নিত্য পুরাণ‘সংরক্ষিত আসন’

আকিমুন রহমান
Published : 19 May 2010, 10:16 AM
Updated : 19 May 2010, 10:16 AM

ভাইসব, আপনারা জানেন, সংসদে নারীদের জন্য 'সংরক্ষিত আসন'-এর সুবন্দোবস্ত আছে। সংসদ অধিবেশন বসে দফায় দফায়। পত্রিকায় পত্রিকায় সাংসদদের তপ্তকথা, নানা কেচাল, বিতন্ডা ও ঐকমত্যের সংবাদ বেরোয়। তবে তারা সবাই প্রায় পুরুষ সাংসদ। চিল্লাহল্লা, মত ও অমত প্রকাশ, বিরোধিতা ও সমর্থন নিয়ে নড়াচড়া করতে দেখা যায় শুধু তাদেরই। নারী সাংসদ (সংরক্ষিত আসনপ্রাপ্তাগণ) কী যে করেন, কী যে ভাবেন, সচল থাকেন, নাকি কেবলই আসনে আসীন থাকেন – জনগণ তার কিছুই জানে না। তবে ভাবে ও আভাসে বোঝে যে, তাঁরা সংসদ ছায়ায় ভালোই আছেন। পরিতোষে আছেন। গৌরবেও আছেন অতি চমৎকার সুবিধাময় পরিস্থিতিতে। সংসদে 'সংরক্ষিত আসন' সংখ্যা বৃদ্ধির সংবাদে জনগণ আরো বুঝতে পারে যে, আমাদের এক গোত্রের আরো নারী-ভাগ্য খুলে যাচ্ছে। বুঝতে পারে যে, বিষয়টা দারুন। মানে হচ্ছে আরো অনেকজনের ভাগ্যে শীত ও আতপের মধুস্পর্শ জুটতে যাচ্ছে। জয় হোক অই মহানুবভগণের- যাঁরা নারীকে বিনা আয়াসে ও বিনা বিঘ্নে একেবারে তুলোয়মোড়া দশায় রেখেই দিয়ে দিচ্ছেন শীতাতপ গৌরবের দুনিয়ার আরাম ও সুবিধা। নড়াচড়া খাটা খাটনির কষ্ট অনেক। অতো কষ্ট এই মহিলা মানুষরা কতোটা করতে পারে। অবলারা তো অবলা, নাকি ! সংরক্ষিত আরামবাসিনীগণ একদমও না নড়ে, মুখটিও না খুলে, আরামে অচল থাকুন। আমরা জেনেই সুখী।

আমাদের আরো সুখী করার জন্য এই অল্প কদিন আগে এলো আরেক 'সংরক্ষিত আসন' ব্যবস্থার সংবাদ এবং তোড়ে জোরে সেই ব্যবস্থা চালুও হয়ে গেলো ধুন্দামার। কি সেটা ? বাসে বাসে তা সে বাস লোকাল মুড়ির টিনই হোক, কিংবা কাউন্টার বাসই হোক সবগুলোতে নয়, নয়টি সীট সংরক্ষিত থাকবে নারীযাত্রীর জন্য। সেই খানেই শুধু নারীযাত্রী বসবে ও যাবে। বাহবা! দিকে দিকে দেখো সংরক্ষিত আসন ব্যবস্থার ফেলিতেছে পদচিহ্ন ! এটা আর সুউচ্চ, সুমহান কোনো কক্ষে আসন সংরক্ষণের ব্যাপার নয় এখন, একেবারে রোদ ধগধগে ঝক্কর পক্কর চতুর্চক্র যানে  (পাবলিক) যানে ছড়িয়ে পড়া বিষয় এক। নারী কল্যাণের মহতী উদ্যোগ। এই সমাজ নড়াচড়ারতাদের কথাও যে ভাবে এই তার নিদর্শন। একটা গোটা বাসের নয় নয়টা সীট মহিলাদের জন্য ! কম কথা নয়! অতি উত্তম বন্দোবস্ত। আগে কি ছিলো ? আগে, এই নয় সীট সংরক্ষিত আসন ব্যবস্থা চালু হবার আগে মহিলারা বসতো কোথায় ? সীট তখনও বরাদ্দ ছিলো কি ? মহিলা সীট (সংরক্ষিত) ছিলো কি ?

ছিলো। চারটি। তাঁদের জন্য তখন বরাদ্দ ছিলো চালকের আসনের পাশের লম্বা টানা জায়গাটা। সেখানে ঠিকঠাকমতো বসতে পারে চারজন, কিন্তু চেপে ঠেসে সেখানে বসতে বাধ্য করা হতো ছয়জন নারীকে। গুঁড়াগাঁড়া থাকলে, তাদেরও চেপেচুপে গুঁজে দেয়ার বিধি ছিলো ওরই মধ্যে। পেছনে বাসভরা কতো সীট। তবে তার সবগুলোই পুরুষের জন্য। সামনের বিঞ্চি ঠাসা হয়ে গেলে নারীরা পেছনে বসার উদ্যোগ নিতো। সঙ্গে পুরুষ থাকলে নির্বিঘ্নেই উপায় একটা হয়েই যেতো। একা হলে সীট পেলে বসা, নয় হাতল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা যতোক্ষণ না কোনো একটা সীট খালি হয়, ততোক্ষণ শক্ত হাতে হাতল ধরে ভারসাম্য ঠিক রেখে দাঁড়িয়ে থাকা- এইই চলতো। আর অন্তরে অন্তরে তাঁকে ডাকা তো যাত্রারই এক অংশ। মনে মনে জপা, আল্লা আল্লা। সীট একটা খালি করে দাও একটা সীট। কদাচিৎ দু'একজন মায়াবান ও দয়াবান পুরুষ যাত্রীর আত্মত্যাগ ও মহানুভবতাও ধেয়ে আসতো দন্ডায়মানা, বিপন্নার দিকে। আপনি বসেন -এই যে বসেন- বসেন – পুরুষ যাত্রীটি নিজের সীট ছেড়ে দিয়ে নিজেকে করুণাময় প্রতিপন্ন করতো। সত্যিই তারা দারুণ। সেইসব নারীকষ্ট-কাতর করুণাময়দের কল্যাণ হোক। এইসব নিয়ে নগরীর ধুলো-মৃত্তিকা-লগ্ন বাসযাত্রী নারীদের দিনরাত যাচ্ছিলো। এমন সময়ে অই সংরক্ষিত আসনের বিধিবিধান জারি হওয়া ও তা চালু করার বন্দোবস্ত শুরু হওয়া।

বিধি হলো যে, বাসে ওঠার পরে হাতের ডানদিকের প্রথম তিনটি সীট (যদি তিন আসনের হয় তবেই তিনটি। দু আসনের হলে  প্রথম তিনটি ও ড্রাইভারের পাশের টানা বেঞ্চিটি) হচ্ছে মহিলা সীট। ওতেই মহিলারা বসবে এবং যাবে। আরো বিধি হলো যে, মহিলা যাত্রী না থাকলে ফাঁকা যাবে সীটগুলো। তারপরে নতুন বিধি এলো। সেই বিধিমোতাবেক মহিলাসীটে মহিলা না থাকলে ওগুলো ফাঁকা যাবে না, পুরুষ যাত্রী বসবে। কিন্তু মহিলা উঠলেই ছেড়ে দেবে। সীটের ওপরে, জানালার মাথায় মাথায় লাল রঙে লেখা হয়ে গেলো কথা- 'মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধী সীট।' সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন, এখন নারী যাত্রীরা স্বর্গসুখ ভোগ করতে করতে খালি যাবে আর আসবে। খেলা কথা নয় কিন্তু ; নয় নয়খানা আসন! বিশাল ব্যাপার! সরকারের বিপুল দয়া ও নারী হিতব্রততার স্বাক্ষরবাহী ঐতিহাসিক ঘটনা একখান! আমি নিত্য বাসযাত্রী। আমি ও আমার মতো আরো কতো কতোজন বিপুল কৃতজ্ঞতাবোধে একেবারে জলটলমল হয়ে সারা! থ্যাংকু – থ্যাংকু গো সরকার। আবার গৌরবও লাগলো। চিত্তে। আমাদেরই উত্তমা ভগিনীগণ শীতাতপ মোড়ানো সংরক্ষিত আসনে  যেমন, আমরাও তেমনি রৌদ্রবাসিনীগণ-রক্ষিত আসনে। নয়ে আর নব্বুইয়ে কী এমন ফারাক।

তবে মহিলাদের তো চির ফাটা কপাল -সমাজ সংসার এই কথা ঐতিহাসিক কাল থেকে জানে। ওই সংরক্ষিত আসনের সুখ ও সৌভাগ্য এই ঠাটা কপালীদের সইবে কী করে। ওই বন্দোবস্ত চালু হবার পর থেকে যা যা অপরুপ বৃত্তান্ত ঘটা শুরু হয়েছে তা আমি একমুখে বলে শেষ করে উঠতে পারবো না ভাইসব ও মেঘলোকবাসী মিনার আমীনা ভাগিনীগণ ! হয়েছে কী, সংরক্ষিত আসনপ্রথা চালুর আগে না একটা ব্যাপার ছিলো। আগে আসিলে আগে পাইবেন ভিত্তিতে কেউ যদি অবশ্যই  নারী আগে এসে পুরুষের সবগুলা সীটের যে কোনোটিতে বসে পড়তো, তো সে তাতেই বসে যাবার সুযোগটা পেতো। তখন অন্তত মহিলা সীটের বাইরের যে কোনো সীটে বসার অধিকারটা ছিলো নারীর। এখন পরিস্থিতি জবর রকম। ওই নয় সীটের  বাইরে যে কোনো সীটে নারী এখন বসার কোনো অধিকার রাখে না। পুরুষ যাত্রীরা সোজা হাঁকানী লাগায়। 'যান যান – বরাদ্দ সীটে যান – এই খানে আইসেন না।' 'আমাগো সীটটা  নষ্ট কইরেন না।' একজনের সঙ্গে গলা লাগায় অন্যজন, আরো  একজন। পুরুষের ঐক্য একটা দারুন জিনিস এবং নারীটিকে সীট থেকে বিতাড়িত করে ছাড়েই ছাড়ে।

নারী যাত্রীর এখন কোনো অধিকার নেই যে কোনো সীটে বসার। তাকে বসতেই হবে বাধাবরাদ্দের আসনে এবং সমাজ সংসারের ওটাই তার জন্য শেষকথা- তাই না ? এখন, বাঁধা আসনে সে কেমনে যাচ্ছে ? এটাই দারনু এক দেখার বিষয়। অধিকাংশ সময় নারীযাত্রীরা দেখেন যে, তাদের জন্য সংরক্ষিত আসনে গ্যাঁট হয়ে বসে আছে দৃঢ়চেতা পুরুষগণ। মেয়েদের তারা বাসে উঠতে দেখে, দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে, বিস্মিতও হতে দেখে; কিন্তু ভ্রুক্ষেপও করে না, নড়া তো দূর। বিরক্তি ও উপেক্ষা, ও বিদ্বেষ মুখে লেপ্টে নিয়ে সামনের দিকে চেয়ে থাকে। অধিকাংশ মেয়ে মুখ বুজে সহ্য করে। কেন না সহ্য ও ধৈর্য অতি মহাগুণ – নারীর অলঙ্কার। কেউ কেউ একটু তেরা, লজ্জা সংকোচ বোধ করে কম।  সেইসব মেয়ে চিল্লাপাল্লা জোড়ে – এই যে ভাই, এইটা তো মহিলা সীট। ছাড়েন – ছাড়েন'। অধিকাংশ বাসের ড্রাইভার ও কন্টাকটর এই সীট বিষয়ক মামলার দিকে ফিরেও দেখে না। যাত্রী গো মামলা এইটা, হে গোটা হেরাই বুঝুক–এই নিরপেক্ষ মনোভাব নিয়ে তারা ঝামেলামুক্ত ও নিরাপদ থাকে। তবে কোনো কোনো কন্টাকটর একটু কিছু বলার জন্য আগায়। একটু  মিটমিটে গলায় কোনো কোনো কন্টাকটর মহিলা যাত্রীর সঙ্গে গলা মেলায়, 'এই যে ভাই সীট ছাড়েন – এইটা মহিলা সীট।' ভাইরা শোনে, না শোনে না কিছু বোঝা যায় না। কেউ সীট ছাড়ে না। উত্তর দেয় না। বা কখনো কখনো পুরুষভাই ক্ষিপ্ত গলায় জানায়, 'লেখা আছে কোনখানে যে এইটা মহিলা সীট ?' তাকালে দেখা যায়, জানালার ওপরের লালরঙে লেখা 'মহিলা শিশু ও প্রতিবন্ধী' শব্দগুলো ঝাপসা, চল্টা ওঠা হয়ে আছে। স্পষ্ট বোঝা যায় না কোনো শব্দ। খেকানি দিয়ে তারা আরো আরাম করে বসে। নড়ে না। যতো চিল্লাও, যতো বলো – কি আসে যায়? 'সীট তো খালি আছিল তখন। খালি সীটে বসছি অহন ক্যান উঠমু? ওঠে না তারা। গাদাগাদিকরা নারীযাত্রী শক্ত মুঠোয় সিটের রড ধরে দাড়িয়ে পেরোতে থাকে রাস্তা।

কখনো কখনো অন্যরকম মজাও দেখা যায়। তিন সারি তো বরাদ্দ মহিলাযাত্রীর জন্য – ওই তিন সারিজুড়ে বসা পুরুষরা বড়ো মানবিক উদ্বেগ ও করুণা প্রদর্শন করে। পেছনের সারি হাঁকতে থাকে মাঝের সারিকে এই ছাড়েন, ছাড়েন সীট। মাঝের সারি হাঁকাতে থাকে প্রথম ও শেষকে -আপনেরা ছাড়েন। এই যে – ছাইড়া দেন ! আর এ ওরে দুষতে থাকে। এ বলে -আপনেরা ছাড়তে পারেন না ? ও বলে, আপনে ছাড়েন না ক্যান ? ফল কি হয়? ফল হয়, তারা সকলেই আসীন থাকে। মহিলারা খাড়া সটান। অন্যদল 'না-ওঠা' পন্থীরা বলে, 'ক্যান, মহিলারা আমাগো সীটে বসে না ? তাইলে আমরা এই সীটে বসলে দোষ হইব ক্যান ?' অতি উৎকৃষ্টমানের সমতাপন্থীদের এমন কথার উত্তর কে কী বলার সাহস রাখবে। রাখে না। আর তারাও সীট ছাড়ে না। বরং তাদের অন্য উচিতবাদী পুরুষেরা গলা মেলায়, 'সবটি সীট তাইলে এই মহিলারই নিয় নেউক। এগো লেইগা তো রাজত্বিটা। পুরা বাস দিয়া থুইছে মহিলা গো ! কতো বড়ো অনায্যি কাম।' গলাবাজী দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে মহিলা যাত্রীরা অপরাধে কাঁচুমাচু হয়ে থাকে। তাতে দাঁড়িয়ে থাকার কষ্টাটা আর তার লাগে না।

প্রতি বেলা, সকাল ও সন্ধ্যা ও দুপুর ও বিকেল ও দিনের সারাটা সময় বাসযাত্রী প্রতিটি নারী এই হেনস্থা, অসম্মান ও ঘৃর্ণার বিষে জর্জরিত হয়।  প্রতিটি যাত্রায় তারা ক্লিষ্ট ও অসুস্থ এক অসহ দশা। নারী বাসে থাকে গন্তব্যে যায়, বাড়ির দিকে আসে। কী বদ্ধ মূর ক্ররতা পুরুষের ভেতরে। নটি আসন খোয়ানোর ক্রোধে এই যে তড়পানি, একী দুএকজনের বিচ্ছিন্ন রাগমাত্র ? কখনোই নয় কিন্তু! এইই হচ্ছে ভেতরকার আসল মুখ। কিচ্ছুই নির্দিষ্ট করে থাকা চলবে না নারীর জন্য। তাকে অনিশ্চিত রাখো, রাখো দয়া ও করুণার পাত্র – তখন ছিঁটে ফোটা বা দুএক দল দয়া ও করুণা করতে পুরুষের বাঁধবে না। পুরুষ সম্মতও আছে তা করতে। কিন্তু নারীকে আইন করে অধিকার প্রাপ্ত নিশ্চিত একজন করে দেয়া চলবে না – না- । তাহলে সম্পত্তিতে সমান অধিকার প্রাপ্তির বিষয়টি যদি কার্যকর হওয়ার পথে যায়, তখন কোন হিংসায় দাঁতানো সুখটা বেরুবে – বুঝহেন তো ভাইসব ? হাউমাউ খাউ  রাক্ষসেরা কিন্তু রুপকথার দেশে থাকে না – এইটা জানবেন।

আর প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্ধ আসন নারী আসনের সঙ্গে কেনো বলুন তো ? কেনো আবার – কারণ সমাজ ও বিধি-নিয়ম চালুকারীরা প্রতিবন্ধী বলতে বোঝায় নারীকেই ।