চাই নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চর্চা

বাবু রহমান
Published : 24 May 2010, 03:07 PM
Updated : 24 May 2010, 03:07 PM

বাংলাদেশে নজরুল চর্চা বিশ শতাব্দীর বিশ দশক থেকে শুরু। নজরুলের সুহৃদ হবীবুল্লাহ বাহার, আবুল কাশেম, শামসুন্নাহার, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ নজরুল চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। কবির জীবদ্দশায় ছান্দসিক আব্দুল কাদির কবির জীবন ও সৃষ্টি নিয়ে কাজ করেছেন। পরবর্তীতে উর্দুতে কিছু কাজ হয়। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী একটি নাতিদীর্ঘ জীবনী রচনা করেন।

১৯৪২ সনে কবির অসুস্থতার পর নজরুল জীবন ও সৃষ্টি ধীরে ধীরে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যেতে থাকে, এর কারণ প্রধানত দু'টি। একটি পাকিস্তানের ইসলামপ্রীতি এবং নজরুলকে সেভাবেই গণমাধ্যমে উপস্থাপন করা। আর দ্বিতীয়ত উপরোক্ত কারণে প্রগতিশীলদের নজরুল-গবেষণা উপেক্ষা করা। অথচ আজ পর্যন্ত প্রকাশিত নজরুলের ইসলামিক গান মাত্র সোয়া তিনশ (৩১৮টি)। আর সনাতনপন্থীদের দেব-দেবী, পূজা-পার্বন, মিথ নিয়ে প্রায় বার'শ গান নজরুলের রয়েছে যার কয়েকটি বাজতো আকাশবাণী কোলকাতায়। ইসলামী ঐতিহ্য নিয়ে গানের কয়েকটি বাজতো তথাকথিত রেডিও পাকিস্তান থেকে। ফলে দুই বাংলার সকল নিরক্ষর মানুষের নিকট নজরুল পরিচিত হলেন উভয় সম্প্রদায়ের কবি হিসেবে। কিন্তু নিজে ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। শুধু তাঁর লেখা নয়, এমনকি তাঁর সম্পাদিত ধূমকেতু, যুগবাণী, নবযুগ, লাঙল ইত্যাদি পত্রিকার নাম থেকেও বোঝা যায় কোন মত ও পথের ছিলেন তিনি। সুভাষ বোসের মতো লোকের প্রশংসা লাভ করেছেন যিনি, কৃষক নেতা হেমন্তের সঙ্গে গাটছড়া বেঁধেছেন যিনি তাঁকে বানানো হলো ইসলামী কবি!

প্রাতিষ্ঠানিক নজরুল চর্চা শুরু হয়েছে অনেক বিলম্বে। ততদিনে কবির বন্ধুরা বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন, আর কবির সৃষ্টি ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে নজরুল চর্চা ব্যাহত হয়েছে অনেক। নজরুলের শ্রেষ্ঠ সম্পদ গান। রেকর্ডকৃত গানগুলির সকল অফিস কপি সাম্প্রদায়িকতার শিকারে ধ্বংস হলো। কে বা কারা এর নায়ক তা গবেষণার বিষয়।

কবির উত্থানকালে তাঁকে ফতোয়া দেয়া হয়েছিলো কাফের বা শয়তান বলে। তারাই এখন কবিকে করেছেন জাতীয় কবি। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক নজরুল চর্চার সূত্রপাত হয়েছিলো 'নজরুল একাডেমি'র মাধ্যমে। কবি তালিম হোসেন এর মূল হোতা, যদিও সর্বস্তরের নজরুল প্রেমিকরা এখানে যাতায়াত শুরু করে। যারা একসময় নজরুলকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছে তাদের কাছে নজরুল নামাঙ্কিত এই প্রতিষ্ঠান ভাগ্যোন্নয়ণের চাবিকাঠি হিসাবে পরিগণিত হলো।

তারপরে স্বাধীন বাংলাদেশে নজরুল সঙ্গীতে প্রশিক্ষণ, স্বরলিপি প্রকাশ, গবেষণা পত্রিকা প্রকাশ উল্লেখযোগ্য কাজ। সরকারী অনুদান ও ছাত্র-ছাত্রীদের বেতন দিয়ে এসব কাজ চলতে থাকলো। শুরু হলো স্বরলিপি প্রকল্প। লক্ষীর ভাণ্ডারের গন্ধে অর্থগৃধ্নুরা রবীন্দ্র চর্চা থেকে নজরুল প্রেমিক হিসেবে আবির্ভূত হলেন। শেখ লুৎফর রহমানের মতো প্রগতিশীল দক্ষ শিল্পী হলেন বঞ্চিত। নজরুল একাডেমি থেকে প্রায় এক ডজন স্বরলিপি প্রকাশিত হলো। ধান্দাবাজ স্বরলিপিকার পশ্চিমবঙ্গ থেকে কবির সুহৃদকৃত স্বরলিপি ও সংগৃহীত মূল সুর মিলিয়ে একটি কাঠামো তৈরি করবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু নজরুল সঙ্গীতের স্বরলিপি করার জন্য হিন্দুস্তানী সঙ্গীতে দক্ষ বাংলা গানের অভিজ্ঞতা এবং নজরুল সঙ্গীতে ব্যাপক জ্ঞানসমৃদ্ধ সঙ্গীত ব্যক্তিত্বদের এ স্থান থেকে সুকৌশলে দূরে রাখা হলো। নজরুল সঙ্গীত প্রেমিকরা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে থাকলেন। নিরাভরণ নজরুল স্বরলিপি নজরুল শিল্পীদের করলো হতাশ।

১৯৮৬ সালে সরকারী নজরুল ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠিত হলো। চললো সামরিক সরকার আর তার দোসরদের নজরুল চর্চা। লোক দেখানো পুরোনো কাসুন্দি আবার চালু হলো। এখানে স্বরলিপিকার ওই পুরোনো ব্যাক্তি। প্রথম খণ্ড স্বরলিপি প্রকাশিত হলে সমালোচনার ঝড় উঠলো। কাজেই স্বরলিপিকারকে দৌড়ুতে হলো কোলকাতায় সনদ আনতে। সেই সনদে কিছুদিন চললো। নিজের অক্ষমতা ঘোচাতে সমালোচিত হবার পর স্বরলিপিকার হিসেবে তদীয় শিষ্য ও মূলধারার দু'একজন নতুন স্বরলিপিকারকে সমন্বয় করলেন নিজের সাথে। তাদের ভাগ্য স্ফীত থেকে স্ফীততর হতে থাকলো। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত স্বরলিপি হয়েছে বত্রিশ খণ্ড। কিন্তু মূল স্বরলিপি নজরুল প্রেমিকদের নিকট না পৌঁছানোয় এ ধারাটির লক্ষ্যে পৌঁছুতে বিলম্ব হলো। মূল নজরুল সঙ্গীত শিল্পীদের একজন ইতিমধ্যে বিছানায়, একজন সদ্যোপ্রয়াত এবং নবীনরা প্রবীণের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। বর্তমানে প্রায় পঞ্চাশটি সিডিতে আমরা পাঁচশ' গানের আদি সুর পাচ্ছি। স্বরলিপিতে ঊনতা থাকলেও তা পুষিয়ে নেয়া যাবে।

পরিশেষে আর একটি দিক পরিলক্ষিত হয় তা হলো পল্লীগীতি থেকে যিনি নজরুল সঙ্গীতে এসেছেন তাঁকে দেয়া হলো প্রশিক্ষণ শাখার দায়িত্ব। হিন্দুস্তানী সঙ্গীতে তাঁর শূন্য প্রশিক্ষণ থাকায় প্রশিক্ষণ প্রকল্পটির ফলাফল শূন্যে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থ খরচের ও বাজেট সমন্বয়ের এই প্রকল্পে ইন্সটিটিউটের একধরনের কর্মকর্তার পকেট স্ফীত হবার এবং চাকুরি রক্ষা করার প্রকল্প হিসেবে দাঁড়িয়েছে। নজরুল পুরস্কারের অর্থমানও প্রশ্নবোধক। তাই আমাদের বক্তব্য নজরুলকে সাম্প্রদায়িক চক্র থেকে উদ্ধার করতে হবে। যোগ্য লোকদের স্বরলিপি ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে। পরিচালক ও কর্মকর্তা পদে রাজনৈতিক নিয়োগ নয়, স্থায়ীভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। নজরুল পুরস্কারের মান ন্যূনপক্ষে পাঁচলক্ষ টাকা করতে হবে। নজরুলের স্মৃতি প্রকাশনা, প্রচারণা ও মুদ্রণে আধুনিকতার ছোঁয়া সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পারলে নজরুল বেঁচে থাকবে।

কাজী নজরুল ইসলাম