণের স্বাস্থ্য সেবার মান উন্ন্য়ন সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা ও সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারন করা। স্বাধীনতার এত বছর পরও মেন্টাল হেলথ্ এ্যাক্ট পাশ হয়নি; এ ব্যর্থতা আমাদের সকলের । তাই এবারে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্যদিবসে আমাদর সকলের প্রত্যাশা সরকার দ্রুত এ আইন পাশ করে মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় জনগণের মানবাধিকার নিশ্চিত করবেন  যা জািত হিসেবে বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি  আরও উজ্জ্ব্ল করবে।