স্বাধীনতার সাঁতারু অরুণ নন্দীর সঙ্গে

আশীষ চক্রবর্ত্তী
Published : 21 Nov 2008, 05:22 AM
Updated : 21 Nov 2008, 05:22 AM

—————————————————————–
কতবার যে শরীরের যন্ত্রণায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি, তবু থামিনি। আসলে ওই সাঁতারটাকে আমি বাংলাদেশের মান-মর্যাদার সাথে এক করে দেখেছিলাম। সে জন্যই ব্যক্তিগত কষ্টের চিন্তা আমলে নিয়ে মাঝপথে থামবার কথা ভাবতেই পারিনি। একটানা ৯০ ঘন্টা ৫ মিনিট সাঁতার কেটে তবেই থেমেছি। আগের রেকর্ড তখন ৩৩ মিনিট পেছনে। পরবর্তীতে বহু পত্র-পত্রিকায়, আলাপ-আলোচনায় আমার ওই সাঁতারকে 'স্বাধীনতার সাঁতার' হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
—————————————————————-

গত ১৬ নভেম্বর চিরবিদায় নিয়েছেন সাঁতারু অরুণ নন্দী। শুধু সাঁতারু বললে অবশ্য কম বলা হয়, সদ্য প্রয়াত অরুণ নন্দী ছিলেন সাঁতারু মুক্তিযোদ্ধা। না, রণাঙ্গনে সশস্ত্র যুদ্ধ তিনি করেননি। একাত্তরে নেমেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার লড়াইয়ে। কলকাতার এক সুইমিং পুলকেই বেছে নিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে। যুদ্ধে নেমে গড়েছিলেন দূরপাল্লার সাঁতারে নতুন বিশ্বরেকর্ড। নাতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকারসহ সরল, নিরহঙ্কার আর সাঁতার-অন্তপ্রাণ মানুষটিকে নিয়ে আশীষ চক্রবর্ত্তীর এ লেখা পাক্ষিক শৈলীতে প্রকাশিত হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৯৬ সালে। অরুণ নন্দীর বাস তখন আরামবাগ অগ্রণী ব্যাংক মাঠের পাশের কলোনির এক ১০ ফুট বাই ১২ ফুট কক্ষে। গত ১২ বছরে বেড়ে বেড়ে বয়স হয়েছিল ৬৭, জীবনের শেষ কয়েকটা বছর কাটিয়েছেন সেই ১০ ফুট বাই ১২ ফুটের মতোই হকি স্টেডিয়ামের দোতলার এক ছোট্ট ঘরে। পরিবর্তন বলতে এটুকুই। নইলে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজের অবদান নিয়ে অহঙ্কার, দেশের সাঁতারকে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন, সুইমিং ইনস্টিটিউট গড়তে না পারার হতাশা — চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার আগ পর্যন্ত অরুণ নন্দী এসব জায়গায় একটুও বদলাননি। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীতে প্রকাশিত (কিছুটা সংক্ষেপিত) এই লেখা সে কারণেই এখনো বড় বেশি প্রাসঙ্গিক।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: আশীষ চক্রবর্ত্তী

পরিচয়পর্বেই সবাইকে বেশ আপন করে নিতে পারেন। কিন্তু তারপরও কারো সাথেই তাঁর ফারাকটা ঘোচে না। ওটা আসলে ঘুচবারও নয়। অরুণ নন্দী দূরপাল্লার সাঁতারে একটা বিশ্বরেকর্ড গড়ে সাধারণের চেয়ে অনেক অ-নে-ক উঁচুতে আসন গেড়েছিলেন ১২ অক্টোবর ১৯৭১-এ। একাত্তর বাংলাদেশের বিজয়ের বছর — আমাদের স্বাধীনতার বছর। অরুণ নন্দীর সমস্ত সত্তা সবসময় তাই বুঁদ হয়ে থাকে একাত্তরে।


বিশ্ব রেকর্ড গড়ার পর ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলের সম্বর্ধনায় বক্তৃতা করছেন অরুণ নন্দী।

স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীতে অরুণ নন্দী'কে আরো জানবার-জানাবার প্রবল ইচ্ছে ছিল। সেই ইচ্ছের কথা শুনে হাঃ হাঃ হাঃ হাসিতে ফেটে পড়লেন অরুণ নন্দী। পরক্ষণেই অট্টহাসির কারণ অন্বেষণের চেষ্টায় ছেদ টানলেন এই 'ইয়ংম্যান'-এর পিঠ চাপড়ে দিয়ে। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাৎলে দিলেন তাঁর আবাসের ঠিকানা, বললেন, 'কথা হবে সেখানেই'।

চাঁদপুরের বাগাদী গ্রামের ছেলে অরুণ নন্দী। বাবা বিনোদ নন্দী আর মা কুমুদ বালা নন্দীর তৃতীয় সন্তান। জন্ম ১৯৪১ সালের ২৬ নভেম্বর। বাড়ির কাছেই ডাকাতিয়া নদী। তার সাথে ভাব হয়ে যায় শিশু অরুণের। দু'য়ের মাখামাখির ফলই সাঁতারু অরুণ নন্দী। সাঁতরে সাঁতরে পুরস্কার জিতে তা দিয়ে ঘর সাজানো সেই কৈশোরেই হয়ে ওঠে নেশা। ছোটদের প্রতিযোগিতায় চাঁদপুর চ্যাম্পিয়ন হলেন মাত্র ১০ বছর বয়সে। তারপর বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে খ্যাতি। '৫৬ থেকে '৫৮ — টানা তিন বছর ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইলে আন্তঃস্কুল চ্যাম্পিয়ন। তাঁর কাঁধে চেপে আন্তঃকলেজ প্রতিযোগিতায় রানার্স আপ হয়ে যায় চাঁদপুর কলেজ। সেটা '৫৯ সালের কথা। সময় গড়িয়ে চলে। একসময় অল্প দূরত্বের সাঁতারের জন্যে টানটা যায় কমে। অরুণ নন্দী ঝুঁকে পড়েন দূরপাল্লার সাঁতারের দিকে। 'নতুন ঝোঁকের ঝুঁকি সামলাতে পারবো তো?' এ সংশয় মন থেকে মুছে ফেলেন তিন মাইলের এক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে। সেটাও '৫৯ সালের কথা। পরের বছর চাঁদপুর-ঢাকার ৬০ মাইল দীর্ঘ জলপথ সাঁতরে পাড়ি দিতে গিয়ে শেষটায় ক্লান্ত হয়ে হলেন দ্বিতীয়। '৬৪তে সাঁতরালেন ৪২ মাইল; নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুর। '৬৬ তে ৩২ মাইল, দাউদকান্দি থেকে চাঁদপুর। দু'বারই হলেন দ্বিতীয়। আবার প্রথম হলেন ফরিদপুরের ১৪ ঘন্টা সাঁতারে, '৬৭ সালে। পরের বছর কুমিল্লায় ৫৮ ঘণ্টা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৫৩ ঘণ্টা, চাঁদপুরে ৫২ ঘণ্টা আর নোয়াখালিতে ৩৬ ঘণ্টা অবিরাম সাঁতার কেটেছেন অরুণ নন্দী। '৬৯ -এ সাঁতরান টানা ৪৮ ঘণ্টা, ফেনিতে আর '৭০-এ ৪২ ঘণ্টা, বরিশালে। '৫৯ থকে '৭০ — এই এক যুগে অল্প দূরত্বের সাঁতারে বলতে গেলে নামেনইনি। শুধু কলকাতার ক্লাব সুইমিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে জিতেছিলেন ৪ x ১০০ মিটার রিলের প্রথম পুরস্কার আর ৪০০ মিটার ফ্রি স্টাইলের দ্বিতীয় পুরস্কারটি। স্বল্পপাল্লার সাঁতারে নেমে আরেকবার বলার মতো সাফল্য পেয়েছিলেন '৭০-এ। সেবার প্রাদেশিক প্রতিযোগিতায় রিলেতে (৪ x ১০০ মিঃ) হয়েছিলেন দ্বিতীয়।

পঁচিশে মার্চের কালোরাত্রির পর প্রাণভয়ে কলকাতায় গিয়ে ওঠে নন্দী পরিবার। গোটা দেশ তখন বিশাল এক বধ্যভূমি। ঘাসের সবুজে বাঙালির রক্তের ছোপ। সে অবস্থায় অরুণ নন্দীও মুখ বুঁজে বসে থাকতে পারলেন না। ঠিক করলেন সামর্থ্যের শেষ বিন্দু ঢেলে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেবেন পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তিলাভের আকাঙ্ক্ষায় সংগ্রামে লিপ্ত বাঙালি জাতির কথা — স্বপ্নের বাংলাদেশের কথা। ঝট করে মাথায় আসে দূরপাল্লার সাঁতারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বি.সি. মুন-এর গড়া ৩২ বছরের পুরোনো বিশ্ব রেকর্ডটার কথা। স্থির করলেন, রেকর্ডটা ভাঙবেন। অরুণ নন্দী জানতেন, তামাম দুনিয়াকে একটু চমকে দিতে না পারলে বাঙালির কথা শুনতে চাইবে না কেউ। ৮ অক্টোবর, ১৯৭১। সকাল সাড়ে আটটা। কলকাতা কলেজ স্কোয়ার সুইমিং পুলের চারপাশে শুধু মানুষ আর মানুষ। ভারতে বাংলাদেশের তখনকার হাইকমিশনার হোসেন আলী সগর্বে ওড়ালেন জাতীয় পতাকা। বেজে উঠলো জাতীয় সঙ্গীতের হৃদয়স্পর্শী সুর। অন্যরকম ভাবালুতায় আচ্ছন্ন হলো সমস্ত পরিবেশ। ৩০ পেরোনো বাঙালি তরুণ ঝাঁপ দিলেন জলে। ৩২ বছরে কোনো হোমোস্যাপিয়েন-ই যাঁর গর্বে কাছাকাছি ঘেঁষতে পারেনি, সেই মুন সাহেবের সাথে তফাৎটা কমতে থাকলো। বাগাদি গ্রামের তরুণ এগিয়েই চলেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একদিন। দু'দিন। তিন দিন। সাত কোটি মানুষের আনন্দ-বেদনা বুকে নিয়ে বয়ে চলেন অরুণ নন্দী। তাঁর ক্লান্তিতে অবসন্ন শরীর এগিয়ে চলে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মনের শাসনে। এক সময় নাছোড় বাঙালির কাছে হেরে যান বিসি মুন । তার ৮৯ ঘণ্টা ৩২ মিনিটের অহঙ্কার ধুলোয় মিশে যায়। সাহস, ধৈর্য আর সহ্যশক্তির চূড়ান্ত নমুনা ভেসে ওঠে অবিরাম ৯০ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতরে গড়া অরুণ নন্দীর নতুন বিশ্ব রেকর্ডটিতে।

জাতির চরম দুর্দিনে অরুণ নন্দীর সেই কীর্তি সাড়া ফেলে দেয় চারিদিকে। ভারতীয় প্রচারমাধ্যম তো বটেই সেইসঙ্গে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকাসহ পৃথিবীর প্রায় সবগুলো সংবাদমাধ্যমেই প্রচার করা হয় ১২ অক্টোবর ১৯৭১-এ অরুণ নন্দীর বিশ্বজয়ের খবর। এক বাঙালির এ সাফল্য রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদেরও অনুপ্রাণিত করেছিল দারুণভাবে। অরুণ নন্দীর তখন প্রশংসা আর অভিনন্দনবার্তার তোড়ে ভেসে যাবার অবস্থা। ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার হোসেন আলী অভিনন্দনবার্তায় লিখলেন 'By establishing the new world record, you have not only brought fame and glory to yourself, but also have focussed world attention to our new-born nation.'

অরুণ নন্দীর সাফল্যে সেদিন গর্বিত হয়েছিল সমগ্র বাঙালি জাতি। গর্বের সেই অনুভূতি প্রকাশও পেয়েছে নানা সময়, নানাভাবে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক শওকত ওসমান তাঁর ডায়েরিতে অরুণ নন্দীর বিশ্ব রেকর্ডটাকে মূল্যায়ন করেছিলেন এভাবে, "বাংলাদেশের অধিবাসীর এই তাকলাগানো ম্যাজিক বিশ্বকে দুর্দিনে আরো আমাদের কাছে টেনে আনবে।" (১৯৭১ : স্মৃতি খণ্ড মুজিব নগর, শওকত ওসমান)। তা এনেছিল বৈকি। আর এনেছিল বলেই অরুণ নন্দীর বুক ভরে গিয়েছিল গর্বে।

আরামবাগ অগ্রণী ব্যাংক মাঠের পাশের কলোনীর এক দশফুট বাই বারো ফুট সাইজের ঘর। অরুণ নন্দীর বৈঠকখানা কাম শয়ন কক্ষ। ঘরে আসবাবপত্র বলতে একটা খাট আর খাটের পাশেই দুটো চেয়ার আর একটা ছোট্ট টি টেবিল। সেখানে বসেই মুখে খই ফোটালেন অরুণ নন্দী। দেখতে দেখতে জমে ওঠা আড্ডা থেকেই জানা গেল অনেক কিছু।

আশীষ চক্রবর্ত্তী: দূরপাল্লার সাঁতারে আপনার বিস্তর খ্যাতি। সাঁতারের এত কষ্টদায়ক ধরনটির দিকে ঝুঁকেছিলেন কেন?

অরুণ নন্দী: দেখুন, সাঁতার জগতে আসতে না আসতেই ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী বাঙ্গালি সাঁতারু ব্রজেন দাসের কীর্তির কথা শুনে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সেই সাথে চ্যানেল পাড়ি দেয়ার ইচ্ছেটাও উঁকি দিয়েছিল আমার মনে। ইচ্ছে পূরণের যোগ্যতা প্রমাণ করা দরকার ছিল। তাই দূরপাল্লার সাঁতারে এলাম। পরে যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছি নানাভাবে। মীরপুর থেকে চাঁদপুর অবধি সাঁতরেছি। ব্রজেন দাসও তা পারেননি। বিশ্ব রেকর্ডও করেছিলাম। ওটা ভেঙে গেছে। এশিয়ান রেকর্ডটা তো এখনো অটুট। মোট কথা, ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার স্বপ্ন নিয়েই শুরু করেছিলাম দূরপাল্লার সাঁতার। কিন্তু নানা ধরনের বাধা-বিপত্তি চ্যানেলের দিকে এগোতেই দেয়নি আমাকে।

আশীষ: যতদূর জানি, প্রতিকূল পরিবেশেই আপনি বিশ্বরেকর্ড ভেঙেছিলেন। ইংলিশ চ্যানেলে যেতে পারলেন না কী ধরনের প্রতিকূলতা বা প্রতিবন্ধকতার কারণে, একটু খুলে বলবেন?

অরুণ: বি. সি. মুন-এর রেকর্ড ভাঙার সময় আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ ছিলাম। তখন সবাই আমাকে সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু স্বাধীন দেশে পরিস্থিতি একটু অন্যরকম হয়ে যায়। আমার সাফল্যকে অনেকেই বাঁকাচোখে দেখতে শুরু করেন। তাদের জন্যেই আমার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার ইচ্ছেটা অপূর্ণ থেকেছে।

আশীষ: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আপনি আমাদের জন্য অসামান্য গৌরব বয়ে এনেছিলেন। সেই দিনগুলোর কথা কিছু বলুন।

অরুণ: আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তটা এসেছে একাত্তরে। পঁচিশে মার্চ-এর পর আমরা সপরিবারে কলকাতা চলে যাই। কিন্তু দেশ ছেড়ে গিয়ে মন মানছিলো না। চরম দুর্দিনে দেশের জন্যে কিছু করার তাগিদ অনুভব করছিলাম। অস্ত্র হাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মানুষ তো আমি নই, তাই ঠিক করলাম যে কাজের মানুষ, সে কাজেই নামবো। সাঁতারটা চালিয়ে গেলাম। ওখানকার ক্লাব সাঁতারে আর ওয়াটারপোলো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ফিট্‌নেস বজায় রাখলাম। এক সময় ঘোষণা করলাম, অবিরাম সাঁতারে যুক্তরাষ্ট্রের বি. সি. মুন-এর বিশ্ব রেকর্ডটা ভাঙবো। লক্ষ্য ছিল একটাই, ওই রেকর্ড ভেঙে বাংলাদেশের কথা পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেয়া। কলকাতার চাঁদপুর সম্মিলনী সমিতি এবং বৌবাজার ব্যায়াম সমিতি ও সুইমিং ক্লাবের উদ্যোগে একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল। ৮ অক্টোবর সকাল সাড়ে আটটায় কলেজ স্কোয়ারে জাতীয় পতাকা ওড়ালেন ভারতে বাংলাদেশের তৎকালীন হাইকমিশনার জনাব হোসেন আলী। জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হলো। তখনকার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। যা হোক, উপস্থিত হাজার হাজার দর্শকের করতালি আর হর্ষধ্বনির মাঝে জলে নামলাম। সাঁতার চলতে থাকলো। চারিদিক থেকে সবাই আমাকে উৎসাহ দিচ্ছিলো। প্রথম দু'দিনের সাঁতারে কষ্টটা তেমন টের পাইনি। আসল কষ্ট অনুভব করলাম ১১ অক্টোবর থেকে। ১২ অক্টোবর পর্যন্ত আমার ওপর দিয়ে কেমন ধকল গেছে তা শুধু আমিই জানি। কতবার যে শরীরের যন্ত্রণায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি, তবু থামিনি। আসলে ওই সাঁতারটাকে আমি বাংলাদেশের মান-মর্যাদার সাথে এক করে দেখেছিলাম। সে জন্যই ব্যক্তিগত কষ্টের চিন্তা আমলে নিয়ে মাঝপথে থামবার কথা ভাবতেই পারিনি। একটানা ৯০ ঘন্টা ৫ মিনিট সাঁতার কেটে তবেই থেমেছি। আগের রেকর্ড তখন ৩৩ মিনিট পেছনে। পরবর্তীতে বহু পত্র-পত্রিকায়, আলাপ-আলোচনায় আমার ওই সাঁতারকে 'স্বাধীনতার সাঁতার' হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সর্বস্তরের মানুষ আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। বাংলা ছায়াছবির কিংবদন্তির নায়ক উত্তম কুমার স্বয়ং এসেছিলেন অভিনন্দন জানাতে। মনে পড়ে, এক অনুষ্ঠানে অন্নদাশংকর রায়, আশাপূর্ণা দেবী এবং আরো কয়েকজন খ্যাতনামা সাহিত্যিক আমাকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। 'সন্তরণশ্রী' উপাধিতে ভূষিত করেছিল ত্রিপুরা সমিতি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন (সম্ভবত) আশরাফুল আলম। আকাশবাণীর পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।

আশীষ: স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে…

অরুণ: তখন তো এ দেশ বিরাট একটা ধ্বংসস্তূপ। দেশে ফিরেই কুমিল্লা জেলা দলের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিলাম। তবে সাঁতার ছাড়িনি তখনো। উল্লেখ করার মতো একটা কাজ করেছিলাম চুয়াত্তরে। সে বছরের ৩০ অক্টোবর মিরপুর থেকে চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে সাঁতার শুরু করলাম। ৭০ মাইল দূরত্ব শেষ হলো ৩ নভেম্বরে। ভারতের মিহির বোসের গড়া ৬১ মাইলের দূরপাল্লার সাঁতারের এশীয় রেকর্ডটা এভাবেই ভেঙেছিলাম সেদিন। রেকর্ড ভাঙার পথে আমাকে তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, পদ্মা, মেঘনা আর ডাকাতিয়া মিলিয়ে মোট সাতটি নদীর বুক ছুঁয়ে যেতে হয়েছিল। এ সাফল্যের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তলব করলেন। গেলাম। বঙ্গবন্ধু সস্নেহে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, "তোরে দিয়া আমি বে অব বেঙ্গল পার করামু। তুই আমার দেশের গর্ব।" তার দেয়া উপহার (স্যুটপিস) হাতে নিয়ে আমি একটা সুইমিং ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার ইচ্ছে প্রকাশ করলাম। তিনি জবাব দিলেন, "ঠিক আছে, হবে।" কিন্তু হবে কী করে? ৭৫-এ বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন। আমার আর সুইমিং ইনস্টিটিউট গড়া হলো না।

আশীষ: চেষ্টা করেছিলেন তারপর?

অরুণ: করেছি। আশ্বাসও পেয়েছি অনেক। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ইংলিশ চ্যানেলের কথা তো আগেই বলেছি। কোচিংয়ের ওপর বিদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ চেয়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল দেশের জন্য সাঁতারু গড়ার চেষ্টা করবো। অনেক চেষ্টার পর '৯৩-তে পাকিস্তান থেকে একটা কোর্স করে এসেছি। এখন বেইলি রোডের অফিসার্স ক্লাবে সাঁতার শেখাই। স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় ১৬/১৭ বছর চীফ টার্নিং জাজ-এর দায়িত্ব পালন করেছি। তিন বছর হয় বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশনের সিনিয়র জয়েন্ট সেক্রেটারির দায়িত্বে আছি। বাংলাদেশের সাঁতারের উন্নয়নে আপ্রাণ চেষ্টা করার ইচ্ছেটা এখনো আছে। জানি না এ বয়সে কতটা পারবো।

আশীষ: সাঁতারে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনি কতটা আশাবাদী?

অরুণ: হতাশ হলে তো চলবে না। আমি মনে করি, থানা পর্যায়ে সুইমিংপুল তৈরি করে ব্যাপক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিলে, গ্রাম-গঞ্জের প্রতিভাবান সাঁতারুদের যত্ন নিলে আমাদের পক্ষে এশিয়ার মানে পৌঁছানো অসম্ভব নয়। সরকারের পরিকল্পনাও সেরকম। সারাদেশে নতুন ২০টি সুইমিং পুল নির্মাণ করা হবে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় এটাও তেমন কিছু নয়। আরো অনেক কাজ করতে হবে। সচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েদেরও সাঁতারের প্রতি আগ্রহী করে তোলা দরকার। আসলে বর্তমান বিশ্বের তুলনায় আমাদের সাঁতারের মান একেবারেই আশাব্যঞ্জক নয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হচ্ছে, আশাবাদী হয়ে সকল প্রয়াসকে সফল করে তোলার জন্যে আন্তরিক প্রয়াস জোরদার করা।

আশীষ: আপনি সাঁতার শুরু করেছিলেন চার দশকেরও বেশি আগে। এ সময়ে এ অঞ্চলের সাঁতার কতটা এগিয়েছে?

অরুণ: এগিয়েছে তো বটেই। তবে সময়ের বিচারে অগ্রগতিটা হয়তো তেমন বেশি নয়, আবার যেটুকু হয়েছে তা একেবারে ফেলে দেয়ার মতোও নয়। আমাদের সময়ে প্রতিকূলতা ছিল বেশি। পারিবারিক উৎসাহ-উদ্দীপনা ছাড়াই আমাকে এগোতে হয়েছিল। সাঁতারকে পেশা হিসেবে নেয়ার কোনো উপায় ছিল না, বাবা-মা উৎসাহ দেবেন কোন ভরসায়? এখন তো ভালো সাঁতারুরা ভালো ভালো চাকরি করতে পারছেন, অনেকে আবার চাকরি-বাকরি না করে স্রেফ সাঁতার শিখিয়েও দিব্যি রুটিরুজির ব্যবস্থা করে নিচ্ছেন। সাঁতারুদের জন্য পরিবর্তনটা অনুকূলই বলতে হবে। আর সাঁতারের গুণগত মানোন্নয়নের কথা বলছেন? হ্যাঁ, স্বল্প পাল্লার সাঁতারে আমরা কিছুটা উন্নতি করেছি। সাফ গেমস থেকে বেশ কিছু সাফল্য পেয়েছে আমাদের সাঁতারুরা। কিন্তু দূরপাল্লার সাঁতারের চর্চা কম, সাফল্যও নেই। আমার তো মনে হয় দূরপাল্লার সাঁতারে আমরা অনেক ভালো করতে পারবো।

—-

ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts