দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ও সরকারের ওয়াদার বরখেলাপ

কিউ আর ইসলাম
Published : 27 Dec 2010, 05:54 PM
Updated : 27 Dec 2010, 05:54 PM

সরকারের উপর আস্থাহীনতা ও রাজনীতিবিদদের প্রতি জনগণের অবিশ্বাস মনে হয় বেড়েই চলেছে বাংলাদেশে। এর বড় একটা কারণ হল দ্রব্যমূল্যের অযৌক্তিক উর্ধ্বগতি। স্বাধীনতার জন্য মুক্তি যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার পেছনে বাঙালিদের বিভিন্ন অসন্তোষের মধ্যে একটা ছিলো একই দেশের দুই অংশে দ্রব্যমূল্যের মধ্যে বড় ধরণের অসঙ্গতি। এই অসঙ্গতি তুলে ধরে স্বাধীনতার প্রাক্কালে দেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল একটা জনপ্রিয় পোস্টারও বের করেছিল। দ্রব্যমূল্য নির্ধারণে পশ্চিমি শাসকের অন্যায় হস্তক্ষেপ থেকে স্বাধীনতা আমাদের রেহাই দিলেও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি থেমে থাকেনি। এ ব্যাপারে এদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে মনে হয় স্বাধীনতার চেতনা কাজ করেনি। স্বাধীনতার পরপরই ঢাকার স্কুটার মালিক-ড্রাইভার সরকার প্রধানের কাছে নিবেদন করে মিটার উঠিয়ে দিল। রিক্সা চালকেরা ভাড়ার তালিকা ফেলে দিল। হোটেল -রেষ্টুরেন্ট মালিকরা খাবারের মূল্য তালিকা সরিয়ে ফেলল। দোকানগুলোতে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম প্রতিদিন বাড়তে থাকল। অন্যরাও পিছিয়ে থাকলো না। সরকারী কর্মচারীদের অফিসে যাতায়াতের জন্য বাস চাই, নতুন বেতন স্কেল চাই, বাসা চাই। চারিদিকে শুধু দাবী আর দাবী। সেই সাথে বাড়তে থাকল জিনিসপত্রের দাম। এক পর্যায়ে জাতির পিতা এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বলতে বাধ্য হলেন "তিন বছর কিছু দিবার পারুম না"।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারী উদ্যোগ নিয়েও কিন্তু কাজ হল না। টিসিবির আমদানী করা ভোজ্য তেল, ডালডা, শিশু খাদ্য, গুঁড়োদুধ নির্ধারিত কসকোর দোকানের পরিবর্তে বিক্রি হতে থাকলো আশেপাশের দোকানে, দুই-তিন গুণ মূল্যে। সোমবার সকালে রেশন দোকান খোলার কয়েক ঘন্টার মধ্যে সাপ্তাহিক বরাদ্দের সয়াবিন,তেল, চাল, চিনি শেষ হয়ে যেত। এগুলো পাওয়া যেত নিকটবর্তী দোকানে, অনেক বেশি দামে। ঢাকার মৌলভী বাজারে তখন বিদেশী পণ্যের সমাহার। টাকা দিলেই সব পাওয়া গেছে। দাম এখানকার সিন্ডিকেট নির্ধারণ করেছে। ফলে এক সের শুকনা মরিচের দাম একশত বিশ টাকায় ঠেকেছে। যা ছিল একজন সরকারি কর্মচারীর বেতনের অর্ধেক। লবণ ষাট টাকা কেজি পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। শিশু খাদ্য গুঁড়োদুধ পাঁচ পাউন্ডের এক টিন একশত ষাট টাকা, যেটা শুধুমাত্র ষাট টাকায় বিক্রি হওযার কথা। ব্যবসায়ীদের তখন সুদিন। কলকাতায় যাচ্ছেন ঈদের কেনাকাটায়, বিয়ের বাজার করতে। সরকারী হুকুম করে তখন বিয়ের অনুষ্ঠানের অতিথি সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে।

এরপর অনেক সরকার এসেছে। বাকশাল সরকার, রাষ্ট্রপতি সরকার, সামরিক সরকার, নো সরকার, অস্থায়ী সরকার, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সংসদীয় সরকার, ঐকমত্যের সরকার, চারদলীয় জোট সরকার, সামরীধায়ক সরকার এবং বর্তমানে মহাজোট সরকার। সব দলই নির্বাচনের আগে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও স্থিতিশীল রাখার ওয়াদা করেছে। ক্ষমতায় এসে হয় ভুলে গেছে, না হলে ব্যর্থ হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ঠেকাতে পারেনি কোন সরকারই। কারও আমলে চিনির দামে উর্ধ্বগতি, কারও আমলে তেলের দাম, বেগুনের দাম। এতে করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের সদিচ্ছার প্রতি জনগণের আস্থা থাকেনি। বরং অমূলক প্রতিশ্রুতি দেয়ায় নেতাদের উপর বিশ্বাস চলে গেছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার থেকেছে। বিগত চারদলীয় জোট সরকার সরকারের সময় কে এবং কীভাবে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করছে তা চিহ্নিত করেছে, জোরেশোরে প্রচারিতও হয়েছে। অথচ এই দল ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ইতোমধ্যে চিনি, আটা, কাঁচামরিচ, আদা, আলুর দামে উর্ধ্বগতি দেখতে না দেখতে এখন আবার তেলে-পেঁয়াজে। ফলে মনে হচ্ছে এই মহাজোট সরকার দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে পারবে বা উর্ধ্বগতি রোধ করবে– জনগণ এই আস্থা আর রাখতে পারছে না।

দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির পেছনে যৌক্তিকতা থাকলে মেনে নেয়া যায়। যদিওবা অনেক সময় আমরা এ ব্যপারে অহেতুক ব্যবসায়ীদের বা সরকারকে দোষারোপ করে থাকি। যেমন উৎপাদন ব্যয়, কৃষকের মেহনতি এবং টাটকা অবস্থায় সরবরাহের জন্য প্রক্রিয়াজাতকরণে খরচের বিষয়টি বিবেচনায় না এনে সব্জির দাম একটু বেড়ে গেলে দোষারোপ করতে থাকি। কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা ফড়িয়া বা মিডলম্যানদের দোষারোপ করি। কৃষকেরা সরাসরি সরবরাহ করতে পারে না বা সেই পদ্ধতি গড়ে ওঠেনি বলে গ্রাম থেকে ছোট ছোট ফড়িয়ারা কষ্ট করে পণ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করে কিছু মুনাফা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তাছাড়া এদের মধ্যেও রয়েছে প্রতিদ্বন্ধিতা। ইচ্ছামতো মুনাফা করতে পারেনা। অনেক সময় অথবা আন্তজার্তিক বাজারে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারে মূল্য বৃদ্ধি হলেও আমরা দোষারোপ করি। তবে এ ব্যপারে সরকারেরও উচিত সঠিক কারণসমূহ জনগণের কাছে তুলে ধরা। এটা ঠিক যে বাংলাদেশে ছোট ছোট পর্যায়ে ক্ষুদ্র পরিসরে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদিত বা তৈরি হয়। উৎপাদিত দ্রব্যের প্রক্রিয়াজাতকরণে সমস্যা আছে। বাজারজাত পদ্ধতির অভাব আছে। গুদামজাত করণের সুবিধা সীমিত। কিন্ত এর ফলে কি হঠাৎ করে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে? যদি সরবরাহ কম থাকত তাও কথা ছিলো।

কিন্তু সরবরাহ যথেষ্ট অথচ মূল্যবৃদ্ধি– এতে ভোক্তাদের অবাক হতে হয়। Laws of Supply Demand নীতির কোনটি বাংলাদেশে কার্যকর তা বোঝা মুস্কিল। দ্রব্যের চাহিদা, মূল্য ও সরবরাহ সবই বেশি। বাজারে কোন জিনিসেরই অভাব নেই, কিন্তু দাম বেশি। তবে বেশি দাম বলে বিক্রি থেমে নেই। ঈদের আগে বাজারে প্রচুর সরবরাহ বজায় রেখেই প্যাকেট দুধের, চিনির, মসলার দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেশি বলে মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে থাকে তা নয়। এ ব্যপারে সরকার থাকে নির্বিকার। সরকারও কম যায়না। এ দেশে একটি টেলিফোন লাইন এর বিনিময়ে টিএন্ডটি নিয়েছে ৩০ হাজার টাকা (অবশ্য তিন হাজার টাকা দামের একটা সেটসহ)। বিশ্বে কোথাও টেলিফোন লাইন নিতে এত দাম দিতে হয়েছে বলে জানা নেই। বর্তমান সরকার গতবারে ক্ষমতায় এসে গাড়ির ট্যাক্স টোকেন ও ফিটনেস বাবদ ১,৩০০ টাকা এক লাফে বৃদ্ধি করে ৬,০০০ টাকায় পৌঁছে দিল আর পেট্রোল ও ডিজেলের দাম করে দিল দ্বিগুণ যা' ছিল তখনকার আন্তর্জাতিক বাজার দর থেকেও বেশি। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার স্কুল-কলেজে সন্তানদের পাঠানোর জন্য তখন সস্তায় পেয়ে গাড়ী কিনেছে, তারা পড়ল বিপদে। এবার একই দল ক্ষমতায় ছোট গাড়ির মালিকদের ৩ হাজার টাকা এবং বড় গাড়ির মালিকদের ৬ হাজার টাকা ট্যাক্স দেয়ার বিধান করে দেয়া হলো। যদিওবা তা আয়করের সাথে সমন্বয় করা হচ্ছে। এ বছরে এই ট্যাক্স বৃদ্ধি করে যথাক্রমে ৮ হাজার টাকা ও ১৬ হাজার টাকা করা হলো। কোন নিয়মে বা নীতিতে এই বৃদ্ধি হল বোঝা মুস্কিল।

বলা বাহুল্য ক্রয়ের সময় গাড়ির মালিকরা ট্যাক্স বাবদ বিরাট অংকের অর্থ প্রদান করে থাকেন। যে সমস্ত গাড়ির মালিকদের আয়কর ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত পৌঁছায় না তাদের নিকট থেকে এই পরিমাণ অর্থ আদায় অনেকটা জোর করে নেয়ার সমান (মাসিক আয় ৩৫ হাজার টাকার উর্ধ্বে হলে এই পরিমাণ কর প্রযোজ্য হতে পারে)। পাসপোর্ট তৈরি করতে গেলে ৫ হাজার টাকা। জমি বিক্রি করে বিপুল পরিমাণে অর্থ দিয়ে বিদেশে চাকুরির জন্য একজন বাংলাদেশীর জন্য এই পরিমাণ অর্থ বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া কোন নিয়মনীতিতে যে-দেশের একজন নাগরিকের গড় আয় বছরে ৬০ হাজার টাকা, তাকে ৫ হাজার টাকা খরচ করে পাসপোর্ট তৈরি করতে হবে। যারা এগুলো স্থির করেন তারা সরকারী গাড়িতে চড়েন, সরকারী পাসপোর্টে ভ্রমণ করেন আর সরকারী বেতনে জীবন যাপন করেন। অন্যদিকে, সরকারের এই ধরণের কার্যকলাপ ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করে। অনেক জিনিসপত্রের অত্যধিক দামের কারণ বোঝা যায় না। একই ধরণের মিষ্টির দামে বড় রকমের পার্থক্য দেখা যায়। বাসের টিকিট মূল্য ১ কি.মি. পরে নামলেও যা ৫ কি.মি পরেও একই। একই শাড়ি এক দোকানে যে দাম অন্য দোকানে তার থেকে অনেক বেশী বা কম। একই সাইজের ইলিশ মাছ কোথাও পিস ২০০ টাকা কোথাও বা ৩০০ টাকা। একই ধরণের খাবার কোন রেস্টুরেন্টে ১২০ টাকা কোনটাতে ২০০ টাকা। দামের ক্ষেত্রে কোন নিয়মনীতি নেই। ক্রেতা সজাগ না হলে ঠকলেন।

ব্যবসা হলো মানুষের সেবা করার একটা সুযোগ। দেশে ব্যবসা প্রসার, ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও ব্যবসায়ে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের সাথে সাথে এখন মনে হয় সেই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যাচ্ছে। অতীতে ব্যবসা বৃত্তিকে ও ব্যবসায়ীকে ভক্তির সাথে দেখা হতো। হিন্দু ব্যবসায়ীরা ব্যবসা বৃত্তিকে লক্ষী হিসেবে দেখে থাকে। ক্রেতা যেন দামে, ব্যবহারে, অভ্যর্থনায় কোনরকম কষ্ট না পায় সেদিকে থাকে সদা দৃষ্টি। ফলে অনেক ব্যবসায়ী পরিবারকে দেখা গেছে যে তারা বংশানুক্রমে ব্যবসা করে গেছেন ঠিকই কিন্তু তাদের অবস্থার পরিবর্তন এখনকার মত এত দ্রুত ঘটেনি। ব্যবসাকে এখন পেশা হিসেবে না দেখে শুধুমাত্র মুনাফা অর্জনের ও দ্রুত বড়লোক হওয়ার পথ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ফলে কষ্ট বাড়ছে ভোক্তাদের।

আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্য অনেকাংশে নির্ভর করে ব্যবসায়ীদের ইচ্ছার উপর। সরকার নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের আমদানী শুল্ক হ্রাস করলেও মূল্য কমেনা বা সাময়িকভাবে কমলেও পুনরায় বৃদ্ধি পায়। যদিওবা আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য, জ্বালানী বাবদ খরচ, বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবহন সমস্যা, চাঁদাবাজি, সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে যোগাযোগ বা সমন্বয়ের অভাব, মূল্য পরীক্ষা না করা, ইত্যাদি কারণে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ এক গবেষণা অনুযায়ী বড় বড় ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠানসমূহের সম্মিলিত সংস্থা আমদানির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে আছে (ডেইলি ষ্টার, ১৮ মে ২০০৭)। এই গবেষণায় জাতীয় রেভিনিউ বোর্ডের নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে ২০০৬-৭ অর্থ বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত পাঁচটি আমদানিকারক দেশে আমদানীকৃত মোট অশোধিত চিনির শতকরা ৯৬ ভাগ, শোধিত চিনির শতকরা ৪৬ ভাগ, অশোধিত সয়াবীন তেলের শতকরা ৬৭ ভাগ, অশোধিত পাল্ম তেলের শতকরা ৬০ ভাগ, গমের শতকরা ৪৯ ভাগ, চালের শতকরা ভাগ ৩৭, মসুর ডালের শতকরা ৩১ ভাগ এবং পেঁয়াজের শতকরা ৩১ ভাগ আমদানী করেছে। উল্লেখ্য গত চার দলীয় জোট সরকার আমলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে পর পর দুই মন্ত্রীকে বানিজ্য মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করতে হয় এবং পরবর্তী মন্ত্রী এসে বিবেকবর্জিত বণিক, সিন্ডিকেট ও মজুদদারদের রুখতে মজুদবিরোধী আইন প্রণয়ণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। বছর দুয়েক আগে এক গবেষণার অধীন জরিপের ফলাফলে উল্লেখ করা হয়েছে যে বেশিরভাগ উত্তরদাতার মতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মূল কারণ সিন্ডিকেট ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতাসহ রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি (The main reasons and public's reaction about recent price hike in Bangladesh by Md. Murtoza Ali Quader, North South University)|

অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা সরকার থেকে কতটুকু সহযোগিতা পেয়েছে তা' নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী বৃন্দ। তাদেরকে আকাশচুম্বি মূল্যে ব্যবসা-স্থান, দোকানঘর ক্রয়, বন্ধক বা ভাড়া করতে হয়। ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে টাকা ধার নিতে হয়। সেই সাথে আছে ট্যাক্স আর ভোক্তাদের থেকে ভ্যাট আদায়। আর চাঁদাবাজি তো আছেই। বড় ধরণের মার্কেটগুলোতে এখন সব্জি বিক্রির জন্য ছোট্ট একটা দোকান ভাড়া করলেও বছরে লক্ষ টাকা দিতে হয়, অগ্রিম তো আছেই। এই দোকানে দশ টাকার বেগুন পঁচিশ টাকায় বিক্রি না করলে দোকানির পোষায় না।

সাধারণ নিয়মে প্রক্রিয়াজাত, বাজারজাত ও গুদামজাত করণের সুবিধা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকলে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল থাকা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে মনে হয় এ নিয়ম চলছে না। সম্প্রতি দেশে প্রচুর রাইস মিল হয়েছে। অনেকগুলোই আধুনিক প্রযুক্তির ও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন। মিল সংলগ্ন বড় বড় গুদাম নির্মাণ করা হয়েছে। গুদাম ভরে ধান রাখা হয় যেন সারা বছর মিল চলতে পারে। এর পরেও হঠাৎ করে বছরে কয়েকবার চালের মূল্য বেড়ে যায়। মুল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে বাজারে চাল এসে ভরে যায়। ভোক্তারাও বেশী করে কিনতে থাকেন, যদি আরও দাম বাড়ে।

বর্তমান যুগে বিশ্বের কোন সভ্য দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের এ ধরণের মূল্য বৃদ্ধি আছে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে খাদ্য দ্রব্যের। যদি কোন সুনির্দিষ্ট কারণ থাকে অন্য কথা। দ্রব্যমূল্য যদি স্থিতিশীল না থাকে, আয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হয়, হঠাৎ করে কোন কারণ ছাড়াই উর্ধ্বগতি হয় তাহলে সরকার ও ভোক্তা উভয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতিরিক্ত মূল্য বহন করতে হয় সরকারকে (আমদানী শুল্ক হ্রাস বা মওকুফ করে) অথবা ভোক্তাকে (বেশী দামে কিনে) অথবা উভয়কে। এতে সরকার বঞ্চিত হয় কর থেকে। আর ভোক্তা অতিরিক্ত মূল্য বাবদ বেশি খরচ করে টানাটানির বা অভাবের শিকার হতে হয়। সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নির্ধারিত ও সীমিত আয়ের ভোক্তারা। যাদের সংখ্যা আমাদের দেশে বেশি। অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই কোন জিনিসের মূল্য বৃদ্ধির ফলে ভোক্তারা যখন দিশেহারা তখন ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো। ব্যবসা করে সবাই দ্রুত ধনী হয়ে পড়ছেন। নতুন নতুন ব্যবসায়ী, ব্যবসা ও ঝকঝকে দোকনপাট বাড়তে থাকে। ক্রেতারাও ভিড় করে, নির্বিচারে কিনতে থাকে। একশ্রেণীর লোকদের হাতে প্রচুর কালো টাকা। জিনিষ পেলেই তারা কিনছেন। মূল্য কোন বিষয় নয়। এইভাবে ব্যবসায়ীদের সুযাগ করে দেয়া হচ্ছে। আর ব্যবসায়ীরাও সুযোগটা নিচ্ছেন। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র মজুত করে ইচ্ছামতো দামে বিক্রি করছেন। ধনী হচ্ছেন, ব্যবসার প্রসারতা বৃদ্ধি করছেন, খবরের কাগজ বের করছেন, স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল খুলছেন, সংসদ সদস্য হচ্ছেন এবং নীতি নির্ধারণ করছেন।

দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ঠেকাতে হলে প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা ও ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা। সেই সাথে প্রয়োজন কার্যকরী মূল্য নির্ধারণ বা স্থিতিশীল রাখার নীতিমালা প্রণয়ন। দেশে উৎপাদিত দ্রব্যের পরিমাণ, আমদানির পরিমাণ, চাহিদা, ক্রয় ক্ষমতা ইত্যাদির সাথে সঙ্গতি রেখে এই নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। উৎপাদন বা আমদানী খরচের উপর ভিত্তি করে দ্রব্যের মূল্য নির্ধারিত হবে। কোন অজুহাতে এই মূল্যের বৃদ্ধি হবে না, হলে কঠিন ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান ও প্রয়োগের পথ খোলা রাখতে হবে। তা না হলে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি কেউ ঠেকাতে পারবে না।