শ্রদ্ধাঞ্জলি: কবি সমুদ্র গুপ্তকে

papri_rahman
Published : 22 July 2008, 05:35 AM
Updated : 22 July 2008, 05:35 AM

কে না মৃত্যুর পায়ের শব্দ পায়! কবি, ফল বিক্রেতা, মধ্যদিবসের সুঠাম নারী — শীতের রাতে যারা গভীর ঘুমে অচেতন, তাঁরা — আর যাঁরা গ্রীষ্মের

…….
সমুদ্র গুপ্ত, (সিরাজগঞ্জ ২৩/৬/১৯৪৬ — ব্যাঙ্গালুরু, ভারত ১৯/৭/২০০৮)
…….
পান্থশালায় জড়ো হয়ে দক্ষিণের বারান্দায় — সবাই হাওয়ার মধ্যে এই দাম্ভিক মৃতুর দরোজা খোলার অপেক্ষাই করে — তথাপি আমরা যারা অমরতার কথা বলি, তারা নশ্বর মানুষ! কোনো পতঙ্গ বা বৃক্ষের পক্ষে যা বলা সম্ভব হয়নি।

কবি সমুদ্র গুপ্ত কি ঋতুচক্রের মাঝে বর্ষাকালকে বেশি ভালবাসতেন? তিনি যখন জন্মেছিলেন তখন কি আকাশ মেঘে মেঘে ঢাকা ছিল? সুর্মারঙা মেঘ, কালোকেশর মেঘ, নাকি শিমুলতুলার মতো সাদা মেঘের তলায় সূর্য লুকানো ছিল? অজস্র সূঁচের মতো ঝরে পড়া ঝিরিঝিরি বৃষ্টিপাতে কি পৃথিবী সদ্য ভিজতে শুরু করেছিল? অথবা তুমুল বর্ষণে একেবারে নেয়ে উঠেছিল প্রকৃতি? কবির জন্মদিন ২৩ জুন। বর্ষাজন্মা কবি। এবং তিনি চলে গেলেন ১৯ জুলাই। ঘোর শ্রাবণের এক সকালে! গত বছর ২৪ জুন বৃষ্টি মাথায় করে আমি শাহবাগ পৌঁছেছিলাম। আজিজ মার্কেটের দোতলার 'মুক্তচিন্তায়' ফুলের Bouquit দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। এত ফুলের সমারোহ কেন হঠাৎ? ফুলগুলো তখনো একেবারে মলিন হয়ে ওঠেনি! কয়েকটা পাপড়িতে সদ্য কালচে দাগ পড়তে শুরু করেছে। Bouquit-এর শরীরে সাঁটানো ছিল কবি সমুদ্র গুপ্তের শুভ জন্মদিন। আমার মন খারাপ হয়ে গেল! ইস! ভীষণ মিস করলাম! কবির জন্মদিনে উইশ করতে পারলাম না!

কবি সমুদ্র গুপ্তের সঙ্গে যখনই আমার দেখা হয়েছে তখনই তাঁকে ঋষির মতো মনে হয়েছে। সৌম্য, শান্ত, স্নিগ্ধ, নিষ্পাপ, নির্জন, সরল। হতে পারে তাঁর সফেদ বাবরি চুল, গোঁফ অথবা একটু বেশি চুপচাপ থাকার কারণে। ওই 'মুক্তচিন্তায়' বসেই তাঁর সঙ্গে আমার দুই-চার বার চা পানের সৌভাগ্য হয়েছে। কবির সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তাও বলেছি। কবি ছিলেন সদা হাস্যোজ্জ্বল। তাঁর বয়সের তুলনায় অনেক বেশি সতেজ। তাঁকে দেখে আমার কখনো মনে হয়নি কোনো অসুখ তিনি বয়ে চলেছেন। অথবা মৃত্যুর কালোঘোড়ার দিকে এগিয়ে চলেছেন।

আমার উপন্যাস বয়ন-এর কাজ নিয়ে আমি তখন এতটাই দিশেহারা যে 'মুক্তচিন্তার' শিহাব ভাইকে ম্যাটার দেয়া-নেয়া, প্র"ফ দেখার যাতাকলের নিচে একেবারে নাস্তানাবুদ অবস্থা। আমার এই দশা যে কবি খেয়াল করছেন ঘুণাক্ষরেও তা বুঝতে পারিনি! বুঝতে পারলাম ফেব্রুয়ারির মেলায় যখন বইটি প্রকাশ পেল। বাংলা একাডেমির প্রেস ম্যানেজার সাজজাদ আরেফিনের রুমে সারাক্ষণই গুণীজনদের সমাবেশ — কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা, প্রাবন্ধিক আহমাদ মাযহার, শিশু সাহিত্যিক লুৎফর রহমান রিটন, আমিরুল ইসলাম, কবি সুহিতা সুলতানা, কবি সমুদ্র গুপ্তসহ অনেককেই দেখি। এরই মাঝে কবি সমুদ্র গুপ্ত হঠাৎ একদিন বললেন —

'আজ তোমাকে অনেক গোছানো আর স্থির লাগছে।' বলেই কবি মুহম্মদ নুরুল হুদার দিকে ফিরে বললেন, 'এই বইটির কাজ করার সময় ওকে তো দ্যাখো নাই — বাপরে! কী যে অবস্থা! একেবারে পাগল দশা!'

কবি নুরুল হুদা হেসে বললেন, 'যাই বলেন ওই কাজ-পাগল-দশারও একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে।'

কবি সমুদ্র গুপ্ত তাঁর স্বভাব সৌন্দর্যে ঘর ভরিয়ে দিয়ে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, 'তা তুমি ঠিকই বলেছ।'

তারপর দুই কবির কৈশোর-যৌবনের নানা স্মৃতি আর কাজের কথা। আর আমি নিরব শ্রোতা। বইমেলা শেষ হলে দীর্ঘদিন আর শাহবাগে যাওয়া হয়নি। হঠাৎ পত্রিকার পাতায় কবির অসুস্থতার সংবাদে চমকে উঠলাম। কবি সমুদ্র গুপ্ত অসুস্থ! কিন্তু কবিকে দেখে তো একবারও বুঝতে পারিনি তিনি অসুস্থ!

দেখলাম কবির চিকিৎসার ব্যয় বহনের জন্য কবিকন্যা স্বপ্ন সমুদ্রসহ সকলের নানান প্রচেষ্টা চলচ্চিত্র উৎসব, আবৃত্তি-সঙ্গীতসন্ধ্যা ইত্যাদি। পত্রিকার পাতায় এসব পড়ে ভীষণ আনন্দ লাগছিল — আমাদের দেশটা এখনো তাহলে নষ্টদের অধিকারে চলে যায়নি! এখনো আমাদের সুহৃদ-স্বজনেরা আছেন! আমরা এখনো ধরতে পারি একে অন্যের হাত!

এইসব দেখেশুনে আশায় বুক বেঁধেছি — কবি নিশ্চয়ই সুস্থ হয়ে উঠবেন। সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসবেন। ফের আজিজ মার্কেটে তাঁর সঙ্গে দেখা হবে, কথা হবে। এত মানুষের ভালোবাসাই হয়তো তাঁকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেবে। ফের আমি তাঁর জন্মদিনের পরদিন হাজির হয়ে অর্ধমলিন পুষ্পাঞ্জলি দেখতে পাবো। কিন্তু আমি জানতাম না মৃত্যু কখনো বন্ধুর মতো নয়। সে কোনোদিন অনুতপ্ত হয় না। অপ্রিয় কথার পরে কাঁপে না তার আত্মা।

কিন্তু কবি তো দুঃসাহসী হয়ে লিখেছেন —
এইভাবে স্বপ্নে আর দুঃস্বপ্নে আবর্তিত হতে থাকা কতোদিন আর কতোকাল
মন ও মননে অমন
উত্থিত কি আবার আসবে না
হে মাছি
স্বপ্নের দ্রুততার পক্ষ ঘূর্ণনে বসানো হে
এখনো মরিনি আমি বেঁচে আছি

হ্যাঁ — আমরাও জানি তিনি বেঁচে আছেন। নিশ্চয়ই বেঁচে আছেন।

কৃতজ্ঞতা: সিকদার আমিনুল হকের 'মৃত্যু এক শীতল শৈশব'