একদিন আহমদ ছফার বাসায় আমরা

admin
Published : 1 July 2008, 08:15 PM
Updated : 1 July 2008, 08:15 PM

[১৯৯৬ সালে এক রাতে পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়। তখন লেখক আহমদ ছফার বাংলামোটরের চারতলার ভাড়া বাসাটি ছিল তরুণ-প্রবীণ লেখকদের আড্ডাস্থল। ঢাকার শাহবাগের আজিজ মার্কেটের দুই তলায় আড্ডা দেওয়ার জন্য ছফা একটি

…….
আহমদ ছফা (৩০/৬/১৯৪৩ — ২৮/৭/২০০১)। ছবি. নাসির আলী মামুন
…….
দোকানও ভাড়া করেছিলেন। এর নাম ছিল উত্থানপর্ব। পাশেই তিনি গরীব বাচ্চাদের একটি স্কুলও খুলেছিলেন। বিকেলে ছফা শাহবাগে বসতেন। বিবিধ বন্ধু এবং চাকুরিহীন ও চাকুরি আছে এমন তরুণ কবি- সাহিত্যিকরা তখন তাঁর কাছে আসতেন। শাহবাগের আড্ডা শেষে প্রায়ই সে আড্ডার কেউ কেউ ছফার সঙ্গে বাসা পর্যন্ত হেঁটে এগিয়ে দিতেন তাঁকে। কোনোদিন তাঁর বাসায়ই আড্ডা বসতো। র চা ও পনির দিয়ে আপ্যায়ন করতেন ছফা। আমরা যারা তাঁর একটু ঘনিষ্ঠজন ছিলাম তাদেরকে তিনি কখনো-সখনো তাঁর জার্মান বান্ধবীর কল্যাণে প্রাপ্ত নেপোলিয়ন ব্যবহার করতে দিতেন। র চায়ে দুচামচ ব্র্যান্ডি আর পিরিচে কাটা পনির এটি ছিল সে সময়ের ডেলিকেসি।

প্রায় সব বিষয়ে ছফা মত দিতেন। সবার সঙ্গেই ভাল সম্পর্ক বজায় ছিল তাঁর। শোনা যায়, গোপনে কাউকে কাউকে অর্থসাহায্য করতেন। সাক্ষাৎকারটি শুরু হয় নাট্যকার ও অভিনেতা আশীষ খন্দকারের একটি প্রশ্ন দিয়ে। ক্যাসেটে সে প্রশ্ন ধারণ করা যায় নাই এবং অনেক পরে রেকর্ডার থেকে শুনে শুনে সাক্ষাৎকারটি লেখা হয়েছে বিধায় ছফার কথা দিয়েই সাক্ষাৎকারটি শুরু করা হলো। — ব্রাত্য রাইসু, ২/৭/২০০৮]

আহমদ ছফা: আরে না, আমি মুন্ত্রী হয়ে গেছি তো। আমি মুন্ত্রী তো, উল্টাপাল্টা প্রশ্নের জবাব দ্যাব না।

আশীষ খন্দকার : ছফা ভাইয়ের ওপর একটা ডকুমেন্টারি করে রাখতে চাই, ফিল্ম ডকুমেন্টারি।

ছফা: কর্নেল ফরহাদের (ফরহাদ মজহার) একটা ডকুমেন্টারি ইউনিট আছে।

…….
আহমদ ছফা এক সময় কাঁধে পাখি নিয়ে চলাফেরা করতেন। ছবিটি আট খণ্ডে পূর্ণাঙ্গ আহমদ ছফা রচনাবলীর (প্রকাশক: খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি) দ্বিতীয় খণ্ড থেকে নেয়া হয়েছে।
…….
ফরহাদকে বললে যে কোনোদিন… প্রতিদিনই রিকোয়েস্ট করছে আমাকে, ওদের একটা ভিডিও ক্যামেরা আছে, ইত্যাদি আছে…কিন্তু এগুলোর করার একটা বিপদ আছে কী জানো, খুব তাড়াতাড়ি বোধহয় মরে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।

আশীষ: এটা করতে গেলে খুব শিল্পসম্মত ডকুমেন্টারি করতে হবে। তথাকথিত যেসব বায়োগ্রাফির ওপর ডকুমেন্টারি হয়, সে ধরনের কাজ না।

ছফা: আমি একটা জিনিস ভয় পাই। ভয় পাই কী জানেন, অর্থাৎ ডকুমেন্টারি করা যায় কেমনে, একজন লেখক কিংবা ক্রিয়েটিভ লেখক আনকনশাসলি করলে ভালো। কিন্তু আমি তো এখন জানতে পারছি সব।

শাহ্‌রীয়ার রাসেল : এমনি নরমালি করলে অসুবিধা কী?

ছফা: আমি জানতে পারতেছি তো আমার পাবলিসিটি হচ্ছে! তখন তো এতে কোনো মজা নেই আর।

ব্রাত্য রাইসু: মজা কীসে ছফা ভাই?

ছফা: একটা জিনিস মজা আছে না? এই যে ধরো ওই যে ছবিটা, দশ বিশ বছর অজ্ঞাতবাস ছিল…

রাইসু: পাখিঅলা ছবিটা?

ছফা: হ্যাঁ, দু হাজার টাকা দিয়া আদায় করছি। একটা মজা আছে। যেমন ধরো কালকে জিটিভি থেকে টেলিফোন, একটা সিরিজ করার প্রস্তাব দিয়েছে, তার একটা মজা আছে না? আমি যে সমস্ত লোক চিনি, তারা ম্যানেজারি করে কাজ করার মধ্যে। একটা ঘৃণা আছে না। এই যে লিখে দেয়া আর কি না, 'আমি অমুক, আমি তমুক, আমি অমুক' — তাহলে লোকে বলবে, হ্যাঁ, লোকটা বেশ কাজের! একজন লেখককে ভালোবাসার জন্য একটা নিজস্ব পদ্ধতি আছে। সেটা আমি নষ্ট করতে চাই না। আমার আবার অটোবায়োগ্রাফি — আবার বায়োগ্রাফি — হুস্‌স্‌স্!

ব্রাত্য রাইসু: শিস দিলেন নিকি ছফা ভাই।

ছফা: এগুলোর কোনো দাম নেই। কারণ আমি দেখছি, সবচেয়ে খারাপ লোকেরা সবচেয়ে ভালো বায়োগ্রাফি তৈরি করে।

রাইসু: ইয়াং ছেলেদের ওপর আপনার সাক্ষাৎকারটা আজকে নিতে চাই ছফা ভাই। ইয়াং ছেলেদের আপনারা বেশি পছন্দ করেন।

ছফা: হ্যাঁ, এটার একটা মজা আছে। ও আল্লা, আমি যদি হোমোসেক্সুয়াল হতে পারতাম, আমার অনেক প্রবলেম সলভ হয়ে যেতো।

রাইসু: কী কী প্রবলেম সলভ হতো ছফা ভাই?

ছফা: মহিলারা এত কষ্ট দিতে পারত না আমারে।

রাইসু: তাহলে আপনে বাই সেক্সুয়াল, মানে দুইটাই।

ছফা: না তা না। আমি হোমোসেক্সুয়াল হতে পারলে অনেক প্রবলেম সলভ হয়ে যেত। কিন্তু সেটা সলভ হয়নি। হোমোসেক্সুয়াল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আমার নেই। আমার অন্য জায়গায় একটা নালিশ আছে। আল্লাহতালা তো সব জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। এবং এইটা একটা প্রাকৃতিক নিয়ম লংঘন করা। আমি মনে করি আমি একটা ধর্মজীবন যাপন করি। যেকোনো খানকি যেকোনো বদমাশ আমার কাছে আসলে তাকে আমি গুড ছেলে কিংবা গুড মহিলায় পরিণত করতে পারি।

রাইসু: আচ্ছা ছফা ভাই, আপনি কি কখনো বেশ্যাগমন করছেন?

ছফা: না আমি যাই নাই, এটা হয় নাই। আমি একবার, ক্লাশ নাইনের যখন ছাত্র, তখন আমার বন্ধুরা বললো, রিয়াজউদ্দিন বাজারে গেলে পরে মহিলারা নূরজাহানের মতো গান করে। দশ টাকা নিয়া তোমাকে স্বর্গে পৌঁছে দেবে। আমি দশ টাকা নিয়ে, বাড়ি থেকে চুরি করে, বাসে করে রিয়াজউদ্দিন বাজারে আসছি। প্রথম যে অভিজ্ঞতাটা হলো : মাগুর মাছেরে ছাই মাখালে যেরকম হয়, কতগুলো মহিলা সারা শরীরে পাউডার মেখে দেখি যে গুয়ের গন্ধ, মুতের গন্ধ, চিকন গলি…আমি দৌঁড়ে ওইপারে যখন গেছি — দেখি যে আমার পুরুষাঙ্গটা নাই! ভয়ে। দিস ওয়াজ মাই ফার্স্ট এক্সপেরিয়েন্স ইন ব্রথেল। সেক্স কিনে-বেচে এমন কোনো মহিলার সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়নি। আমার এইটা কনসেপ্টে আসে না। কালকে আমি পিকনিকে গেছি আমার বান্ধবীরে অনার করার জন্য। আমার বৌদ্ধমূর্তিটা নিয়ে গেছি তারে দেওয়ার জন্য। কিন্তু লোকজনের সামনে দেওয়া গেল না। আজকে সকাল বেলা তার মাকে এই কথাটা বললাম। অর্থাৎ আমার জীবনের মধ্যে একটা পরিচ্ছন্নতা আছে। এগুলোর কোনো স্কোপ নেই।

রাইসু: সেক্সের?

ছফা: সেক্স থাকবে না কেন?

রাইসু: আপনে তো একটু প্লেটোনিক ছফা ভাই।

ছফা: কেন প্লেটনিক হবে। বাঘ যখন বাঘিনীর সঙ্গে মিশে প্লেটোর চেয়ে বেশি ওরা। ইটস এ পার্টস অফ ইউর এক্সিসটেন্স। এই যে লিঙ্গপূজা করত হিন্দুরা এটার অর্থ আছে। আমি মনে করি আমার জীবনের এই পর্যন্ত যে উপলব্ধিতে এসে পৌঁছেছি, পুরো সমাজকে আমার দেওয়ার মতো কিছু আছে।

রাইসু: আপনি প্রেমট্রেম করছেন কখনো ছফা ভাই?

ছফা: লোকে বলে। আমি তো বুঝতে পারি না।

রাইসু: আপনার প্রথম প্রেম কি অসামাজিক কিছু ছিল?

ছফা: মানুষের ছোটবেলা যেইটা, একটা পশুর ছোটবেলার মতো। আমি সেইটা বলার মতো মানসিক শক্তি অর্জন করি নাই। ট্রূথ উচ্চারণ করার মতো যে শক্তি তা এই মুহূর্তে আমার নেই। মানুষ অটোবায়োগ্রাফি যেগুলো দেয়, এগুলো হচ্ছে 'হতে-পারতো-অটোবায়োগ্রাফি'। অর্থাৎ যে মানুষ অনেক কথা অকপটে বলে সে অনেক কথা অকপটে লুকিয়েও রাখে। সুতরাং এই যে লোকে ফ্রাঙ্কনেসের ভান করে…ব্রিডিং সেন্টারে ষাঁড়কে যে কাজে ব্যবহার করা হয়, একজন সফিস্টিকেটেড লোকও নিজের কোয়ালিটি থেকে একটা বৃহত্তর ষাঁড় হওয়ার জন্য তা করে। আমার মনে হয় মানুষ বোধহয় অন্য কিছু। মানুষ অন্য কিছু। আমার অভিজ্ঞতা যেটা, সেক্স ইজ নট এভরিথিং অফ লাইফ।

রাইসু: যেসব ভদ্রমহিলা আপনার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করছেন, করছেন তো অবশ্যই…?

ছফা: হ্যাঁ।

রাইসু: আমার মনে হয় এক ধরনের ভক্তিমূলক সম্পর্কের থেকে আপনার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক হয়। তাই নয় কি?

ছফা: হ্যাঁ।

রাইসু: ওইখান থিকা, মানে ভক্তি থিকা আপনি যৌন সম্পর্কে কীভাবে যান?

ছফা: ইট ইজ পার্ট অফ দি হোল, এগুলিকে মামুলি সেক্স হিসেবে দেখা ঠিক না। আমি অনেক সময় গ্যেটের জীবনী পড়ে ভাবতাম যে লোকটা আর কোনো কাজই করে না, যৌনসঙ্গমই করে। এত যৌনসঙ্গম করে, লোকটা বাঁচে কীভাবে? মামুলি লোক মনে করবে যে সতীচ্ছদ করা একটা মস্ত বড় জিনিস। এবং প্রায় কবিদের মধ্যেও আমি এটা দেখেছি। অর্থাৎ কোনো মহিলা দেখলেই মরদ আমি…আমার অভিজ্ঞতা এইটা, সেক্স ইজ নট এভরিথিং অফ লাইফ। সেক্স হচ্ছে একটা এক্সপ্রেশন, দেয়ার আর মেনি আদার এক্সপ্রেশনস। ইয়ুং-এর অটোবায়োগ্রাফি পড়বে যারা তারা বুঝবে। ফ্রয়েড যেইটা দেখেছে যে মানুষের সব কিছুই যৌন কার্যাবলী। যৌন এনটিটির বাইরেও তো মানুষের আর একটা এনটিটি আছে। আমরা যদি পশুজগতে যাই, গাছের জগতে যাই, কিছু গাছ আছে তার অঙ্গ দিয়ে তৈরি করে, কিছু গাছ আছে বীজ থেকে তৈরি করে, কিছু প্রাণী আছে তার সেল থেকে বংশবৃদ্ধি করে। এবং মানুষ তার বংশবৃদ্ধি করে যেটা সেটা হচ্ছে ম্যামাল, স্তন্যপায়ী। আমরা যদি অন্য প্রাণী হতাম, আমরা আমাদের অনুভূতি কীভাবে মূল্যায়ন করতাম…?

রাইসু: কীভাবে করতেন ছফা ভাই?


ছফা, তাঁর ঘোষিত গুরু প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে, গুলশানের বাসায়। ছবি: ব্রাত্য রাইসু, ১৯৯৫

ছফা: আমি জানি না, অন্যভাবে যদি আবার প্রাণী হিসেবে আমি জন্মাই…আমার একবার টিবি হয়েছিল, আমাকে সেকলুশন করে রাখছিল। একটা বিড়াল ছিল আমার সঙ্গে। এটা ছিল হুলো। দাউ ইট কেম উইথ হিজ গার্ল ফ্রেন্ড। এবং বিড়ালের যে করে বাচ্চা হয়, এবং বাচ্চার প্রতি যে অপত্য স্নেহ — মানুষকে আমার মনে হয়েছে অনেক স্টেজে পশুদের নকল করতে হয়েছে। মানুষের মধ্যে সামথিং এই যে 'গডলি' যেটা কল্পনা করা হয়, মানুষের এই যে সমস্ত বন্ধন ছাড়াইয়া যাওয়ার ক্ষমতা আছে এইটাই হচ্ছে ঈশ্বরত্ব।

রাইসু: যৌনতা এই ঈশ্বরত্বকে নষ্ট করে না?

ছফা: যৌনতা দিয়ে মানুষ একটা কাজই করে, বংশবিস্তার করে।

রাইসু: না।

ছফা: না, আমাকে বলতে দাও। মানুষের আরো ফ্যাকাল্টি আছে, সমস্ত ফ্যাকাল্টিগুলি যৌনতার অধীন নয়। ইয়ুং এই জায়গায়ই ডিফার করে ফ্রয়েডের সঙ্গে। মানুষের জীবন হচ্ছে সাইকো সোমাটিক ফোর্স। শারীরিক, মনোদৈহিক একটা ব্যাপার।

আশীষ: ইলেক্ট্রনিক বায়োলজিক্যাল সাইকো ফিজিক্যাল ফোর্স।

ছফা: এবং এরই মধ্যে যেগুলি আছে, যেমন রিলিজিয়াস এক্সপিরিয়েন্স, আধ্যাত্মিক এক্সপিরিয়েন্স এগুলি এক ধরনের…যেমন বাউলরা প্রেমভাজা খায়, প্রেমভাজা মানে দুইজনের পায়খানা খায়। ফরহাদ তো এগুলি বলে না। এগুলিকে তারা বলে আধ্যাত্মিক এক্সপিরিয়েন্স। কিন্তু এখন বাস্তব জীবনে যেটা দেখা যায়, ফিজিক্সে যদি যাও, তো বস্তু আর ভাবের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব পাবে না। হায়ার ফিজিক্সে। বাউলরা যে জীবন যাপন করে, জীবনযাপনটা তারা একটা ধর্ম মনে করে।

রাইসু: আমার মনে হয় ছফা ভাই, এইখানে বাউলরা হইছে সবচেয়ে বড় এলিট।

ছফা: এলিটিজম হচ্ছে একটা জিনিস, যখন একটা অংশে নিজেদের আইডেনটিটি এসার্ট করতে করতে তারা মনে করে যে দে আর স্টে ফর সামথিং। বাউলদের এই যে সেকল্যুড মানসিকতা, এইটা আমি খুব অপছন্দ করি। দেখো, জৈনরা মনে করে সমস্ত বস্তুসত্তার মধ্যে প্রাণ আছে। এই কাঠটার মধ্যেও প্রাণ আছে। প্রাণের যে ভেরিয়েশন, সেটা হচ্ছে ডিগ্রি এবং স্টেজের। সেজন্য উর্দুতে একটা শের আছে : "সে মুক্তাতেও নেই, সে পাথরেও নেই, সে নানা বর্ণে দীপ্ত।"

রাইসু: এটারই উল্টা করে রবীন্দ্রনাথ বলতেছেন, তোমারই স্পর্শে পান্না হলো সবুজ।

ছফা: রবীন্দ্রনাথ এটা গ্যেটের সেকেন্ড পার্ট থেকে চুরি করেছে।

রাইসু: রবীন্দ্রনাথ তো তাইলে তো অত বড় মাপের কিছু ছিল না।

ছফা: এগজাক্টলি, এই যে বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ে, তালি দেওয়ার যে ক্ষমতা এটাই মানুষকে বড় করে।

রাইসু: এইটা তো দামি কথা বললেন, ছফা ভাই।

ছফা: দামি কথা তো বলি, কিন্তু কারো মাথায় তো সান্ধায় না। আমরা একটা গিভেন পয়েন্ট অফ টাইমে বাস করছি। আজকে যে মানুষের জীবন, পাঁচ হাজার বছর আগের কোনো ইতিহাস নেই। পাঁচ হাজার বছর পরেও কোনো ইতিহাস থাকবে না।

রাইসু: কেন, পাঁচ হাজার বছর আগে লেখে নাই কেন?

ছফা: লিখে রাখার প্রয়োজনীয়তা ফিল করেনি। ইতিহাস লেখার সঙ্গে একটা সাবজেক্টিভ আইডিয়া যুক্ত আছে। ইতিহাস কথাটা যখনই উচ্চারণ করবা, তখনই তার সঙ্গে একটা সাবজেক্টিভ আইডিয়া যুক্ত আছে।

রাইসু: কী রকম?

ছফা: আমরা অন্যদের চাইতে আলাদা। আমাদের কথা লিখে রাখা লাগবে। এলিটিজমের মধ্যে মানব জাতিটাই নিমজ্জিত। আমরা যে গ্রেকো রোমান হিস্ট্রি বলি এটা হচ্ছে গ্রিক ইগোর ফল। ইতিহাস তখনই লেখে মানুষ…সে রবি ঠাকুর যখন রবি ঠাকুর হয় তখন তার অটোবায়োগ্রাফি লেখতে গেলে তার তেরো পুরুষের বর্ণনা দেওয়া লাগে। বুঝেছো? যে লোক রবি ঠাকুর হয়নি সে অটোবায়োগ্রাফিও লেখে না, তেরো পুরুষকেও টেনে আনে না। এই যে সাবজেক্টিভ, এটা হচ্ছে মানুষের একটা স্পেশাল কোয়ালিটি। আমি এইখানে পাঁচতলার থেকে দাঁড়িয়ে যে আকাশ দেখি, তখন আকাশের চারপাশে যতটা গোল দেখি, নিচের তলায় দাঁড়ালে আর কিনা সে গোলটা আরো সঙ্কুচিত হয়ে আসে। একটা বায়োলজিক্যাল প্রপার্টি আছে, কারণ হচ্ছে তুমি যত উপরে উঠবে তত বলয়টা বাড়বে। তখন প্রশ্নটা, মানুষের জীবনকে ঘিরে চারপাশে কতগুলো আঁধার কতগুলো আলো থাকে। যেখানে আমি নিজের চোখে দেখি না, ফিল করি না, সেইখানে সিভিলাইজেশন নেই।

রাইসু: সিভিলাইজেশনকে ওইভাবে জরুরি মনে করেন?

ছফা: মনে না করার উপায় নাই, সিভিলাইজেশনের একটা অংশ সাইন্স।

রাইসু: সাইন্সরে মূল্যবান মনে করেন?

ছফা: কম মূল্যবান মনে করার মতো…সিভিলাইজেশন ইজ হোয়াট উই হ্যাভ, কালচার ইজ হোয়াট উই আর। কালচার সিভিলাইজেশন এইগুলি সবই হচ্ছে মানুষের অস্তিত্বের এক্সটেনশন।

আশীষ: আচ্ছা, যে নারী জেনেটিক্যালি তার সেক্সকে চেঞ্জের চিন্তাভাবনা করছে এবং নারী যখন পুরুষ ভাবছে নিজেকে, সে বিষয়টা নিয়ে আপনার কী মত?

ছফা: প্যান্ট পরলেই যাবতীয় প্রবলেম সলভ হয়ে যায় না। অনেক কমপ্লেক্স মহিলা আছে যারা শাড়ি পড়ে, অথবা সফিস্টিকেটেড অথবা অভিজাত। মেয়েদের একটা আলাদা এনটিটি হিসেবে দেখা উচিত। একেকটা স্পিসিজের যৌনতারও নিজস্ব একেকটা প্যাটার্ন আছে। যেমন এই যে কেঁচোদের যৌনতা, সাপের যৌনতা একরকম নয়। কেঁচো তার সেল থেকে জন্ম দিতে পারে। সাপ আবার তার আণ্ডা থেকে জন্ম দেয়। পেঙ্গুইন তার দুধ খাওয়ায় বাচ্চারে। এই যে গাছ, কোনো গাছ আছে তার ডাল থেকে তৈরি করা হয়, কোনো গাছ বীজ থেকে তৈরি করা হয়। কোনো গাছ শিকড় দিয়ে তৈরি হয়। এখন এই যে সমস্ত প্রাণবান সত্তা এগুলোর একটা গতি আছে। এটা কখনো একটা বড় একটা ছোট নয়। যে সমস্ত জায়গায় সূর্যের আলো পড়ে না সেখানে ঘাস গজায় না। ঘাস না গজালে প্রাণও গজাতে পারে না। যেখানে ঘাস গজায় সেখানে জঙ্গলও গজাতে পারে। জঙ্গল গজালে জন্তু থাকতে পারে। যদি হরিণটাও থাকতে পারে, তখন বাঘটাও থাকতে পারে। বাঘটাঘ থাকলে মানুষটাও থাকতে পারে। এই যে লড়াইটা শুরু হয়ে গেল। এই মানুষের জীবনের যে বৈশিষ্ট্য, তার খাদ্যাভ্যাসই তাকে চেঞ্জ করে দিয়েছে। সে মিনারেল খায়, ঘাস মাটি সৈন্ধব লবণ এগুলো খায়। সে বীজ জাতীয় জিনিস খায়। সে জন্তু জাতীয় জিনিস খায়। এই যে খাদ্যাভাসের ভেরিয়েশনের জন্য তার ইতিহাসের মধ্যে হয়তো মাঝে মাঝে তুমি নিরামিষাশী লোক পাবে, কিন্তু নিরামিষাশী লোক প্রমাণ করবে যে অ্যাকসেপশন প্রুভ্স দ্য রুল। অর্থাৎ কিছু লোক যেহেতু আমিষ খায় কিছু নিরামিষাশী থাকলে একটা ভারসাম্য রক্ষা হয়। তখন যেই জিনিসটা… মানুষরে শুধু যৌনতা হিসেবে দেখা… আমি জানি না অত বেশি। একটা স্ট্রিক্ট সিচ্যুয়েশনে মানুষ কাপড় পরতে শিখেছে। এবং যখন লোম ছিল তখন কাপড় পড়ার দরকার ছিল না। মানুষের শরীরে ঘন লোম ছিল। মানে যখন আর কি গীতিকবিতা লিখতো না, গীতিকবিতা যখন তৈরি হয়নি তখন যুধিষ্ঠিরের দুঃখের মধ্যে সকলে সান্ন্ত্বনা পাইতে চেষ্টা করতো। হিস্টিরিক এক্সপিরিয়েন্সগুলি বাইপাস করে মৌলিক অভিজ্ঞতায় ফেরত যাওয়া যায় না। মানুষ সকলে সমান বয়সের, কিন্তু আসলে মানুষ সমান না। একই ভাবে জন্মাইছি, কিন্তু মানুষের ফ্যাকাল্টি এক রকম নয়। এবং প্রতিটা কথার যেভাবে আমরা টটোলজি শিখছি এবং বিশ্বাস করতে অভ্যস্ত অর্থাৎ এক মায়ের যন্ত্রণার মধ্যে আরেক মাকে ফিল করো এগুলো আমাদের সো কল্ড সাহিত্যিকরা কষ্টকল্পনা করে এ সমস্ত ফিলিংগুলো সবার মধ্যে চালু করেছে। এবং চালু করেছে বলে আমাদের মধ্যে যখন একটা গর্ভ হচ্ছে, তখন উই ফিল ভেরি…আমরা তখন তার প্রতি খুব কোমল হয়ে যাই। আর এইগুলি তৈরি করেছে ভাষা।

আশীষ: আপনি কখনো ন্যাংটা মেলায় গেছেন?

ছফা: ন্যাংটা মেলায় যাইনি আমি, ন্যাংটা থাকি বাড়িতে। ভাইয়ের ছেলেটাকে…পাঠাইতে চেষ্টা করতেছি অথবা বলছি অন্য কোনো জায়গা দেখতে…রাত্রিবেলা আমি হস্টেলে থাকার সময়…

আশীষ: ন্যাংটা থাকতেন?

ছফা: একদম।

রাইসু: কেন?

ছফা: আই ইউজড টু ফিল ফ্রি। আমি মনে করতাম যে আমি খুব লিবারেটেড সোল, কাপড়-চোপরের আমার কোনো প্রয়োজন নেই। লোকজনের সামনে তো পারি না। এমনকি আমি আমার বান্ধবীদেরও একটু ইন্সপায়ার করতে চেষ্টা করেছিলাম, এটা বাঙালি মহিলাদের ই করা অসম্ভব।

রাইসু: ইউরোপিয়ানদের পারছেন?

ছফা: অলমোস্ট।

রাইসু: তারা থাকছে?

ছফা: থাকছে। বাঙালি মহিলারা না, তারা মনে করে যৌন অঙ্গটা তাদের সোনার খনি। ইউরোপিয়ানরা মনে করে যে এটা পার্ট অফ দেয়ার বডি। আর এইখানে যারা লেখে না শরীর-টরির নিয়ে দে আর নট ক্লিয়ার।

রাইসু: ইমদাদুল হক মিলন?

ছফা: ইমদাদুল হক মিলন তো আর পড়ি নাই। আমি তো সব লেখা পড়ি। আমি লেখা পড়ি প্রাণের বিকাশ দেখার জন্য।

রাইসু: কী দেখেন?

…….
উপন্যাস অলাতচক্রের নকশা। আহমদ ছফা রচনাবলী, খণ্ড ৮ থেকে।
……..
ছফা: এরা তো এখনও পাথর যুগেই আছে। মানুষের ভাষা পায়নি আজো। পাথর যুগে মানে ইন এ সেন্স, তারা যে ভাষাটা ব্যবহার করছে এটা প্রিমিটিভ। এখন প্রতিটা ব্যক্তি-মানুষ জীবন্ত মানুষ। প্রতি মুহূর্তে তার যে চেঞ্জগুলো হচ্ছে…এই যে ধাবমান পরিবর্তনের মাঝখানে মানুষের কনটেক্সটে মানুষের চরিত্র যদি তুমি স্থাপন না করো তখন মানুষ সম্পর্কে তোমার কতগুলো টাইপড ধারণা প্রোজেক্ট ধারণা…এগুলো সাহিত্যের কিতাবের মধ্যে আছে। মেয়েরা ছেলেদের আগে খাওয়াইয়া ভাত খাইতো। সাফার করতে পছন্দ করতো। এটা আসল ব্যাপার না, এটা এক ধরনের লিটারারি কনসেপ্ট। আসলে মেয়েরা যেটা চায়, তাদের ওপর সুবিচার চায়। বেশির ভাগ পুরুষ মানুষ মেয়েদের সুবিচার করে না। এমনকি যারা নারীবাদী তারাও না। নারীবাদ পুরুষের এগেনস্টে মেয়েদের দাঁড় করাচ্ছে। কিন্তু মেয়েদের প্রতি সুবিচার হচ্ছে পূর্ণ সহানুভূতি নিয়ে তারা যে রজস্বলা হয়, তারা যে গর্ভ ধারণ করে, এরই মধ্যে যে একটা মহত্ত্ব আছে, এরই মধ্যে যে একটা রহস্য আছে এটা যদি কেউ আবিষ্কার করে…একবার এক বাড়িতে এক মহিলাকে আমি প্রেমের কথা বললাম। আমি শুধু স্টিক করতে থাকলাম, ইফ আই ডু নট লাভ ইউ, হোয়াই শ্যুড আই টক টু ইউ। পরে দেখা গেল, আমি যখন চলে আসছি বার্লিন থেকে…সেই যে ইউরোপিয়ান মহিলা সে হু হু করে কাঁদছে। অর্থাৎ যেই কনসেপ্টগুলো ছিল আগে মানুষের — প্রেম — আমরা এখন পাই না ব্যক্তিগত জীবনে, এটাকে ক্ষুধা মনে করছি।

রাইসু: আচ্ছা ছফা ভাই, এটা শুধুমাত্র মেয়েদের ক্ষেত্রেই কেন সাফারিংসটা দেখা যায়, পুরুষের ক্ষেত্রে কেন যায় না?

ছফা: আমার তো মনে হয় না।

রাইসু: দেখেন আপনি?

ছফা: অবশ্যই দেখি।

রাসেল : কী রকম ছফা ভাই?

ছফা: একটা মেয়েকে হয়তো দেখেছি খুবই ছোটবেলায়, সে যে আমাকে রিফিউজ করছে এই ব্যথাটা যদি আমি ফিল করি, আমি তো কাঁদি। দুটো প্রবলেম আছে। জার্মানরা চমৎকার একটা কথা বলে। পুরুষ আর মেয়ের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হচ্ছে কাচির মতো। কাচির দুটা হোলের মতো। ওরা নিজেরা ঝগড়া করবে কিন্তু তৃতীয় জিনিস আসলে এটা হচ্ছে অনধিকার চর্চা।

রাইসু: আপনি কি মাস্টারবেশান করছেন কখনো?

ছফা: অনেকদিন করেছি। মাস্টারবেশান করতে গিয়ে একটা সময় ফিল করলাম, মাস্টারবেশান যদি আমি করি, আমার ভার্জিনিটি আমি নষ্ট করবো, অর্থাৎ আমি লেখক হতে পারবো না। আমার জীবন খুব কষ্টের ভাঙাচোরা জীবন। মাঝে মাঝে আমি অমৃতের সন্ধান পেয়েছি। আমি সমস্ত সম্পর্কের মধ্যে অমৃতের সন্ধান পাই। আমি একটা প্রাকৃতিক এনটিটি। কিছুদিন বাদেই আমি নিরস্তিত্ব হয়ে পড়বো। আমার পুষ্প বৃক্ষ বিহঙ্গ পুরাণের কনক্লুডিং চ্যাপ্টারটা খুব ইন্টারেস্টিং। অর্থাৎ আমি তো পাখির জগতে অবস্থান করলে পারতাম। কিন্তু মানুষের জীবনের করুণ রঙ্গভূমি, এখানে থাকা ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই। কিন্তু পাখিদের গাছদের সঙ্গে আমি এ কারণে নেই যে মানুষের জীবন শুধু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর যে জোড়া — পাখির সঙ্গে, পশুর সঙ্গে, নক্ষত্রের সঙ্গে, গাছের সঙ্গে এ জীবনের যে বিস্তার, যাকে বলে অধিকারবোধ — এটা আমি পাখিদের সঙ্গে না মিশলে জানতাম না। যেমন ধরো গাছ দাঁড়িয়ে আছে, তুমি চলছো — চলার মধ্য দিয়ে যে চলছে না তার সঙ্গে একটা সম্পর্ক আছে। উপনিষদ-এ চমৎকার একটা কথা আছে : ইশ্বরের যে কনসেপ্ট, হয়তো নাই। কিন্তু এই যে আকাশের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে বৃক্ষের মতো কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছেন, এইটা হয়তো সত্যি নয়, এইটা হয়তো নাস্তিকেরা বলবে যে সত্যি নয় — কিন্তু আমার তো নাস্তিকতা দিয়ে চলে না। আমার নাস্তিকতা কোনো কাজে আইয়ে না। আমি ছোটবেলা থেকে একটা আস্তিক পরিমণ্ডলের মধ্যে বড় হয়েছি। এবং স্নেহের মধ্যে বড় হয়েছি। স্নেহটার যেখানে অ্যাবসেন্স…। আমারে যেটা টানে সেটা হলো গিয়ে মানুষের বর্তমান যে অস্তিত্ব, এরই মধ্যে ইশ্বর আছে, এরই মধ্যে স্বর্গ আছে, এরই মধ্যে নরক আছে এটা ফিল করার ক্ষমতা…। আর আমি তো কামেল লোক নই। কামেল লোক হইলে অত কথা কইতাম কেন? আমি জঙ্গলে থাকতাম, বনের বাঘ ভাল্লুক সিংহ এরা আমার সাগরেদ হইয়া যাইতো। এই কামালিয়াত নাই বইলাই তোমোগো লগে কতা কইতে…ডায়লগ করতে চাই।

আশীষ: কিন্তু আপনার পৃথিবীতে তো তারা আপনার সাথেই আছে।

ছফা: আপনারা কি নেই? সেটা তো, আপনারা তো বাইরে নন। গানের মধ্যে বিশ রকম কোয়ালিটি আছে। রক্তগুণ, মাংসগুণ, এইডা গুণ, ওইডা গুণ — সংস্কৃতে কত নাম যে দিছে! তখন প্রশ্নটা, এই যে ইতিহাসের যুগে তার আগে পঞ্চাশ হাজার বছর মানুষ সুপ্ত ছিল। মানুষের অবস্থা সুপ্ত ছিল, অন্য প্রাণীর মধ্যে ছিল। আস্তে আস্তে সে যখন বিশিষ্ট হয়ে উঠছে তার মধ্যে একটা বিশিষ্ট রকম চিন্তা

……
১৯৯৫ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সফরকালে আহমদ ছফা, সঙ্গে ব্রাত্য রাইসু। ছবি: ইকবাল খান চৌধুরী
……
জাগছে। সে একটা পর্যায়ে এসে আল্লা আবিষ্কার কইরা ফেলাইছে। একটা পর্যায়ে এসে তাদের মধ্যে পয়গম্বর বানিয়ে ফেলেছে। এখন যখন মানুষকে আপনি টোটালি দেখবেন, এই অভিজ্ঞতাগুলিকে আপনি মূল্য দেবেন। সঙ্গীতটাই নেন না কেন? সে 'সা' শব্দ আনছে গাধার আওয়াজ থেকে, 'মা' শব্দ হচ্ছে ছাগল। সঙ্গীতটা যখন হয় তখন এইটা ছাগলও হয় না, গাধাও হয় না, কাকও হয় না, কোকিলও হয় না। তখন এর একটা নিজস্ব এনটিটি হয়ে যায়। এবং যে জিনিসগুলি মানুষের ভেতরে আছে, মানুষের ভেতরে আছে সে আগুন যাকে বলা যায় প্রমিথিয়ান ফায়ার, সে সব সময় তার অতীতকে অস্বীকার করে। এবং অতীতের যা কিছু কোয়ালিটি সেটা সে লেখ্য বর্ণমালার মাধ্যমে সামনে প্রবাহিত করে দেয়। সো, মানুষ তো শুধু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। মানুষ তো ক্রমাগত চলছে। তার অভিজ্ঞতাগুলো চলছে। তার গবেষণাগুলো চলছে। আমেরিকা আর ফ্রান্স এইডস-এর ঔষধ কে আগে আবিষ্কার করবে তার প্রতিযোগিতা তারা করলো। মানুষ হয়তো ইশ্বর-ঘেরা রইছে। এই যে গান আছে: চিনতে পারো নাকি রে মন বুঝতে পারো নাকি/খাঁচার পিঞ্জিরায় থাকে অচেনা এক পাখি। তখন এই যে মানুষ, তার ক্লান্ত প্রাণ বুকের তলায়, চব্বিশ ঘণ্টা দুঃখে দুঃখে থাকে, কোথায় কালকে পয়সা পাবে, কোথায় কালকে খাবারটা হবে…তখন এই যে মানুষ, এই ভাঙাচোরা মানুষ তার জ্ঞানের জন্যে কোথায় যাবে, সমুদ্র লংঘন করে, গিরি লংঘন করে, পৃথিবীর অপর প্রান্তে যে মানুষ তার কাছে ছুটে যায়। মানুষ কে…মানুষ ইশ্বর-ঘেরা…আমি বোঝাতে পারবো না।

আশীষ: না বোঝাতে হবে। সেটা হচ্ছে যে তাহলে এ চিরায়তের সংজ্ঞা কী হবে?

ছফা: চিরায়তের কোনো সংজ্ঞাই নেই।

আশীষ: তাহলে কী হবে, সেটা কী?

ছফা: প্রশ্নটা হচ্ছে গাছকে যদি ধরেন, গাছের যে ডাল, এটা কিন্তু গাছের বোঝা বওয়ার জন্য, গাছের প্রাণকে হেল্প করে না। গাছের প্রাণকে হেল্প করে বাকল। তখন এই অবস্থাটা হচ্ছে এই জায়গায়…আমার ঘুম পেয়ে যাচ্ছে…এই অবস্থায় গাছের যে ডালটা এইটা কিন্তু ওজন বইবার জন্য।

রাসেল: অনেক গাছ যে বাকলটা ছেড়ে দেয়?

ছফা: ত্যান্দর গাছ। তখন যেটা, গাছের বাকলটা হলো গাছের প্রাণশক্তির উৎস। কাণ্ডটা না। তখন সিভিলাইজেশন বলে যে বস্তুটা বুঝি, মানুষের ইনডিভিজ্যুয়াল উদ্যোগ মরে মরে সিভিলাইজেশন তৈরি হয়। যেমন এই যে কোরাল, প্রবাল দ্বীপের সিভিলাইজেশন এইটা মরা সিভিলাইজেশন। তখন মানুষের যে বিহেভিয়র, এক্সপ্রেশন — কোন কনটেক্সটে কোথায় এক্সপ্রেস করবে এটা তার অরগ্যান, অরগানোগ্রাম ঠিক করে দেয়। আনফরচুনেটলি


তরুণ আহমদ ছফা, বাংলা একাডেমীতে বক্তৃতা দিচ্ছেন।

আমাদের তরুণ ছেলেরা যেটা বুঝতে চাইছেন না, একটা কাজের জন্যে একটা সাধনা দরকার। একটা অন্যরকম…পুরাপুরি না হলেও এক ধরনের আইসোলেশন দরকার।

আশীষ: আইসোলেশন ফ্রম?

ছফা: ফ্রম দি ক্রাউড।

রাইসু: আচ্ছা ছফা ভাই, একটা কথা জিগ্যেশ করি, আপনি এখনো জীবন ধারণ করে আছেন কেন, আত্মহত্যা করেন নাই কেন?

ছফা: আত্মহত্যা করার আমার ইনস্টিংট ছিল খুব প্রবল। আমার মারে কীভাবে কাঁদাবো, বাপরে কীভাবে কাঁদাবো…আমি যদি মারা যাই ওরা কীভাবে কাঁদবে খুব দেখার ইচ্ছা আর কি। এই উপলব্ধিটা তো অনেক পরের। আমি ক্রমাগত ভয় দেখাতাম, ট্রেনের গোড়ায় গোড়ায় বসে থাকতাম। টাকার জন্য, পয়সার জন্য।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: ঢাকা, ১৯৯৬

—-
ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts