হরতাল বিষয়ে একটি সাবঅল্টার্ন গল্প কীভাবে লেখা হয়

সুমন রহমান
Published : 11 Nov 2008, 11:43 AM
Updated : 11 Nov 2008, 11:43 AM

'দহ' শহীদুল জহির-এর একটি গল্প। ১৯৮৫ সালে লেখা এই গল্পটিকে তিনি তাঁর জীবদ্দশায় কোথাও প্রকাশ করেন নি। তাঁর মৃত্যুর পর ২০০৮ সালে প্রথম আলো-র ঈদসংখ্যায় গল্পটি প্রথম মুদ্রিত হয়। আশির দশকের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এই গল্পের বিষয়বস্তু হরতাল। কীভাবে একটা ইস্যুতে হরতাল ডাকা হয়, কীভাবে প্রস্তুতি নেয়া হয়, ভোরবেলা
—————————————————————–
শেষপর্যন্ত গল্পটি আর পুলিশের থাকল না। মরিয়মের হয়ে উঠল। সেই সাথে মরিয়মের মাধ্যমে মধ্যবিত্তের তথা মূলস্রোতের হয়ে উঠল। ফলে যে গল্পটি আদিতে ছিল সাবঅল্টার্ন প্রণোদনার, অন্তে সে হয়ে উঠল এলিটিস্ট। 'দহ' শেষমেশ আর পুলিশের হরতাল ডিউটির গল্প নয়, বরং মরিয়মের পেটে সন্তান আসা না-আসা কিংবা তার বাড়ি চলে যেতে চাওয়ার গল্প। ঠিক এই জায়গাটিতে এসে সাবঅল্টার্ন প্রণোদনা মূলধারার চিন্তার কাছে হেরে গেল।
—————————————————————-


১৯৮৬-র শহীদুল জহির

কীভাবে পিকেটিং হয়, কীভাবে রাস্তায় হরতাল না-মানা যানবাহন ভাঙচুর করা হয় এসবই হরতালের নৈমিত্তিক গল্প। কিন্তু শহীদুল জহির এই গল্পে হরতালকে দেখতে চেয়েছেন হরতাল-প্রতিহতকারী শক্তি পুলিশের চোখ দিয়ে। সেই গল্পে আমরা দেখি পুলিশের সেপাই আবুল বাসার, যে তার স্ত্রী মরিয়মকে নিয়ে ঢাকায় কায়ক্লেশে বসবাস করছে, তার জীবনে একটা হরতালের দিন কীভাবে আসে, কীভাবে পার হয়, কীভাবে সেই হরতাল তার পারিবারিক জীবনে প্রসঙ্গ হয়ে ওঠে, ইত্যাদি।

হরতাল বিষয়ে একটি সাবঅল্টার্ন গল্প কীভাবে লেখা হয়? শহীদুল জহিরের 'দহ' গল্পটিকে ঘিরে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাই বর্তমান নিবন্ধের লক্ষ্য। অন্বেষণের গোড়াতেই পরিষ্কার করে নেয়া যাক সাবঅল্টার্ন গল্প বলতে আমি কী বোঝাতে চাচ্ছি। "সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ" নামক একটি ফ্রেমওয়ার্ক দিয়ে রণজিৎ গূহ, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, শহীদ আমিন, জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে, গৌতম ভদ্রসহ আরো অনেক তাত্ত্বিক প্রায় দুদশক ধরে ভারতীয় উপনিবেশিক ইতিহাসের ভিন্নতর একটি ভাষ্য নির্মাণ করে চলেছেন। এই তত্ত্বকাঠামোটি বিকশিত হয়েছে রণজিৎ গূহ-র ক্যাসিক এলিমেন্টারি আসপেক্টস অভ প্যাজান্ট ইনসার্জেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া নামক গ্রন্থটি থেকে। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থে রণজিৎ গূহ উপনিবেশ আমলের কৃষক বিদ্রোহের এক অন্যরকম চেহারা হাজির করেছেন। এই চেহারাটি কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে ইংরেজদের লেখা ইতিহাস থেকে অনেকখানি ভিন্ন, যদিও ইংরেজদের লিখিত দলিল দস্তাবেজকে আশ্রয় করে রণজিৎ গূহ তাঁর ইতিহাসটি লিখেছেন। একই উপাত্ত দিয়ে দুরকম এবং প্রায় পরস্পরবিরোধী ইতিহাস কীভাবে রচনা করা সম্ভব? রণজিৎ গূহের মতে, সেটা সম্ভব ইন্টারপ্রিটেশনের মাধ্যমে। অর্থাৎ আপনি কীভাবে বিদ্যমান উপাত্তকে ব্যাখ্যা করছেন তার ওপর নির্ভর করছে। এই ইন্টারপ্রিটেশনের জায়গাতে এসেই "সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ" একটা স্বতন্ত্র ফ্রেমওয়ার্ক হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। সাবঅল্টার্ন অ্যাপ্রোচ মূলত ইতিহাসকে নিম্নবর্গের জায়গা থেকে দেখতে চেষ্টা করে, ফলে উচ্চবর্গের বা শক্তিমানের আহরিত উপাত্তকে আহরণকারীর প্রেক্ষিত থেকে ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করে, যার ফলে পুরো বিষয়টিই ভিন্ন একটি মাত্রা পেয়ে যায়।

শহীদুল জহির ১৯৮৫ সালে "সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ"-এর সাথে পরিচিত ছিলেন কিনা জানা যায় না। না থাকাই সম্ভব, যেহেতু ১৯৮৩ সালের আগে "সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ"-এর অস্তিত্ব ছিল না। তবে সাহিত্যে সাবঅল্টার্ন প্রণোদনা অর্বাচীন বিষয় নয়। বাঙলা সাহিত্য ঘেঁটে এরকম অনেক গল্প উপন্যাসের নাম করা যাবে যেগুলো সাবঅল্টার্ন প্রণোদনা কিছুমাত্রায় হলেও ধারণ করে। শক্তিমান কথাশিল্পীরা প্রায়ই সাবঅল্টার্ন প্রেক্ষিত থেকে কাহিনী বর্ণনা করার প্রয়াস পেয়েছেন, সে হাঁসুলির তারাশংকর থেকে ধরে পদ্মানদীর-এর মানিক কিংবা আরো অনেকে। কিন্তু সেসব গল্প শেষবিচারে সাবঅল্টার্ন কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ, যেহেতু এরা এদের ডিসকোর্সের মূল ফোকাস থেকেই লিখিত। আমি "সাবঅল্টার্ন গল্প" বলতে আসলে সেই প্রণোদনাকেই বোঝাতে চাইছি যা মূলত শক্তিহীনের বা নিম্নবর্গের জায়গা থেকে কোনো বিষয়ের ওপর আলো ফেলতে চেষ্টা করে। সেই শক্তিহীন যে সবসময় নিম্নবর্গীয় জনগোষ্ঠীই হবে এমন নয়, ডমিন্যান্ট বা ক্ষমতাশালী ভাবনাকাঠামোর বাইরেও যদি কোনো সাহিত্য পা ফেলে, তাকে সেই অর্থে সাবঅল্টার্ন সাহিত্য বলা যায়। অনেক সাহিত্য, যেমন ধরা যাক সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যে নিম্নবর্গের মানুষ কিন্তু শক্তিশালী সাহিত্যিক চরিত্র। ফলে সে আর্থিকভাবে নিম্নবর্গ হলেও আদর্শিকভাবে হয়তো নয়। সাহিত্যিকভাবেও নয়। সেই অর্থে শহীদুলের 'দহ' গল্পটি, যেটি হরতালকে একটি পুলিশের জায়গা থেকে দেখতে চেষ্টা করেছে, অবশ্যই একটি সাবঅল্টার্ন গল্প। বাস্তবের পুলিশ যদিও ক্ষমতাশালী, কিন্তু সাহিত্যের পুলিশ খুবই অনাদরণীয় চরিত্র। একটি মার্জিনাল অস্তিত্ব। শহীদুল জহির সেই মার্জিনালিটির বাইরে যেতে চেয়েছেন এই গল্পে। ফলে এখানে হরতালকে ঘিরে যেসব জনপ্রিয় এবং বহুলচর্চিত চরিত্র (যথা রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র, টোকাই ইত্যাদি) বাঙলা সাহিত্যকে এযাবতকাল শাসন করেছে, এই গল্প সেখানে ব্যতিক্রম।

সাহিত্যে সাবঅল্টার্ন অ্যাপ্রোচ নতুন না হলেও "সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ"-এর প্রেক্ষিতে এ নিয়ে নতুন করে ভাবনার অবকাশ আছে। সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ মূলত একটা মেথডকে ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, এবং সেই জায়গাটি ধরে সাহিত্যের সাবঅল্টার্ন প্রণোদনা নতুন রাস্তা দেখতে পারে বলে মনে করি। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি বর্তমানের সাবঅল্টার্ন সাহিত্য একই সঙ্গে সাহিত্যের চিরায়ত সাবঅল্টার্ন প্রণোদনাকে যেমন ধারণ করবে, তেমনি সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ-এর মেথডলজি থেকেও প্রয়োজনীয় রসদ নেবে। সেটা নেবে একটা ডিসকোর্সের মধ্যে এলিটিস্ট উপাদানগুলো শণাক্ত করার মাধ্যমে। সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ ফ্রেমওয়ার্ক দিয়ে সেটি সম্ভব। এলিট ডিসকোর্স থেকে প্রস্থানের একটা উপায় হতে পারে সাহিত্যের ন্যারেটরের চিরচেনা মধ্যবিত্তীয় চরিত্রটিকে চ্যালেঞ্জ করার মাধ্যমে। অদ্বৈত মল্ল বর্মণ সেটি ভালোভাবেই করেছেন তার তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে, কিংবা আমরা শহীদুল জহিরকেও জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেই সাধনায় ব্রতী হতে দেখি। আরো কীভাবে সম্ভব সেই আলোচনায় যাওয়ার জন্যই শহীদুল জহির-এর 'দহ' গল্পটিকে বেছে নেয়া। শহীদুল জহির গল্পটিকে প্রকাশ করেন নি এবং এতে করে বোঝা যায় তিনি এই গল্পের ব্যাপারে খুব উচ্চাভিলাষী ছিলেন না। বর্তমান আলোচনায় আমরাও এই গল্পের নান্দনিক উৎকর্ষের ব্যাপারে খুব উচ্চাভিলাষী নই, কিন্তু শহীদুল জহিরের যাত্রাপথে সাবঅল্টার্ন প্রণোদনার চেহারাটি শণাক্ত করার জন্য এই গল্পের পাঠ জরুরি।

'দহ' গল্পের নায়ক আবুল বাসার পুলিশের এক সাধারণ সেপাই যে নববিবাহিত এবং স্ত্রী মরিয়মসহ ঢাকায় বসবাস করে। পুরো গল্পটি একটা হরতালের দিনকে ঘিরে পুলিশের সাধারণ সেপাইদের ভাবনা ও কর্মকাণ্ডকে তুলে ধরেছে। কিন্তু গল্পের চৌম্বক অংশটি আবুল বাসার ও তার স্ত্রী মরিয়মকে ঘিরে। আবুল বাসার যে হরতালপালনকারীদের উপর গুলি চালাতে পারে, সেই সম্ভাবনাটি মরিয়মকে আপসেট রাখে। আবুল বাসার যতই এই জিনিসটাকে তার উপর অর্পিত দায়িত্বের স্বাভাবিকতা থেকে দেখতে চায়, মরিয়ম যেন ততই এর ওপর নৈতিকতা কিংবা মানবিকতার ভ্যালু আরোপ করতে চায়। হরতালে কেউ একজন নিহত হয়, আবুল বাসারকে হরতালকারীদের ছোঁড়া ইঁটের আঘাতে আহত হয়ে হাসপাতালে যেতে হয়। ঘরে ফিরে এলে মরিয়ম তাকে বিষণ্ণ গলায় বলে যে তার পেটে বাচ্চা এসেছিল কিন্তু সেই "ছাওয়াল" মরে গেছে। মরিয়ম বাড়ি চলে যেতে চায়। গল্প এখানেই শেষ।

এই গল্পে আরেকটা প্রসঙ্গ উটকো হয়েই থেকে গেছে: গোরস্থানে কাছের বস্তির বাচ্চু নামে এক কর্মজীবী কিশোর যে কিনা হরতালের কারণে আজ বেকার দিন কাটাবে, সে ঘুম থেকে উঠে খেয়েদেয়ে বস্তির ছেলেপুলেদের হরতাল মিছিলে শামিল হয়ে যায়। বাচ্চুকে পরবর্তীতে গল্পে আর পাওয়া যায় না, গল্পের মূলধারায় তাকে দেখা যায় নি আর। তবে তথ্য আকারে এটুকু আছে যে হরতালের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে একটি বাচ্চা ছেলে, এ থেকে পাঠক অনুমান করে নিতে পারেন যে ঐ বাচ্চা ছেলেটিই বাচ্চু। কিন্তু লেখকের তরফে এর চেয়ে বেশি ইঙ্গিত গল্পে নেই। হতে পারে তিনি এর বেশি বলতে চান নি, হতে পারে যে গল্পটির পরবর্তী ড্রাফটে হয়ত তিনি বাচ্চুর প্রতি আরো সুবিচার করতে পারতেন। কিন্তু যেহেতু শহীদুল জহির এই গল্পটি প্রকাশ করেন নি, তাতে আমরা ধরে নিতে পারি যে গল্পের বর্তমান দশাটিকে তিনিও অনুমোদন করেন নি। ফলে এটি আসলে একটি খসড়া গল্প এবং এই গল্প শহীদুল জহিরের নান্দনিক উৎকর্ষ বহন করে না। আমাদের আলোচনার উদ্দেশ্যও যেহেতু শহীদুলের নান্দনিক উৎকর্ষের বিচার নয়, ফলে আমরা এই খসড়া গল্পের বিশ্লেষণ থেকে শহীদুলের যাত্রার গোড়ার দিকটা চিনতে চেষ্টা করছি।

আগেই বলেছি যে, আমাদের গল্প-উপন্যাসে হরতাল নামক প্রপঞ্চে পুলিশ অবশ্যই একটি অবহেলিত চরিত্র। অপরপক্ষ। একইভাবে, হরতাল একটি শাহরিক ঘটনা সত্ত্বেও নগরগরিবের ওপর এর প্রভাবটিও সাহিত্যে তেমন উঠে আসে নি। শহীদুল তাঁর সাবঅল্টার্ন সাহিত্যের দিকে যাত্রা শুরু করেছেন এই চরিত্রগুলো শণাক্ত করার মধ্য দিয়ে। এক্ষেত্রে তিনি প্রায় শতভাগ সফল। পুলিশের জায়গা থেকে হরতাল কিছুমাত্রায় হলেও অন্য ব্যঞ্জনা পায়, আবার বস্তিবাসীর জীবনেও হরতাল আমাদের চিরচেনা ব্যঞ্জনা নিয়ে আসে না। শহীদুল বস্তিবাসীর হরতাল-সংশ্লেষ নিয়ে তেমন না আগালেও পুলিশের ভাবনাচিন্তাকে বেশ ভালোমতই তুলে এনেছেন। ফলে, এই গল্পে আমরা দেখি যে, হরতালে যারা আমাদের পরিচিত চরিত্র তারা যেন অনেক দূরে, ঝাপসা ঝাপসা। আমরা আবুল বাসারের মনোভাব ও পুলিশদের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে খুব হালকাভাবে তাদের শণাক্ত করতে পারি। ঠিক যেভাবে গতানুগতিক গল্পে আমরা পুলিশকে শণাক্ত করতাম। এই যে গল্পটি লিখতে গিয়ে শহীদুল তাঁর পক্ষবদল করতে চেষ্টা করেছেন, এমন কিছু চরিত্রের চোখ দিয়ে ঘটনাটিকে দেখার চেষ্টা করেছেন যাদের চোখ আছে কিনা আগে আমরা সেটিই ভেবে দেখি নি, এটিই সাবঅল্টার্ন প্রণোদনা। ফলে, ১৯৮৫ সালে লেখা এই গল্প কিংবা গল্পখসড়াটি আসলে শহীদুল জহিরের 'ডুমুরখেকো মানুষ' কিংবা 'চতুর্থ মাত্রা' কিংবা 'আমাদের কুটিরশিল্পের ইতিহাস' এর গল্পকার হয়ে-ওঠার ইতিহাসটি তুলে ধরে।

কিন্তু তারপরও কেন শহীদুল এই গল্পটিকে প্রকাশ করেন নি, কিংবা প্রকাশযোগ্য করে তোলেন নি? লক্ষণীয়, এই গল্পের নাম 'দহ' এবং নামানুসারে যে দহনটি আমরা এই গল্পে দেখি সেটি কিন্তু আবুল বাসারের নয়, বরং তার স্ত্রী মরিয়মের। মরিয়ম পুলিশের স্ত্রী হয়েও হরতালকারীদের ব্যাপারে যতটা না আতঙ্কিত, তারচে বেশি যেন সহমর্মী! তার স্বামী হরতালরত ছাত্রদের গুলি করতে পারে এই আতঙ্কে সে নীল হয়ে থাকে। আবার এদের যে ঠেকানোও যাবে না এমন বিশ্বাসও যেন তার আছে। এই জায়গায় এসে মরিয়মের চরিত্রটি নিয়ে আমাদের ভাবনা হয়। হতে পারে, নববিবাহিত বলে মরিয়ম এখনো পুলিশি ভাবনা দিয়ে পুরোপুরি ওরিয়েন্টেড হয়ে উঠতে পারে নি। ফলে বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নে আমরা শহীদুল জহিরকে খুব দূষতেও পারি না। কিন্তু মরিয়ম চরিত্রটি এখানে কার প্রতিনিধিত্ব করে?

আমার বিবেচনায় মরিয়ম চরিত্রটি এখানে এমন একটি উইনডো যা দিয়ে নাগরিক মধ্যবিত্ত লেখক পুলিশের সাবঅল্টার্ন জীবনে প্রবেশ করতে পারেন, ভ্যালু অ্যাড করতে পারেন। আদতে হয়েছেও সেটাই এই গল্পে। পুরো গল্পে মরিয়ম যেন হরতালকারীদের চেয়েও শক্তিশালী প্রতিপক্ষ, আবুল বাসারদের। আরো লক্ষণীয়, গল্পটি পুলিশের হলেও এর নাম 'দহ' — যে দহ মরিয়মের। কারণ এক মরিয়ম ছাড়া এই গল্পে আর কোনো চরিত্রে দহন দেখা যায় না। এখানে এসে বিষয়টি খুব অবিশ্বাস্য লেগেছে, কারণ শেষপর্যন্ত গল্পটি আর পুলিশের থাকল না। মরিয়মের হয়ে উঠল। সেই সাথে মরিয়মের মাধ্যমে মধ্যবিত্তের তথা মূলস্রোতের হয়ে উঠল। ফলে যে গল্পটি আদিতে ছিল সাবঅল্টার্ন প্রণোদনার, অন্তে সে হয়ে উঠল এলিটিস্ট। 'দহ' শেষমেশ আর পুলিশের হরতাল ডিউটির গল্প নয়, বরং মরিয়মের পেটে সন্তান আসা না-আসা কিংবা তার বাড়ি চলে যেতে চাওয়ার গল্প। ঠিক এই জায়গাটিতে এসে সাবঅল্টার্ন প্রণোদনা মূলধারার চিন্তার কাছে হেরে গেল। আর হেরে গেল বলেই হয়তো শহীদুল জহির তাঁর ১৯৮৫ সালে লেখা এই গল্পটিকে কোথাও প্রকাশ করেন নি, এমনকি পরিমার্জনাও করেন নি। কিন্তু এই গল্পের পাঠ আমাদের ঠিকই চিনিয়ে দেয় সেইরকম একজন কথাশিল্পীর বেড়ে ওঠাকে, পরবর্তীকালে যিনি 'আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস' লিখবেন, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার পাঠ নেবেন। ফলে, শহীদুল জহিরের 'দহ' গল্পটির পাঠ তাঁর পাঠকের জন্য নিঃসন্দেহে একটি দুর্লভ অভিজ্ঞতা, এ কারণে যে এই গল্পের মাধ্যমে শহীদুলের পাঠক তাদের প্রিয় লেখকের অভিযাত্রাকে আরো নিপুণভাবে শণাক্ত করতে সক্ষম হবেন।

যে প্রশ্নটি শুরুতে ছিল, কীভাবে হরতাল নিয়ে একটি সাবঅল্টার্ন গল্প লেখা সম্ভব? বর্তমানের ঢাকা শহরের প্রেক্ষিতে এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো অন্যরকম। শহীদুল জহিরের 'দহ' গল্পে আমরা যেমন কর্মজীবী কিশোর বাচ্চুকে এক ঝলক দেখেছি, বস্তিবাসী সে, খেয়েদেয়ে হৃষ্টমনে পাড়ার দামাল ছেলেদের হরতাল হরতাল খেলায় শামিল হয়ে পড়ে। বর্তমানের হরতাল বস্তিতে আরেকটু অন্যরকম অভিঘাত ফেলে বলে মনে হয়। আমার ধারণা, 'দহ' গল্পটি শহীদুল জহির যদি ২০০৮ সালে লিখতেন তাহলে হয়তো মরিয়মের বদলে বাচ্চু প্রধান চরিত্র হয়ে উঠত। ব্যক্তির অন্তর্দহনের বদলে নিরুপায় সমষ্টির কাহিনী প্রাধান্য পেত। ১৯৮৫ সালের বিবেচনায় হরতাল নামক প্রপঞ্চে পুলিশকে সাবঅল্টার্ন চরিত্র বিবেচনা করা ঠিক আছে, কারণ তখনো নগর-দরিদ্রদের ঘিরে ক্ষমতাবানের "ম্যাশিন পলিটিকস" সেভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে নাই। ওঠে নাই বলেই 'দহ' গল্পে বাচ্চুর চরিত্রটিও বিকশিত হয় নাই। ২০০৮ সালের হরতালবিষয়ক সাবঅল্টার্ন গল্প হয়তো শুরুই হবে বাচ্চুদের বস্তি থেকে। হরতাল বাচ্চুদের কাছে এখন আর হরতাল হরতাল খেলা নয়, বরং এমন একটি প্রপঞ্চ যেখানে ইচ্ছানিরপেভাবে বা অনিচ্ছায় শামিল হতে হয়। একটি সাবঅল্টার্ন মেথডলজি দিয়ে হরতাল-পূর্ব সন্ধ্যায় পুলিশের ৫৪ ধারায় গ্রেফতার লিস্ট থেকেও আগামি দিনের হরতালের অন্য একটি চিত্র পেয়ে যাওয়া সম্ভব।