পথে, প্রদেশে (পর্ব ১)

মাসুদ খানমাসুদ খান
Published : 16 May 2008, 05:18 AM
Updated : 16 May 2008, 05:18 AM

বাংলা প্রাণের দেশ, বাংলা গানের দেশ, মায়া ও প্রেমের দেশ, বাংলা যেন এক জাদুবাস্তবের দেশ…

যে দেশে উজান বেয়ে চলে, প্রেমে, ভাটির ভাসান
স্রেফ ভালোবাসাবাসি দিয়ে যেইদেশে বহু মুশকিল আসান!
যে দেশে সুজন দেখে করলে প্রেম, মরলেও বাঁচাতে পারে তারে
সত্যি-সত্যিই, এবং বারে বারে!

অরূপ রূপের সেই দেশে উড়ে চলো মন
ঘুরে ঘুরে বেড়াই এ-মনপবনের জাদু-উড়াননৌকায়
দূর-দূরান্তের নানা জেলায় জেলায়…

অরূপ রূপের সেই দেশের ছোট্ট একটি জাদুবাস্তব শহর বগুড়া — যেখানে কেবলই মিলে-মিলে যায় রোদ ও কুয়াশা, মিলে-মিলে যেতে চায় স্বপ্ন ও বাস্তব। একাকার হতে চায় প্রাপ্তি আর বাসনা…সম্ভব-অসম্ভবের দোলাচলে টালমাটাল দাঁড়িয়ে থাকে বগুড়ার ল্যান্ডস্কেপ, এর পথঘাট, বাহন-বিপণী, আড়ত-ইমারত! এখানকার মানুষ ও কবিকুল হাঁটেন স্বপ্নসম্ভব পথে। ঘুরে বেড়ান কুয়াশাসম্ভব মাঠে ও প্রান্তরে! অবাক-করা এক শহর! বেশ কিছুকাল আমিও ছিলাম সেই স্বপ্নশহরে। এক অর্থে বগুড়া আমারও শহর…আসলে প্রত্যেকেরই থাকে একটি করে শহর, মনের মতো, স্বপ্নময় শহর — যেখানে উপশহরের আধো-আলো-আঁধারি-জড়ানো কোনো বিষাদমাখা বারান্দা থেকে দেখতে পাওয়া যায় শহরের কোনো নার্সিং হোমের শুশ্রুষাময় আলো…।

সেই স্বপ্নশহরে আমার, আমাদের যাপন ও উদ্যাপনের আলো-আঁধার দিয়ে রচিত এই সন্ধ্যাভাষ্য।

* * *

জিন্সের প্যান্ট। নীল টি-শার্ট। শার্টের পিছনে লেখা 'অ্যান্ড মাইল্‌স টু গো বিফোর আই স্লিপ…অ্যান্ড মাইলস্ টু গো বিফোর আই স্লিপ…'। শার্টে কুয়াশা। নীলচে-নীলচে। প্যান্টে কুয়াশা। কাঁধ বেয়ে নেমে আসা লম্বা-লম্বা চুল। চুলেও কুয়াশা। এই হালকা-হালকা শীতের গোধূলিবেলায় ধীরপায়ে হেঁটে চলেছে ওই যে এক কিশোর কবি। নিরুদ্দেশ পথিকের মতো। নির্জন গোহাইল রোড ধরে হেঁটে যাচ্ছে দক্ষিণে। ঘুমিয়ে পড়বার আগ-পর্যন্ত কবিকে পেরুতে হবে মাইল-মাইল পথ। কবি বায়েজিদ মাহবুব। মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকি তার ওই মাথানিচু হেঁটে যাওয়া, অনেকদূর পর্যন্ত। একসময় আস্তে-আস্তে মিলিয়ে যান কবি আরো অধিক কুয়াশার ভেতর।

এক বিখ্যাত তরুণ, বজলুল করিম বাহার, কবি, চিরসবুজের চিরবসন্তের দেশ থেকে আসা অজর অক্ষর ঝলমলে বসন্তবাহার! রাগ মিয়া-কি-মল্লার, রাগ অনন্ত-ভাটিয়ার…পা-থেকে-মাথা-পর্যন্ত কবি, নখ-থেকে-লিঙ্গ-পর্যন্ত কবি — বিস্ময়কর এক তরুণ…মানুষের চোখেমুখে যে এত আলো ও বিজলিচমকানি থাকে, থাকতে পারে…মানুষ যে কখনো কখনো এতটা শিশু আর এতটা কবি হয়ে ওঠে, উঠতে পারে — আমরা দেখিনি কখনো…আর তার সেই বিখ্যাত শৈশববোধ — শৈশবে, জ্যোৎস্নারাতে, দূর ভুটানের পাহাড় থেকে স্বপ্নের মতো নেমে আসত সব নীলগাই। নেমে আসত বাঘ, বাঘদাস (ডিম পাড়ে হাঁসে/ খায় বাঘদাসে) আর ভুটান মুলুকের ভুটিয়ারা। দলে দলে। এই ধানজুড়ি, এই কইগাড়ি, এই বৃন্দাবনপাড়া, এই দত্তবাড়ি, এই নামাজগড়, মালতিনগর…আর আমরা সত্যি-সত্যি একদিন দেখলাম, ম্যান্ডোলিন-এর দোতলায় দাঁড়িয়ে, লাফিয়ে ওঠার ভঙ্গিতে একদম ফ্রিজ করে দেওয়া সেই তীরবিদ্ধ পাথরিত ঘোড়ার পায়ের নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, বাহার, ফখরুল-পাগলা, শিবলী, আদিত্য, পাগলা-রাইসু আর আমি…(আমি আর আমার বউ তখন কবি ব্রাত্য রাইসুকে প্রীতিবশত কখনো পাগলা-রাইসু কখনো রাইসু-পাগলা বলতাম, সামনে নয় আড়ালে! আর ফখরুলকে তো পাড়াসুদ্ধ সবাই পাগলা কবিই বলত! তো সেই সময় কবি সাজ্জাদ শরিফ, রাজু আলাউদ্দিন, ব্রাত্য রাইসু, আদিত্য কবির এঁরা ক-দিনের জন্য বেড়াতে এসেছিল আমাদের সেই বৃন্দাবনের বাড়িতে, আদিত্য তো এসেছিল সারাপথ নাঙ্গা পায়ে, গিয়েছিলও তাই) তো আমরা সত্যি-সত্যিই দেখলাম, রাত দশটা বাজতে না বাজতেই উডবার্ন লাইব্রেরির পার্ক থেকে বেরিয়ে গোহাইল রোড ধরে আসছে চকচকে সব ডোরাকাটা বাঘ, সাতমাথার দিকে। একটা, দুইটা, তারও পরে আরো একটা, হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে। আর পেছনে পেছনে সত্যিই একটা বাঘদাস, একটা নয় ঠিক, দুইটা। সাতমাথার সেই ছোট্ট গোল আইল্যান্ডে দাঁড়িয়ে এক বেরসিক ট্রফিক পুলিশ তার নির্বিকার হাতের সংকেতে থামিয়ে দিচ্ছে তাদের। আর বাঘ ও বাঘদাসগুলোও সব কেমন লাইন ধরে দাঁড়িয়ে পড়ছে সুশীল বালকের মতো। অবাক কাণ্ড!

সপ্তপদী। কেউ বলে, সাতমাথা। সাতটা পথ এসে মিশেছে এখানে। ছোট্ট গোল ট্রফিক আইল্যান্ড। ফুলছড়ি ঘাট থেকে ট্রেন এসে থেমেছে বগুড়া স্টেশনে। যাত্রীরা আসছে খরগোশের মতো ব্যস্তসমস্ত হয়ে রিকশায়, পায়ে হেঁটে…। শহরের বাসগুলো ট্রাকগুলো সারাদিন কোথায়-কোথায় দৌঁড়ে বেড়িয়েছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। এখন সব বাড়ি ফিরছে নিরীহ কিশোরের মতো নানা দিক থেকে, নানা দেশ থেকে। সাতমাথা আর রেলস্টেশনের মাঝামাঝি জায়গাটায় তাদের আস্তানা। বাহার ভাই বলছেন, অনেকটা প্রফেটিক ভঙ্গিতে, দেখবেন, বাঘগুলা যেই সাতমাথা পার হয়ে এদিকটায় আসবে, অমনি বদলে গিয়ে হয়ে যাবে একেকটা নতুন-নতুন ট্রাক। দেখবেন তা-ই হবে। আর কী অবাক কাণ্ড! সত্যি-সত্যি শহরের এই নতুন অংশের দিকে আসতে আসতে রূপান্তর হচ্ছে বাঘদের! বাঘের চোখ দুটো বদলে যাচ্ছে একজোড়া জ্বলজ্বলে হেডলাইটে। ধেয়ে চলা পা-চারটি ওই যে আস্তে-আস্তে গোলাকার হয়ে বদলে যাচ্ছে চাকায়! হুঙ্কার রূপান্তরিত হচ্ছে হর্নের আওয়াজে। আর বাঘের ডোরাকাটা তেলচকচকে শরীর হয়ে যাচ্ছে ট্রাকের পেইন্ট-করা স্ট্রাইপ-অলা চকচকে বডি। শহরের এই নতুন অংশের চোখধাঁধানো আলো পিছলে পড়ছে বডি থেকে।

আজ রাতে বাহার ভাই যা-যা বলছেন, ঠিক তা-ই তা-ই হচ্ছে। নেকড়েমতো একটা প্রাণী, লম্বামুখো, হুসহুস করে ছুটে আসছে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে, শেরপুর রোড ধরে। সাতমাথার ওই গোলচত্বর পার হয়ে এসেই হয়ে যাচ্ছে টেম্পো। হুড়ুৎ করে দ্রুত বাঁক নিয়ে চলে যাচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দিকে, নিজস্ব ডেরায়।

আপনি যদি কখনো বগুড়ায় আসেন, দেখবেন, এখানে এরকমই হয়।

চম্পক। গার্ডেন রেস্তোরাঁ। আলোজ্বলা গোল-গোল ছাতার নিচে গোল-গোল টেবিল। নানান বাহারি গাছ। ফুলগাছ। শহরের সব আলো নিভে যাবার পর সেখানে আপন তেজেই আলোকিত হয়ে থাকে উদ্ভিদগুলো। আজ তারা সেজেছে খুব করে। খোঁপা করেছে, নানা রকমের বাহারি খোঁপা-টপনট, পনি টেইল…কানে পরেছে দুল, ঝুমকা, রূপলঙ্কা…।

সপ্তপদী থেকে আকবরিয়া মার্কেট, সারাক্ষণ উৎসব-উৎসব আমেজ। রাস্তার দুধারে ভিখারি বণিতা কবি প্রেমিক উন্মাদ ফলবিক্রেতা ওষুধবিক্রেতা গন্ধবণিক রেস্তোরাঁ প্রেক্ষাগৃহ, হরেক রঙের প্রথা, রিচুয়াল, নানান যজ্ঞ লেগেই আছে। মহাধুমধাম।

একজন লোক। খুবসম্ভব কোনো ওষুধ কোম্পানির সেল্স্ রিপ্রেজেনটেটিভ। নতুন এসেছেন এ শহরে। হয়তো দূরের কোনো শহর থেকে। হাতে ব্যাগ। সন্ধ্যার পর শ্যামলী-তে আহার সেরে বাইরে এসে আরাম করে পান চিবাচ্ছেন। তাম্বুলরসে রঞ্জিত তার মন ও মুখ। চোখেমুখে ফুর্তি-ফুর্তি ভাব। লম্বা জাহাজের মতো এক সিনেমা হল। উত্তরা হল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী বালকের মতো সিনেমার বড় বড় পোস্টার দেখছেন। দেখছেন তাকিয়ে তাকিয়ে চারদিক। হাসি-হাসি মুখ। যেন সর্ব-অঙ্গ দিয়ে বোধ করছেন পুলক ও পবিত্রতা। আমাদের শিবলী, কবি শিবলী মোকতাদির, হঠাৎ কোত্থেকে এসে জানা-নাই-শোনা-নাই আচমকা কী-কী যেন বলছে লোকটাকে, মিটিমিটি হেসে হেসে — জানেন, জানেন, খবর শুনছেন, নানান দেশ থেকে, গাইবান্ধা সিলেট রংপুর রাজশাহী বগুড়া বাঁকুড়া ব্রেমেন বাস্তিল বীরভূম থেকে সব কবি-সাহিত্যিকরা আইসা বলা-নাই-কওয়া-নাই পথিকের বাসায় উঠতেছে। আরে পথিক মানে…চিনলেন না! ওই যে, কামরুল হুদা পথিক, গল্পকার পথিক, গল্পকার চিনলেন না? গল্প করে যে…গল্পকার…উপপদ তৎপুরুষ, আরে তৎপুরুষ বুঝলেন না? তাহার পুরুষ…তৎপুরুষ, ষষ্ঠী তৎপুরুষ… যাঃ শালার তৎপুরুষ তো দেখতেছি নিজেই এক তৎপুরুষ সমাস! আসলে কী জানেন, বাংলা এক আজব ভাষা, এক মজার ভাষা…এই ধরেন সমাস, ধরেন-ধরেন, ধরেন না! …ধরছেন তো! 'দুই গু-য়ের সমাহার'…বলেন তো কী? আহ্হা! পারলেন না…(আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে বাজিয়ে গুনগুন করে গাইতে থাকে) 'উল্লুকেরও থাকিতে নয়ন…' এটুকু গাওয়ামাত্র লোকটা বেশ ঘাবড়ে যায়, ভাবে, তাকেই বোধহয় উল্লুক বলছে…তো শিবলী গাইতে গাইতেই ইশারায় লোকটাকে আশ্বস্ত করে, বলে, 'না-না আপনাকে না, এটা তো গান, এমনি-এমনিই গাই আর কি!' বলেই ফের শুরু করে দেয় — "উল্লুকেরও থাকিতে নয়ন/ না দ্যাখে সে রবিরও কিরণ/ কী কবো দুঃখেরো কথা… সে-জন ভাব জানে না-হা/ সে-জন মানিক চেনে না/ যে-জন প্রেমের ভাব জানে না, তার সাথে নাই লেনা-দেনা/ খাঁটি সোনা ছাড়িয়া যে নেয় নকল সোনা, সে-জন সোনা চেনে না// ' এতখানি গাইবার পরও তার ওপর লোকটার পুরাপুরি একিন আসে নাই দেখে শিবলী আরেকটা গান শুরু করে — "তোর নামের ভরসা ক'রে তরী দিলাম ছেড়ে…/ একবার হাইল ধরিয়া বইসো গুরু ভাঙা তরীর 'পরে রে/ অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে…" তো, দুই গু-য়ের সমাহার…দ্বিগু…আচ্ছা দ্যাখেন তো কী কীর্তি! দ্বিগু নিজেই দ্বিগু সমাস… হাঃ হাঃ হাঃ কী তামশা!…আবার দ্যাখেন, কর্মধারয়…ব্যাসবাক্য কী?… কর্ম যে ধারয়… কর্মধারয়… (ঠিক হইতেছে তো!)… হাহ্, কর্মধারয় নিজেই এক কর্মধারয়… আবার ধরেন বহুব্রীহি…বহু ব্রীহি আছে যাহার…নিজেই বহুব্রীহি সমাস…! আবার দ্যাখেন, অব্যয়-অব্যয় ভাব…অব্যয়ীভাব! আর যেন কী আছে? তৎপুরুষ। ও হো…তৎপুরুষ তো আগেই বললাম। তো দেখলেন তো, কী তামশা! সব ফকফকা! আর যেন কী! ও, দ্বন্দ্ব…দ্বন্দ্ব সমাস…এইবার দ্বন্দ্বে এসে পড়লাম তো বেশ ধন্দে! "মোরে কূলে রাইখা বারেবার/ না যাইও গাঙ্গেতে আর// সাথে সাথে নিয়ো তুমি নৌকাতে/ নাও বাইয়ো না মাঝি বিষম দইরাতে// কলোকলো ছলোছলো নদী করে টলোমলো/ ঢেউ ভাঙে ঝড়-তুফানে রে…/ নাও বাইয়ো না মাঝি বিষম দইরাতে//" তো যা বলতেছিলাম, সেই পথিক, গল্পকার পথিক, লিটল ম্যাগ স¤পাদক পথিক। ইদানীং খালি সায়েন্স ফিকশন ছাপাইতে চায় তার লিটল ম্যাগে…খালি বলে সাই-ফিক, সাই-ফিক… অবশ্য কবিতাও ছাপাইব…তো, তার বাসাটা তো এক্কেরে থইথই করতেছে, একদম ভর্তি দেশী-বিদেশী কবিসাহিত্যিক দিয়া! মাটির মসজিদের পাশে বাসা। জানেন, চা বানাতে বানাতে ভাবি একেবারে হিমশিম খাইতেছে! (ফের দুলে-দুলে গাইতে থাকে…) "পিরিত যতন, পিরিত রতন, পিরিত গলার হার/ পিরিত কাঞ্চন পাইল যে-জন, পিরিত কাঞ্চন পাইল যে-জন, সফল জনম তারো রে/ দুনিয়া পিরিতের বাজার//।" শেষে শুধু গান আর গানেরই জোয়ার… লোকটাও গুনগুন করে তাল দিতে থাকে আস্তে আস্তে —

"ক্যালন মাছের ত্যালন-ত্যালন, তেইল্যা মাছের গোসা/ নতুন মাইয়ার বুড়া জামাই, নতুন মাইয়ার বুড়া জামাই/ নিত্যই করে গোস্‌সা গো/ দুনিয়া পিরিতের বাজার…// (ফের…) কই মজে কইয়ের ত্যালে, মাগুর মজে ঝোলে/ রসিক মরে প্রেমের জ্বালায়, রসিক মরে প্রেমের জ্বালায়/ ফড়িং মরে ফান্দে গো// রঙ্গের নাও রঙ্গের বৈঠা…/"

আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, শিবলী অনর্গল বলে যাচ্ছে আর তুড়ি বাজাতে বাজাতে গুনগুন করে গাইছে, আর অচেনা লোকটা শিশুর বিস্ময় ও কৌতূহল নিয়ে সব শুনছেন। কোনো অপ্রস্তুত ভাব নেই। খুব খুশি-খুশি লাগছে তাকে।

লোকটার কাছে সবকিছু অপূর্ব-অপূর্ব লাগছে! ওই জাহাজের মতো লম্বা সিনেমা হল — তার সাতরঙা পোস্টার, সাতরঙা হোর্ডিং, অচেনা এক শিবলীর কাছ থেকে আচমকা অপ্রত্যাশিত সব তথ্যপ্রাপ্তি, স-ব, সবকিছু… দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন, শুনছেন, আর মিটিমিটি হাসছেন।

আকবরিয়া মার্কেট। পড়ুয়া। বইয়ের দোকান। কবি শোয়েব শাহরিয়ারের। সন্ধ্যা হয়ে আসছে তখন। শহরের নানান জায়গা থেকে তরুণ কবিরা, ছোট কাগজের স¤পাদকেরা, কবি-যশোপ্রার্থীরা ধীরে ধীরে এসে জড়ো হচ্ছে পড়ুয়া-র সামনে। আড্ডা হচ্ছে তুমুল, কখনো পড়ুয়া-র সামনে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই, কখনো শ্যামলী-তে, কখনো আকবরিয়া-য়, কখনো এশিয়া-য়, মিষ্টির দোকানে, মিষ্টি খুব পছন্দ কবিদের, কখনোবা তৃষা-য়। আকবরিয়া এলাকাটা যেন শহরের হৃৎপিণ্ড, এই ছোট্ট স্বপ্নসম্ভব শহরের! আ স্মল বিউটিফুল হার্ট দ্যাট অলওয়েজ থ্রব্স্!

আজ বৃহস্পতিবার। ওই যে এক দীর্ঘকায় ছিপছিপে তরুণ। কবি মাহমুদ হোসেন পিন্টু। কী এক অচেনা নেশায়, অজানা আকর্ষণে তিব্বতি ছোরার মতো দুধারে বাতাস কেটে কেটে হনহন করে হেঁটে আসছে পড়ুয়া-র সান্ধ্য আড্ডার দিকে। যেন একরকম ছুটেই আসছে! কাঠের আসবাবের দোকান তাদের। বনানী ফার্নিসার্স। এখন সন্ধ্যা বৃহ¯পতিবারের। কাল বন্ধ। কাল ছুটি। পড়ুয়া-র বাঁশির সুর কানে এসে বাজছে, মন একেবারে উন্মন হয়ে আছে! প্রাণ পিপাসিত হয়ে আছে ওই সান্ধ্য আড্ডার জন্য। "তরল্লা বাঁশেরো বাঁশি ছিদ্র গোটা ছয়/ বাঁশি কতই কথা কয়/ আমার নাম ধরিয়া বাজায় বাঁশি রহনো না যায়/ প্রাণসখী রে, ওই শোন কদম্বতলায় বংশী বাজায় কে//" সন্ধ্যা হয়ে আসছে আর তার সেই কাঠের ছোট্ট অরণ্যে, বিচিত্র সাইজ-করা সব কাষ্ঠখণ্ডে, বার্নিশবিহীন অসমাপ্ত আসবাবের কাঠামোতে গজিয়ে উঠছে ঝলমলে পাতা ও পল্লব। প্রাণ পাগল হয়ে যায়! সন্ধ্যায় তড়িঘড়ি শ্রমিকদের সপ্তাহের পাওনা মিটিয়ে দিয়ে, হিসাবনিকাশ সেরেই দে ছুট…।

আরো একজন। বিপরীত দিক থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছেন পড়ুয়া-র দিকে। সরকার আশরাফ। কথাকার। নিসর্গ-র সম্পাদক। চেহারাটা বেশ রাফ অ্যান্ড টাফ। প্রেস থেকে এলেন। পায়ে ধুলা, চুলেও ধুলা উড়ছে। লিটল ম্যাগাজিন তার ধ্যান, জ্ঞান, সাধনা…।

কবি ফখরুল আহসানের সঙ্গে রিকশায় চলেছি। রিকশা চলছে তো চলছেই, তন্দ্রাচ্ছন্ন, মদালস। দুপুরের রোদের ভেতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে ঠনঠনিয়া, কানছগাড়ি, মালতিনগর, জলেশ্বরীতলা…। রাস্তার ধারে এক ছোকরা নাপিত টুল ও চেয়ার পেতে, আয়না খাটিয়ে বসে পড়েছে দিব্যি। টেকোমাথা এক খদ্দের। মাথায় অল্প কিছু চুল অবশিষ্ট। টাক থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে আলো। চকচকে করছে তাই। নাপিত ছোকরা খুব কায়দা করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চুল ছেঁটে দিচ্ছে। খালি গায়ে নেয়াপাতি ভুড়ি ভাসিয়ে আয়েশে চোখ বুজে চেয়ারে বসে আছেন টেকোমাথা। কী মজা! কী আমোদ আকাশে বাতাসে ও রোদে! কী আনন্দ আলোর বিদ্যুচ্চুম্বক ঢেউয়ে, ফড়িঙের পাখার কাঁপনে, লাউডগার লিকলিকে জিহ্বায়, আকর্ষিকায়, বাতাসের গুলতানিতে! শ্রুতি ছুঁয়ে যাচ্ছে শ্রুতি, হৃদিতে মিশছে হৃদি, শ্রবণে শ্রবণ…। এই তো হচ্ছে যোগাযোগ, একদম সরাসরি, সোজা ও সহজ! নাপিতের পাশে রাখা রেডিওতে গান বাজছে। গানের ঝলক বেতার থেকে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে তারে। ইলেকট্রিকের তার। তারে প্রতিহত হয়ে কানে এসে লাগছে গানের সুর, ফুটে উঠছে কলি "নদীর নাম সই অঞ্জনা, নাচে তীরে খঞ্জনা, সই, আমি যাব না আর জল আনিতে, ওই-না নদীরও ঘাটে, পখি তো নয় নাচে কালো আঁখি…।"

রিকশা চলছে। চলছে তো চলছেই, তন্দ্রাচ্ছন্ন, মদালস।

মফিজ পাগলার মোড়। সাঁৎ করে একটি রিকশা আড়াআড়ি পার হয়ে গেল। আরোহী দুজন তরুণী। চালকের চোখেমুখে স্ফূর্তি, অনির্বচনীয়। গলা ছেড়ে গাইতে গাইতে যাচ্ছে, ওই সেই একই গান "নদীর নাম সই অঞ্জনা, নাচে তীরে খঞ্জনা, সই, আমি যাব না আর জল আনিতে, ওই-না নদীরও ঘাটে, পখি তো নয় নাচে কালো আঁখি…।"

জলেশ্বরীতলা। পথের পাশে ছোট্ট একটি মুদিদোকান। দোকানিটা খুব সরল-সোজা। অনেক কজন খরিদ্দার এসেছে দোকানে। দোকানি একটু হিমশিম খাচ্ছে হয়তো-বা। বিরক্ত-বিরক্ত ভাব। একপর্যায়ে সে সবাইকে অবাক করে দিয়ে, যেন এক তুড়িতে বিশ্বের তাবৎ বাণিজ্যনীতির গালে চটকনা মেরে বলে উঠল, "আর কারো দোকান দ্যাখো-না, খালি আমার দোকানে আইসা ভিড় করো!" রিকশায় এক চক্কর দিয়ে যখন আবার যাচ্ছিলাম সেই দোকানের সামনে দিয়ে, দেখলাম এক আশ্চর্য ব্যাপার, বিরসবদন ওই লোকটিই কিনা দোকানদারি ছেড়ে বাইরে এসে কাঁধে একটি শিশুকে তুলে নেচে নেচে গাইছে, অবাক, সেই একই গান "নদীর নাম সই অঞ্জনা, নাচে তীরে খঞ্জনা, সই, আমি যাব না আর জল আনিতে, ওই-না নদীরও ঘাটে, পখি তো নয় নাচে কালো আঁখি…।"

রিকশা চলছে। চলছে তো চলছেই, তন্দ্রাচ্ছন্ন, মদালস। বর্ষাশেষের উদাস-উদাস দুপুর। পাশে শীর্ণকায়া করতোয়া। নিচু ভল্যুমে মাইক বাজিয়ে উজান বেয়ে চলেছে পালতোলা একটি নৌকা, বনভোজে যাচ্ছে বোধহয়। কিন্তু বন কই? মাইক তো কখনো এত নিচু স্বরে বাজে না! যা হোক তবুও পাল উড়ছে, নৌকা চলছে, মাইক বাজছে… ভেসে আসছে সেই একই গান, একই কলি ''নদীর নাম সই অঞ্জনা…"। কিন্তু নদীর নাম তো করতোয়া, তীরে খঞ্জনা পাখির জোড়া হয়তো এখনো নাচে কিন্তু জল নিতে আসা কাউকে দেখলাম না, যে কিনা সইদের বলবে, "পাখি তো আর কিছু রাখিবে না বাকি…"।

একজন বৃদ্ধমতো মানুষ। অবসরে যাওয়া শিক্ষক হয়তো-বা। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। নাতিকে নিয়ে এসেছেন মাছ ধরতে। বড়শি ফেলে বসে আছেন সিরিয়াস ভঙ্গিতে। স্মিতমুখ নাতি দাদুকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। দাদু কিছু তার জবাব দিচ্ছেন, কিছু দিচ্ছেন না। বড়শিতে মাছ ধরছেন — চেলা, নলা, পুঁটি, টেংরা, বউমাছ…। মাছ ধরে ধরে পেছনে রাখছেন বিছিয়ে রাখা গামছায়। ফাৎনার দিকে নিরঙ্কুশ মনোযোগ দাদু ও নাতির। এদিকে তিনটি টিট্টিভ পাখি পেছন থেকে এসে একটি একটি করে মাছ মুখে পুরে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে। গিলে ফেলছে টপাটপ। কিন্তু টেংরাকে তারা বাগে আনতে পারেছে না কিছুতেই।

মাছ তো সব খেয়ে গেল টিট্টিভে। নাতির চোখ ছলোছলো। পায়জামার ধুলো ঝেড়ে দাদু ও নাতি উঠে এবার হেঁটে যাচ্ছে নদীর কিনার ধরে। হাত নেড়ে নেড়ে দাদু নাতিকে কী কী যেন বলছেন, বোঝাচ্ছেন। হয়তো ধৈর্যধারণের কথা, হয়তো আগামী স্বপ্নের কথা… আগামীকালে, আরো আরো আগামীকালে তারা আবারও বসবে ছিপ ফেলে, অসীম ধীবরধৈর্যে, আর অনেক অনেক মাছ পাবে তারা, বড়শিতে।

সম্পাদক, প্রাবন্ধিক, কবি ফারুক সিদ্দিকী। পাকাচুল, কিন্তু নিরলস। টানা চল্লিশ বছর ধরে বিপ্রতীক বের করছেন। নবীন কবিরা মজা করে বলে 'বীরপ্রতীক'। তাঁর বাড়ির নাম "কে-লজ"। সূত্রাপুর, বগুড়া। বিশাল জায়গা জুড়ে অদ্ভুত এক বাড়ি। স্পিলবার্গের ছবির শ্যুটিং লোকেশনের যেন এক অতীত সংস্করণ।

আগে সূত্রাপুর, মালতিনগর, জলেশ্বরীতলা, মফিজ পাগলার মোড় — পুরো এলাকাটা ছিল জঙ্গলে ভরা। প্রাণবৈচিত্র্যে উপচানো। বাহার ভাই যে বলেন সাতমাথার দিকে বাঘ আসত, বাঘদাস আসত, নীলগাই নামত, তা তো আসত এই ফারুক ভাইয়ের পরগণা থেকে। হঠাৎ-হঠাৎ ফারুক ভাই বাঘ আর বাঘদাস পাঠাতেন আর বাহার ভাই কেবলই বিস্মিত হতেন আর জীবজানোয়ারদের যাতায়াত কন্ট্রোল করতে হিমশিম খেতো ট্রাফিক পুলিশ।

ফারুক ভাইয়ের পরগণায় এখন আর বাঘ নাই, বাঘদাসও নাই। অরণ্যও নাই। পরিষ্কার। কালে কালে গজিয়ে উঠেছে ঘরবাড়ি, জেগে উঠেছে পাকা রাস্তা। তবে তাঁর হাবেলি যেখানটায়, শুধু ওই জায়গাটুকুতে কিছুটা অরণ্য এখনো অক্ষুণ্ন রয়েছে। ইটকাঠলোহাপাথরের বিশাল মরুভূমির মধ্যে ছোট্ট একটি মরূদ্যান। কালের চাবুকে পাতা ঝরে, প্রাণ-প্রাণী-প্রকৃতিতে ধস নামে, অতঃপর বৃক্ষের বীজ থেকে, প্রাণী ও মানুষের বীজ থেকে ফের গজিয়ে ওঠে নতুন অঙ্কুর, নতুন পাতা, নতুন পাখি, নতুন প্রাণ, নতুন মানুষ। যে বৃদ্ধা বাঘিনী জরা ও অনশনে জীর্ণা হতে হতে অরণ্যের ওই যে ওখানে নেতিয়ে পড়ে মরে গিয়েছিল, ঠিক ওখানটাতেই পড়ে আছে সে। লোম-লাবণ্য সব উবে গেছে হাওয়ায়, চামড়া-মাংস সব পচে ধুয়ে ফুরিয়ে গেছে একেবারে, এখন মাটির ওপর জেগে আছে শুধু হাড়ের কাঠামো। অবিকৃতপ্রায়। ময়লা জমেছে, শ্যাওলা ধরেছে মাত্র।

ফারুক ভাইয়ের বনে বিচিত্র গাছগাছালি। হঠাৎ একটি খেজুর গাছ। গুনা দিয়ে মাটির কলসি বেঁধে লাগানো হয়েছিল গাছে। পরে গাছিয়াল লোকটির কী জানি কী মনে হয়েছিল, কোনোদিন আর কলসি নামাতে যায়নি সে। কলসিতে রস জমেছে, উপচে পড়েছে, শুকিয়ে গেছে, পিঁপড়ায় বোলতায় খেয়েছে। তারপর মাটির মৌচাকের মতো ছোট ছোট টিবি গড়েছে বোলতারা ঝুলন্ত ওই কলসির ওপরেই।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম পার হয়েছে বোলতাদের। টিবি ঝরে গিয়ে গজিয়েছে নতুন ঢিবি, ওই কলসিরই গায়ে। যে-সময় গাছটি কলসি বেঁধে নিয়েছিল গলায়, সে-সময় সে ছিল তরুণ। পরে কলসিকে অনেকদূর পেছনে ফেলে বেড়ে উঠেছিল তরতরিয়ে। আরো পরে বাজ পড়েছিল মাথায় একদিন। বজ্রাঘাতে মৃত্যু হয়েছিল গাছটির। মরেও দাঁড়িয়ে আছে সটান। সারা গায়ে কাঠঠোকরার খোঁড়ল। আর তরুণ বয়সের গলায়-বাঁধা কলসি এখন কোমরে। লোহার সরু গুনাটি পর্যন্ত শুকিয়ে মড়মড়ে হয়ে গেছে।

আমরা — মানে ফারুক ভাই, বাহার ভাই, কথাকার সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ, সরকার আশরাফ, কামরুল হুদা পথিক, রোহন রহমান, কবি মঈন চৌধুরী, শোয়েব শাহরিয়ার, সাজ্জাদ শরিফ, রাজু আলাউদ্দিন, ব্রাত্য রাইসু, আদিত্য কবির, আবদুল্লাহ ইকবাল, শেখ ফিরোজ, ফখরুল আহসান, মাহমুদ হোসেন, সৈয়দ মাহবুব, শামীম কবীর, বায়েজিদ মাহবুব, শিবলী মোকতাদির, আশিক সারোয়ার, আমি — সে-এক বিশাল অভিযাত্রীবাহিনী, ঢুকে পড়লাম সেই অরণ্যের ভিতর। মনে হলো অন্তত আশি বছর কোনো জনমানুষের পা পড়েনি এখানে। আশি বছরের অগেকার সময় তার গন্ধ হাওয়া স্মৃতি আমেজ উষ্ণতা নিয়ে জড়িয়ে ধরল আমাদের। এক অবিশ্বাস্য অনুভূতি! সময় যেন থমকে রয়েছে, আবার ঠিক থমকেও নেই। আসলে এখানে, অন্তত এই জায়গাটুকুতে, সময় বইছে এক ভিন্ন চালে। নির্বিঘ্নে, আপনমনে। একটুও ডিসটার্ব করেনি কেউ কখনো এখানকার কোনোপ্রকার স্থিতি, গতি বা প্রবাহকে। এই তো কিছুক্ষণ আগে কে যেন এসে আমাদের উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তাদের টাইম মেশিনে, অল্প কতক্ষণ ঘুরিয়ে নামিয়ে দিয়ে গেছে এখানে। আর তাতেই পার হয়ে গেছে আশিটি বছর…

(চলবে)