জেন্ডার ধারণায় স্ত্রী বাচক লিঙ্গ

umme
Published : 3 Jan 2008, 05:34 PM
Updated : 3 Jan 2008, 05:34 PM

আজকাল দৈনিক বা সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকা জ্ঞানী-গুণীজনদের ভালোলাগা-মন্দলাগা বিষয়ের উপর প্রশ্নোত্তরমূলক কলাম রাখছে। অনেকটা টিভিতে টক শো জাতীয়। গুণীজনদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের কথা জানতে পেরে পাঠকের কৌতুহল নিবৃত্ত হচ্ছে। প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটা কমন প্রশ্ন প্রায় সব পত্রিকাতেই থাকে, আর তা হলো তাদের 'ছেলেবেলার নায়ক' কে? বেশিভাগই উত্তর দেন – তাদের বাবা। কেউ কেউ বলেন রবীন্দ্রনাথ বা অন্য কোন প্রবাদপুরষ। অনেকে নায়ক বলতে সিনেমার নায়ক ভেবে বলেন উত্তম কুমার বা গ্রেগরি পেক। নারী ব্যক্তিত্বরাও একইধরনের উত্তর দেন। কেউ বলেন ছেলেবেলার ('ছেলেবেলা' শব্দটিও অনেকের কাছে বিতর্কিত) নায়ক তাদের পিতা, পিতামহ, মাতামহ বা ঈশ্বরচদ্র বিদ্যাসাগর জাতীয় কোন পুরুষ। কখনও বেগম রোকেয়া বা ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেল বলেননি। তবে অদ্যাবধি একমাত্র রেহমান সোবহান ছাড়া কেউ-ই বলেননি যে ছেলেবেলার নায়ক তাদের মা। এসব কলামের সম্মানিত সম্পাদকগণ মনে হয় না এখানে 'নায়ক' বলতে কেবল পুরুষকেই বোঝান। একটা জনপ্রিয় দৈনিকের একটা কলামের নাম ছিল 'এ সপ্তাহের নায়ক'। সেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একজন করে সমাজে কোন গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি নির্বাচিত হতেন। বলা বাহুল্য একাধিক নারীও 'এ সপ্তাহের নায়ক' হিসেবে সম্মানিত হয়েছিলেন।

জেন্ডার সমতার জন্যে আজকাল নারীবাদীরা লেখিকা, নায়িকা, অভিনেত্রী, পাঠিকা, গায়িকা, সেবিকা, উপস্থাপিকা, সভানেত্রী ইত্যাদি লিঙ্গ চিহ্নিতকরণ শব্দসমূহ পরিহারে সচেষ্ট হয়েছেন। তাঁরা বলেন যে এগুলো ব্যবহার করা মানে নারীকে অধস্তন বা ছোট ভাবা। বলা বাহুল্য এ বিষয়টিকে অনেক নারীবাদীও ঠিক মেলাতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে না। শেখ হাসিনার পরিচিতিপর্বে বলা হতো 'আওয়ামি লিগ সভানেত্রী ও সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা' আর খালেদা জিয়াকে 'বিএনপি সভানেত্রী ও চার দলীয় জোটনেতা'। সভাপতির বিপরীত লিঙ্গ আমরা এতকাল ব্যকরণে পড়ে এসেছি সভানেত্রী। সেটাও বজায় রাখা হচ্ছে আবার নেতা বলে জেন্ডার বৈষম্য দূর করার পদক্ষেপও নেয়া হচ্ছে। আগে বলা হতো চেয়ারম্যান। এখন চেয়াপারসন। এর বাংলা করলে দাঁড়ায় কেদারাপ্রধান। এটা প্রচলিত হয়নি বলে ঐ চেয়ারপারসনই সই। তো সভাপতির উভয়লিঙ্গ 'সভাপ্রধান' বললেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। একইজনকে একইসাথে নেত্রী ও নেতা বলার এ বৈসাদৃশ্য থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচা যায়।

আমাদের যদি ইংরেজির মতো শি আর হি থাকতো তাহলে লিঙ্গ নির্দেশক শব্দগুলি নিয়ে আমাদের আর তেমন বিপাকে পড়তে হতো না। ধরুন বাংলা টিভিতে কোন একটা অনুষ্ঠানের মাঝখান থেকে আপনি দেখতে শুরু করলেন যেখানে একজন সাহিত্যিক বা একজন গানের শিল্পীকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আলোচকরা প্রথম দিকে তাদের নাম উচ্চারণ করেছেন কিন্তু পরে দ্বিরুক্তিজনিত শ্র"তিকটুতা পরিহারের জন্য নাম না বলে লেখক বা গায়ক বলছেন। আপনার সাধ্যি আছে বোঝার যে আলোচকরা নারী না পুরুষ কাকে নিয়ে আলোচনা করছেন? অথচ ইংরেজিতে এ নিয়ে কোন সমস্যা নেই। তারা নাম উচ্চারণ না করেও যখন বলেন 'শি ইজ অ্যান এক্সিলেন্ট এ্যাকটর' তখন আর তাকে 'এ্যাকট্রেস' না বললেও কোন ক্ষতি নেই। তাই বোধহয় দ্বিধাভরে 'সভানেত্রী ও নেতা' বলে আমাদের লিঙ্গসমতায় বিশ্বাসী শিক্ষিত মানুষেরা ঝোলেও থাকেন আবার অম্বলেও। কিংবা হয়তো মনে করেন নারীদের একেবারে পুরুষ না বানিয়ে বরং মাঝামাঝি রেখে দেয়াটাই শোভন। সেক্ষেত্রে 'সভাপ্রধান ও দলপ্রধান' বললে তো আর কোন ঝামেলাই থাকে না।

কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী নারী লেখক দিলরুবা শাহানা তার লেখার মধ্যে একটি গল্প বলেছিলেন। গল্পটা অনেকটা এরকম ছিল Ñ একজন ভদ্রলোক তার শিশু পুত্রকে নিয়ে গাড়িতে করে যাওয়ার পথে দূর্ঘটনায় মারা গেলেন। আহত শিশুপুত্র হাসপাতালে ভর্তির পর তার অপারেশন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ডাক্তার চিৎকার করে বলে উঠলেন যে তিনি শিশুটির অপারেশন করতে পারবেন না কেননা শিশুটি তার নিজের। প্রায় সবাই প্রথমে হা হয়ে যান। আরে, যে বাবা মারা গেল গাড়ি দূর্ঘটনায় সে আবার কী করে হাসপাতালে এলো? এক মুহূর্তে ভূত হয়ে নাকি? ডাক্তারটি যে শিশুটির মা হতে পারেন এ ধারণা অবচেতন মনে অনেকেরই থাকে না। জেন্ডার প্রশিক্ষণে জেন্ডার ধারণা প্রদানের সময় এ ধরনের গল্প বলে প্রশিক্ষণার্থীদের মনোভাব যাচাই করা হয়। তাই 'নায়ক' বললে স্বশিক্ষিত পণ্ডিত ব্যক্তিরাও একজন মহান পুরুষকেই কল্পনা করেন।

একটি কবিতায় কবি জাহিদ হায়দার নারীকে 'শে' আর পুরুষকে 'সে' সর্বনামে অভিহিত করার প্রস্তাব রেখেছিলেন। প্রস্তাবটি লিখিত ভাষার জন্যে প্রযোজ্য হলেও মুখের ভাষার জন্যে উপযোগী নয়। কেননা আমরা উক্ত দুটো সর্বনামকে একইভাবে উচ্চারণ করে থাকি। বরং নারীকে 'শে' করে পুরুষকে 'হে' করা গেলে মন্দ হতো না। উচ্চারণের ভিন্নতায় উভয়লৈঙ্গিক অভিন্ন সম্মোধন চিহ্নিতকরণে অসুবিধা দূর হতো। তখন নারীকে লেখক, নায়ক, গায়ক বা নেতা বলতে গিয়ে বারবার তার নাম উচ্চারণ করা লাগতো না। শুধুমাত্র পুরুষের ব্যবহারের জন্য যেসকল পারফিউম তৈরি করে পশ্চিমারা সেসব বোতলের গায়ে আগে লেখা থাকতো 'ফর মেন'। ইদানিং লেখা থাকে 'ফর হিম'। তো আমরা অদূর ভবিষ্যতে পুরুষের জন্যে পারফিউম তৈরি করে কী লিখে রাখবো? 'তার জন্যে' লিখে দিলে কি আর তা কেবল পুরুষকেই বুঝাবে? একবার এক অনুষ্ঠানে এদেশের এক বিখ্যাত নারী লেখককে এক প্রবীন পুরুষ সাহিত্যিক অনভ্যাসজনিত কারণে বারবার লেখিকা বলছিলেন। নারী লেখক এ কারণে বেশ গোসসা করেছিলেন। ভার্সিটির এক মজার শিক্ষক (পুরুষ) জেন্ডার নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলছিলেন নারীবাদীরা 'হিস্টোরি' শব্দটিরও পরিবর্তন চান। শুধুই কেন হিজ স্টোরি হবে? হার স্টোরিও হতে হবে। কিন্তু যখন বলা হয় ঠিক আছে তাহলে 'ম্যানহোল' শব্দটিই বা কেন পুরুষতান্ত্রিক নাম নিয়ে টিকে থাকবে? ওটা পরিবর্তন করে উইম্যানহোল রাখা হলে কেমন হয়? নারীবাদীরা এ প্রস্তাবকে 'অশ্লীল' বলে উঠে যান।

আসলে পুরুষবাচক মূল শব্দের সাথে প্রত্যয়যোগে নারীকে মূল সম্মোধনের লেজুড়বৃত্তি করতে হয়। বাংলা ব্যকরণে বোধহয় ননদ, মাসি, পিসি, খালা, ফুপু ও আরও দুএকটি ছাড়া স্ত্রীলিঙ্গ থেকে প্রত্যয়যোগে আর কোন পুংলিঙ্গ তৈরি হয়নি। বাদবাকি পুরুষবাচক থেকেই সৃষ্টি। আবার এমন কতোগুলো স্ত্রীবাচক লিঙ্গ রয়েছে যেগুলোর কোন পুংলিঙ্গ নেই। যেমন পতিতা। পতিত কিন্তু পতিতার পুংলিঙ্গ নয়। বৈয়াকরনিকদের ধারণা বোধহয় এরকম ছিল Ñ পৃথিবীর প্রথম নারী ইভ্-এর জন্ম হয়েছে আদমের বাম পাঁজরের একটি হাড় দিয়ে সুতরাং ব্যকরণের নারীরাও পুরুষ থেকেই উৎপন্ন হোক। যেমন লেখকই মূল। পরবর্তীতে নারীরা লেখনী ধরলে লেখিকা বলে তাদের কিঞ্চিৎ সম্মান দেখানো হলো। কিন্তু কালক্রমে লেখিকাদের ধারণা জন্মালো এ যেন সম্মান নয় বরং ঠাট্টা।

আবার দেখা যায় একুশে বইমেলায় 'লেখককুঞ্জ' নামক ছাউনির নিচে নারী-পুরুষ সবধরনের লেখকরাই বসে আড্ডা দেন আবার অন্যদিকে লেখিকাসংঘ নামে একটি সংগঠন দিব্যি অস্তিত্ব জাহির করে চলেছে। আমাদের চলচ্চিত্রের অভিনেতা অভিনেত্রীরা সবাই নিজেদের বলেন আমরা অভিনেতা আবার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জন্য আলাদা পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে। সেক্ষেত্রে যেসব দেশ বলে বেস্ট এ্যাক্টর ফিমেল বা বেস্ট এ্যাক্টর মেল তারা বরং অনেক সঠিক। আমাদের দেশেও বলা যায় শ্রেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী পুরুষ, শ্রেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী নারী Ñএভাবে।

লিঙ্গ পরিবর্তনে যেসকল পুরুষবাচক শব্দের সাথে ই, ঈ, ইকা, আনি, ইনি, ইতা ইত্যাদি প্রত্যয়যোগে স্ত্রীলিঙ্গ করা হয় সেগুলোর জন্ম বোধহয় খুব বেশিদিনের নয়। যেগুলি আদি তা হলো Ñ বাবা-মা, পিতা-মাতা, জনক-জননী, স্বামী-স্ত্রী, বর-বধু, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে, জামাই-বউ, ভ্রাতা-ভগ্নী, রাজা-রাণী, পুত্র-কন্যা, ভাসুর-জা ইত্যাদি। এগুলো যেমন পিতা-পিতানী, জনক-জনিকা, স্বামী-স্বামীকা, রাজা-রাজী বা ভ্রাতা-ভ্রাতী নয় বলে এগুলোর স্বতন্ত্র স্ত্রীবাচক লিঙ্গে নারীবাদীদের কোন আপত্তি নেই তেমনি অমর্যাদা এড়াতে নায়কের স্ত্রীলিঙ্গ নায়িকা না করে অর্থাৎ প্রত্যয় যোগ না করে এতদসংশ্লিষ্ট কোন অর্থপূর্ণ শব্দ সৃৃষ্টি করলে কিন্তু এসব বিতর্ক এড়ানো সহজতর হতো। আর লেখিকা বললেই বা ক্ষতি কী? নর-এর স্ত্রীলিঙ্গ 'নারী'কে মেনে নিয়ে যখন 'নারীবাদী' হতে বাধা নেই তখন ও বিতর্কে না গেলেই হয়। যেমন প্রশ্ন জাগে কোন নাটক, উপন্যাস বা চলচ্চিত্রে যদি নায়িকাই প্রধান হন তখন সেসব শিল্প-সাহিত্যকে বলা হয় নায়িকাপ্রধান শিল্প-সাহিত্য। তাহলে প্রধান নারী পুরুষ উভয়কেই নায়ক বললে এসব শিল্প-সাহিত্যকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করবো কীভাবে? বরং আসুন ই, ঈ, ইকা, আনি, ইনি, ইতা ইত্যাদি প্রত্যয় রেখেই আমরা যে যার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার চেষ্টা করি। যখন লেখিকারাই বড় বড় পুরস্কার ছিনিয়ে আনবেন তখন ক্রমান্বয়ে লেখকরাই হবেন লেখিকা থেকে জাত। পুংলিঙ্গে প্রত্যয় যোগ করলে নিজেদের নারী বলে চিনতে যেমন সুবিধা হয়, তেমনি নারী হতে পারার মধ্যে যে কোন অগৌরব নেই – বরং এ নশ্বর পৃথিবীর উদ্ভিদ-প্রাণি জগতে স্ত্রীজাতীয় জীব থেকেই যে সবকিছুর সৃষ্টি সে কথা লেখক, নায়ক, পাঠক, গায়ক, সম্পাদকরা কি গায়ের জোরে অস্বীকার করতে পারেন?

————

লেখকের আর্টস প্রোফাইল: উম্মে মুসলিমা
ইমেইল: lima_umme@yahoo.com

ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts