রৌরব (কিস্তি ১)

লীসা গাজী
Published : 23 Jan 2009, 05:08 AM
Updated : 23 Jan 2009, 05:08 AM

আর হবে না মানব জনম
কুটলে মাথা পাষাণে

১.

রাস্তায় আবোল তাবোল ঘুরতে লাভলীর খুব ভালো লাগে। কিন্তু বাসা থেকে বের হওয়াটা পুল সিরাত পার হওয়ার মতো কঠিন এবং জটিল। আজ অবশ্য ঘটনা অন্য রকম, আজ সে সম্পূর্ণ একা বের হয়েছে। কীভাবে এই অসম্ভব সম্ভব হলো তা একমাত্র খোদা'তায়ালাই বলতে পারেন। তাই বলে একেবারেই যে বাইরে যাওয়া হয় না, তা না। তবে যখন যায় মায়ের সাথেই যায়, দু'একবার অবশ্য বিউটির সাথেও গেছে। সেও যাকে বলে মনে রাখবার মতো ঘটনা। কিন্তু আজ শেলওয়ার কামিজের কাপড় কেনার উদ্দেশ্যে ও একাই বেরিয়েছে। অবিশ্বাস্য, কিন্তু সত্যি। অবশ্য ফরিদা খানম, লাভলীর মা, যথারীতি বিউটিকে সাথে নিয়ে যাবার জন্য অনেক পীড়াপিড়ি করেছেন। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, বিউটি শেষমেশ যাচ্ছে না দেখেও ওর যাওয়া বন্ধ করেন নাই। তার মতির এই হঠাৎ পরিবর্তনের কারণ কী কে বলতে পারে। বরং গাউছিয়া যাওয়ার প্রস্তাব তার মুখ থেকেই এসেছিলো।

— গাউছিয়া গেলে চল। দেখ বিউটি যাবে কী না? মহারানী তো মটকা মাইরা পইড়া আছে।

লাভলী বৃথাই কিছুক্ষণ বিউটির দরজা ধাক্কা দিলো। ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এটাই হচ্ছে অসুবিধা, একবার যদি ঘুম দেন মহারানী সেই ঘুম ভাঙতে খবর আছে। সবে তো বাজে নয়টা, দশটা সাড়ে দশটার আগে বিউটির ঘুম ভাঙে না। ঘুম ভাঙার পরেও নানান কায়দা। দাঁত
—————————————————————–
অনেকেই তার পাশ দিয়ে হুটহাট চলে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু একটু দূরে গিয়েই আবার মাথা ঘুরিয়ে ওকে আপাদমস্তক দেখে নিচ্ছে। দু'টা অপরিপাটি লম্বা বেণী, কামিজের ঝুল হাঁটু ছাড়িয়ে আরও এক বিঘৎ নেমে গেছে, ভ্রুজোড়া যেমন কে তেমন, চোখে বিহ্বল হারিয়ে যাওয়া দৃষ্টি, মুখের লাবণ্যটুকু বিদায় হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এমন জিনিস ঢাকা শহরের বাজারে সচরাচর দেখা যায় না। একটা কাপড় নিয়ে কতোক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে দোকানদারও পাত্তা দিচ্ছে না। হঠাৎ করে চোখ ভিজে উঠলো লাভলীর।
—————————————————————-
মাজা, মুখ ধোওয়া এগুলো তো আছেই এছাড়া আর যা আছে তাতেই তার ঘণ্টাখানেক লেগে যায়। মাথার ঠিক মাঝখানে সিঁথি করে ডান পাশের চুল আর বাঁ পাশের চুল গুনে গুনে একশো'বার আঁচড়াবে, তারপর চুল ছেড়ে রাখবে বা টানটান করে একটা লম্বা বেণী করবে। বিউটির জন্য সব সময় ডাল বাটা ফ্রিজে তৈরী থাকে, সেই ডাল বাটা মুখে দিয়ে কম পক্ষে আধ ঘণ্টা বসে থাকবে। ডাল বাটা মুখে শুকিয়ে ঝুরঝুর করলে একটা ছোট তোয়ালে গরম পানিতে ডুবিয়ে ভালো করে চিপে নিয়ে সেটা দিয়ে আস্তে আস্তে মুখ পরিষ্কার করবে। সুতরাং বারোটার আগে যে তাকে তৈরি করানো যাবে না এটা মোটামুটি নিশ্চিত। তাও লাভলী ফরিদা খানমের কথামতো বিউটিকে ঘুম থেকে তোলবার চেষ্টা করলো কিন্তু লাভ হলো না।

— আম্মা বিউটি ঘুমাইতেছে। ডাকলাম শুনে না।

— ডাইকা লাভ নাই, হাটকালের বংশ। নামায নাই কালাম নাই শুধু ঘুম। ঘুম থিকা উঠলেও লাভ নাই, আয়না নিয়া বসবেন। যা, তুই তৈরি হ… যাওয়ার আগে দ্যাখ, যায় কী না…।

লাভলীর অতো বায়নাক্কা নাই। বিউটির মতো ও চুলে সিঁথি কাটতেও বসলো না, মুখে ডালও ঘষলো না। কোনো রকমে চুলটা আলুথালু বাঁধলো। সব সময় যা করে তাই করলো — দু'টা লম্বা বেণী। চুল বাঁধতে গিয়ে টের পেলো আগা ফেটে চৌচির। চুল পিঠ ছাড়িয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু নিচের দিকে ইঁদুরের লেজের মতো অবস্থা। না, বিউটিকে ব‌লতে হবে আগাটা একটু ছেটে দিতে। মুখে সাবান ঘষলো। আজকাল মুখে সাবান দিলেই মুখ টানতে থাকে। আগে এরকম হতো না — ভাবতে ভাবতে মুখে নিভিয়া ক্রিম মাখে লাভলী। শীতের সময়ই যা একটু ক্রিম লাগায় ও। গরমের সময় ওর ওসব লাগে না। ড্রয়ার খুলে যে কামিজটা প্রথমে চোখে পড়লো তাই টেনে বের করলো। লাভলী মনে মনে খুব চাইছে আজকে যেন ফরিদা খানম ওদের সাথে না যান। এই চাওয়ারও কোনো কারণ নাই। ফরিদা খানম সাথে না গেলেও যে খুব একটা উনিশ বিশ হবে তাও না। বড় জোর দুই বোনে মিলে চটপটি বা ফুচকা খাবে। ফরিদা খানম সাথে থাকলেও খাওয়া যায়, তবুও শুধু ওরা দুই বোন যখন যায় তখন অন্য রকম ফুরফুরা লাগে।

লাভলীর তৈরি হতে লাগলো বড় জোর দশ মিনিট। কিন্তু বিউটি কিছুতেই সাথে যেতে রাজি হলো না। দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে কী করছে কে জানে। লাভলীর মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। ফরিদা খানম দু'একবার চেষ্টা করলেন ধাক্কা দিয়ে দরজা খোলাতে, কিন্তু পারলেন না।

'অলক্ষীর একশেষ।' ফরিদা খেদ ঝাড়লেন। 'এক বান্দা সারাক্ষণ বাইরে যাওয়ার জন্য কই মাছের মতো হাঁ কইরা থাকে, আরেকটারে মাইরাও বাইর করা যায় না।'

তা যেভাবেই হোক, মোদ্দা কথা হলো রাস্তায় এখন লাভলী একাই হাঁটছে। এই অসাধ্য কীভাবে সাধিত হলো লাভলী তাই ভাবছে। পৃথিবীর আশ্চর্যতম ঘটনা হিসাবে এটা খুব সহজেই গীনিজ বুক অফ রেকর্ডসে ওঠার যোগ্যতা রাখে। অবশ্য আজ ওর জন্মদিন; আজ ওর বয়স চল্লিশ হলো। এই কারণেও আম্মা হয়তো ওকে একাই বের হতে দিলেন। দু'টা সিএনজি ওর পাশ দিয়ে ধীরে বের হয়ে গেলো। ডাকি ডাকি করেও ডাকলো না লাভলী। কিছুক্ষণ হাঁটা যাক। কেউ দেখে ফেললে অবশ্য বাসায় রিপোর্ট হয়ে যাবে। কাজের ছেলেটা পিচ্চি কিন্তু শয়তানের একশেষ। আম্মাকে সারাক্ষণই ওদের দুই বোনের নামে ভাঙানি দিচ্ছে। 'একদিন সুযোগ মতো এমন ধাতানী দিবো যে জন্মের মতো সোজা হয়ে যাবে, শয়তানের শয়তান।' লাভলী এইসব যখন ভাবছে তখন একটা সিএনজি ওর পাশে এসে দাঁড়ালো।

— আপা, গাউছিয়া যাইবেন উঠেন।

সাট করে পিছনে ফিরলো লাভলী। যা ভেবেছিলো তাই। পিচ্চি শয়তানটা বেশ খানিকটা দূরে দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে আছে। আম্মা ঠিকই পিছনে লাগিয়ে দিয়েছেন। সেই মুহূর্তে লাভলীর মরে যেতে ইচ্ছা করলো। পিছন ঘুরে পিচ্চিকে চড় দেখিয়ে সিএনজি-তে উঠে পড়লো লাভলী। এখন বাজে দশটা, দুপুরের খাবারের আগে ফিরতে হবে। লাভলী বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করে। এই প্রথম আম্মা তাকে কোনো নির্দিষ্ট সময় বলেন নাই। শুধু বলেছেন, দুপুরের খাবারের আগে ফিরতে। তার মানে ২টা পর্যন্ত সময় এখন শুধুই তার। মনে মনে দোয়া করছে জামে যাতে না পড়ে। সিএনজিটাও চলছে বেশ জোরে, মানে যতোটুকু তার সাধ্যে কুলায়।

কী আশ্চর্য, দশটা পঁয়তাল্লিশের মধ্যে লাভলী গাওছিয়ায় পৌঁছে গেলো।

সিএনজি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে কিছুক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। এখন কী করবে, কোন দিকে যাবে বুঝে কুলাতে পারলো না। চাঁদনী চকের ভিতর ঢুকতে পারে আবার গাওছিয়ার দিকেও হাঁটা দিতে পারে। হঠাৎ করেই কেমন নিঃসঙ্গ লাগলো লাভলীর। এই সুযোগে মাথার ভিতরের লোকটা কথা বলে উঠলো। কেমন ভাঙা ভাঙা মিনতিমাখা গলা। আপুমনি, আপনি এমন কেন বলেন তো? চলেন না, ঝটপট যেকোনো একটা কাপড় কিনে বুড়িগঙ্গায় হাওয়া খেয়ে আসি। শুধু আমি আর আপনে।

না, এই মুহূর্তে লোকটাকে পাত্তা দিতে রাজি না লাভলী। আজকে শখ মিটিয়ে শপিং করবে সে। তারপর পছন্দমতো একটা কোথাও দাঁড়িয়ে লাচ্ছি চটপটি খাবে, বা খাবে না।

ধীরে এক পা দু'পা করে চাঁদনী চকের দিকে পা বাড়ালো। মোটে পোণে এগারোটা বলে কঠিন মেয়েমানুষ থ্যাঁতলানো ভিড় এখনও শুরু হয় নাই। চিন্তার কিছু নাই, আর ঘণ্টাখানেক পরেই শুরু হয়ে যাবে। তবে এখনও যা আছে সেও কম না। আজ ও সম্পূর্ণ একা কোথাও এলো। শেষবার একা কবে গিয়েছিলো মনে পড়লো না লাভলীর। সত্যিই কি কখনও কোথাও গিয়েছিলো একা? হাল ছেড়ে দেয় লাভলী। নিজের বোকামিতে বিরক্ত হয়। জীবনের সবচাইতে কাঙ্ক্ষিত সময় এভাবে ফালতু চিন্তা করে কাটিয়ে দিবে নাকি! ধ্যাৎ।

যেকোনো একটা কাপড়ের দোকানে ঢুকে পড়ে। মুশকিল হচ্ছে সব কাপড়ই ওর পছন্দ হচ্ছে। অবশ্য যে কাপড়ই বানাক না কেন ওকে মানাবে না। ওর মধ্যে কেমন একটা খালাম্মা খালাম্মা ভাব চলে এসেছে। কী মনে করে যে ও দু'টা বেণী করে চাঁদনী চকে এসে হাজির হলো কে জানে। দেখতে নিশ্চয় সঙ-এর মতো লাগছে। অনেকেই তার পাশ দিয়ে হুটহাট চলে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু একটু দূরে গিয়েই আবার মাথা ঘুরিয়ে ওকে আপাদমস্তক দেখে নিচ্ছে। দু'টা অপরিপাটি লম্বা বেণী, কামিজের ঝুল হাঁটু ছাড়িয়ে আরও এক বিঘৎ নেমে গেছে, ভ্রুজোড়া যেমন কে তেমন, চোখে বিহ্বল হারিয়ে যাওয়া দৃষ্টি, মুখের লাবণ্যটুকু বিদায় হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এমন জিনিস ঢাকা শহরের বাজারে সচরাচর দেখা যায় না। একটা কাপড় নিয়ে কতোক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে দোকানদারও পাত্তা দিচ্ছে না। হঠাৎ করে চোখ ভিজে উঠলো লাভলীর।

— এই যে ভাই কাপড়টার গজ কতো? ভাই… একটু শুনেন ভাই…।

— বলেন, কোনটার গজ কমু? আপনের দুই হাতে দুইটা কাপড়।

— লালটার।

— ১২০ টেকা।

— আচ্ছা আড়াই গজ দেন আর এইটার সাথে মিলায়ে শেলওয়ার আর ওড়না দেন।

— শেলওয়ারের কাপড় দিতে পারমু কিন্তু ওড়না আপনেরে অন্য দুকান থিকা কিনতে হবে। সেট ছাড়া আমরা ওড়না বেচি না। শেলওয়ারের কাপড় কতো গজ?

— আড়াই।

দোকানদার তার কাপড় কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। চাঁদনী চকে কাপড় কিনছে কিন্তু দামাদামিতে নাই এ আবার কেমন ধরনের কাস্টমার। কাপড় কাটতে কাটতেই বেশ ভালো করে মেপে নিলো সে। দেইখা তো লাগে বেকুব কিসিমের।

— ধরেন, গজ প্রতি ১১০ টাকা দিয়েন, দেমাদেমি করলেন না সেই কারণে কমায় দিলাম।

টাকা দিয়ে বেরিয়ে এলো লাভলী। লাল রঙটা ওর পছন্দের রঙ না, তাও কেন যে কিনলো। অবশ্য বিউটির ভীষণ পছন্দ লাল। সব চড়া রঙই তার পছন্দ যদিও। এপাশ-ওপাশের দুই একটা দোকানে ঢুকেই আবার বেরিয়ে এলো লাভলী। ওড়না কিনতে আর ইচ্ছা করছে না ওর। পরে একদিন আম্মাকে নিয়ে আসা যাবে। আম্মা বরং খুশিই হবেন। ফরিদা খানম সারাক্ষণই প্রমাণ করতে ব্যস্ত থাকেন যে ওরা দুই বোন তাকে ছাড়া অচল। কতোটা যে অচল সেটা ওড়না কিনতে না পারার মধ্যে আরও প্রমাণিত হবে। তবে ধরেই নেয়া যায় তার কাপড়টা পছন্দ হবে না। ফরিদার অনুপস্থিতিতে ওরা দুই বোন যাই করুক না কেন সেটা ঠিকঠাক মতো হয়েছে এটা কখনোই তাকে বিশ্বাস করানো যায় না।

ধা করে লাভলী প্রায় ২৬ বছর পিছনে চলে গেলো। মাথার ভিতরের লোকটা পড়িমরি করে বলে উঠলো, এতো তাড়াতাড়ি যাবেন না আপুমনি, প্লিজ, আমার ভীষণ মাথা ঘোরে।

যদিও লাভলী বিউটির চেয়ে প্রায় তিন বছরের বড় তবুও ওরা একই ক্লাসে পড়ত। তখন লাভলীর বয়স ১৪। দুই মেয়েকে ফরিদা বেগম স্বামী মুখলেস সাহেবের জিম্মায় রেখে বাইরে বেরিয়েছেন। প্রথমে যাবেন খিলগাঁ চৌধুরী পাড়া, বড়বোন রাহেলার বাসায়। রাহেলার মেঝো মেয়ে রুমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। মেয়ে দু'টাকে বাসায় রেখে যাচ্ছেন বলে বোনের বাসায় বেশিক্ষণ বসার ইচ্ছা নাই ফরিদার। তবে ফেরার পথে টুকটাক কাঁচা বাজার না করলেই না। ঘরে সব্জি বলতে কিছুই নাই। দু'টা বেগুন দেখে এসেছেন শুধু। মুখলেস সাহেবের শরীরটা খারাপ হওয়ায় ২/৩ দিন যাবত বাজারে যাওয়া হয় নাই। ফেরার পথে সব্জি অন্তত কিনতেই হবে আর আটা। সকাল বেলা টেনেটুনে দশ-বারোটা রুটি হয়েছে। তবুও স্কুটারে যাওয়ার পুরো পথটা কপাল কুঁচকে রাখলেন ফরিদা। ভিতরটা খচখচ করছে। না, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফেরা দরকার।

মুখলেস সাহেব জ্বরে কাতর; দুই বোনকে কোনো রকম শব্দ করতে কঠিন নিষেধ করে গেলেন ফরিদা। কান পর্যন্ত কাঁথা মুড়ি দিয়ে মুখলেস সাহেব শুয়ে ছিলেন। মাথার যন্ত্রণায় দিশাহারা অবস্থা। বাসায় ওরা ছাড়া বুয়া আর একটা ছোট কাজের মেয়ে। মেয়েটার নাম সুলতানা। সুলতানাও ওদের দু'বোনের প্রায় সমবয়সী। ফরিদা খানম বাসায় থাকলে সুলতানার সাধ্যি নাই দুই বোনের ধারে কাছে ঘেঁষে। এই ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত কড়া। চাকর বাকর থাকবে চাকর বাকরের মতো। ওদের সাথে আবার আলগা খাতির কীসের!

বাবাকে কচি মুরগির স্যুপ দিয়ে এসে লাভলী বিউটির সাথে সাপ লুডু খেলতে বসলো। এই খেলায় ও বিউটির কাছে অবধারিতভাবে হারে। এমনি লুডুতে যাও বা জেতার ইতিহাস আছে কিন্তু সাপলুডু খেলতে বসলেই সাপের কামড়ে লাভলীর দফারফা। বিউটি অবশ্য সব সময় খেলার জন্য মুখিয়ে থাকে। সাপলুডুর বোর্ড দেখেই খুশিতে বিউটির চোখ দু'টা গোল গোল হয়ে গেলো।

— আফা ছাদে যাইবেন?

— চুপ কর। সাপলুডু খেলবি? — আয় বস।

— না, খেলুম না, কিন্তুক ছাদে যামু।

— ছাদে যাবি মানে, কীভাবে যাবি? ছাদ তো তালা দেওয়া।

— না, ছাদ খোলা আছে। রাষ্ট্রীয় গোপন খবর ফাঁস করবার ভঙ্গিতে সুলতানা বললো।

— বুয়া আম্মাকে বলে দিবে।

— বুয়ায় ঘুম পাড়ে। এতো সকালে উঠবো না।

— বিউটি খবরদার যাবি না। আম্মার মানা আছে না।

— আম্মা তো আর দেখতেছে না। আমি যাব, তুমি না যেতে চাইলে যাইও না।

— গেলে ওখনই আসেন। একটুক্ষণ ঘুইরাই চইলা আসুম। কাক-পক্ষীও টের পাইবো না।

সুলতানার গম্ভীর মুখ দেখে লাভলী সাহস পেলো।

— দাঁড়া, আব্বাকে একটু দেখে আসি।

— আব্বাকে দেখার কী আছে, আব্বা হইলো দুধভাত।

বিউটিক পাত্তা না দিয়ে লাভলী পা টিপে টিপে মুখলেস সাহেবের ঘরে উঁকি দিলো। তিনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, হালকা নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। তারপর ওরা তিনজন রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো বুয়া পাটি পেতে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। লাভলীর বুকের ভিতরটা হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে। তিনজন হাত ধরাধরি করে পায়ে পায়ে সামনের দরজার সামনে গেলো। নিঃশ্বাস বন্ধ করে দরজা খুললো বিউটি। তেলহীন মর্চে পড়া দরজা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে খুলে গেলো। দুপুরের নিস্তব্ধতায় এইটুকু শব্দই ঠাটা পড়া গাছের মতো তিনজনকে স্থবির করে দিলো। প্রথম স্বাভাবিক হয়ে উঠলো বিউটি।

— দরজার সামনে দাঁড়ায় থাকবো নাকি? আসো…।

ঢাকনা দেয়া ফুটন্ত পানির মতো সারা শরীরে হাসির দমক নিয়ে ওরা ছাদে উঠে গেলো, শব্দহীন। ভিড়ানো দরজা খুলে ছাদে পা দিয়েই তুমুল হাসিতে ফেটে পড়লো তিনজন। কার্নিশে বসে থাকা কাক উড়ে গেলো। ছাদে পা দেয়ার মুহূর্তটা কখনও ভুলবে না লাভলী — কী উত্তেজনা, কী উত্তেজনা, কী উত্তেজনা।

ওরা কতোক্ষণ ছাদে ছিলো এখন আর তা মনে পড়ে না লাভলীর। শুধু দুঃস্বপ্নের মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা আম্মার মুখটা মনে পড়ে ওর। দুই বোনকে কিছুই বললেন না ফরিদা খানম। শুধু পত্রপাঠ বিদায় হয়ে গেলো সুলতানা আর বুয়া। স্বামীর সাথেও তিনি কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না। যেন তিনি জানতেন তার অনুপস্থিতিতে এরকমই হবার কথা। শেষ পর্যন্ত বোনের বাসায় না যাওয়ার সীদ্ধান্তটা কতো বেশি জরুরী ছিলো তা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন তিনি।

শুরু হলো দুই বোনের কবরের আজাব। বাসা আবার বদল হলো। এবার অবশ্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। ফরিদা খানম পল্লবীতে তার বাবার দেয়া পৈতৃক জমি বিক্রি করে মনিপুরি পাড়ার ভিতর দিকে ছোট একটা দোতলা বাড়ি বানালেন। এই বাড়ি বানাবার সমস্ত দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নেন। বাড়ি পুরোপুরি তৈরি হওয়ার আগেই সেই বাড়িতে উঠে গেলেন। এরপর থেকে ফরিদা খানম আর কখনই কোনো অল্প বয়সী কাজের মেয়ে রাখেন নাই। তার পরিবর্তে ৮ থেকে দশ বছর বয়সী কাজের ছেলে রাখা শুরু হলো। আট বছর বয়সে চাকরি শুরু আর তেরো-য় পা দিলেই বিদায়।

খয়েরি কাগজের মোড়ক থেকে লাল কাপড়টা একটু বের করে দেখে নিলো লাভলী। না, কাপড়টা বেশ সুন্দর, এটা পছন্দ না হওয়ার কোনো কারণ নাই। অবশ্য একটু বেশি লাল। শেলওয়ারের কাপড়টাও লাল কেনা উচিৎ হয় নাই। লালে লাল দুনিয়া হয়ে গেছে।

(– আম্মাগো লাল তেরি লাল কেয়া খুনিয়া!) মাথার ভিতরের লোকটা হঠাৎ বলে উঠলো। বলেই চুপ। কিন্তু ভীষণ চমকে গেলো লাভলী।

এই জীবনে বাসা ওরা কম বদল করে নাই। মনিপুরি পাড়ায় বাড়ি হওয়ার আগে অন্তত ছয়বার। ওরা যখন বেশ ছোট তখন থেকেই দুই বোন জানে যে স্কুল চলাকালীন সময়টা ফরিদা খানম স্কুল-গেইটের বাইরে অপেক্ষা করেন। খুব ছোট থাকতে অসুবিধা হতো না, কিন্তু ওরা যখন ক্লাস থ্রিতে উঠলো তখন স্কুলের বড় আপা আর সেটা বরদাস্ত করলেন না। একদিন ফরিদা খানমকে ডেকে পাঠালেন।

— আসসালামালাইকুম।

— ওয়ালাইকুমআসসালাম।

— আপনি তো লাভলী আর বিউটির মা।

— হ্যাঁ।

— দারোয়ানের কাছে শুনলাম আপনি নাকি রোজ স্কুল শুরু হয়ে যাবার পরেও গেইটের বাইরে দাঁড়ায় থাকেন।

— হ্যাঁ থাকি।

— কেন থাকেন?

— আমার মেয়েরা স্কুলের ভিতরে আর আমি বাসায় চলে যাব?

— পুরা সময়টা কি আর কোন মা বাইরে দাঁড়ায় থাকে?

— আপনাদের তো আমি কোনো অসুবিধা করতেছি না। গেইটের বাইরে দাঁড়ায় থাকি। আমার মেয়েরা ভিতরে, কখন কী লাগে না লাগে।

— আপনি দয়া করে নামিয়ে দিয়ে যাবেন আবার ছুটির সময় এসে তুলে নিয়ে যাবেন, বাকি সময়টা বাইরে অপেক্ষা করার দরকার নাই। যদি কিছু লাগে তার ব্যবস্থা আমরা করব।

— আমার মেয়েরা খুব মুখচোরা, কিছু লাগলেও তারা আপনারে বলবে না।

— না বললেও ক্ষতি নাই। ৩/৪ ঘণ্টা পরে তো আপনাকে বলতেই পারবে। ঠিক আছে, আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন না।

এরপর প্রায় এক বছর ওদের আর কোনো স্কুলে যাওয়া হয় নাই। ফরিদা স্বামীকে বুঝিয়ে বাসা বদল করলেন। সাজাহানপুর বালিকা বিদ্যালয়ের ঠিক উল্টা দিকে ওরা বাসা নিলো। ফ্ল্যাট বাড়ির তিনতালায় ওরা উঠে গেলো। শুরু হলো ফরিদার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা। স্কুল চলাকালীন সময়ের পুরোটা তিনি সামনের বারান্দায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতেন। তারপর ছুটির ঘণ্টার চাপা আওয়াজ কানে আসলে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে নেমে যেতেন। তার চাইতেও ধীরে রাস্তা পার হতেন। মেয়েদু'টা স্কুল থেকে বের হয়ে ভীরু ভীরু চোখে মায়ের দিকে তাকালে উনি হেসে ওদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেন। মেয়েরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতো। ডেইলি একই ঘটনা। প্রতিদিন একই রুটিন। প্রকৃতির নিয়মের মতো অমোঘ!

পায়ে একটা ছোট নুড়ি পাথর ঠেকে প্রায় পড়বার উপক্রম হয়েছিলো লাভলীর। চাঁদনী চক থেকে বের হয়ে নিজের অজান্তেই সিনেমা হলের ঠিক সামনে এসে পড়েছে। বিশাল বড় হোর্ডিং-এ ততোধিক বিশাল নায়িকার উদ্ধত শরীর প্রায় বেরিয়ে আসতে চাইছে।

আশেপাশের মেয়েগুলোকে এবার একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলো লাভলী। আজকাল পথে বের হলেই মনে হয় এতোগুলি সুন্দর মেয়ে এক শহরে বাস করে! সবাই খুব রূপটান টুপটান মাখে বোধহয়। বিউটি পারলারে যাবারও খুব চল হয়েছে। আজকে একবার যাবে নাকি কিংবা সিনেমা হলেও চট করে ঢুকে পড়া যায়! অবশ্য আম্মা জানতে পারলে জানে মেরে ফেলবেন। কেমন করে জানি মহিলা আবার সবকিছু টের পেয়ে যান। ওর মতোই আরেকটা মেয়ে একটু দূরে একা দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য নিজেকে আর মেয়ে বলার সাহস নাই। হাজার হোক বয়স আজকে চল্লিশ হলো। কী অদ্ভুত! চল্লিশটা বছর চলে গেছে অথচ কিছুই হলো না, বিয়েটা পর্যন্ত না। হঠাৎ করেই মেয়েটার সঙ্গে চোখাচোখি হলো ওর। মেয়েটা মিষ্টি করে হাসলো। সাথে সাথে পিছন ফিরে তাকালো লাভলী তারপর বুঝলো আসলে মেয়েটা ওকে দেখেই হেসেছে। ও-ও হাসিমুখ নিয়ে মেয়েটার দিকে ফিরলো, ততোক্ষণে মেয়েটা চোখ সরিয়ে নিয়েছে। লাভলী ঠিক করলো মেয়েটাকে অনুসরণ করবে। মেয়েটা যদি একা সিনেমা হলে ঢুকে যায় তাহলে ও-ও টুপ করে ঢুকে যাবে, মেয়েটার পাশে বসবে আর দু'জনে মজা করে সিনেমা দেখবে। টুকটাক গল্পও করবে। বাসায় ফিরে রসিয়ে রসিয়ে নতুন বন্ধুর গল্প বলবে বিউটিকে।

কখন যে মেয়েটার পাশে এক সরু গোঁফওয়ালা কলেজ ছোকরা এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি লাভলী। কায়দা আছে ছেলের। বাহারি একখান ফতুয়া পড়েছে, কমলা রঙের। তাতে হলুদে কী জানি সব লেখা। আজকালকার ছেলেরা গায়ে বেশ রঙ চড়াতে পারে। লাভলী ওর আব্বাকে কখনও নীলের নানান শেড আর সাদা ছাড়া অন্য কোনো রঙে দেখে নাই। লাভলীর চাচাতো ভাই রিয়াজ অবশ্য মেরুন শার্ট খুব পড়তো। সেও কতো বছর আগের কথা। এখন জার্মানিতে থাকে, দুটা ফুটফুটা বাচ্চা, বিদেশি বউ।

নিজের অজান্তেই একটু অস্বস্তি লাগলো লাভলীর। ছেলে মেয়ে দু'টা মাথা নিচু করে কথা বলছে, মনে হয় ওকে নিয়েই। ছেলেটা চকিতে একবার লাভলীকে দেখে নিলো। মেয়েটার ঠোঁট খুব নড়ছে। কে জানে কী বলছে ছেলেটাকে। ছেলেটা অদ্ভুতভাবে একটা ভ্রু নাচালো আর বিশ্রীভাবে জিভ বের করলো। হাসলো বোধহয়। পায়ে পায়ে লাভলী সিনেমা হলের সামনে থেকে সরে পড়তে চাইলো। বাপ বেটির যুদ্ধ না দেখলেও চলবে। এই এক জীবনে 'মা মেয়ের যুদ্ধ' তো আর কম দেখছে না। অবশ্য লাভলী কখনও মায়ের অবাধ্য হয়েছে তা কেউ ভুলেও বলতে পারবে না। তবে মনের কথা যদি ধরা হয় ঘটনা হবে ভিন্ন। হঠাৎই দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো ও। টালমাটাল পায়ে অনেকটা হেঁটে এসে ওভারব্রিজ পার হয়ে তবে থামলো। ভিতরটা কেমন শুকিয়ে এসেছে। ইশ ডাবের পানি পাওয়া গেলে ভালো হতো। রাস্তার পাশে কায়দা করে দাঁড়িয়ে স্ট্র-তে চুমুক দিতে পারতো। ডাবের খোঁজে এদিক ওদিক তাকায় লাভলী।

ফুটপাতে পাওয়া যাচ্ছে না এমন কোনো জিনিস নাই। আর মানুষের মাথা মানুষ খায় এমন অবস্থা। এরই মধ্যে মাথার ভিতরের লোকটা ঘুম থেকে জেগে ওঠা গলায় বললো, "আপুমনি, বারোটা কিন্তু প্রায় বাজে, চলেন না কোথাও যাই, একটু হাওয়া খাই। আচ্ছা না হয় চলেন নিউ মার্কেটের ভিতরে ঢুকি। একটা বুদ্ধি আসছে মাথায়।"

লোকটার খিকখিক হাসি লাভলী ওর সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়তে শুনলো। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে হাঁটা দিলো নিউ মার্কেটের যেকোনো একটা গেটের দিকে। কেন যেন মনে হচ্ছে বিশেষ কোনো কাজে সে নিউ মার্কেটে যাচ্ছে। লোকটার চাপা উত্তেজনা ওর ভিতরেও সংক্রমিত হতে শুরু করেছে। অজান্তেই চলার গতি দ্রুত হতে থাকে। সামনের বলপ্রিন্ট শাড়ি পরা মহিলার স্যান্ডেল মাড়িয়ে দেয়, হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে মহিলা নিজেকে সামলায়। এক ঝটকায় পিছনে ফিরে তাকিয়ে দাঁত-মুখ খিচিয়ে কী একটা বলে, তার কিছুই ও শুনতে পায় না। লোকটা এখন মাথার ভিতরে আঙুলের টোকা দিচ্ছে: ঠক ঠক ঠক ঠক। টোকার লয় যত দ্রুত হচ্ছে ওর হাঁটার গতিও ততো বাড়ছে।

নিউমার্কেটের গেইট দিয়ে ঢুকে ব্লাউজের দোকান পার হলো লাভলী, স্ন্যাকস আর আবোল-তাবোল খাবারের দোকান পার হলো, তারপর শাড়ির, তারপর গয়নার, তারপর আরও ভিতরে ঢুকলো। নিউমার্কেটের শেষ মাথায় ক্রকারিজের দোকানগুলোর কাছে এসে দম ফেললো। আর মগজের ভিতরের ঠক ঠক শব্দও বন্ধ হয়ে গেলো। যেন কেউ লাভলীকে তাড়া করছিলো একটা দুঃসাহসিক অভিযান শেষ করবার জন্য আর লাভলী তা জীবন বাজি রেখে শেষ করেছে।

খুব অবসন্ন লাগলো লাভলীর আবার একই সাথে আরাম বোধ হলো। আরাম নাকি স্বস্তি বুঝতে পারলো না। আলো ঝলমল দোকানগুলোর সামনে দিয়ে কবুতরের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগলো।

— ভাবি, আসেন ভিতরে আসেন। কী লাগবে?

— না, কিছু না। দেখি…।

লোকটা ওকে ভাবি বলেছে, লাভলীর ভিতরটা খুশিতে ভরে গেলো। খুব ইচ্ছা করতে লাগলো দোকানটা থেকে কিছু একটা কেনে।

(– কিছু লাগবে না মানেটা কী? এই চান্স আপনে পাবেন আর? প্লিজ আপুমনি, ভিতরে ঢুকেন।)

— ছুরি আছে, ছুরি। পাউরুটি কাটার, না না সব্জি কাটার?

— হ্যাঁ, আছে। বিভিন্ন সাইজের আছে, কোনটা চান? দাঁড়ান ভাবি, আপনেরে বিদেশি একটা ছুরির ছেট দেখাই।

— না, না সেট লাগবে না। মোটামুটি একটা ধারওয়ালা ছুরি দেন। মাঝে সাঝে রান্নাঘরে তো ঢুকতেই হয়, আর উনি এইসব দুই চোখে দেখতে পারেন না, আমার স্বামীর কথা বলতেছি, — মানে মেঝের উপর বসে কাজের মানুষের মতো সব্জি টব্জি কাটি যে সেইটা। আচ্ছা, এমন একটা ছুরি দেন তো যেটাতে মাংসও কাটে ভালো।

বলতে বলতে লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো লাভলী। সে স্পষ্ট দেখতে পেলো ওর স্বামী ওর উপর খুবই বিরক্ত।

— এইসব কী, মাটির উপর চেগায়া বইসা বাড়ির চাকরানির মতো কাটাকাটি করতেছ?

— কই কাটবো?

— কেন টেলিভিশনে দেখো না, ছুরি দিয়া কী সুন্দর শাকসব্জি কাটে। মাছও কাটা যায়।

— মাছও কাটা যায়? হ্যাঁ বলছে তোমারে!

— ছুরি দিয়া প্রথমে পিঁয়াজ টিয়াজ কাটো তারপর দেখবা অভ্যাস হয়ে গেছে।

(– উঠেন আপুমনি, উঠেন, জাগেন — দোকানদার আপনেরে তখন থেকে দেখাবার জন্য মরে যাচ্ছে।)

বিশ্রী ভঙ্গিতে হাসলো লোকটা। গাল টাল লাল হয়ে উঠলো লাভলীর, এইসব কী!

— ভাবি, এই ছুরিটা দেখেন, খুব ফাইন, ফরেন মাল। ধার দেখেন, মাংস কাইটা আরাম পাবেন।

— হ্যাঁ, এইটাই, এইটাই দেন।

গলাটা একটু কেঁপে উঠলো লাভলীর। চকিতে আশপাশটা দেখে নিলো। না, দোকানে এই মুহূর্তে আর কোনো কাস্টমার নাই। দোকানদার বেটা দাম নিলো একটু বেশিই। কিন্তু লাভলীর কোনো আফসোস হলো না, ছুরিটা আসলেই ভালো, ফরেন মাল।

প্লাস্টিকের কভারে আবার ঢুকে গেলো স্টেনলেস স্টিল ছুরি। দোকানদারের হাত থেকে ছুরিটা নেয়ার সময় হাতে হাত ঠেকে গেলো। ভালো লাগলো লাভলীর, খুব ভালো লাগলো। আবারও কান মাথা গরম হয়ে গেলো, এইসব কী হচ্ছে!

(– লাগ ভেলকি লাগ, চোখে-মুখে লাগ!)

— চুপ একদম চুপ।

জীবনে প্রথম মাথার ভিতরের লোকটাকে ধমক দিলো। ধমক তুচ্ছ করে খিক খিক করে হেসে উঠলো লোকটা। লাভলী ছুরিটা খুব সাবধানে ঝোলার ভিতরে রাখলো।

রচনাকাল: ২০০৮, লন্ডন

অলঙ্করণ: রনি আহম্মেদ

বন্ধুদের কাছে লেখাটি ইমেইল করতে নিচের tell a friend বাটন ক্লিক করুন: