ব্রহ্মাণ্ডের ইসকুল

shamim_reza
Published : 2 August 2008, 09:28 AM
Updated : 2 August 2008, 09:28 AM

বিসর্জনের প্রতিমার মতো ভাইসা যাচ্ছি কূল থেইকা কূলে জোয়ার ভাটায়, নক্ষত্র থেইকা অপার অন্ধকারে… অন্তিম চাহুনি ভাইসা গেছে স্বপ্নের জলের বহু আগে দুঃস্বপ্নের অন্তহীন রাতে। নিরন্তর আশ্বাসে যারা কাহিনী লিখাছে তাদের প্রতি করুণা বর্ষণ করি, অন্তহীন মৃত্যুর জমপেশ এই উৎসবে। তোমাদের অভিসম্পাত দেই আর জিজ্ঞাস করতে চাই, পায়রা রঙের দিন ছিল কোন কালে কবে? এথেনসের জন্মঘড়ি থাইমাছিল কলিঙ্গের মৃত উৎসবে, অন্ধকারের পটভূমি লেখা আছে উদয়গিরি, অস্তগিরির গায়, দেখো দেখো নগরীর সমস্ত নিষ্প্রাণ আলো বিমর্ষ তাকায়। মৃত্যু তুমি কোন গ্লানি রেখা মুইছা দিতে চাও আমার সবুজ ডানায়… শূন্যে শূন্যে সংঘর্ষ রেখা আঁইকা যাবো মৃতপ্রায় স্তনের গোল কমলালেবু চিহ্নের উপর, তোমার শরীর আর শরীরের ভেতর যত প্রিয় মেঘ আছে সব আমি বৃষ্টি হয়া ভইরা দেব রক্তধারায়। অহেতু নিরুদ্দেশ যাত্রাকালে তোমার শরীর কাবার মিনার ভেবে জিয়ারত ছলে পোড়া নক্ষত্রের স্বাদ পাইয়া চুপি চুপি ফিরাছি ডেরায়। চোখের তারায় নগ্ন নারী দেহের মতো বিদ্যুৎ চমকায়, সেই থেইকা… গ্যাস চেম্বারে পুরো সাতটা বসন্তকাল ঘুমানোর আগে, অনন্ত মরুর দিকে চাইয়া থাইকে শুধু কিছু উটের ওলানের ছায়া আটকে যাইতে দেইখাছি অপোগণ্ড রাতে। একি দৃষ্টির বিলোড়ন!…

গভীর অন্ধকারের দিকে যেতে যেতে নিমজ্জিত জাহাজের হুইলে হাত রাইখা দেখেছি স্বাধীন মাছের সংঘারাম, পটশূন্য কার্তিকের মাঠে তোমার আমার কঙ্কাল ছায়া পইড়া আছে খড়ের ভাঁজে। কী সব অনুভূতির কেলি শুয়োরের সদ্য আগুনের অক্ষরের মতো পোড়ে মনে, চারিদিকে বিবস্ত্র বিশুদ্ধ অযুক্তির ভিতর থেইকা পাশা হাতে কতিপয় মুখ প্রেমিকার স্তন কাইটা জুয়া খেলে রাতে; অসমাপ্ত গল্পের পোকা শাইন জাল বুইনা চলে গভীর অক্ষরে, আততায়ী চোখে ঠাণ্ডা আগুন বাড়ে, আর কতিপয় বন্য শুকোর তার চোখ থেইকা নামে হৃদয়ের সবুজ কফিক্ষেতে, স্খলিত ঈশ্বরীর স্তনে মুখ রেখে তীরে বিদ্ধ করি জোছনার শরীর, কী সব অনুভূতির কেলি শ্মশানের সদ্য আগুনের অক্ষরের মতো পোড়ে মনে, ঘোড়ার কঙ্কাল হাঁটে কলিঙ্গের রাজপথে, সেইসব খোরাসানী ঘোড়া — ঘুড়ির খোঁজে মধ্যরাত শেষে নাইমা আসে আমাদের গাঁয়, সিডরের বাণ তখন হেমন্তের সমস্ত জানালা ভাইঙা দিয়া যায়।

কোনো এক কঠিন অন্ধকারের পায়ে বারবার ঘুঙুর বাঁইধা অসমাপ্ত গল্পের পোকা জাল বুইনা চলে গভীর নিরুদ্দেশে… সূর্যার রথারহণকালে তুমি কেন মৃত আপেলের ঠোঁটে কামড় দিছিলা? চারিদিকে রক্তের নেশা, রাত্রির কঙ্কালে মৃত খোলা ঝিনুকের মতো যোনির লাবণ্য ছড়ায়; তবুও কোথাও জন্মের উদ্ভাস চোখে পড়ে, মৃত্যুর আহ্বানে। এ কোন আদিম রূপকথার জোছনায় ডাকছো তুমি, প্রিয়তমার নিঃশ্বাসের ভিতর থেইকা হায়ানার সাদা দাঁত বাইর হয়, জোছনা রঙে; ঐ দেখো, ইন্দ্র তুচ্ছ সাধন ত্রুটিতে নিদ্রিতা প্রিয়তমা দিতির গর্ভে প্রবেশ করে ভ্রূণ খণ্ডিত করে যোগমায়ায়; এত নিয়ম মেনে কীভাবে বেঁচে থাকা যায়? কী সব অনুভূতির কেলি শ্মশানের সদ্য আগুনের অক্ষরের মতো পোড়ে মনে; ও কালপুরুষ, তুমি সবার অলক্ষ্যে কী দেখছো অমন করে? দেখো দেখো জ্বলন্ত অঙ্গার তালুতে মুঠো কইরা তৈরি করছি স্বর্ণের বাড়, তোমাকে পড়াবো এমন অলঙ্কার।

আমি এক প্রদোষের যাদুকর; অদৃশ্য শকুনের ছোবলে উপরে গেছে আমার চোখ, বুকের সমস্ত প্রিয় অক্ষর, তবুও প্রত্নচিহ্ন মুইছা যাওয়া মৈথুনমূর্তির সমস্ত রূপ পাঠ শেষে ভালবাসার খাদ থেইকা দূরে দাঁড়াই বাসক সন্ধ্যায়; আর তখন আবহ দৃশ্যে সুর তোলে নীলাম্বরী হাওড়ের ঢেউ; আমি কি প্রমিথিউস, জিউসের ঈগলের ছোবলে ছোবলে পুনঃ পুনঃ যকৃত জন্ম যার, ককেসাস পর্বত ঢালে; নাকি মা-কালীর অনাড়ম্বর সন্তান যাকে ধ্বংসের জন্য পাঠানো হয়েছে আনবিক- অমানবিক এই মৃত্তিকায়, সমুদ্র সৈকতে জন্মানো বিলি কাটা লাল কাঁকড়ার মতো আমার অন্ধ চোখ থেইকা বেরিয়ে আসে সাদা কবুতর, আর তখন পাগলা গারদের দেয়ালে সমস্ত রহস্য উন্মোচিত হতে থাকে, মেথরপট্টিতেই শুধু চড়সের ঘোরে নাচে কৈতর — তোমরা যাকে তুচ্ছ করো, তোমরা কমলালেবুর মতো গোল সার্কাস মাঠে ইঁদুর-বিড়াল খেলার মায়ায় গল্প ফাঁদো। প্রতিটি মজা পুকুরে ডুমুর বিষ ছড়াতে ছড়াতে প্রিয় মাছগুলি মেরে জোছনা তাড়াও। ভাবো, জলবেশ্যাদের উপবাসী রাতে ঈশ্বরের নপুংশক শিশ্নের কথা, ভাবো আমার অন্ধ চোখের গোলকধাঁধায় নিমজ্জিত হাজার বছরের না ঘুমানোর কথা।

জীবন-জুয়ার কোর্টে টিকটিকির মতো লাফালাফি করে আমার অবিশ্বস্ত আঙুল, মুমূর্ষু গ্রামের দেয়ালে সারারাত সুর তোলে নদীর ভাঙন, আর টিকটিকি চোখে তুচ্ছ পতনের মতো ভাসি ঘূর্ণিজলের ছায়ায়; সরোদের সুর শুনি ভাঙনের গাঁয়… সুরের ভিতর থেইকা একটা আত্মঘাতী বাইসন কীভাবে যে তাইড়া আসে নিরীহ অনুভূতির পাড়ায়। আমিও যোগমায়ায় ডুইবা যেতে চাই প্রিয়তমা তোমার অপর দিঘির ভিতর… শত্রুতায় নয় শুধু ভালবাসায়, ও কালপুরুষ জ্বলন্ত অঙ্গার বুকে পুইড়া রাখি যেখানে ভালবাসা ফুরায়।

বিক্রি হয়া যাওয়া সেবাদাসীর চোখের মতো আমার চোখে ভাসে শৈশবের অন্তহীন নক্ষত্রের পথ, সমস্ত হাওড়ের স্থির জল বুকে পুইষা পুইষা মেলাই প্রত্নযুগের হারানো অক্ষর। সৃজনের পিছের আঁধার দেখতে চেও না তুমি, চারিদিকে মিলবে শুধু অদ্ভুত-অদ্ভুত মরুভূমি, মরুভূমিরও সৌন্দর্য আছে, এমন কি মরীচিকার। জানো কি, অসীম কালের কোন রেদ্যার টানে, গ্রহের দেহ পাল্টায় ভাটা আর জোয়ারের বানে;
শৈশবের কথা মনে এলে টেঙো আর সানাই বেজে ওঠে বৃক্ষ শাখায়। এখনও তারা যেন ইসকুল মাঠে বৌচি খেলার ছলে নক্ষত্র বাজায়। পাহাড়ি রাস্তার ভাঁজ খুলে দুর্গম গিরি অতিক্রমের পর মনে হলো এ যেন তোমার অসমাপ্ত সুর আর শরীর, প্রাচীন পাণ্ডুলিপির অক্ষর আবিষ্কারের নেশায় পেয়েছে আজ: সারারাত ধরে ঘুমের সঙ্গে যুদ্ধ, প্রার্থনার মতো পইড়া থাকা বিকলাঙ্গ পিতার মুখ, আলো না অন্ধকার ছড়ায় — এ কথা বলা দায়, এ আর এক যুদ্ধের পরিহাস, রাত্রিকে তার অন্ধকার নিয়া থাকতে দাও, রাত্রি শেষেই তো সকালের সবুজ গান, একথা বলে গেল অচেনা এক কবুতর।

দ্রাক্ষাবনের কাছে শান্তির বাণী শোনাবে বলে যে মেয়ে ক্রীতদাসী হয়া বিক্রি হয়া গেলো ত্রিপলীর মন্দির থেকে অবেলায়; সেইই ছিল আমার রক্তের বোন, তাকে এখন পাবো কোন অ্যাসিরীয়ায়। হায় নিশাপুর, খৈয়াম, তোমাকে দেখবে বলে রুমী গিয়াছিলে… তোমার ডেরায়, হাফিজের সাথে ছিলাম আমি — একটি হ্রদের পিছনে পিছনে সমুদ্র হাতে হেঁটেছি কাল থেকে কালের ফুলশয্যায়। হায় সেবাদাসী তোমার পাঠানো চিঠি থেইকা অক্ষরগুলা ক্রমাগত কোথায় যেন ঝইরা ঝইরা যায়, একদিন যারা তোমার শরীর পরিভ্রমণ শেষে স্বর্গের নয়টি স্তবক এক করেছিল মিথ্যা ভালবেসে, তারা আজ কোথায়? অথচ তোমার সমুদ্রের বিভিন্ন সত্তা এই গ্রহটি সাতটি নাম পরিগ্রহণ শেষে একটি নামে মিশে গেছে একই আত্মায়, আত্মা থেকে একটি সুর সমস্ত পাখিদের কণ্ঠে পৌঁছে গেলে পৃথিবীতে ভিন্ন ভিন্ন সুরের সিম্ফনি তৈরি হয়, এই সুর বুকে কইরে সপ্ত আসমান সপ্ত জমিন উপরে নিচে খুঁইজা কোথাও পাওয়া গেল না সপ্ত আসমান জমিনের রূপভার, সপ্তর্ষিমণ্ডলে ঘুইরা ফিইরা আইসাছি এবার। নক্ষত্র আর নক্ষত্রের গোলকধাঁধাকে মহাজন এক কবি ভেবেছেন অনন্তশয্যার এই স্বপ্নগোলক, যাকে তোমরা অন্য নামে জানো।

এতদিন পরে আমি জেনে গেছি সমস্ত জ্যোতির্ময় গোলক পাওয়া যাবে আমার আত্মার ভিতর — আর এই জ্যোতির্ময় গোলকের ভিতরই আমার আবর্তন। জমিন কি আসলেই আকাশের ক্রীতদাস? দেহ কি আত্মার, তুমি কি আমার…? মাকড়শার নিপুণ জালে যেমন পোকামাকড় আটকে যায় তুমি আটকে গেছো গভীর গোপনের গোপন গোপনীয়তায়; পর্বতের শেষ শিখর স্পর্শশেষে খ্যাতির মোহে আর উন্মাদনায় মেতে উঠছিলা সবকিছু জেনে; নিচেই উপত্যকা গভীর খাদ — জানো তো তোমাকে নামতে হবে শেষ স্টেশনে, চূড়ায় উঠলেই আরো নিচে…হয়তো নামতে হবে নিস্তব্ধতারই জলে, জানি আমাদের এই ছোট্ট গ্রহখানি ছড়ায়ে পড়বে মহা বিস্মরণে অন্য কোনোখানে… সব প্রতিশ্রুতি ভাইঙা চইলা যাবে নিঃস্তব্ধতার গানে, অসংখ্য ঘূর্ণনে যখন মাতৃগর্ভ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলাম সেদিন ছিল না অফুরান আলো — সেই তো নিঃসঙ্গ হলাম, আবার ফিরে যাব স্তব্ধতার দেশে, ঐ দেখো মৃত মানুষ জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর এক একটা উজ্জ্বল আলো হয়া ভাসে।

যে আমি জ্ঞানের কাছে বিনম্র, যে আমি বেহেশতের চাবি হারায়েছি মেথরপাড়ায় — যা আমি খুঁজতে চাই না আর — এ এখন জাইনা গেছি অর্জনের আকাঙ্ক্ষাই যদি তাৎপর্য হয়, তবে তুমি অর্জন হেতু মৃত, তমসার। তমসার পক্ষপাত হয়ো না মানুষ — মানুষের অতীত ভবিষ্যৎ নেই — থাকে শুধু মানবতা- ভালবাসায় — একথা বলেছিলা তুমি। জানো তো স্খলিত ঈশ্বরীর পা থেইকা ঘুঙুর সইরা গেছে আজ ঘৃণায়। উত্তর দিকে চাইয়া দেখো ওইসব খোরাসানী ঘোড়ার কঙ্কাল আজ বাতাসে নাচে — বাবুরনামার পৃষ্ঠা থেইকা কামান আর শাদা শাদা ঘোড়ারা সব ঝইরা গেছে অবশেষে, সাপের খোলশে হেমন্ত ঢুইকা বইসা আছে আজ, সম্মুখের পথ আগামীর গান গাইয়ে ওঠে বলে অনুসরণ করো আলোর নদীর দিকে যাত্রার… অথচ তোমার বুক পকেট থেইকা অনাহুত পোকার মতো বেরিয়ে আসছে অদ্ভুত সব শাদা শাদা খরগোশ; আত্মাকে খরস্রোতা জলের মতো করে মস্তক অন্বেষার কাজে লাগায়ে সেইসব খরগোশের বাড়ি যাব এবার।

বিগত সব বসন্তে স্মৃতির করিডোরে গোপনে হাঁইটা গেছি নীল নদের ডানায়, মনপোড়া ছাইহীনতার ভিতর দাঁড়ায়েছি এই শিশুগাছ; সেইলেনাস হে অর্ধমানব, তোমার সিম্ফনির ধ্বনির অনুরোধ, শৈশবের কৌটায় যে রাণীর প্রাণভোমরা আটকে ছিল সমুদ্র তলের পাতাল সিন্ধুকে — তাকে তুমি সুরের তালে তুইলা আনো এই সৈকতের নির্জন বালুরেখায়। পৃথিবী থেইকা সব স্বপ্নরেখা মুইছা যাচ্ছে, মৃত্যুর সিঁড়ির তলায় ঘুমাইয়া পড়েছে একে একে অবশেষে, পৃথিবীর সমস্ত কালো ঘোড়া একসাথে ঢুইকা যেত ঠাকুমার ঝুলির অন্দরে, সেসব ঠাকুমারা নাই, বিশাল আকাশ-মাঠ-দিগন্তরেখা ঢাইকা গেছে পোড়ামাটির বেশে। নিঃসঙ্গ শিশুবৃক্ষ আমি, ঠাকুমার ঝুলি থেইকা বের হয়া কালো হাতির পিঠে চড়ে বেরিয়েছি কাল থেকে কালে, এসব এখন কল্পনার দূরতম গ্রহ, স্বপ্ন ফবিয়া বইলে মুছে দিচ্ছো প্রিয় পায়রার উড়াল! শিকারীর ফেইলা যাওয়া মুহূর্তগুলির ভেতর মাছ হইয়া সাঁতরাই আর মাঝে মাঝে সুরের খোঁজে কাঁসারিপট্টির দিকে যাই — দেখি দূরের শহর উইঠা আসে বন্দি পাখির খোপে, ফ্ল্যাট মনে কইরা ঘুমাইয়া আছে প্রিয়তমা আমার, অনুগত একটা রাতের সরলতা হারানো ক্ষোভ মনে পড়ে, বসন্ত উচ্ছেদ কালে…

আমাদের চোখগুলা নিয়া যারা মার্বেল খেলেছে মধ্যদুপুরে পশ্চিমপাড়ায়, তাদের কথা এবার থাক, পাগল হবার কিছুদিন পূর্বে সে চোখ বন্ধ করে হাঁটতো আর মধ্যরাতে একটা সাদা ঘোড়া তার বুক থেইকা বাইর কইরা তার পিঠে চইড়া মিলায়ে যেত দূর টিলার উদিত রেখায়, সকালে ট্রেনের হুইসেলের মধ্যে বিরান মাঠের নিঃসঙ্গতা বাজতো তার কানে, আর আমরা দেখতাম শ্রীচৈতন্যের হাড়পোড়া ছাই হাতে সে সূর্যরশ্মি আঁচলে গাঁইথা দুপুর উড়ায়। আমি হাতির চামড়ার তাবু তলে অনুগত একটি রাতের পিঠে চইড়া ছুটছি অদৃশ্য শিকারের খোঁজে… এবার সমুদ্রকে শিকার করবো জেনে হনুমান পিঠে করে পালায়েছে তারা, দেখা হবে ভূশণ্ডির প্যারেড গ্রাউন্ডে… আসলে কী চোখ বন্ধ কইরা হাঁটতো সে? নাকি জন্মের পর পশ্চিম পাড়ার লোকেদের মার্বেলের প্রয়োজনে চোখ দুটা নিয়াছিল বড় অবেলায়। সাঁকো উপড়ে পইড়া ছিলা বারানী খালের উপর, তারপর কতবার পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ শেষে সমুদ্রকে কোলে নিয়া ঢুকেছে লেপের ভিতর। আর ব্রহ্মাণ্ড তুমি চোখ বুইজা ছিলা — যেন পাখি টুনটুনি! বিগত দিনের পুঁথির মতো অবেলায় পইড়া থাকা তার শৈশব ঋষি দৃষ্টিতে তাকায় আকাশের অন্তরালে — পৃথিবীর সব সুর সব পথ থাইমাছে যেখানে — সেই পথের ওপারে নাকি স্ট্রবেরির ঝোপ — সেখানে একাত্তরটা ব্রাউন-কালো জেব্রার চোখ পইড়া আছে আঙুর বাগানে। সাত মার্চে সিংহের গর্জন শোনার আগে বাগানখানা ছিল হায়ানার দখলে, এদিকে সরলতা গাছটি ঝড়ে উপড়ে নিয়া গেছে বিষখালী নদী — সেইসব পোড়ো কুঠীবাড়ি, তাঁতীদের গাঁও, বাড়ৈপাড়া, কৃষ্ণচূড়া গাছের ছালে যে নাম লিইখা ছিলা তুমি সেই প্রিয় নাম, আহা! সব-সব নিয়া গেছে অদৃশ্য বাইসন…

দূরে নাবিকের লাশ, সূর্যসেনের সেই ছেলেকে ভুইলা গেছি আজ। যে সূর্যকে মুঠো কইরা ব্রহ্মাণ্ড ঘুইরাছে অসীম ক্ষমায়, তোমরা তাকে পাগল বলেই জানো, হায়! নিদ্রাহীন শুক্লপক্ষের গুমগুম রাত — কুমারী মায়ের মেয়ে যার বিন্যস্ত বেনীতে নদী সাঁতরে গেছে — সাঁতরে গেছে পুলসিরাতের রাত, মুক্তিকামী মানুষের দীর্ঘশ্বাসের ডানায় আমার উড়াল — সারাদিন ধইরে বাল্যকালের হারানো মার্বেল খুঁজি — হাতে উইঠা আসে অচেনা গেরিলাদের অসমাপ্ত চোখের অক্ষর — আর সেইসব অক্ষর থেইকা বের হয়া আসছে মুক্তির অচেনা সবুজ পথ। ও রহস্য প্রতীম রাত — তোর পিঠে চইড়ে ছুটছি অদৃশ্য শিকারের খোঁজে — এদিকে কুমকুম কাঁপে অন্তিম সন্তাপে আগুন রঙে — একবার সমস্ত রহস্যের পকেট কেটে ফেলছিলা তুমি — বলছিলা এ ফসল যৌথহেতু জন্মবৃত্তান্ত নিয়া কখনো ভাবিনি, ডিএনএ ঘেটে দেখো — চূড়ান্ত বিচ্ছেদ কালে তোমারে কী কইরে বলি এ সন্তানের দায় আমার সকলি, আমার। আঙুল কাটার ইতিহাস লেপ্টে আছে, আজ তাঁতের শরীরে — ওসব ভুইলা গেছো তুমি — জাইনা গেছো সব জেলপাখি পলায়নপর নয় — জেলপাখি — আর নিরক্ষর জালুয়ার বউয়ের স্বাধীনতা কি একই সূত্রে গাঁথা…? একথা জানতে চেয়েছো তুমি। বরফকলের শব্দ বাজছে দূরে, জন্ম গুলতি হারায়ে বোবা-কালা বালিকা নেশাগ্রস্ত ঘোরে বিজনের মাঠে। নীল নীল ট্রেন-নীল আয়না নীল আসমান — চিতাবাঘের ক্ষুধার্ত নীল চোখে ভাসে বালিকার নিরীহ ঝিনুক যোনি। অবচেতনের পাহাড় চূড়ায় এ কার চিৎকার ধ্বনি, হৃদয়ের কাঁটাঝোপে হামাগুড়ি দিয়া নামে, অচেনা নদী আর এদিকে নগ্ননীলের ভিতর থেইকা অঞ্জলি হাতে তুমি উড়ছো নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে সেতু রেখায় রেখায়।

চুল থেইকা খইসা যাওয়া শ্লোকের মতো কিছু আঁধার এখনো আমাকে ডাকে, আমি দেখি শবাধারে পইড়া থাকা বিবর্ণ গোলাপ তুমি — প্রেম কি ফুটন্ত গোলাপের মতো কখনো ফোটার পরে নিদ্রা না যায়, নাকি ব্রাউন নর্তকীর উরুমূল থেইকা বেড়িয়ে আসা পাখির উড়াল? আসলে সে কি ঈশ্বরের স্বপ্নদোষে সৃষ্ট কোনো আদিগন্ধম ফল? এখন আমি নীল চোখ আর নীল জোছনার পার্থক্য খুঁজি, খৈয়ামের কলমে আঁকতে চাই আলআকসার মিনার, যাকে নর্তকীর স্তনের গোলকধাঁধার মতো মনে করে কতদিন মধুমক্ষিকার কাছে গিয়া তোমাকে খুঁইজাছে ওমর। তরল কফিনের মধ্যে জেগে ওঠা সভ্যতা সুহৃদ আগুনে পোড়ানোর আগে স্যাক্সোফোনের সুরে মাতৃগর্ভের নিজস্ব ঘোরে দোল খায় মন; মাহুতটুলীতে এখন কারা থাকে কিংবা ইংলিশ পাড়ায় — সেইসব মেয়েরা লালময়ূরের ডানায় মারিজুয়ানা ঘোরে জীবন বেঁইচাছে বাগের মাথায়। বাগের মাথার কথা মনে হইলে বাগেরহাটের কথা মনে পড়ে, আর তুমি মারা বাঘের চামড়ায় জীবিতের ধূসর রঙ খুঁজছিলা ঈশ্বরীর। মনে পড়ে সংখ্যালঘুর প্রতি হায়েনার অফুরান আহ্বান।

নগদের বায়না ছাইড়া দিয়া কালের আয়না রাখছি হাতে, তুমি জানো না বিষাক্ত সাপের খাঁচায় রাত কাটায়ে চিনাছি তোমায়, তোমার শয্যায় কোলবালিশ হয়া শুইয়া আছি শ্বেত শুভ্র লাশ। এও জানি জোছনা রাতে ম্লান শ্মশান গাত্রে আঁকা লাল গোলাপ তুমি। ভার্জিলের বন্ধু অগাস্টাস কিংবা হোরেস সাক্ষী, স্বর্গলোকের অধিপতি রীয়ার গর্ভে যার জন্ম সে আমার সন্তান। ভর সন্ধ্যায় নিমগ্নতা ভাইঙা পাখিদের কান্না থেইকা যে জল গড়াচ্ছে তাদের বাষ্প হয়া উইড়া যেতে দেখছি সুমেরু পর্বতে, আর তাই চারদিকে বরফের বিস্তরণ, জীবন থেইকা কেন এতদূরে গিয়াছিলা অমন হীম নিঃস্তব্ধতায় — বরফের নদী একাই যায়, কীসের টানে — নাকি সে দেখেছে আর্যদেবতাদের নাভিমূলে হীন বর্ণভেদ — নাকি, কালো ইংরাজ নেটিভ বামনদের দেখেছিল সে — দক্ষিণের বারান্দায় উজাগরি ছায়াপথ চুপিচুপি বইলে যায়, জানো কি? বলিভিয়ায় যত রক্ত পলাশ ফোটে চে গুয়েভারার চেহারায়, বর্ণভেদ দেখিনি কেউ এসব পলাশ-পাপড়িতে। মন জালুয়ার জাল ভুল জোছনায় ফেইলা ফেইলা একটা শীতকাল অদ্ভুত পাখি হয়া যেতে দেখি। শ্রাবণ পুইড়া যাচ্ছে ভুল বৃষ্টিতে, তোমার সন্দেহে বৈচিত্র্যহীন বেহেস্তে দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস বাষ্পিভূত হয়ে অচেনা নক্ষত্রের জন্ম দেয়। শিরদাঁড়ায় সন্দেহের শীতল রাত্রি নামে, আঙুরবালা দাদরা বাজায় আর রাতের রহস্য গলে গলে পড়ে নক্ষত্রের অগোচরে। নক্ষত্রের শরীর বেয়ে নাইমা আসা পাহাড়ি মেয়ে তেঁতুলপচা গন্ধ গায় তার, অভিযাগে বলে, মায়াপুরে তোমরা যারা পরীদের স্তনে মুখ রাইখা বিপন্ন বিস্ময়ের ঘোরে কাটছো সাঁতার তাদের বলি সময় চেতনায় মজে যাইও না ইতিহাসের পাতায় খোঁজো দূর কোনো হেলেনের অভিসার — আবারও প্রশ্ন কেন করো — টিকটিকির লেজের প্রাণ কীভাবে মর্মে নিলা তুমি? কীভাবে বলতে পারো দেবতা এক মুখোশের নাম? মৃত্যুবিষ — গিইলা তুমি কীভাবে করছো হজম? সমকামী পিঁপড়েদের মন্দিরে প্রস্তরলিপিতে আঁকা পাইছো ইভ আর আজাজিলের সঙ্গম, ইভের জন্মের বহুকাল আগে নাসপতি বনের অদূরে কে প্রথম ভূতগ্রস্তকালে উদ্ধত হয়াছিল আদিমাতার উপর — আর সেদিন একটা নতুন সকাল ঘুমায়ে ছিল তোমার নিপলের বিমূর্ত-মূর্ততার ভিতর।

আমিই কি সেই আদি পিতা? ভূতগ্রস্তকালে যার ছায়াপথ হারায়েছিল তোমার জলপাই ডানায়। আর তখন এক একটি নক্ষত্রের জন্ম, এদিকে ইঁদুর দাঁতে কাটছো তুমি হৃদয়ঘড়ি, তুমিই কি সেই আদিমাতা, যার বুকে ছিল খোরাসানী তরমুজের ঘ্রাণ। পূর্বজন্মের বীজ অন্তর্লীন ছিল চোখে তার; সাবওয়ে ধইরা আকাশ নামছে ভাঙা ব্রিজের ওপর — জেনে রাখো দীর্ঘশ্বাসেরও আছে দীর্ঘ দীর্ঘ সেতুর ইতিহাস, শিরার ভিতর দলিতের রক্ত চলাচল, বিমর্ষ অনুযোগে সিকান্দার তোমাকে বলি, অবিশ্বাসের দীর্ঘ সেতু হচ্ছি পাড়, সাপ ঝুইলা আছে সবুজ লতার ভিতর; গভীর সমুদ্রে নীলতিমিদের সমকামী গানে জরায়ুর মতো ফাটা চাঁদ ওঠে রূপকথার হারানো বাগানে। ভেনাসের মর্মর মূর্তির ভাঁজে জ্বলন্ত চুরুট ভিজে যায়, উগান্ডার রাজপথে ইদি আমিনের চোখ গলে সীসা ঝরে — আর সেই সীসা বুকে কইরা অভিশপ্ত কোন পথশিশু দৃষ্টি হারায় — তাহলে অন্ধ লোকটি মূর্ছনা নদী তীরে কুফরী কালামে কেন সুর তোলে? নিশিবক ছাপ ফেইলা আত্মঘাতী জোছনায় কেন ওড়ে? এসব দেখে নিঃসঙ্গ মধ্যরাত পাশ ফিইরা শোয়।

এবার পরিত্যক্ত এক সেবাদাসীর কথা বলবো যে কী না চন্দ্রগ্রহণকালে তার যুবতী স্তন ভোগ দিয়াছিল আর্যদেবতার কোলে অনিচ্ছায়, তারই সন্তান নাকি আমি? এ প্রশ্ন নিজকে করেছি বহু বহুবার, প্রতি সন্ধ্যাবেলা জুয়ার ছকে গোলাম গোলাম হয়ে ওদের হাতে হেরেছি হাজার বছর, হাজার হাজার জন্মের অন্ধকারে, তাই এবার দেবী ও দেবতাকে মধ্যরাতে দিয়াছি বেঁচে সুজনঘাটার ওপার, তেড়ে আসা উল্কার পিঠে চড়ে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে খুঁইজাছি প্রথম কুমারীর স্তনের ছাপ — যা কি না তোমার ছায়া বহন করে…

মহাকালের দিকে একটা সিপটিফিন ছুইড়া দেয়াই যথেষ্ট, যা দিয়া আটকায়া রাখছিলা তোমার কৌমার্য, হৃদয়ের ভিতরে আটকে যাওয়া মহাকাল আর তার সমস্ত মায়া বিক্রি করবো ভেবে যেই পশরা সাজায়ে বসেছি অনন্তের পথে, অন্ধকারের উজ্জ্বলতায়, তখনই গুপ্তঘাটি থেইকা কে যেন আমায় তুইলা নিল, সেই কি প্রথম স্বাধীনতা হারালাম, নাকি স্বাধীন হলাম আমি? সেই কি প্রথম কৌমার্য ভেঙে ভিন্ন কোনো গন্ধমফলের স্বাদ এলো পৃথিবীতে, বন্ধন কি পরাধীনতা নাকি মুক্তির যে কোনো নাম?

হে জৈতুন বৃক্ষ, তুমি তোমার শারীর খোল পিছনেই আততায়ীর তীর, লক্ষ স্থির — জৈতুন বৃক্ষ আমার কথা শুনলো, আর আগলে নিল তার আপন অন্দরে, যেন প্রকৃত মা আমার, কিন্তু স্বার্থান্ধ জীবগুলা গাছটাকে টুকরা টুকরা করে ফেললো — আর আমি সেই থেইকা কাঠের ভিতর জাইগা আছি — অসীম ক্ষমায়, আমৃত্যু তোমাদের গৃহে, গৃহের অন্তরে, অন্দরে।

কেন এক কার্তিকের খরার রাতে টবের ফুলের পাশে অন্ধ চাঁদ শুইয়া আছে দেখে ভুবনেশ্বরের রাণী উন্মাদের মতো শরীর উড়ায়ে ছিল তারায় তারায়, আহা ভুবনেশ্বর যার দৃশ্যগন্ধে পুরোটা সময় চইলা গেল বাঁজাদের দখলে, সময়ের অন্তর্বাসে সময় — রহস্য লিপির মায়াযুগ থেকে কিছু প্রেমপত্র পাঠায়েছিল আমায়, অন্ধকার থেকে ছিলানো কুমারী জোছনার স্বর নেশাগ্রস্ত চাঁদের শরীরে আছড়ে পড়ে, তিমিগুলি আঁকা ছিল লিপির অন্দরে — আর লিপির ভিতর থেইকা বের হইয়া আসছিল ঋতুবতী মেয়েদের কফিন বক্স — আর কফিন বক্সের উপর লেখা — বাবার বাড়ি! স্বামীর বাড়ি! এই আমার বাড়ি এই আমার প্রকৃত ঘর — , ও দাসেরে নির্বাসিতের গান শুনাও — গানের মধ্য দিয়া বেরিয়ে আসবে ঝুমুরদলের সেই কিশোরী মেয়ে যে কি-না ছায়ারেখা আঁইকাছিল পাণ্ডলিড চিংড়িতে — অর্থাৎ শুরুর প্রথমভাগে পুরুষ আর মধ্যভাগে নারী হয়ে, হায়রে কোরাল দ্বীপ! নীলমাছ, র্যা শ মাছ তোমাদের জন্মের কালে কান্নাগুলা বিক্রি কইরাছি ফেরারি জোছনার সীমানায়, বনশীলায় সাদা পাখিটার মতো একা একা নির্জন ডাকি কুলহীন ভয়াল চরে, যেখানে চাঁদ একটা ফালতু পরকীয়া ফাঁদ বলে মনে হয়। জুয়াগ্রস্ত ফিউদরের হাত ধইরা একটু একটু করে খুন হইয়া যাওয়া আমার রক্তে আমি ভীষণ উল্লাসে মাতি।

বাঁইচা থাকার কতগুলা শর্ত দিয়াছিলা তুমি — মহাপ্রস্থান রাতে, আকাশের সব ক্যালিগ্রাফি ভেঙে পড়বে গোপন সংঘাতে, জানো তো তিব্বতের রাস্তায় অতীশের পায়ের ধুলো এখনো শান্তির বাণী হয়া কাঁদে, ঋষিরা অদৃশ্য পর্বতের সানুদেশে জোছনা গায় মেখে প্রতীক্ষা করে, কাকে চায় তারা — তাদেরই প্রতিনিধি নাকি তুমি? ওহে অন্ধ বাউল।

কসাইয়ের চাপাতির নিচে শান্ত মাংসপিণ্ড কাঁইপা কাঁইপা ওঠে কার, কফিনের ভাইঙা যাওয়া তক্তা থেইকা বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস আমাতে লুকায়, আমি কালো গরিলার চইলা যাওয়া দেখি, তারাগলা রাতের গর্ভে দেশত্যাগী পাখি কাঁদে খাদের চূড়ায়, অনন্তের দিকহীন জালে পেচায়ে গেছি আমি আর রাবেয়া বসরি, তার মুখ থেইকা বাইর হয় কিশোরী বেলার গোপন অক্ষর — অক্ষরে লেখা আছে শান্তি, শান্তিরেখার উপর মৃত পড়ে আছে কতিপয় জালালি কৈতর। নিজের লাশ বহন কইরা নিয়া যাচ্ছি আমি — জীবন জুয়ায় হেরে যাওয়া যুবককুমার, খড়ের চাতাল বইলা এ শহরে যা কিছু আছে তা নিয়া গেছে রাতচোরা পাখি। একটা মেঠো ইঁদুর মইরা পইড়া আছে ডাকবাক্সের নিচে, পিয়ন আর এ পাড়ায় হয়তো আসবে না কোনোদিন, তার প্রিয়তমার চিঠির পতিত বাক্সের খোঁজে ইঁদুরটা আইসাছিল বুঝি — কিছু অক্ষর আর কাগজের লোভে তুমিই কি সেই ইঁদুর, নাকি আমি? এদিকে ঈশা গাধার পিঠে চড়ে মরুঝড় থামাতে যাচ্ছে দীপ্ত আড়ম্বরে।

আমি চলমান নদীর কান্না দেইখা চোখের দীর্ঘশ্বাস ছড়ায়ে দিয়াছি প্রতিটি শ্লোকের বাণীর ভিতরে। বিষাদের পোর্ট্রেট হাতে তুমি বলছিলা শিকারী চোখের সব মন্ত্র শিখা গেছি আমি, প্রিয়ার হৃদয়পোড়া ছাই দিয়া বানায়েছি দাঁতের মাজন? আমাকে দাবানলের ভয় দেখিয়ে কী লাভ? এত জাল কারা পেতেছে কূলে? প্রিয়ার একটা তিলের জন্যে আজ আর আঙুরের দেশ সমরখন্দ বুখারা কেউ দিবে না সুন্দর হাতে তুলে; প্রেমের আয়ু আজ দু'মিনিটের বায়ুতে নাচে, মায়ের জরায়ু থেইকা ব্যবচ্ছেদ শেষে ভালবাসা ভাগ হয়া যায়, স্বপ্নও কি পোড়ে নিঃশ্বাস দ্রোহে, অদৃশ্য মানবের গায় জ্বর, আগুনে তৈয়ারি শরীর মনেতে সাঁটা তাম্র মোহর।

কালিপূর্ণিমা রাইত টেঙো বাজছে তারাদের গাঁয়, গান্ধারীর পুত্র দুর্যোধন মৃতপ্রায়, জালালী জোড়া কৈতর নিয়া বেহুলার গান গায় যুধিষ্ঠির কৈবর্তপাড়ায়। একটা ডুবন্ত চাঁদ নরম ঘাসের মইধ্য থেইকা ভাইসা ওঠে, ফিরিঙ্গির কোসা নৌকার পাটাতনে বসে কে তুমি মায়া দ্বারা মুক্ত করলা অভিশপ্ত খাঁচাজীবন, বয়সন্ধির চুমুতে ছিল প্রথম বিস্মরণ — নক্ষত্রে অবগাহন, এরপর বরফ নক্ষত্রের দেশে রুপালি রুপালি ট্রেন আসে, যাত্রী নাই, শূন্য আবিষ্কারের বহু আগে তুমি আইছিলা অচেনা সমুদ্রের নীল ভালবেসে, পথিবী জন্মেরও বহুকাল আগে — সেসব কথা লেখা আছে বৃক্ষের বাকলে পরাণকথার আড়ালে, অদৃশ্যের শাখায় শাখায়।

প্রাচীন নদীকথার খসড়ায় জলঘুঙুরের নৃত্যরেখা আঁকা আছে প্রিয়তমা, কালরাত্তিরে ঠাকুমার ঝুলি থেইকা দুয়োরানীর ফেইলা যাওয়া দেড় জোড়া হীরকখচিত ঘুঙুর পাওয়া গেছে — ময়না পাহাড়ের গাঁয়, হরপ্পার বহুকাল আগে পতিত এক প্রাচীন মৃৎ শয্যায়; আর সেখানেই নৃত্যরতা ছিলা তুমি, তোমার দীর্ঘশ্বাসের সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁইজে পাওয়া গেলো এক গ্লাস বাঘের দুধের ভিতর। মৃতদের শাদা জামায় বোতাম থাকে না, যেমন দীর্ঘশ্বাসের অর্থের ভিতর নির্বিকার বাতাসও গড়ায়, জানো তো আসন্ন মারীর মধ্যে যেতে যেতে তোমার ছেঁড়া শাড়ি আজ পতাকা হতে দেখেছি, তারপরও প্রশ্ন জাগে মনে তুমিই কি সাত ভাইয়ের এক বোন চম্পা, যার পায়ের ছাপচিত্র আঁকা ছিল প্রাচীন প্যাগাদাসের গায়? আজ শান্তিবিদ্ধ হয়া ঝুইলা আছে তোমার হৃৎপিণ্ড, মাংস দোকানের শিকের আড়ায়। হায়! একদিন তুমিই বলছিলা যেখানে জ্ঞান কোনো লাভের সম্ভাবনাই তৈরি করে না, সেখানে বিজ্ঞ হওয়া মানেই দুঃখ পাওয়া — আমি প্রতিবাদ করেছিলাম, আর তুমি সূচকলে গার্মেন্ট মেয়েদের দিকে আঙুল নির্দেশ করে আমার অলক্ষে চইলা গেলা আলেকজান্দ্রিয়া থেকে দক্ষিণের কোনো বন্দরে, আমি শৈশব বীজের ভিতর পুনঃ উদ্গম হেতু দেখতে পেলাম প্রেম ঘুমায়ে পইড়াছে যে মৃত নদীর পাড়ে সেখানে শরাহত এক দুপুর ঘুঘুর তানে অন্ধ বেহালাবাদক ছড়ে সুর তোলে, তোমাকে ডাকে আর তুমি আত্মার কাফেলা ছাইড়া ইসকুল বালিকার মতো মন্ত্রমুগ্ধ হয়া বইসা আছো সামনের বেঞ্চিতে নিরাকার, বানানো ঈশ্বরের ছায়ায়।

আমার মনে পইড়া যায় তাঙবংশীয় চীনা সম্রাটদের কথা যারা কী না, রক্ষিতাদের সতীত্ব রক্ষার্থে নিষিদ্ধ নগরীর প্রাসাদে রাখতো মহিলা কারারক্ষী — কেন মনে পড়ে এ কথার উত্তর জানি না আমি, যদিও এখনও এসব ঘটে আমাদের গাঁয়। বীজের স্বরের ভিতর সিন্ধুর ঢেউ কে কবে দেখেছে এমন প্রশ্নের জবাব চেয়ো না তুমি? কোন অসীম র্যাঁদার টানে গ্রহের কক্ষপথ পাল্টায় আর পৃথিবীতে নেমে আসে ক্যাটরিনা-সিডর নার্গিসের মতো অনিন্দ-প্রলয়-শিবাগ্রহ জোয়ার ভাটায়। হায় রাত্রি, যজ্ঞডুমুরের ফেটে যাবার শব্দে তুমি ভয় পাও, তোমার ভিতরের পোষা সিংহের ডাক শুনেছি আমি শৈশব নদীর ওপারে, অন্ধ বেহালাবাদক ছড় টানে এখনো অবেলায়; প্রেম ঘুমায়ে আছে মৃত নদীর ওপাড়ে — দূর থেইকা ডাক নামে ডাক দাও কেন তারে — ভুবনেশ্বর? হায় ভুবনডাঙার চিল। কেন ডাকো তারে, অসীম খেয়ায় অবেলায়, হস্তী সীলের হারেমেও থাকে অনেকগুলা মক্ষীরাণী সীল, একে মাছ না বলে অন্য কী নামে ডাকা যায়, একই কি খেলা চলে ব্রহ্মমণ্ডলে? সেখানেও কি পুরুষ নক্ষত্রের ডাকে এমনই ছুইটা আসে নারী নক্ষত্র সেবাদাসী সেজে? আমারই মায়ের মতো বোবা কালা স্বাধীনতা হীনতায়? সরস্বতী আর লক্ষ্মীকে সাজায়ে রেখেছি বাম পাঁজরের নিচে, শুধু জানতে চাই দেবতা আর ঈশ্বর কতকাল পুরুষ সেজে রূপকথার গামলার সমস্ত খাবার একা একা গিলে খাবে? আদর্শলিপির দিন চুকেছে সেই কবে, ফ্রকের চলও উইঠা গেছে আমাদের পৃথিবী থেকে, অনিন্দ উৎসবে ইংলিশ প্যান্ট পরে না কেউ, তবু কেন পৌরুষ আর উপনিবেশি মুখোশের ঢেউ, মনুসংহিতার ভিতর আঁতকে আঁতকে ওঠে! সুতোকাটা ঘুড়িটার খোঁজে শৈশবে বায়ু মণ্ডলে ঘুরে ঘুরে চাঁদের বুড়ির কাছে গল্প শুনেছি কত-কত এসব এখন শোনা হয় না অত শত।

প্রিয় বালিকার বয়ঃসন্ধির রহস্য — কাজলরেখা-গুনাইবিবির পালা আর সমস্ত দেবী কেন যে মা উতলা মাতৃভোগা, এ কথা বলেছেন বাংলোর বারান্দা জুড়ে হাস্নাহেনার জোনাকি ঘ্রাণ ছড়ানো সেই চাঁদের বুড়ি, আদিগন্ত অন্ধকারে হাপায় এখন, হৃদি শুনতে পাচ্ছো প্রিয় প্রিয় নাম — শূন্যে মহাশূন্যে গোলকধাঁধার মতো ঝিমায় নক্ষত্র বিভায়। সময়ের মধ্যে হাত-পা চালায়ে কী লাভ, খাদের বাঁক থেইকা কে যেন বলে শৃঙ্খলে রাখার এ আর এক উপায়, দেবীর ঘরে শলতে জ্বেলে অর্ঘ্য মারো পূজায় পূজায়! দুপাশে বেহালাবৃক্ষের প্রান্তর বনঝোপ সুরে ভাসে শিরশির পাহাড়ি হাওয়া — শলতে জ্বলছে অদ্ভুত জোছনায়।

মন্দির বলতেই যৌনমন্দিরের গান ভাইসা কেন ওঠে মনে?… একথা অন্ধ বেহালাবাদকের — একি হোমার — না কি তার পূর্ব কোনো পুরুষ? সে কেন খাদের বাঁক থেইকা নাম ধইরা ডাকে — আর বলে এবার সমস্ত ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি পাঠাচ্ছি দূরাগত কোনো দেবতার ঠিকানায়। ডুবরি চোখে সমুদ্রের তলদেশ দেখতে পাচ্ছ বইলা ভেবো না জাইনা গেছো আপন অন্দর। ঢেউয়ের নেশা অপ্রতিরোধ্য, বাঁইকা যাওয়া বীজ থেইকা উত্থিত স্বপ্নীল বীজ আমি — আদিবাসী ওম শরীরে আমার, তোমরা আকাশ স্পর্শ করতে পারো জাইনা দুহাতে আগুন পুইড়ে শায়ারীর গুপ্ত করাত হাতে ছুটছি মৃতদের পোঁয়াতি পাড়ায়। সেখানেই অন্ধ বেহালাবাদকের সাথে দেখা, সুরের মূর্ছনায় পরানকথার শরীর থেইকা বের হয়া আসছে ছোট্টবেলার পড়া যুবতী কাজলরেখা — আর তাকে দেখছি নিরুদ্দেশ ছায়াপথে ধূলা উড়ায়ে আজ সাকিরার কণ্ঠে স্পানিশ গান গেয়ে রাত্রি ফুরায়… এদিকে কাজলা দিদি বাগানের গায়ে লেপ্টে থাইকা চন্দ্র হাতে আমাকে ডাকে আদুরে গলায়, রূপকথার সব সুয়োরাণী দুয়োরাণীর শরীর পাল্টায়, হায় আলেখ্যলিপি দৃশ্যের পট — পাল্টায় পার্কের বেঞ্চ, আর আমরা দেখি অনাহারী মানুষের শরীর চাইটা খাওয়া এক একটা দিন গুঞ্জারমালার পুতির মতো ঝইরা পইড়া যায় সবার অলক্ষ্যে। প্রতিদিন অসংখ্য চিঠি আসে শোকে-চের ভিতর তারা ঘুমায়, পিয়ন এপাড়ায় আসে না স্বাধীনতার পরই ডাকের ভিতর ভাঁজ-করা চিঠির অক্ষর মুক্তা হয়ে গড়ায় সমুদ্র চড়ায়। শিশুঘুমে নিঃস্তব্ধ এত এত বছর। দিগন্তের ছায়া আইসা গাঁইথা গেছে ভিন্ন রূপকথার গাঁয়, মাঠ বাইয়া যে ছায়া মিইশা গেছে হৃদয়ের ঘুমন্ত বন্দরে — না ঘুমের রাত্তিরে তারে কেন আনমনে এড়াতে চাও, কোথাও অচেনা পাখির শিস চিঠির অক্ষর নিয়া কেঁদে ওঠে, খুব চেনা মনে হয় — এমন কি তোমাদেরও ঘটে অঘ্রাণের শেষরাতে ?… যখন জলপাই রঙের গাড়ি ঝলসে দিয়া যায় রাস্তা, ঘাট, মনের দরজায়। নিস্তব্ধতার মানে মুখোমুখি শিকারী চোখ নিয়া ইঁদুর বিড়াল খোঁজা? নাকি আহত শিকার চোখে নিঃশব্দ জলের পতন দূরে বাদ্য বেজে ওঠে অচিনপাড়ায় — এ খেলা চিরকালের।

বরিশালের পথে লঞ্চের কেবিনে বসে রাত পান আর নদীকে নারী মনে করে কে কবে ভাসায়েছো ভেলা — কোথায় পালালো আজ কথকঠাকুর, এই ঘুমন্ত বেলায় — অন্তহীন প্রসববেদনায় রাত জাগে, ভূমিষ্ঠ হবার অপেক্ষায়, নীলিমায় নিঙড়ানো ঘাসে হাত রেখে অন্ধ বেহালাবাদক সুর তোলে অন্তরীক্ষে বেলা-অবেলায়, আর চালতা ফুলের মতো শোভিত সফেদ স্তন জাগে গরিব মেয়ের বুকে।

আবার কোথাও নির্জনে অচেনা পাখির শিস শুইনা তোমার কিশোরী কণ্ঠে শোনা পিয়া পিয়া ডাক মনে পড়ে নওরীন, এই অবেলায়, মাঠ বেয়ে যে ছায়া মায়া হয়া মিশা গেছে হৃদয়ের নির্জন গুহায়, তার কথা সতের বছর পর কেন ভূমিষ্ঠ হয় — ভালুকবাদুরের মতো স্বমেহনে মেতে উঠি এই অবেলায়। বিশ্বস্ততার ছুটি নিয়া কেন কান্নাগুলা বিক্রি কইরা চইলা গেলা হাজতি পাড়ায়। ইচ্ছের হাতে হাতকড়া পইরা তুমি কেন পইড়া আছো অচেতন গাঁয়। এইসব কথা জেনে পৃথিবীর সব অন্তঃস্বত্ত্বা নারীর গর্ভ থেইকা ভ্রণেরা বের হয়া বিভিন্ন নামে উড়তাচ্ছে মহাকালের অন্ধখারায়। হার্টের বাল্ব দিয়া কি দেশলাই জ্বলে? তোমার বুকের চারণভূমিতে হরিণ হয়া ছুইটাছি অফুরন্ত বেলায়, আর রিরংসার পাকে কত কত পোকা মরে পড়ে থাকে; তখন রাজ-রক্ষিতার মুখ মনে আসে, আসে প্রিয় মুখ — যা সেলাই করা হয়েছে জন্মের আগে। তবুও তো দেখি কুলহীন ভূমিরেখা জলরেখার অন্তর্বাসে জাগে, সামরিক রাষ্ট্রের দিকে থু-থু দিতে দিতে মনে হয় পাখিদের রাষ্ট্রে অস্ত্র হাতে কোন দানব দাঁড়ায়ে থাকে? হায় নির্জন ভিটামাটি জন্মভূমি আমার, তোমার দু'কাঁধে নাকি মুনকার নাকির বইসা বইসা ডায়েরি লেখে স্বমেহনবেলার! অনুরাগ জ্বলে মুহ্যমান সন্ধ্যায়। দেখে যাও একটি অনাথ বাচ্চা আর কত করুণ হলে পরে, ডানা গজানোর আগে চোখ দুটা বিক্রি হয়েছে তার অগোচরে। আমিই কি সেই বাচ্চা পাখি ত্রিভুবনের বাইরেও এক ভুবন ছিল যার!

জন্মের বন্ধনে যে মায়া তার, মুক্তিতে যিনি অকৃতদার, যাত্রী কি জানে গন্তব্যের শেষ কোথায় — পারাপারের মধ্য সীমায় সময়রেখা কোথায় হারায়ে যায় — ওপাড়ে যেতে হলে অচিন এক পাখি ডেথ সার্টিফিকেট চায় — হায় অনন্তের পাড়, কবরস্থানে বাঁশের কঞ্চি থেইকা একটা বাঁশ জ্বালায়েছে রুষ্ট শিব দেবতায়।

জানো তো ধ্বংসচূড় পাহাড়ের পথ ছেড়ে এবার যাবো আমি জন্মউপকূলে। যেখানে মৃত উপত্যকা থেইকা শহীদেরা ফুল নিয়া জাইগা আছে আলোর ইসকুলে, নক্ষত্র নামবে বলে। আমি কি সেই নক্ষত্র? যার শিষ্যরা বেদান্ত প্রজ্ঞা পারমিতা গীতবিতান রূপসী বাংলা হাতে এসেছিল আমার জন্ম উপকূলে। প্রজ্ঞা পারমিতার এক একটি অক্ষর পাখি হয়া শান্তির বাণী বিলায়েছে বহুকাল এই মৃত্তিকায় — তোমরা তাকে অনাদরে বিদায় করেছো — বুঝতে চাও নাই, এখনো আলোর ডাকবাক্স হাতে সুবর্ণনগরের রাস্তাগুলা ফুইটা আছে পদ্ম পাপড়ির অন্তরালে, যেন স্নিগ্ধ নদীর জলরেখায় এক একটা ঢেউ, আর দেখো প্রিয়তমা? পদ্মনাভির মুদ্রায় শান্ত সমুদ্র চমকায় মনের গ্রহে, কারণ দেশভাগের পাণ্ডুলিপি অসমাপ্ত স্বর হয়া বাইজা চলে বিউগলে, লিপির অক্ষর বোঝা দায় স্থায়ী বা অন্তরার আড়ালে সুর ছিঁইড়া যায়, সঞ্চারি পাখা বদলায়, দরজায় পরাধীন উড়াল এখনো পাখা ঝাপটায়, হারানো শৈশবে যে হাফপ্যান্ট হারায়েছি তা এখন কাটাতারে ঝুইলা আছে, নিজের দেশের ভিতর অপর দেশের আখড়ায়; তাহলে আমার শৈশব আটকে গেছে ষড়যন্ত্রের তারকাঁটায়! এই হলো উত্তর! ওপারে তাম্রলিপিতে আঁকা বসন্ত দিনে বৃষ্টির শব্দ কান্না হয়া ঝরে এপারে, আমাদের দেশে — সুবর্ণগাঁয়। যদিও গুহাচিত্রে আঁকা আছে শ্বেত ছায়াপথের কুটিল ছবি — এই পথে হাঁটি না আমি, সাগরবলাকারা নাচিতেছে ধুলোঝড়ে, ধূসর অন্ধকারে, অথচ মেরুদণ্ডে চিরধরা বসন্ত বৃক্ষ ফোঁপায়, তবুও রথের করিডোরে নক্ষত্র পায়চারী করে — নক্ষত্রের খোঁজে তোমরা গিয়াছো পরীদের কোকাবনগরে — সেখানে দেইখাছো আমায়, শান্তির কবুতর হাতে মায়াবৃক্ষের ছায়ায় আটকে পইড়া আছি, ভেবেছো কৃষ্ণকালি মা আমার সেবাদাসী নাম, কীভাবে তার ছেলে আসবে ভয়ানক ঘুণেধরা এ পাড়ায়? দু'পা কাটা ঈগলচিহ্নিত শ্বেত মানব, আলোকবর্তিকা আর কবুতর ডানা কামড়ে ধইরা আছে মহাকালের গোলকবেলার। আমার হৃৎপিণ্ডে সেলাইকলের শব্দ ঘোড়ার খুরের আওয়াজ হয়া বেজে চলে। ডোরাকাটা এ্যাপ্রোনে মিনার্ভা দেবী দাঁড়ায় নক্ষত্র বাড়ির দরজায়, তুমি কি এ্যাপোলোর ভালবাসার প্রিয় মুখ, কৃষ্ণকায় হেলেন, বিপর্যয়। দেশবিভাগ ধ্বস্ত চোখে দূর থেইকা দেখে কাসান্ড্রা — হায়! হেলেন, হায় কাসান্ড্রা! বৃষ্টির ঝালরে লিইখা যাচ্ছো সবুজ কান্নার দাগ, তবুও হারানো শৈশবের প্যান্ট খুঁজি রোদের জানালায়, সেই থেইকা কাপড়হীন বাঁইচা আছি ন্যাংটো এক সবুজ খোয়ানো পাখি… সন্ধ্যার বৃষ্টিতে মধ্যরাত নামে দুপুরে, স্বরগ্রামের ভিতর সমুদ্র আটকে যায়, মায়ের নাকফুল হারানোর শোক ভুলিতে পারি না এই মধ্যবেলায়, তারাপীঠ শ্মশান চিশতির কবরস্থান ভাগ হয়া যায়।

এদিকে কুমারের ঘুরন্ত চাকায় নরম মাটির ঘুম ভাঙে, পাখিদের অন্তর্গত কৃষিকর্মে এবার সভ্যতার প্রথম বীজ রোপিত হবে আমার জন্মউপকূলে, যে জোছনা শুইয়া ছিল বন্দি খামের ভিতরে চিঠির অক্ষরে, সে এখন দারুচিনি গাছের ছালে সূর্য ডুবে গেলে মৃত ঘোষণাপত্র পাঠ করে দিনের। তোমরা দেইখাছো শুধু জলরঙ গায় মাইখা মহাশূন্যে নিহারিকা হাতে ঘুমায়ে পইড়াছি আমি, যে আমি কাছিমের পিঠে চইড়া মহাশূন্যে যাত্রা শেষে ফিরবো সুবর্ণগাঁয়, তাকে কেন জিভকাটা যুবতীর স্তন ধইরা যে দেবতা অস্থির তাকায় তার কথা বলো? ব্রহ্মাণ্ড এক জাদুর বাক্স — রাতের পাপড়িগুলা বাতাসের ডানা বাইয়া মহাশূন্যে ভ্রমণ হেতু গেলে গুল্মহীন গোপন গর্ভকেন্দ্র ভাইঙা পড়ে অগোচরে, উদ্ভিদ পাড়ায়।

প্রিয়তমা তুমি জানতে চেয়েছো, তুমি কি শৈশব নক্ষত্র ইসকুলের ছাত্র, নাকি শিক্ষক, নাকি কল্কি অবতার — অন্য নাম ইমাম মেহদী যার। ওসব তুচ্ছ প্রশ্ন জানার আগে চেয়ে দেখো মায়াপথে কোনো এক নীলপাখি হাতছানি দিয়া ডাকে তোমায়, ওদিকে বালিকার মমির ঘ্রাণে আমার নিদ্রা ভঙ্গ হয় — আমার ঘুমহীন চোখ দেখে মহাকালের আয়না ভাইঙা পড়ে আছে তোমার বিছানায়, তোমার কি মনে পড়ে ইভেরও আগে কোনো এক নারীর দুধের বাটে প্রথম মুখ রাখছিল কোন প্রেমিক আর কোন শিশুর উজ্জ্বল ঠোঁট? যার ঠোঁটের স্পর্শে বিশ্ব যাদুর বাক্স খুইলা নক্ষত্র গড়াইছিল অচেতন দাওয়ায়। বোধিকাল লাভের দিন শেষ, ওহিও আর আসে না পৃথিবী চড়ায়, বোবা লণ্ঠনের তেল গইলা আগুন সমুদ্রের উৎপত্তি — আর আমি সেই সমুদ্র থেইকা আলোকবর্তিকা হাতে এসেছি তোমাদের গাঁয়, আমারই জন্ম উপত্যকায়।

অনন্তের সিঁড়ি বাইয়া হিমগর্ভের ভিতর প্রবেশের আগে মুসাকে তার প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করায়েছি কালরাতে — সে মূর্ছিত পৃথিবীর শরীর থেইকা বুদ্ধু ভিক্ষুকের তাড়ানোর ইতিহাস দেখে নাই বলে তাকে রেখে মীননাথ দেখায়ে দেখায়ে নর্তকী নৃত্যে বসায় আফিম আসর, সেই থেইকা তার লিঙ্গ সাপ হয়া ছোবলে ছোবলে সুন্দরী রমণীদের নীল করে গড়ে দেন কংক্রিট পাথর। আর আমি পাথরের দেহকোষ থেইকা বার কইরা আনি প্রজ্ঞা পারমিতার উজ্জ্বল পাণ্ডুলিপি, তাই সাধনাবলে ছিন্ন খঞ্জনার দেহ এক হয়া মিশা যায় আমার আত্মায়। জোছনার রঙ যুবতীর স্তনে মিশা গেছে বলে দুধসাদা শিশুর চোখ-মুখ থেইকা বের হয় নক্ষত্রের আলো। তবুও চারদিকে ভূতগ্রস্ত সরীসৃপের গান, ময়ূরপাখার ঝাপটানিতে মরুঝড় ওঠে সমুদ্র উপকূলে! একটা গিরগিটি তার গোপনতা প্রকাশে ঝাঁপ দেয় অন্ধকার উপকূল পাড়ে, আর তখন স্বাধীন স্বাধীন মনে হয় তোমায়। নক্ষত্রপার্কের শোভাযাত্রায় মৃত নারীর হাসির রেশ বন্ধ হয়, আর এদিকে দেখো পদ্মচক্রের ভিতর জোছনা বিছায়ে আছে যেন বিষাক্ত সরীসৃপের বিচ্ছিন্ন পাণ্ডুর দেহ, তাইতো পাগলি যুবতীর ডায়রি আজ স্তন-লিপিতে আঁকা বেদনা মন্দিরে। মৌরিফুল মৃত্তিকায় নয় আকাশে ফুটে আছে কে তাকে পৃথিবীতে নামাবে আজ; তাইতো নিঃশ্বাস বাষ্পিভূত হলে হৃদয়ের ভিতর বৃষ্টি নামে, প্রান্তিক গেটে একটা লাল ট্রেন কাপড় খুলে জন্মদিনের পোশাকে আহ্বান করে আমায় তার একান্ত যাত্রী হতে, তাইতো বিস্ময়ের তাৎপর্য খুঁজি বিয়াত্রিসের চেতনার বলকলে।

বিউগলের সুরে ডুবন্ত জাহাজের নাবিকের স্বর ভাইসা আসে, নিহত নাবিকের কণ্ঠে আমার নিরীহ পিতার স্বর। হাইপার স্পেস কিংবা কোয়ান্টাম মেকানিক্স থেইকা দূরে তবু কেন এমন চেনা চেনা লাগে স্বর। তার স্বরে জীববিবর্তনের ইতিহাস লেখা আছে, পৃথিবীর প্রথম পাথরের উপর বসে এই আমি ডুবন্ত জাহাজের মাস্তুল দেখি — শিউরে ওঠা ঘূর্ণির আবর্তে দেখি জাহাজ নয় এ যেন আমারই মাতৃভূমি! ভাড়াটে বাড়ির মেয়েরা শরীর উড়ায় ছাদে আর ঝিনুক বাটা খাবার দাও তুমি আমায়! চন্দ্রযানের গায়ে আঁকা যে আপেক্ষিকতার অনাবাসিক সূত্র তা কি আমার পিতার ছবিকেই মনে করিয়ে দেয় — মনে করিয়ে দেয় না-কি ডুবন্ত জাহাজটাই আগামী পৃথিবীর ছবি! ঘাসফড়িংয়ের পিঠে পতাকা নিয়া ঘুরি দিব্যজ্ঞানের খোঁজে, নারীর সলীল থেইকা ভাইসা আসে লবণের স্বাদ, পোষা চাঁদের আলো থেইকা মৃত সরীসৃপ বের হইয়া আসে, জল ও আগুনের মধ্যরাস্তায় গোপন সুড়ঙ্গ খুঁড়ে চলি জোছনার অন্ধকারে।

এবার আমি উল্কাজীবনের অন্তরালে একটা দীর্ঘ ঘুমের পরাণকথা শোনাবো তোমায়, ভ্রমরের মুদ্রাদোষে চিহ্নজন্মরেখা মুইছা যায় পোয়াতি বালিকার, একটি কঙ্কাল মাতৃগর্ভে বেড়ে ওঠে সময়ের অগোচরে, ভ্রূণের ঘুম ভাইঙা দেখে হিজড়ে বাড়ির গেট — পিকচার গ্যালারির ছাদ, মায়াবৃষ্টি নামে সেই ছাদে, আর প্রশ্ন জাগে খোরাসানেই কি শুধু খচ্চর বেশি জন্মে? তা না হলে জলপাইরঙা ওইসব প্রাণী কেন এত বেড়েছে আমাদের তৃতীয় তান্ত্রিক পাড়ায়।

কে হে তুমি জন্মউপকূলে অন্ধকার গীটার হাতে সুর তোলো অন্তজীবনের আলোর খোঁজে…মাধ্যাকর্ষণচ্যুত যৌনমন্দির আটকে যায় সনাতনী দেবীর জঙ্ঘায়, মর্গের দেয়ালে অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপির ভাঙা অক্ষরে লেখা হয় কুহকীমায়া নাকি পৃথিবীর নাম। পৃথিবীর শেষ শষ্যক্ষেতে একটি নিরীহ তারা উবু হইয়া পইড়া আছে এইকথা জেনে বৃষ্টির আশায়।

এ সময় গিলগামেসের পাণ্ডুলিপি হাতে বুদ্ধ এসে দাঁড়ায় দক্ষিণপাড়ায়, আশ্রমবালিকারা পাণ্ডুলিপির সবুজ অক্ষরগুলা তুইলা রাখে তাদের বুক পকেটে, আর প্রশ্ন করে না কেউ বুদ্ধের হাতে কেন এমন পৌরাণিক ঢেউ? তাই কিশোরী বয়নে বুকের উপর দুধের নহর বইয়া যায় তাদের — এই থেকে শুরু, গণিকা পাড়ার এক চিলতে রাস্তায় ধূসর কিছু অক্ষর ঢুইকা পড়ে সবার অলক্ষে অগোচরে, ডোমেদের টিনঝুপড়িতে ভাতপচা মদের বোতলে চিহ্নময় অক্ষর ভাসে, এটা গিলগামেস নাকি পোপলবুর অক্ষর একথা নিয়া তর্ক হয়া যায়। তাইতো আমার ছাত্রীরা আজ ব্লাডব্যাংকে শুধুমাত্র নেগেটিভ রক্ত দিয়া ফেরে অগত্যা অগোচরে। সবুজ আপেলের কথা প্রথম তুইলা ছিল আদমের ছেলে কাবিলের বোন, তাইতো নীলনদের পাথর ভেঙে বৃষ্টি হয়াছিল তখন।

হারমোনিয়ামের রীড মনে কইরা পাঁজর বাজায়েছি কালরাতে, যখন নাৎসি সেনারা তোমার স্তন কেটে বল বানানোর চেষ্টায় সবুজ আপেল ভাইবা কামড়েছিল অস্ট্রিয়ার রাস্তায়। কসমিক গ্রন্থ থেইকা অন্ধকার দূরতম দ্বীপে ঘোড়ার উড়াল দেখে উদ্ভট লাগে না আর, চাঁদ অথবা তোমার স্তন কশাইয়ের চাপাতির কোপে টুকরো টুকরো হয়ে ঝুইলা আছে নাকি শিকে, বিষাক্ত সাপের ফনার উপর জাগে আমার মানচিত্র, নালন্দার আলোকিত কলোনি রেখায়, নক্ষত্র শোয়া ছিল যা, তা আজ জেহাদী তরবারীতে রক্তগন্ধ বিলায়।

এছাড়া এই পাঁজরের কাছাকাছি গেলে দেখতে পাবে মাঘী পূর্ণিমায় একটা অন্ধ পাগল ধূমকেতু হাতে তার মেরুদণ্ডের হাড়ের ফোঁকরে সুর তোলে, সুরের ভেতরে একটা সবুজ হরিণ দৃশ্যত দৌড়ে দৌড়ে বেড়ায়; মাঝে মাঝে মনে হয় তুমিই সেই সবুজ হরিণ যার মায়ামৃগে আচ্ছন্ন হয়া আছে পৃথিবীর সমস্ত প্রেমিক। এদিকে উল্কাপথের বাঁকে বাঁকে অবচেতনের যত চুমুরেখা আঁকা আছে তা আজ ছায়াপথ হয়া নামে তোমার গৃহে। কে যেন বইলা গেল, তোমার গোপনাঙ্গে রাত্রিস্নান শেষে হৃদয়ের ব্লুপ্রিন্ট হাতে পৃথিবী নামক ডাকবাক্স নিয়া একটা উজ্জ্বল মাছ এসেছে এখানে, আর আমি বায়োস্কোপে চোখ রাইখা দেখি তোমার নগ্ন শরীর পইড়া আছে অপর নক্ষত্রের দেশে। হায় বুড়োকোচোয়ান দেখো দেখো আমি অদ্ভুত সিঁড়ি বাইয়া নাইমা যাচ্ছি নিচে অসীমের পানে।

হঠাৎ একদিন শৈশবে ইসকুলের টিফিনবক্স খুলতেই উইড়া গেল ঘুমন্ত এক কবুতর, কাঁপা কাঁপা কিছু পয়ার আইসা জুড়ে বসলো বক্সের ভিতর। আমি এদের জিততে দেখেছি পাখিডাঙার মাঠে সেখানে সাপলুডু খেলা খেলেছি এদেরই সাথে।

পাখিডাঙার মাঠের ওপাড়ে, এই সেই গিরিপথ — যেখানে অদ্ভুত ঘুমের ভিতর পাখিঘোড়া পেগাসাস ওড়ে আর তার পিঠে চড়ে তুমি দুঃসময় বিক্রি করো আমাদের পৃথিবীতে, কে হে তুমি কোচোয়ান? তোমাকে দেখে নেবো কোন ব্রহ্মাণ্ডে তোমার অবস্থান — চাঁদের চরকা হাতে যে লোকটা এসেছিল গিরিপথ বেয়ে তাকে বিক্রি কইরা দেয়া হয়েছে মৃত্যুর কাছে। ডোমেরা তার লাশ ব্যবচ্ছেদকালে একটা অদ্ভুত কবুতর উড়তে দেখেছে চাঁদের চরকা হাতে লোকটার বামপাঁজরে — সেই থেকে এখানে আর চাইলেও মেলে না সেই কবুতর।

এই সেই সেতুপথ যেখানে সাদা বরফের চাদরে ঢেকে আছে কবুতর — শ্মশানের ছাইমাখা নিঃশ্বাস। সবুজ বিড়ালের ছায়া খামচে পইড়া আছে মর্গের দেয়ালে, আমাদের ঘুমের গহ্বর থেকে একটা সাদা শকুন হামাগুড়ি দিয়া বের হয় — আর তখন আমরা দেখতে পাই নিরীহ ঘুমের হস্তলিপিতে লেখা মৃত্যুর মুদ্রাযন্ত্রের ইতিহাস। গণকবরের ভিতর থেইকা একটা অন্ধকার ঝাঁপ দেয় নিজস্ব ছুটির দিনের ভিতর — তখনো জ্বলন্ত একটা কবুতর দুরূহ মধুচক্রের কথা বলে, পুইড়া যাওয়া কণ্ঠনালী থেইকা বাইর হয় ব্রহ্মাণ্ড ইসকুলের স্বপ্নকথা।

আমার মনে পড়ে, সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর প্রথম ঘূর্ণনকালে আমি একটা বৃক্ষশাখায় কবুতরের চেহারায় চোখ মেলেছি, মহাবিস্মরণের সেই প্রলয় রাতে। তাইতো ইসকুলের কাঠের দেয়ালে চকখড়ি দিয়া প্রথম যে মূর্তি এঁকেছি তোমার, সেই মূর্তি মাঝরাতে ইসকুল মাঠে আইসা বুদ্ধের দেয়া নামে ডাকে আমায়।

ওই মূর্তির ভিতর থেইকা এক পাখিওয়ালা মধ্যরাত শেষ হলে শূন্যখাঁচা হাতে বেরিয়ে আসে মানুষের অন্তরালে, আর শূন্যখাঁচায় ঘুমায়ে থাকা এক বালিকা তার সবুজ চোখ টিপে আহ্বান করে আমায় আকন্দফুলের ভিতর ফুটে যেতে… আমি তাকে প্রশ্ন করি মহাবিস্মরণকালে আসলে আমি কিংবা সে ছিলাম কি না অন্তর বৃক্ষডালে? প্রিয়তমা কিষাণী আমার জানো তো এই নির্জনে কল্পলক্ষ্মীকেও বিক্রয় হতে দেখেছি সাবওয়ে স্টেশনের চোলাই মদের দোকানে, আর আমি তখন কী কইরে বটঝুড়ির দোলনায় চড়ে যাবো জোছনার প্রান্তরে।

কালো মাছিদের প্রাচীন পাঠশালায় যাই, দেখি কবরের দেয়ালে চুনসুড়কি হয়া বাঁইচা আছে সভ্যতা আমার। অলিখিত অক্ষরে সুরকী কিংবা পোড়ামাটির বাড়ির ধূসর দেয়ালে লেখা আছে বীভৎস চিহ্ন জাইসুদ-মর্গেজ খায়খালাসী কিংবা নিলামনামায়। এ-তো গতকালের ইতিহাস, সসপ্যান ভর্তি রক্ত গিলা যাচ্ছে যারা এখনো আমার, তাদের প্রতি অসীম ব্রহ্মাণ্ডের নিদ্রাহীন কালো রাত বর্ষণ করি — দশচক্রের আবর্তনহীন চাকায় তোমরা ঘুরবে একদিন আমার পাঁজরে নির্মিত লৌহপথে। স্মৃতিকথার প্রতিষ্ঠায় যে হন্তারক গোধূলিমায়া লিপিবদ্ধ আছে তার থেইকা বিদ্রোহী একটা জোছনার অক্ষর ছুইটা আসে আমাদের রিডিংরুমের সেলফের উপর। আসলে যে কথা লেখেনি অন্ধ হোমার কিংবা বেদব্যাস বাল্মীকি সেইসব অসমাপ্ত পঙ্‌ক্তি লেখা জোছনার অক্ষর হয়া আসে কলমের জবানীতে — আমার পরিচয়ে যদিও সরুগলির ও মাথায় নদীপথ ঝুইকা আছে আস্থাহীনতায়, এও তো সত্য এই কবরখানার প্রতিটি বাঁশ থেকে উত্থিত সবুজ অঙ্কুর জানে মৃতের নিঃসঙ্গ হাড়ের রহস্যে, মৃত গেরিলার চোখের অক্ষরে লেখা ব্যক্তিগত চিঠির পৃষ্ঠার ভাঁজে উত্থিত সবুজ অঙ্কুরে, আর তার আত্মা শীত হয়া ঝুইলা আছে আমাদের পৃথিবীতে।

এদিকে বিশ্বস্ত উইলোওয়ার বলারের গুপ্ত আশ্রম থেইকা একটা শাদা খরগোশ দৃশ্যত এখনো শান্তির কথা বলে — মৃত গেরিলার স্বপ্নের কথা বলে… আর আমি ভাবি ফুলের পাপড়ি খাইয়া যে পতঙ্গ প্রাণ বাঁচে তাদের চেতনার কথা; কিংবা প্রাগজ্যোতির্মণ্ডলীর আগে কিংবা সমস্ত সৃষ্টির ধ্বংস শেষে আমিই কি আলোকবর্তিকা হাতে দাঁড়ায়ে ছিলাম কিংবা থাকবো কুলহীন-প্রান্তরহীন-প্রান্তরে!

চোখের ভিতর দিয়া যে ছায়াপথ মিইশা গেছে বিষণ্ন রশ্মির ঘরে সেখানেই নিরীহ স্বর্পজন্ম তার, চোখগুলা সুদে বিক্রি হলে ডাহুকের কাছ থেইকা স্বাধীনতা কিনাছি কাল, শরীরের সব হাড় পাকুদের দখলে গেলে জ্যোতিষ্কমণ্ডলের কিছু আলো নিয়াছি ধার, কারণ হাড় কিংবা চোখের চেয়ে এখানে আলোর আজ বেশি প্রয়োজন। অতপর কেয়াপাতার নৌকায় চড়ে নক্ষত্রের আলোকমণ্ডলে ঘুরি যোগমায়ায় যদি কিছু আলো ধার আনা যায়। আত্মার আলোকচিত্র পৃথিবীকে দেব বলে এসেছি এবার, আমাদের তৈরি নিরাকার ঈশ্বরের চেয়ে বড় কিছু নিয়া মানুষী পাড়ায়।

ওই দেখো জঙ্গল সমস্ত প্রাণীসহ চিৎ হয়া শুইয়া আছে আমার ডানায়, ঘুমপোকার ভিতর-বাহির কী এক অদ্ভুত পোড়াগন্ধ, আফিম গাছ দুলছে হৃদয় অন্দরে, নেশায় চোখ ধূসর হয়া আসে প্রিয়তমা, মৃগশিরায় মগ্ন সংকেত, কিশোর ব্লাকারের চোখে বিস্ময়ের অন্তহীন নক্ষত্র, মাতৃগর্ভ থেইকা বের হয়া আসে সমুদ্রের মতো স্বপ্নভাঙা অন্তহীন ঢেউ, স্বপ্নহীন এই রাত্তিকে মৃত ঘোষণা কর, সমস্ত মহাসড়ক শূন্যে উইঠা গেলে রেখাপথ তৈরি হয় মগজের অস্তরেখায়, নদী নিদ্রাকালে স্বপ্নবিক্রয় কেন্দ্র খুইলা গেছে জোছনা পাড়ায়, আর জোছনা পাড়ায় যাবার আগে জলপোকাদের বাড়ির খোঁজে যাব একবার; দেখে যাবো কীভাবে কালকেউটের দেহ বেয়ে সন্ধ্যা নামে; আমাকে অতদূর ব্রহ্মাণ্ডের ইসকুলে খুঁজতে যেও না প্রিয়তমা, বৃক্ষের পাঁজরে লেখা আছে আমার আপন ঠিকানা।

ঢাকা ডিসেম্বর ২৯-৩১, ২০০৫