মনিরুজ্জামান স্যারের স্মৃতি

tapan_bagchi
Published : 5 Sept 2008, 05:06 AM
Updated : 5 Sept 2008, 05:06 AM

পঞ্চাশ দশকের কবি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। কবি ও গীতিকার হিসেবে তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে ছিলেন শ্রদ্ধেয়। প্রায় অর্ধশত ছাত্র-ছাত্রী তাঁর


……..
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান (১৫/৮/১৯৩৬ – ৩/৯/২০০৮)
……..
তত্ত্বাবধানে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। বাংলাদেশে তিনিই সবচেয়ে সফল তত্ত্বাবধায়ক। সংখ্যাবিচারে তো বটেই, গুণবিচারেও তাঁর অধীনে পরিচালিত গবেষণার সংখ্যা বেশি। তাঁর ছাত্র কেবল বাংলা বিভাগেই নয়, গ্রন্থাগারবিজ্ঞান কিংবা গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগেও রয়েছে। একটু ব্যক্তিগত স্মৃতির কথা বলতেই হয়।

আমি গবেষণার জন্য যখন প্রস্তুতি গ্রহণ করি, তখন জানতে পারি যে, আমার বিভাগে অর্থাৎ গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পিএইচডি গবেষণার পথ খুবই জটিল। জটিল এই কারণে যে, পিএইচডি গবেষকের যোগ্যতা হিসেবে এমফিল কিংবা ডিগ্রি পর্যায়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়, কিন্তু এই দুটির সুযোগ এই বিভাগের শিক্ষার্থীদের নেই। এত পুরনো বিভাগ, অথচ এমফিল কোর্স খোলা হয়নি! আর দেশের কোনো কলেজে এই বিভাগটি পড়ানো হয় না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাড়া সাংবাদিকতা বিভাগে গবেষণা করার সুযোগ নেই।

আমি বিকল্প পথ খুঁজতে থাকি। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রফেসর ডক্টর আবুল আহসান চৌধুরীর শরণাপন্ন হই। তিনি বাংলা একাডেমী ও নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে প্রকাশিত আমার গবেষণাগ্রন্থ দেখে আমার গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক হতে সম্মত হন। সাংবাদিকতার ছাত্র হয়ে বাংলা বিভাগে গবেষণার ক্ষেত্রে আইনগত কোনো সমস্যা নাই। তবে নজির নেই বলে স্যার কোনো ঝুঁকি নিতে চাইলেন না। তিনি দুজন বিশিষ্ট গবেষকের কাছ থেকে আমার গবেষণাকর্ম সম্পর্কে প্রত্যয়নপত্র জমা দিতে বললেন।

আমি সাংবাদিকতা ও বাংলা বিভাগের দুই চেয়ারম্যানের কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র নেয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কবি ড. বিমল গুহ আমাকে নিয়ে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন চেয়ারম্যান ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের কাছে। এই প্রথম তাঁর সামনে যাওয়া। তিনি প্রত্যয়নপত্র লিখে দেন 'তাঁর ইতঃপূর্বে প্রকাশিত দুটি গবেষণাগ্রন্থ দেখে আমার এই প্রতীতি জন্মেছে যে তিনি যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি পর্যায়ের গবেষণা করার যোগ্যতা রাখেন।' প্রত্যয়নপত্র আমার হাতে দেয়ার পরে তিনি জানতে চান, আমি কার কাছে গবেষণার ব্যাপারে অগ্রসর হচ্ছি। আবুল আহসান চৌধুরীর নাম শুনে বললেন, ও তো আমার প্রিয় ছাত্রদের একজন। গবেষণার প্রস্তাবনাটা দেখি। আমি একসঙ্গে গাঁথা আবেদনপত্র ও প্রস্তাবনাপত্র স্যারকে দেখাই। বিষয় হিসেবে যাত্রাগান নির্বাচন করেছি দেখে তিনি বেশ উৎফুল্ল হন। আমি বললাম, 'স্যার, যাত্রামঞ্চের নাচের সঙ্গে আমার বেশ কয়েকটি গান গীত হয়, আপনার কি তা জানা আছে?' স্যার অবাক হয়ে বললেন, 'তাই নাকি?' তাহলে তো তোমার গবেষণার সঙ্গে আমারও থাকতে হয়। তিনি আবেদনপত্রের যে স্থানে কো-তত্ত্বাবধায়কের ঘর আছে, সেখানে স্বাক্ষর করে দিয়ে বললেন, 'তোমার স্যারকে বলো, আমিও সঙ্গে রইলাম।' এটি আমার জন্য যে কত বড় প্রাপ্তি, তা বোঝানো যাবে না। আবুল আহসান চৌধুরী স্যারও খুব খুশি হলেন তাঁর শিক্ষক স্বেচ্ছায় কো-তত্ত্বাবধায়ক হতে রাজি হওয়ায়।
—————————————————————–
আমি বললাম, 'স্যার, যাত্রামঞ্চের নাচের সঙ্গে আমার বেশ কয়েকটি গান গীত হয়, আপনার কি তা জানা আছে?' স্যার অবাক হয়ে বললেন, 'তাই নাকি?' তাহলে তো তোমার গবেষণার সঙ্গে আমারও থাকতে হয়। তিনি আবেদনপত্রের যে স্থানে কো-তত্ত্বাবধায়কের ঘর আছে, সেখানে স্বাক্ষর করে দিয়ে বললেন, 'তোমার স্যারকে বলো, আমিও সঙ্গে রইলাম।'
—————————————————————–

আমি যখন গবেষণা শুরু করি, স্যার তখন অসুস্থ। বারবার বাসায় গিয়েছি, স্যার একটুও বিরক্ত হননি। বরং তাঁর স্ত্রী মানে আমাদের আপাকে ডেকে আমাকে আপ্যায়ন করিয়েছেন। আমার স্ত্রীকে নিয়েও একদিন গিয়েছি। আমার থিসিসের খসড়া যখন তৈরি করেছি, স্যার তখন হাসপাতালে। তিনি আমাকে তাঁর সুস্থতা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলতে পারতেন। কথা বলাও অসম্ভব তখন তাঁর জন্য। তিনি কাগজে লিখে জানালেন, আমি যেন তাঁর ছাত্র ডক্টর বিশ্বজিৎ ঘোষকে দেখিয়ে আনি। বিশ্বজিৎ ঘোষ আমার থিসিস পরীক্ষা করে দেন। মূল তত্ত্বাবাবধায়ক আগেই দেখে দিয়েছেন। তখন দুজনের মতামত তাঁকে জানালে তিনিও অনুমোদন করেন। অনেক তত্ত্বাবধায়কের কথা জানি, যাঁরা দিনের পরে দিন কোনো কারণ ছাড়াই, ছাত্রদের ফিরিয়ে দেন। কিন্তু শারীরিকভাবে অসুস্থতা সত্ত্বেও মনিরুজ্জামান স্যার আমাকে একটি দিনও হয়রানি করেননি। এরকম উদারতা খুব কম অধ্যাপকদের মধ্যেই রয়েছে।

১৯৫৬ সাল থেকে তিনি গান লিখতে শুরু করেছিলেন। ষাটের দশকে বাংলা চলচ্চিত্রের গান রচনার ক্ষেত্রে অনেকটা একক কৃতিত্ব ছিল তাঁর। গবেষণা ও প্রবন্ধসাহিত্যে তাঁর অবদান স্মরণীয়। তাঁর লেখা প্রথম গান 'ভালবেসে তবু যেন সবটুকু ভাল লাগে না'-এর সুরকার ছিলেন শিল্পী আনোয়ারউদ্দীন খান। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি। 'আমার দেশের মাটির গন্ধে ভরে আছে সারা মন' (সুরকার আব্দুল আহাদ), আব্দুল জব্বারের গাওয়া 'তুমি কী দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়' (সুরকার সত্য সাহা), 'হলুদ বাটো মেন্দি বাটো, বাটো ফুলের মউ' (সুরকার আলী হোসেন) প্রভৃতি অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা তিনি। 'কবিতায় আর কি লিখব?/যখন বুকের রক্তে লিখেছি/একটি নাম/বাংলাদেশ' নামের কবিতা পাঠ্যপুস্তকে রয়েছে।

তাঁর উল্লেখ্যযাগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, 'দুর্লভ দিন', 'শঙ্কিত আলোকে', 'বিপন্ন বিষাদ', 'প্রতনু প্রত্যাশা', 'কোলাহলের পর', 'ধীর প্রবাহ', 'ভাষাময় প্রজাপতি' ইত্যাদি। 'আধুনিক কবিতার ছন্দ' গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ। এর প্রায় ১২টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। এই বইটি নিয়ে 'মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ছন্দোচিন্তা' নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম দৈনিক 'বাংলার বাণী' পত্রিকায়। তখনও স্যারের সঙ্গে পরিচয় হয়নি। 'বাংলা কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক' গ্রন্থটি বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণার ক্ষেত্রে একটি অনুকরণীয় গ্রন্থ। তাঁর 'স্মৃতি যে অচঞ্চলা' নামের স্মৃতিকথাটি নিয়েও আমি একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। শিশু একাডেমী থেকে প্রকাশিত তাঁর 'ইচ্ছে' নামের ছড়াগ্রন্থটি নিয়ে আমার আলোচনাটি পড়ে তিনি বেশ খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন, 'আমার কবিতা, গান, প্রবন্ধ নিয়ে অনেকেই লিখেছেন, কিন্তু ছড়া নিয়ে তুমিই প্রথম আলোচনা করলে।' এরপর তিনি 'কবিতা সংগ্রহ' বইটি উপহার দিয়েছিলেন। ভেবেছিলাম তাঁর কবিতা নিয়ে লিখব, তা আর হয়ে ওঠেনি। তবে আমি নিশ্চিত যে তাঁর কবিতার উপর অনেক আলোচনা হবে।

আমার পরিকল্পনা ছিল, তাঁর অধীনে যে ক'জন পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছি, তাঁদের সকলের স্মৃতিমূলক রচনা নিয়ে একটি সংকলনগ্রন্থ তাঁর জন্মদিনে উপহার দেব। এব্যাপারে ড. বিমল গুহ ও ড. আলী হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে পরামর্শও করেছি। কিন্তু সেই সুযোগ আর পেলাম না। তাঁর প্রিয় ছাত্র ড. মোহাম্মদ হাননান তাঁর উপর রচিত প্রবন্ধ ও আলোচনা নিয়ে একটি সংবর্ধনাগ্রন্থ প্রণয়ণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমার লেখটি পৌঁছে দিয়েছিলাম আগামী প্রকাশনীর দপ্তরে। সেই গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও মূল্যায়নের একটি উপায় হতে পারে।

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৫ আগস্ট যশোরে। তার পিতা শাহাদৎ আলী, মা রাহেলা বেগম। ১৯৫৮ ও '৫৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১ম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেন। ১৯৫৭-৫৮ সালে তিনি 'দৈনিক মিল্লাত' পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। প্রভাষক হিসাবে বাংলা বিভাগে যোগ দেন ১৯৬২ সালে। ১৯৬৯ সালে 'আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক' অভিসন্দর্ভ রচনা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৯-৭০ সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করেন। সাহিত্যের জন্য তিনি বাংলা একাডমী পুরস্কার ও একুশে পদক-সহ দেশের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ পদক পেয়েছেন। তাঁর চেয়েও বেশি পেয়েছেন ছাত্র ও পাঠকের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা। তাঁর প্রিয় পুত্রকন্যা, প্রিয় স্ত্রী রাশিদা জামান ও অজস্র ছাত্র ও গুণগ্রাহীর মধ্যে তিনি বেঁচে থাকবেন। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্যে।