জলবায়ু পরিবর্তন: আশা ও নিরাশার টুর্নামেন্ট

Published : 22 Dec 2010, 06:11 PM
Updated : 22 Dec 2010, 06:11 PM

ডিসেম্বরের ১০ তারিখ শেষ হল কানকুন সম্মেলন, আমাদের আশা-নিরাশা নামক খেলার আরেকটি বার্ষিক টুর্নামেন্ট | দীর্ঘ দুই সপ্তাহের এই সম্মেলন শেষে ফিরে এলেন আমাদের প্রতিনিধি দল| এবারের জাতিসংঘের কানকুন সম্মেলনের অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক ছিল জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশকে উন্নত দেশগুলো কীভাবে সহযোগিতা করবে এবং এই অর্থায়ন কীভাবে হলে সবচাইতে কার্যকরী হবে| কানকুন সম্মেলন শেষে আমরা জানতে পেরেছি যে উন্নত দেশগুলি সবুজ জলবায়ু তহবিল নামে যেই তহবিল গঠনের প্রস্তাবনা দিয়েছে সেই তহবিল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রতিবছর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় উন্নয়নশীল দেশগুলিকে ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদান করা শুরু করবে| এই সম্মেলনে উন্নত দেশগুলি আমাদের দেশকে ক্ষতিপূরণ বাবদ বিপুল পরিমান অর্থ বরাদ্দেরও আশ্বাস দিয়েছে| এই খবর আপাত দৃষ্টিতে আমাদের জন্য সুখবর বলেই মনে হয়| পূর্বনির্ধারিত এই বার্ষিক টুর্নামেন্টে ১০০ বিলিয়ন ডলারের আশা আমাদের কাছে সান্ত্বনা পুরস্কারই বটে|

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলির মতই বিভিন্ন সময়ে শোষণের শিকার হয়ে এসেছে – কখনো ঔপনিবেশিকতার শিকার হয়ে, কখনো অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়ে, কখনো অসম বাণিজ্যের কারণে, আর কখনো উদারীকরণ নীতি অনুসরণ করে| বাংলাদেশের মত দেশ ঐতিহাসিক কারণেই বহুদিন ধরেই এই ক্ষতিপূরণের দাবিদার| কিন্তু এই সুখবরের পিছনে রয়েছে একটি বিপদ সংকেত| আর তা হল এই অর্থায়নের পিছনে ছুটতে যেয়ে আলোচনায় কম গুরুত্ব পেয়েছে উন্নত বিশ্বের ভুমিকা – কার্বন উদগিরণের মাত্রা হ্রাস | এ যেন উন্নত বিশ্বকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার মধ্যে দিয়ে দায় সারার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার একটি আয়োজন| তাছাড়া প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার যদি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলির মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয় শেষ পর্যন্ত প্রতিটি দেশের জন্য বরাদ্দ হবে প্রয়োজনের তুলনায় খুবই ক্ষুদ্র| আর এই তহবিলের অর্থ কোন উৎস থেকে আসবে সেই বিষয়ে কোন নির্দিষ্ট দিক নির্দেশনার উপর এই সম্মেলনে যথেষ্ট আলোকপাত করা হয় নি| তাছাড়াও এই তহবি্লে অর্থ জমা হবার পর তার বিতরণ, ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রনকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে উঠে এসেছে বিশ্ব ব্যাঙ্কের নাম|

ধরে নিলাম আগের জলবায়ু সম্মেলনগুলিতে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাথে একজোট হয়ে কার্বন উদগিরণের মাত্রা কমানোর জন্য উন্নত দেশগুলোর উপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি | এটি শুধু বাংলাদেশের ব্যর্থতা নয়, বরং সমস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলো্রই ব্যর্থতা | এবছর কানকুনে আলোচনার পূর্বনির্ধারিত বিষয় ছিল কার্বন উদগিরণ হ্রাস প্রযুক্তি, অভিযোজন, বন উজারিকরণ রোধ, এবং জলবায়ু পরিবর্তনে অর্থায়ন | প্রশ্ন জাগতে পারে এই বছর এই বিষয়গুলিই প্রাধান্য পেল কেন | এর পিছনে মুল উদ্দেশ্য হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামনে এই বিষয়গুলি অধিক গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করে কার্বন উদগিরণ হ্রাস বিষয়টিকে আড়াল করা| তাই এবারের সম্মেলনের ফলাফল দেখে মনে হয়েছে যেন এই সম্মেলন ক্ষতিপূরণ আদায়েরই সম্মেলন| কারণ যদিও উন্নয়নশীল দেশগুলো একমত হয়েছে যে জলবায়ু তহবিলের অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হলে কার্বন উদগিরণের মাত্রা পূর্বনির্ধারিত মাত্রার চাইতেও হ্রাস করতে হবে কিন্তু এই সম্মেলন ব্যর্থ হয়েছে কার্বন উদগিরণ মাত্রা হ্রাস বিষয়ে কোন পরিকল্পিত পদক্ষেপের দিক নির্দেশনা দিতে|

জলবায়ু পরিবর্তন অর্থায়ন দুইভাবে হতে পারে| একটি হচ্ছে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে, আরেকটি হচ্ছে বহুপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে| দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলো হয় সাধারণত দুইটি দেশের মধ্যে আর বহুপক্ষীয় চুক্তিগুলো হয় বহুপক্ষীয় দাতা সংস্থা যেমন বিশ ব্যাঙ্ক, এডিবি, ইউএনডিপি, এফএও ইত্যাদির সাথে| দ্বিপক্ষীয় চুক্তির সুবিধা হল এধরণের চুক্তিতে সাধারণত অপেক্ষাকৃত কম শর্তারোপ করা হয় এবং বহুপক্ষীয় চুক্তিতে অপেক্ষাকৃত বেশি শর্তারোপ করা হয়| দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে জলবায়ু তহবিলের অর্থ ব্যয় হলে জাতীয় স্বার্থ প্রাধান্য পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে কারণ এখানে পরিকল্পনা প্রনয়ন ও বাস্তবায়নে সরকারের নিয়ন্ত্রন বেশি থাকে| অন্যদিকে, বহুপক্ষীয় চুক্তি হলে দাতা দেশগুলো অর্থ ব্যবহারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন প্রকার শর্তারোপের মধ্যে দিয়ে পরিকল্পনা প্রনয়ন ও বাস্তবায়নে হস্তক্ষেপ করে| তাই বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলো সব সময় দ্বিপক্ষীয় চুক্তির পক্ষে ও বহুপক্ষীয় চুক্তির বিপক্ষে অবস্থান নেয়াকে সমীচীন মনে করে| এবারের কানকুন জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ এই বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে দেখেছে এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়েছে যেন জলবায়ু তহবিল দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে উন্নত দেশগুলো থেকে আমাদের দেশে আসে|

যেকোন নতুন আবিষ্কৃত ঔষধ বা কসমেটিকের কার্যকারিতা যাচাই করার জন্য যেমন তা প্রয়োগ করা হয় পশু-পাখি বা মানুষের উপর তেমনি যেকোন দারিদ্র দূরীকরণ নীতির কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য প্রথমে তা ব্যবহার করা হয় দরিদ্র দেশের উপর| জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশকে সেরকম একটি ঊপযুক্ত ল্যাবরেটরী বললে ভুল হবে না| কয়েকটি কারণে বাংলাদেশকে ল্যাবরেটরী বলা যেতেই পারে | প্রথমত গত কয়েক বছরে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান ও পর্যালোচনার পর বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে যে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম| কাজেই ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তিতে বাংলাদেশের যে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত এই বিষয়ে তেমন একটা দ্বিমত নেই| কিন্তু উন্নত বিশ্বের কাছে ক্ষতিগ্রস্ত প্রমানিত হওয়াই শেষ কথা নয়| ক্ষতিপূরনের অর্থ কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ব্যবহ্রত হবে, কীভাবে তা অভিযোজনে ও কার্বন উদগিরণ হ্রাসে ব্যবহ্রত হবে এই নিয়ে নানা বিতর্কের শেষ নেই| এই অর্থ কোন খাতে কীভাবে ব্যবহার হবে এর মধ্যে রয়েছে রাজনীতি | মোটা দাগে ব্যাখ্যা করলে বলা যায় এই রাজনীতির সাথে সরাসরি যুক্ত আছে দাতা গোষ্ঠী, সরকা‌র, এনজিও ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ| দাতা গোষ্ঠী আগে জানতে চায় কী পদ্ধতিতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করলে এবং কী খাতে অর্থায়ন করলে সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে| অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার চায় জলবায়ু তহবিলের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রন যাতে সরকার তার উন্নয়ন চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে জাতীয় স্বার্থে তহবিল ব্যবহার করতে পারে |

উন্নত দেশগুলোর আস্থা অর্জনের জন্য বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে এই বিষয়ে অগ্রীম কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে| বাংলাদেশই প্রথম দেশ যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য যুক্তরাজ্যের আর্থিক সহায়তায় একটি কৌশল পত্র : Bangadesh Climate change Strategy and Action Plan (BCCSAP 2009) তৈরি করেছে| শুধু তাই নয় বাংলাদেশ জাতীয় উদ্যোগে National Climate Change Trust fund নামে একটি জলবায়ু তহবিলও গঠন করেছে যেখানে প্রতি বছর জাতীয় বাজেট থেকে নির্দিষ্ট পরিমানের টাকা করে বরাদ্দ করা হবে| ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে এর পরিমান ৩০০ কোটি টাকা ছিল, ২০০৯-১০ অর্থ বছরে এই বরাদ্দকৃত পরিমান যেয়ে দাড়ায় ৭০০ কোটি টাকা| এই সব উদ্যোগের পিছনে রয়েছে সম্ভাব্য জলবায়ু তহবিলের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করার আকাঙ্ক্ষা|

বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশের আছে মূলত দুইটি তহবিল, একটি জাতীয় তহবিল ও অন্যটি দাতা দেশগুলোর উদ্যোগে গঠিত সম্মিলিত তহবিল | জাতীয় তহবিল থেকে বিভিন্ন খাতে অর্থ বরাদ্দ এই বছর থেকে শুরু হয়েছে| ইতিমধ্যে ৭০০ কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ২৭০ কোটি বিভিন্ন খাতে ব্যয় করা শুরু হয়েছে| এর মধ্যে ১৭ টি প্রজেক্ট দেয়া হয়েছে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলিকে এবং ৭ টি দেয়া হয়েছে বিভিন্ন এনজিওকে| জলবায়ু পরিবর্তনের রাজনৈতিক অর্থনীতির সমীকরণ অনুসারে ধরে নেয়া যায় এই তহবিলের টাকা কতটুকু সাফল্যের সাথে খরচ করা হবে তার উপর নির্ভর করছে দাতাদের ভবিষ্যত আস্থা অর্জন | অর্থাৎ বাংলাদেশ যদি সাফল্যের সাথে জাতীয় তহবিলের অর্থ ব্যায় করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে তাহলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সবুজ জলবায়ু তহবিল সুষ্ঠুভাবে ব্যবহারেরও সামর্থ অর্জন করবে| আর জাতীয় জলবায়ু তহবিল ব্যবহারে বিশৃঙ্খলতা, অনিয়ম ও জবাবদিহিতার ঘাটতি থাকলে দাতা দেশগুলো দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে তহবিল বরাদ্দ থেকে বিরত থাকতে চাইবে| আর এর ফলে তহবিল প্রদান ও নিয়ন্ত্রনের জন্য মধ্যস্ততা করতে শক্তিশালী হয়ে উঠবে বহুপক্ষীয় দাতা গোষ্ঠী যেমন বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক|

আরেকটি তহবিলের নাম হচ্ছে Bangladesh Climate Resilient Fund (BCRF) যা পূর্বে Multidonor Trust Fund নামে পরিচিত ছিল| ২০০৮ সালে যুক্তরাজ্যে যখন লেবার পার্টি ক্ষমতায় ছিল তখন গর্ডন ব্রাউন ৬০ মিলিয়ন পাউন্ড বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য আর্থিক সাহায্য হিসাবে দিতে চেয়েছিল| লেবার পার্টির জনপ্রিয়তা অর্জন তখন রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল | এই উদ্যোগে গঠিত তহবিলের নাম তখন ছিল Multidonor Trust Fund | এই তহবিলের অর্থ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার তখন Bangladesh Climate Change Strategy and Action Plan 2008 তৈরি করে| পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে সরকারী উদ্যোগে কিছু পরিবর্তন এনে তৈরি করা হয় BCCSAP 2009 |দেখা গেছে বাংলাদেশের অন্যান্য অনেক নীতি নির্ধারণের মত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার বিষয়টিও দাতা গোষ্ঠী দ্বারা প্রভাবিত|

জলবায়ু পরিবর্তন এমন একটি সমস্যা যার সমাধানের প্রস্তাবনা বহুমাত্রিক| এটি নিতান্তই একটি পরিবেশ বিষয়ক সমস্যা নয়, এই সমস্যার গভীরে রয়েছে তৃণমূল শ্রেণীর জীবন সংগ্রামের ইতিহাস, অথনৈতিক বৈষম্যের ইতিহাস ও শোষণের দীর্ঘ ইতিহাস| এই ইতিহাস বাদ দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবেলা করতে গেলে বাংলাদেশকে আজীবন একটি উন্নয়ন নীতির পরীক্ষাগার হিসাবেই থাকতে হবে| অর্থ আসবে বরাদ্দ বাবদে কিন্তু এই অর্থ যার সবচাইতে বেশি প্রয়োজন তার কাছে পৌঁছাবে না| ২০১০ এর শেষে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা| এই বছরই প্রথম জনগনের দেয়া ট্যাক্সের টাকা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ব্যবহ্রত হওয়া শুরু হয়েছে| বছর শেষে আমরা যেন আবিষ্কার না করি যে জনগনের এই অর্থ কোন অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয়েছে| আশা করছি এই বিষয়ে জবাদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে | আর এটাও আশা করছি যে নীতি নির্ধারক মহল যেন সচেতন থাকেন যাতে দাতা গোষ্ঠী দায়সারাভাবে শুধু আর্থিক সাহায্যের কার্যকারিতার উপর মনযোগ দিতে গিয়ে জাতীয় স্বার্থকে অবজ্ঞা না করেন|