শিক্ষা ও জাতীয় উন্নয়ন : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

সালাহউদ্দীন আহমদ
Published : 26 Oct 2010, 02:53 PM
Updated : 26 Oct 2010, 02:53 PM

আঠারো শতকের শেষের দিকে এ দেশের শাসকশ্রেণী–বাংলার নবাব ও স্থানীয় জমিদাররা– শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় যেমন, হিন্দু ও মুসলমানদের নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। হিন্দুদের ছিল টোল ও পাঠশালা। টোলগুলিতে প্রাচীন হিন্দু ধর্মীয় শাস্ত্র এবং সংস্কৃত সাহিত্য কেবলমাত্র উচ্চ বর্ণের হিন্দু ছাত্রদের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা নিজের বাড়িতে পড়াতেন। পাঠশালা ছিল সাধারণ প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানে সকল শ্রেণীর ছাত্ররা পড়াশুনা করত। তেমনি মুসলমানদের ইসলাম ধর্ম ও অন্যান্য বিষয় আরবি ও ফারসি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানের জন্য ছিল মাদ্রাসা। মক্তব ছিল শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয় যেগুলি ছিল প্রধানত মসজিদসংলগ্ন। যদিও এই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হতো, সমাজের সাধারণত দরিদ্র শ্রেণীর শিশুরাও এখানে পড়াশুনা করত। সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালী শ্রেণীর শিশুদের শিক্ষাদান করা হতো তাদের নিজস্ব বাড়িতে বিশেষভাবে নিযুক্ত গৃহশিক্ষক দ্বারা।

কিন্তু সেকালে শিক্ষার বিস্তার সুষ্ঠুভাবে সম্ভব হয়নি মুদ্রিত পাঠ্যপুস্তকের অভাবে। আঠরো শতকের শেষের দিকে অরাজক পরিস্থিতির ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই পুরাতন ঐতিহ্যিক শিক্ষাব্যবস্থা একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়নি। ১৮৩৫ সালে ইংরেজ বড়লাট লর্ড উইলিয়াম বেনটিংক-এর নির্দেশে উইলিয়াম এডাম এ দেশের শিক্ষা পরিস্থিতির উপর যে জরিপ সম্পন্ন করেছিলেন তাতে দেখা যায় যে, সে সময় বাংলা ও বিহার অঞ্চলে কমপক্ষে এক লক্ষ প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু ছিল এবং এইসব বিদ্যালয়ে সকল সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করত।

ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালের প্রথম দিকে কোম্পানির সরকার এ দেশের শিক্ষা সম্পর্কে কোনো আগ্রহ দেখায় নি। এই বিদেশী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এ দেশে এসেছিল মূলত ব্যবসা করতে। এ দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তারা কোনো রকম হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। বস্তুত, কোম্পানি এ দেশের শাসনব্যবস্থায় কোনো বড় রকম পরিবর্তন করতে অনিচ্ছুক ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার এ দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি (policy of non-interference)অনুসরণ করে পুরাতন মুঘল আমলের বিচার ও রাজস্ব পদ্ধতি কিছুটা রদবদল করে চালু রেখেছিল। মুঘল আমলে সরকারি কাজে ব্যবহৃত ফারসি ভাষা ইংরেজ আমলের প্রথম দিক পর্যন্ত (১৮৩৭) চালু রাখা হয়েছিল। বস্তুত এ দেশের ইংরেজ সরকারের প্রশাসনিক কাজের প্রয়োজনে প্রথম সরকারি উদ্যোগে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হয় সেটি হলো কলকাতা মাদ্রাসা। এটি ১৭৮০ সালে গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস-এর দ্বারা স্থাপিত হয়েছিল। হেস্টিংস-এর ব্যক্তিগত অর্থ দিয়ে মাদ্রাসার জন্য জমি ক্রয় করা হয় এবং তিনি নিজে প্রায় দু-বছর এই প্রতিষ্ঠানের সকল ব্যয়ভার বহন করেন। ১৭৮২ সালে কোম্পানি সরকার কলকাতা মাদ্রাসার কর্তৃত্বভার সরাসরি গ্রহণ করে। এর দশ বছর পর ১৭৯২ সালে কোম্পানি হিন্দুদের প্রধান তীর্থস্থান বারানসীতে একটি সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করে। আপাত দৃষ্টিতে এই দুইটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে ইংরেজ সরকার এ দেশের মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মনোতুষ্টি অর্জন করতে চেয়েছিল। কিন্তু আসলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকারের প্রশাসনিক প্রয়োজনেই এই দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিল।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ দেশে ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও বেশ কিছুকাল পুরাতন মুঘল আমলের প্রথা অনুযায়ী বিচার ও রাজস্ব বিভাগের কার্যপ্রণালী ফারসি ভাষায় চালানো হচ্ছিল। বিচার ও রাজস্ব বিভাগের নিম্ন পর্যায়ের পদগুলি পূরণের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত মুসলমান ও হিন্দু যুবকদের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। ইংরেজ সরকার কর্তৃক স্থাপিত এই দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলকাতা মাদ্রাসা ও বারানসী সংস্কৃত কলেজ এই প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হয়েছিল। ১৭৮৫ সালে সরকার নির্দেশ দেয় যে, ফৌজদারী আদালতসমূহে শূন্য পদে মাদ্রাসায় শিক্ষিত ছাত্রদের নিয়োগ দেওয়া হবে। সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যায় যে, ১৮৩৫ সাল নাগাদ প্রায় দুইশত মাদ্রাসায় শিক্ষিত মুসলমান সরকারি চাকুরিতে নিযুক্ত আছেন। বস্তুত যতদিন পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার প্রাচ্যমুখী (orientalist) শিক্ষানীতি অনুসরণ করছিল এবং কোর্ট-কাছারির ভাষা হিসেবে ফারসি ভাষার চলন রেখেছিল, ততদিন শিক্ষাগত ব্যাপারে মুসলমানদের প্রাধান্য নিশ্চিত ছিল। মুসলমানরা বিশেষ করে শহর অঞ্চলে তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব বজায় রেখেছিল। এমনকি হিন্দু অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা মুঘল পোশাক পরিচ্ছদ ব্যবহার করতেন এবং মুঘল বা নবাবী আমলের কায়দা-কানুন পালন করতেন।

আঠার শতকের শেষের দিকে এ দেশে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার ফলে এই ভূখণ্ডের মানুষ আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে আসে। পাশ্চাত্যের অভিঘাতের প্রতি এই উপমহাদেশের দুই প্রধান সম্প্রদায়, হিন্দু ও মুসলমানদের ভিন্ন প্রক্রিয়ার ফলে এই দুই সম্প্রদায়ের উন্নয়ন সমানভাবে হয়নি। সাধারণভাবে বলা যায় যে, ইংরেজ রাজত্বের প্রতি হিন্দুদের মনোভাব ছিল বাস্তব ও ইতিবাচক। সুদীর্ঘ মুসলিম শাসনামলে হিন্দুরা তাদের নিজস্ব অবস্থানকে টিকিয়ে রেখেছিল মুসলিম শাসকদের সঙ্গে সহযোগিতা করে। যেমন দেখা যায় যে, হিন্দুরা মুসলিম আমলের রাজভাষা ফারসি আয়ত্ব করতে দ্বিধা করেনি এবং তার ফলে তারা মুসলিম শাসকদের নিকট থেকে অনেক রকম সুযোগ-সুবিধা পেতে সক্ষম হয়েছিল। তারা অধিকাংশ মুসলিম শাসকদের বিশেষ করে মুঘল শাসকদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছিল এবং তাদের মধ্যে অনেককে উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত করা হয়েছিল। মুসলমান আমলে হিন্দুরা তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক ক্রিয়া-কর্ম পরিচালনার ক্ষেত্রে মুসলিম শাসকদের নিকট থেকে সাধারণত কোনোরকম হস্তক্ষেপ বা বাধা-বিঘ্নের সম্মুখীন হয়নি। এ দেশে ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হিন্দুদের কোনোই অসুবিধা হয়নি। তারা নির্দ্বিধায় নতুন শাসকদের ভাষা ইংরেজি শিখতে শুরু করল এবং এর ফলে অনেক সুযোগ-সুবিধা পেতে লাগল। শুধু তাই নয়, ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে হিন্দুরা আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও উদারনৈতিক এবং যুক্তিবাদী চিন্তাধারার সংস্পর্শে আসলো এবং এর প্রভাব তাদের চিন্তা-চেতনা ও জীবনযাত্রায় প্রতিফলিত হতে শুরু করল। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সুচিত হয়েছিল ঊনিশ শতকে হিন্দুদের নবজাগরণ বা রেনেসাঁ এবং আধুনিকায়ন।

অন্যদিকে, পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া ছিল বলা যেতে পারে সাধারণত অবাস্তব ও নেতিবাচক। এ দেশে ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠাকে তারা চরম বিপর্যয় বলে ধরে নিয়েছিল এবং তারা পরিবর্তিত অবস্থাকে মোটেই মেনে নিতে পারেনি। বলা যেতে পারে মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অতীতমুখী। তারা একেবারেই উপলব্ধি করতে পারেনি যে, এ দেশে ইংরেজ রাজত্ব স্থাপনের মধ্যে দিয়ে কেবল পুরাতন যুগের অবসান ঘটেনি; নতুন বা আধুনিক যুগের সূচনা হয়েছে যার ফলে সর্বক্ষেত্রে বৈপ্লবিক ও সুদূর প্রসারী পরিবর্তনের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, তুলনামূলকভাবে হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া ছিল একেবারে ভিন্ন। তারা পাশ্চাত্যের চ্যালেঞ্জের প্রতি ইতিবাচকভাবে সাড়া দিয়েছে। তারা আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী চিন্তাধারার প্রভাবে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে প্রাচীন হিন্দু সমাজের ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যবস্থার দোষত্রুটি সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করেছে এবং এর ফলে হিন্দু সমাজে ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের পথ সুগম হয়েছে।

শিক্ষা ক্ষেত্রেও মুসলমানরা বেশি দূর এগোতে পারেনি তার প্রধান কারণ হলো তারা পুরাতন ঐতিহ্যিক মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে আঁকড়ে রাখতে চেয়েছিল। অথচ মাদ্রাসাতে যে সব বিষয় শিক্ষা দেওয়া হতো সেগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এগুলো ছিল ভীষণভাবে অপর্যাপ্ত এবং সমকালীন যুগের চাহিদা মেটাতে একেবারে অক্ষম। ১৮৩২ সালে কলকাতা বিশপ কলেজের গণিত শাস্ত্রের অধ্যাপক ড. মিল যিনি কলকাতা মাদ্রাসার গণিত শাস্ত্রের পরীক্ষা নিতেন, তাঁর মন্তব্য হলো, সে সময় মাদ্রাসায় আরবি ভাষার মাধ্যমে যে ধরনের বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হচ্ছিল সেটা প্রায় হাজার বছরের পুরানো ও একেবারে সেকেলে এবং সমকালীন ইউরোপীয় বিজ্ঞানের তুলনায় অনেক পেছনে রয়েছে। তিনি বেশ জোরের সঙ্গে বলেন যে, প্রাচ্যের ঐতিহ্যিক শিক্ষাব্যবস্থায় বুদ্ধির পূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। কলকাতা মাদ্রাসায় সরকারের জনশিক্ষা বিভাগ (Committee of Public Instruction) কর্তৃক ইংরেজি ভাষা শিক্ষা প্রবর্তন রাখার অনেক চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু যথেষ্ট সাড়া পাওয়া যায়নি।

বাংলার হিন্দুদের তুলনায় মুসলমান সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল দুর্বল। এ দেশের মুসলমানেরা ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে কখনো তেমন উৎসাহ দেখায়নি। বস্তুতঃ এ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রধানতঃ হিন্দু বণিক ও মহাজনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ব্রিটিশ আমলের আগে থেকেই এ দেশের অধিকাংশ ভূ-সম্পত্তি হিন্দুদের হাতে ছিল। নবাব মুর্শিদ কুলি খানের সময় বাংলার জমিদারদের তিন-চতুর্থাংশ এবং অধিকাংশ তালুকদার হিন্দু ছিলেন। মুঘল শাসনব্যবস্থার অধীনে মুর্শিদ কুলি খান বহুসংখ্যক হিন্দুকে রাজকর্মচারী হিসেবে নিয়োগ করেন। বস্তুতঃ মুসলমান আমলে এ দেশের রাজস্ব বিভাগের চাকুরী প্রায় একচেটিয়াভাবে হিন্দুদের হাতে ছিল। কেবল বিচার বিভাগে ছিল মুসলমানদের প্রাধান্য। কিন্তু অধিকাংশ বিচারক (কাজী), উকিল (ওয়াকিল) বা আইনজীবী ছিলেন বহিরাগত মুসলমানদের বংশধর। তারা বাঙালি ছিলেন এ কথা বলা যাবে না। বস্তুতঃ গোটা মুসলমান আমলে বাংলার নবাব ও অভিজাত শ্রেণীর একটা বিরাট অংশ ছিল বহিরাগত এবং অবাঙালি।

মুসলিম আমলে এ দেশে মুসলমানদের আধিপত্য প্রধানত মুসলিম রাজশক্তির উপর নির্ভরশীল ছিল। আঠার শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যখন সেই রাজশক্তি ভেঙে পড়ল তখন ঐ রাজশক্তির উপর নির্ভরশীল আর্থ-সামাজিক কাঠামোতেও ভাঙন দেখা দিল।

ঊনিশ শতকের বাংলার মুসলিম সমাজের একটা বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, এই সমাজ ভাষাগত ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। মুসলমান অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা ছিল অধিকাংশই নগরবাসী ও বহিরাগত মুসলমানদের বংশধর এবং উর্দুভাষী। অন্যদিকে বাংলার অধিকাংশ মুসলমান জনসাধারণ ছিল গ্রামবাসী ও দরিদ্র এবং তাদের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। ফলে নগরবাসী অভিজাত মুসলমানদের সঙ্গে গ্রামীণ দরিদ্র মুসলমান জনসাধারণের একটা বিরাট ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্য বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীকালে যখন প্রয়োজনের তাগিদে নগরবাসী মুসলমান অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে ইংরেজ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করে নিজেদের অবস্থার উন্নতি করতে কিছুটা সক্ষম হলো তখন তার সুফল গ্রামীণ অঞ্চলের বাংলাভাষী মুসলমান জনসাধারণ ভোগ করতে পারেনি। কিন্তু নগরবাসী অভিজাত শ্রেণীর উর্দুভাষী মুসলমান নেতারা বাংলার সমগ্র মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব দাবি করতে দ্বিধা করতেন না। তাঁরা হয়তো মনে করতেন যে, উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলার অবাঙালি নবাবদের স্থান অন্ততঃ সামাজিক ক্ষেত্রে তাঁদেরই প্রাপ্য। যেহেতু বাংলার মুসলমান সমাজে তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী, ইংরেজ সরকারও তাঁদের দাবি মেনে নিয়েছিল এবং তাঁদেরকে 'নবাব', 'খান বাহাদুর', 'খান সাহেব' প্রভৃতি গালভরা উপাধি দিয়ে ভূষিত করে তাদের সন্তুষ্ট রেখেছিল। এইভাবে ঊনিশ শতকে ব্রিটিশ সরকারের অনুরক্ত এক নব্য মুসলিম অভিজাত শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল। পরে এই শ্রেণীর লোকেরা যে রাজনীতি করতে শুরু করলেন সেটা ছিল নিছক আবেদন-নিবেদনের রাজনীতি (politics of petition and prayer) এইসব লোকেরা রাজনীতি করতেন নিজেদের শ্রেণীস্বার্থে। সাধারণ জনগণের রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করে তাদের অর্থনৈতিক কল্যাণ সাধন করা কিংবা তাদের মানসিক উন্নতির জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা কর্মসূচি তাদের রাজনীতিতে ছিল না। এমনকি শিক্ষাক্ষেত্রে নবাব আবদুল লতিফের মতো ব্যক্তি নেহাত জাগতিক প্রয়োজনে ইংরেজি শিক্ষার সমর্থক ছিলেন। কিন্তু সমাজ-চিন্তার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ঘোর রক্ষণশীল। তাঁরই জোর তদ্বিরে মাদ্রাসা শিক্ষার মতো পশ্চাৎমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখা হয়। আবদুল লতিফ সমকালীন মুসলমান সমাজের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারকে প্রতিহত না করে এগুলোর সঙ্গে আপোষ করতে চেয়েছিলেন।

অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলের মানুষ যারা অধিকাংশ ছিল কৃষকশ্রেণীভুক্ত, তাদের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছিল। জমিদার ও মহাজন যারা ছিল অধিকাংশই হিন্দু এবং ইংরেজ নীলকর তাদের শোষণ ও অত্যাচারে বাংলার কৃষক শ্রেণী জর্জরিত হচ্ছিল। কিন্তু এই অবস্থা থেকে তাদের মুক্তি কোন পথে আসবে সে সম্বন্ধে তাদের কোনো সচেতনতা বা পরিস্কার ধারণা ছিল না। শহরের শিক্ষিত মুসলমান অভিজাত শ্রেণী যারা ছিল অধিকাংশই উর্দুভাষী, তারা গ্রাম-বাংলার দরিদ্র অসহায় জনগণের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। দুর্দিনে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়া মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। তাই দেখতে পাওয়া যায় যে, উনিশ শতকের প্রথম দিকে বাংলার দরিদ্র মুসলমান কৃষকশ্রেণী তারা তাদের আর্থ-সামাজিক চরম দুরাবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য যে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল সেটা ছিল মূলত ধর্মীয় আন্দোলন। আঠার শতকের শেষের দিকের আরব দেশের ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে উনিশ শতকের প্রথম দিকে তিতুমীর ও হাজী শরিয়তউল্লাহ্, পশ্চিম ও পূর্ব বাংলার যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন সেটি পুরোপুরি শ্রেণী সংগ্রাম ছিল না যেমনটি কোনো কোনো মার্কসপন্থী ঐতিহাসিক বলে থাকেন। ঐসব আন্দোলন জমিদার ও মহাজনদের শোষণের বিরুদ্ধে ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু এর প্রধান উৎস ও প্রেরণা ছিল ধর্মীয়। তিতুমীর ও হাজি শরীয়তউল্লাহ্ প্রমুখ গ্রামীণ নেতা খুব শিক্ষিত না হলেও অত্যন্ত দৃঢ় চরিত্রের মানুষ ছিলেন। শিক্ষগত ও মানসিক সীমাবদ্ধতার জন্য তাঁরা সহজ-সরলভাবে বিশ্বাস করতেন যে মুসলমানদের অধঃপতনের মূল কারণ হলো তারা হযরত মুহাম্মদের যুগের আদি ইসলাম থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে এবং নিজেদের স্বাতন্ত্র্যকে হারিয়ে ফেলেছে। সুতরাং তারা বিশ্বাস করতেন যে মুসলমানদের অতীতের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে হলে তাদের সেই অতীতের জীবনযাত্রায় ফিরে যেতে হবে। (উল্লেখ্য এই অদ্ভূত অবাস্তব ধারণা বর্তমান আমলের কতিপয় ধর্মান্ধ মৌলবাদী মুসলিম গোষ্ঠী যারা জঙ্গীবাদ লালন করে, তারা এই মতবাদ পোষণ করে থাকে।) সুদূর অতীতের বিধান দিয়ে বর্তমান আধুনিক যুগের জটিল সমস্যাগুলি যে সমাধান করা যায় না– এ সত্য তারা উপলব্ধি করতে পারেননি। ফলে তাঁদের আন্দোলন ব্যর্থ অভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছিল।

উনিশ শতকে বাংলার হিন্দু ও মুসলমান– এই দুই সম্প্রদায়ের সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাস তুলনামূলকভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, হিন্দু সমাজে রামমোহন রায় থেকে শুরু করে অক্ষয় কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও স্বামী বিবেকানন্দ পর্যন্ত নেতারা হিন্দু সামাজের চিরন্তন কুসংস্কারাদি দূর করে হিন্দু সমাজকে সমকালীন যুগের প্রয়োজনে পুনর্গঠনের প্রয়াস করেছেন এবং তাদের আন্দোলনের ঢেউ শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। হিন্দু সমাজে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষের সঙ্গে শিক্ষা, সমাজ ও সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘনিষ্টভাবে জড়িয়ে ছিল।

তুলনামূলকভাবে মুসলমান সমাজের অবস্থা ছিল অন্যরূপ। মুসলমান সমাজের নেতারা ছিলেন অধিকাংশই নগরবাসী এবং নিজেদের বহিরাগত মুসলমানদের বংশধর বলে গর্ব করতেন। তাঁরা নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দিতে ঘৃণা বোধ করতেন, এমনকি নিজেদের পরিবারে উর্দুভাষায় কথা বলতেন এবং বাংলা ভাষাকে নিুশ্রেণীর ভাষা বলে অবজ্ঞা করতেন। এই শ্রেণীর নেতাদের সঙ্গে গ্রাম-বাংলার জনসাধারণের কোনো আত্মিক যোগাযোগ ছিল না। এ ধরনের নেতৃবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় উত্তর ভারত থেকে আগত বিশেষ করে জৌনপুরের মৌলানা কেরামত আলির অনুসারীরা বাংলার গ্রামে গ্রামে পরিভ্রমণ করে ইসলাম প্রচার করতে শুরু করেন। তাঁরা এ দেশের অমুসলমান বা হিন্দুদের ব্যাপকভাবে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতে পারেননি। কিন্তু তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল উনিশ শতকের প্রথম দিকে তিতুমীর ও হাজী শরীয়তউল্লাহ্ যে ধর্মীয় আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন তার সূত্র ধরে এ দেশের বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক ও সাংষ্কৃতিক জীবনকে আদি বা পৌরাণিক মূল ইসলামের অর্থাৎ শরীয়াত-এর বিধান অনুযায়ী পুনর্বিন্যাস করা। তাঁদের এই আন্দোলন উনিশ শতকের শেষের দিকে ব্যাপকতা লাভ করে কিছু সংখ্যক বাঙালি মৌলবি যেমন, মৌলভি জমিরুদ্দিন ও মুন্সি মেহেরুল্লাহ প্রমুখ ধর্ম-প্রচারকের প্রভাবে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাংলার অধিকাংশ মুসলমান ধর্মপ্রাণ হলেও তারা কখনো ধর্মান্ধ ছিল না। এ দেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, রক্ষণশীল ও মৌলবাদী ধর্মান্ধ মোল্লা-মৌলবিদের প্রচারণার চেয়ে উদারমনা সুফী সাধক, পীর-দরবেশ, ফকির-আউলিয়াদের অবদান এ দেশে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে অধিকতর কার্যকর হয়েছে। এইসব মরমী সাধক ধর্মক্ষেত্রে যে ঐতিহ্যের সূত্রপাত করেছিলেন সেটা ছিল আধ্যাত্মিক মানবতাবাদের ঐতিহ্য, পরমতসহিষ্ণুতার ঐহিত্য, যেটা গোটা বাঙালি জাতির মন ও মানসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। যুগ যুগ ধরে পাশাপাশি বাস করার ফলে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ, হিন্দু ও মুসলমান এক সৌহার্দ্যপূর্ণ সহ-অবস্থানের মধ্যে বাস করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। ধর্মীয় পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার দিক দিয়ে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক স্থাপনের ফলে এই অঞ্চলে এক দেশজ সমন্বয়ধর্মী বাঙালি সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটেছিল। কিন্তু উনিশ শতকের শেষের দিকে কতিপয় বলা যেতে পারে অর্ধ-শিক্ষিত ধর্মান্ধ মোল্লা-মৌলবিরা ব্রিটিশ রাজ ও রক্ষণশীল মুসলিম নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে জোরেশোরে যে ইসলামীকরণের আন্দোলন শুরু করলেন তার ফলে সেই সমন্বয়ধর্মী লোকজ বাঙালি সংস্কৃতিতে ভাঙ্গন ধরল। শুরু হলো এক নেতিবাচক আন্দোলন; সংস্কৃতি বর্জনের পালা। মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য হিন্দুদের যা কিছু সব বর্জন করতে হবে, এই ছিল কট্টর মোল্লাদের নির্দেশ। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে উর্দুভাষার প্রচলনের চেষ্টা শুরু হলো। বাঙালি মোল্লা-মৌলবিরা উর্দু ভাষায় মিলাদ পাঠ করা শুরু করলেন। বাংলা ভাষায় যথেচ্ছভাবে উর্দু শব্দ আমদানী করে এক স্বতন্ত্র 'মুসলমানি বাংলা' চালু করার চেষ্টা করা হলো এবং এই অদ্ভুত ভাষায় অসংখ্য নিম্নমানের পুঁথি রচিত হতে লাগল। এই প্রক্রিয়া নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখ রক্ষণশীল এবং ইংরেজ সরকারের একান্ত অনুগত মুসলিম অভিজাত শ্রেণীর অনুকূলে ছিল কারণ উর্দুভাষার মাধ্যমে এই শ্রেণীর নেতৃবৃন্দের বাংলার মুসলমানদের উপর তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এই সব উর্দুভাষী ব্যক্তি বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে ব্রিটিশ সরকার ও জনসাধারণের কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ ঢাকার নবাব পরিবারের কয়েক জনের নাম উল্লেখ করা যায়, যেমন, নবাব সলিমুল্লাহ থেকে শুরু করে খাজা নাজিমুদ্দীন। উল্লেখ্য, এই উর্দুভাষী খাজা নাজিমুদ্দীনই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তানের পূর্ব বাংলা প্রদেশের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করার জন্য জিন্নাহর অযৌক্তিক দাবির অন্ধ সমর্থক ছিলেন।

এইভাবে আমরা দেখতে পাই যে, উনিশ শতকে হিন্দুরা যখন তাদের সমাজ সচেতন, বাস্তবমুখী ও জ্ঞানদীপ্ত নেতৃবৃন্দের অনুপ্রেরণা ও প্রচেষ্টার ফলে সবক্ষেত্রে অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সে সময় বাঙালি মুসলমানদের নেতৃত্বে দেখা দিয়েছিল চরম সঙ্কট। বলা যেতে পারে মুসলমানদের দৃষ্টি সামনের দিকে প্রসারিত না হয়ে ছিল পশ্চাৎমুখী। তারা ছিল গৌরবোজ্জ্বল অতীতের স্বপ্নে বিভোর। ১৮৮২ সালে স্যার উইলিয়াম হান্টারের নেতৃত্বে ব্রিটিশ ভারত সরকার এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পর্যালোচনা করার জন্য যে কমিশন গঠন করে সেই কমিশন শিক্ষা ক্ষেত্রে মুসলমানদের অনগ্রসরতার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে মন্তব্য করে যে, আধুনিক চিন্তাধারার সঙ্গে আপোষ করতে ব্যর্থতাই হলো মূল কারণ। কমিশনের ভাষায়, 'Their failure to come to terms with modern thought.'

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যখন নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখ বাংলার মুসলমান নেতা অনেক দেরীতে হলেও ইংরেজি ও আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের পক্ষে প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন, তার মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে সংঘবদ্ধ উদ্যোগ বা সুগভীর তাগাদা ছিল না। তা ছাড়া যেমন আগে উল্লেখ করা হয়েছে, আবদুল লতিফের চিন্তাধারার মধ্যে অনেক স্ববিরোধিতা ছিল। তিনি ইংরেজি শিক্ষার সমর্থক ছিলেন নেহাত জাগতিক বা বাস্তব কারণে। তিনি মনে করতেন যে, ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করলে মুসলমানরা ইংরেজ সরকারের অধীনে চাকুরি ও অন্যান্য সুবিধা পেতে পারে। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের আধুনিক যুক্তিনিষ্ঠ ও উদারনৈতিক ভাবধারা এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি এ দেশের মুসলমানদের প্রভাবিত করুক, এটা তিনি চাননি। আবার একদিকে আবদুল লতিফ যেমন ইংরেজি শিক্ষার সমর্থক ছিলেন, অন্যদিকে, তিনি প্রাচীন আমলের ধর্মভিত্তিক মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা তুলে দেওয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন। উল্লেখ্য যে, আবদুল লতিফের সমকালীন বাংলার অন্য দুই মুসলমান নেতা যাঁরা ছিলেন আবদুল লতিফের চেয়ে অধিক শিক্ষিত এবং যাদের চিন্তাধারা ছিল অনেক আধুনিক ও প্রগতিশীল, যেমন সৈয়দ আমির আলি ও দেলোয়ার হোসেন আহমদ, তাঁরা কিন্তু যুগের প্রয়োজনে মাদ্রাসাগুলি তুলে দিয়ে সেগুলির স্থানে ইংরেজি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা প্রবর্তন করার সুপারিশ করেছিলেন। ১৮৮২ সালে বিলেত থেকে প্রকাশিত The Nineteenth Century পত্রিকায় আমির আলি দেশীয় ও প্রাচ্য ভাষায় পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ তুলে দিয়ে সেগুলির স্থলে মুসলমানদের ইংরেজি ও কারিগরি শিক্ষা প্রদানের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন। আমির আলির ভাষায়: 'It was unwise of the government to maintain institutions for imparting purely oriental education, as this fosters in the people old ideas of exclusiveness which are inconsistent with the exigencies of British rule.'6 প্রায় ঠিক একই সময়ে দেলোয়ার হোসেনও মাদ্রাসাগুলি তুলে দিয়ে কলকাতায় এবং অন্যান্য শহরে মুসলমানদের জন্য নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন যেখানে ইংরেজি ভাষা ও অন্যান্য আধুনিক বিষয় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হবে। দেলোয়ার হোসেন মনে করতেন যে, মাদ্রাসাগুলিতে যে ধরনের শিক্ষা দেওয়া হতো সেটা তাঁর ভাষায়, "utterly unsuited to the times and it is a mere waste of means to supply people with what has no present value and will be of no future use."7 কিন্তু সেকালের মুসলমান সমাজ ছিল ঘোর রক্ষণশীল। মাদ্রাসা তুলে দেওয়ার কোনো প্রস্তাব রক্ষণশীল মুসলমান সমাজের কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। ইংরেজ সরকারও রক্ষণশীল মুসলিম জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে চায়নি। স্মর্তব্য যে, ১৮৩৫ সালে বড়লাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক-এর নয়া শিক্ষানীতি ঘোষণা করতে গিয়ে তাঁর উপদেষ্টা কাউন্সিলের আইন সদস্য মেকলে (পরবর্তীকালে লর্ড) কলকাতা মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে কলকাতার মুসলমানদের পক্ষে আট হাজারেরও বেশি স্বাক্ষরযুক্ত একটি দরখাস্ত গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক-এর নিকট পেশ করা হয়। ঐ দরখাস্তে ইংরেজ সরকারকে সতর্ক করে দেওয়া হয় যেন সরকার তার নিজের স্থিতিশীলতার স্বার্থে মাদ্রাসাকে তুলে দেওয়া থেকে বিরত থাকে।৮ বেন্টিংক সরকার রক্ষণশীল মুসলমানদের এই মনোভাবকে বিশেষ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে মাদ্রাসা তুলে দেওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। এর প্রায় চার দশক পর যখন মুসলিম সমাজের দুইজন প্রগতিশীল নেতা সৈয়দ আমির আলি ও দেলোয়ার হোসেন আহমেদ মাদ্রাসা তুলে দিয়ে তার জায়গায় ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করার প্রস্তাব করেছিলেন তখন রক্ষণশীল মুসলিম সমাজের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা নবাব আবদুল লতিফ এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। ইংরেজ সরকার স্বাভাবিক কারণে আবদুল লতিফের মতামতকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। বস্তুতঃ আবদুল লতিফের দাবী এবং বলা যেতে পারে জেদ অনুযায়ী আমাদের দেশে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি পুরাতন মধ্যযুগীয় ধর্মভিত্তিক মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা সমান্তরালভাবে চালু রাখা হয় যা এখন পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে। এই দ্বিমুখী শিক্ষাব্যবস্থার ফলে মুসলিম মানসভূবনে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়ে থাকে তার প্রতিফলন দেখা যায় আমাদের সমাজ রাজনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তায়। আমার মনে হয়, এখানেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মূল সীমাবদ্ধতা বা দুর্বলতা। একজন মক্তব-মাদ্রাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত ছাত্র/ছাত্রীর মন ও মানসিকতার সঙ্গে একজন আধুনিক স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীর মন ও মাসনিকতার সাদৃশ্য থাকবে কী করে? এই প্রবাহমান দ্বন্দ¡ আমাদের সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা যায়। এর থেকে উদ্ভূত বিভ্রান্তি ও জটিলতার কারণে আমাদের দেশের সার্বিক উন্নতি দারুণভাবে ব্যাহত হয়েছে এবং হচ্ছে।

এটা সত্যি বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, বিগত প্রায় দেড়শ বছর আমাদের দেশে দুটি সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থা, একটি আধুনিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ বা সাধারণ, আর দ্বিতীয়টি পুরাতন ঐতিহ্যিক ধর্মভিত্তিক মাদ্রাসাব্যবস্থা, কোনো মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া এখনো টিকে আছে বা একে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। ১৮৮২ সালের ইন্ডিয়ান এডুকেশন কমিশন, ১৯০৪ সালের লর্ড কার্জনের সংস্কার, ১৯১৯ সালের স্যাডলার কমিশন, ১৯৫৯ সালের শরীফ কমিশন, ১৯৭৪ সালের কুদরত-ই-খুদা কমিশন, ১৯৮৭ সালের মফিজুদ্দিন আহমেদ কমিশন এবং পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালের মুহম্মদ আদুল বারীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি এবং ১৯৯৭ সালের ড. শাসুল হকের নেতৃত্বে শিক্ষা কমিটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রস্তাব পেশ করেছিল যেগুলির কিছু কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এনে একে আধুনিক, সাধারণ এবং যুগোপযোগী পর্যায়ে উন্নীত করার ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। বর্তমান নতুন আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক গঠিত কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশনও এ ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনোরকম পরিবর্তন আনতে পারবে বলে মনে হয় না।

তবে এর জন্য কোনো সরকারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কোনো বড় রকমের সংস্কার বা আমূল পরিবর্তন জনগণের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না; বিশেষ করে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা যার সঙ্গে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি জড়িয়ে আছে সেই ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হলে এর সপক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন প্রয়োজন। দেশের প্রজ্ঞাবান, জ্ঞানদীপ্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর উদ্যোগ এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সৎ, উচ্চশিক্ষিত উদারমনা রাজনৈতিক নেতৃত্বের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ছাড়া এ ধরনের বৈপ্লবিক সংস্কারের সপক্ষে জনমত গঠন করা সম্ভব নয়।

আজ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশে ইসলামি জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাস যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে যার ফলে গোটা বিশ্বসভ্যতা ভয়াবহ হুমকীর সম্মুখীন, সেই জঙ্গীবাদের উৎস খুঁজতে গেলে দেখা যাবে যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাদ্রাসায় শিক্ষিত বিপথগামী যুবকরাই এই মারাত্মক বিকৃত মানসিক ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো মাদ্রাসাগুলিতে যে ধরনের শিক্ষা প্রদান করা হয় সেটা বর্তমান যুগের চাহিদা মিটাতে একেবারেই অনুপোযুক্ত ও অক্ষম। মাদ্রাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত যুবকরা যখন দেখে যে, বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রে তারা সম্মানজনক স্থান পায় না তখন তাদের মনে সৃষ্টি হয় হতাশা ও ক্ষোভ। যে সমাজ ও রাষ্ট্রে তারা কোনো সম্মাজনক স্থান পায় না তখন তারা সেই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোকেই উৎখাত বা ধ্বংস করতে চায়। মাদ্রাসার ধর্মীয় শিক্ষার প্রভাবে তাদের মধ্যে এই স্থির বিশ্বাস জন্মায় যে পৌরাণিক যুগের ইসলামি হুকুমত কায়েম করতে পারলেই তারা নিজেদের সম্মানিত অবস্থানে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে। এই অদ্ভুত ও অবাস্তব মানসিকতা বা syndrome হলো ইসলামি মৌলবাদী জঙ্গীবাদের মূল উৎস বা চালিকা শক্তি।

এই ভয়ানক ব্যাধি থেকে সমাজকে মুক্ত করতে হলে আশু প্রয়োজন বর্তমান যুগের চাহিদা অনুযায়ী আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। আমার সবসময় মনে হয়, কুশিক্ষা অশিক্ষার চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতিকর। আমরা এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা চাই যা মানুষের সৃজনশীল প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করবে, মানুষকে পূর্ণাঙ্গ মানুষে (complete man) পরিণত করতে সক্ষম হবে। একমাত্র আধুনিক উন্নত মানের বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে সেটা সম্ভব। কিন্তু তার জন্য জনগণের মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন। এ সম্পর্কে সচেতনতা জাগ্রত করার দায়িত্ব বিশেষ করে দেশের আলোকিত বা জ্ঞানদীপ্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর লোকদের। তাঁরা যদি বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান না করে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জনগণের প্রতি মমত্ববোধ প্রকাশ করে তাঁদের চারিত্রিক গুণাবলী ও জনহিতকর কর্মকাণ্ডের দ্বারা জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম হন, তাহলেই এই দুরূহ কাজটি করা সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস।

গ্রন্থপঞ্জী
N. N. Law, Promotions of Learning during Muhammadam Rule, London, 1916.
A. R. Mallick, British Policy and Muslims in Bengal, 1757-1858, Dhaka, 1961.
M. A. Khan, History of the Faraidi Movement in Bengal, 1818-1906, Karachi, 1965.
Willium Adam, Report on the State of Education in Bengal, 1835, 1837, 1838, Calcutta.
Report of the Indian Education Commission 1882 (হান্টার কমিশন রিপোর্ট), Calcutta, 1883.
H. Sharp (ed.), Selection from Educational Records, Calcutta, 1920.
Report on the Commission on National Education (শরীফ কমিশন রিপোর্ট), Karachi, 1959.
Report of the Bangladesh Educations Commission (ড. কুদরৎ-ই-খুদা কমিশন রিপোর্ট), Dhaka, 1974.
Nurullah and J. P. Naik, History of Education in India, during the British Period, Bombay, 1943.
A. F. Salahuddin Ahmed, Social Ideas and Social Change in Bengal, 1818-1235, Leiden, 1965.
_____, Bangladesh: Tradition and Transformation, Dhaka, 1987.
Rafiuddin Ahmed, The Bengal Muslims 1871-1909: A Quest for Identity, Oxford, 1981.
W. W. Hunter, The Indian Musalmans, London, 1971.
Enamul Haque (ed.), Nawab Bahadur Abdul Latif: His Writings and Related Documents, Dhaka, 1968.
M. Mohor Ali (ed.), Autobiography and Other Writings of Nawab Abdul Latif Khan Bahadur, Chittagong, 1968.
K. K. Aziz (ed.), Ameer Ali: His Life and Work, Lahore 1968.
Sultan Jahan Salim (ed.), Muslim Modernism in Bengal: Selected Writings of Delawar Hossain Ahmad Meerza 1840-1913, Dhaka, 1980.
Sufia Ahmed, The Muslim Community in Bengal 1884-1912, Dhaka, 1974.
Abdul Karim, A Social History of the Muslim of Bengal down to 1538 A.D., Dhaka, 1959.
M. A. Rahim, Social and Cultutral History of Bengal 2 vol. Karachi, 1963-67.
M. Shamsul Huq, Changing Education in England, Dhaka, 1948.
_____, Compulsory Education in Pakistan, UNESCO, Paris 1954.
_____, Education Manpower and Development in South and South-East Asia, New Delhi, 1976.
_____, Bangladesh in International Politics: The Dilemmas of the Weak States, New Delhi, 1993.
Muhammad Shamsul Huq and Chowdhury Rafiqul Huq, Aid Development and Diplomacy: Need for an Aid Policy, Dhaka, 1999

কাজী আবদুল ওদুদ, শাশ্বত বঙ্গ, কলকাতা ১৯৫১।
কাজী আবদুল মান্নান, আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা, রাজশাহী ১৯৬১।
আনিসুজ্জামান, মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, ঢাকা ১৯৬৪।
আনিসুজ্জামান (সম্পাদিত), মুসলিম বাংলা সাময়িক পত্র, ঢাকা ১৯৬৯।
মুহাম্মদ এনামুল হক, বঙ্গে সুফী প্রভাব, কলকাতা, ১৯৩৫।
—-, মুসলিম বাংলা সাহিত, ঢাকা, ১৯৫৭।
মুস্তফা নূর উল ইসলাম, মুসলিম বাংলা সাহিত্য, ঢাকা ,১৯৬৮।
মুস্তফা নূর উল ইসলাম (সম্পাদিত), আমাদের মাতৃভাষা চেতনা ও ভাষা আন্দোলন, ঢাকা, ১৯৮৪।
মুহাম্মদ শামস উল হক, বিকাশমান সমাজ ও শিক্ষা, ঢাকা, ১৯৮৭।
—-, বিশ্ব রাজনীতি ও বাংলাদেশ, ঢাকা, ২০০১।
শিক্ষা প্রকল্পন ও উন্নয়ন গবেষণা ফাউন্ডেশন (ফ্রেপড)-এ অনুষ্ঠিত বার্ষিক সাধারণ সভায় ফ্রেপড-এর প্রেসিডেন্ট জাতীয় অধ্যাপক মুহম্মদ শামসউল হকের প্রদত্ত ভাষণসমূহ, ঢাকা, ২০০২।
শিক্ষা প্রকল্পন ও উন্নয়ন গবেষণা ফাউন্ডেশন (ফ্রেপড) বাংলাদেশ: পরিচয় পত্র, ঢাকা, ২০১০।
জাতীয় অধ্যাপক মুহমাম্মদ শামসউল হক সংবর্ধনা গ্রন্থ, ঢাকা, ২০০৩।
(শিক্ষা প্রকল্প গবেষণা ফাউন্ডেশন (FREPD) আয়োজিত জাতীয় অধ্যাপক মুহম্মদ শামসউল হক স্মারক বক্তৃতায় এই প্রবন্ধটি পাঠ করা হয়েছিলো।)