মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির অন্তরায় ইসরাইল ও তার সমর্থক রাষ্ট্রগুলি

মোহাম্মদ সেলিম
Published : 16 June 2010, 01:54 PM
Updated : 16 June 2010, 01:54 PM

মধ্যপ্রাচ্য দীর্ঘ সময় ধরে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে আছে। সম্প্রতি ইসরায়েলি নৌবাহিনী আন্তর্জাতিক জলসীমায় মানবিক সাহায্য বহনকারী জাহাজে আক্রমণ চালিয়ে যে নজিরবিহীন মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং একই সঙ্গে উন্মুক্ত সমুদ্রে জাহাজ চলাচলের আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন করেছে তা সারা বিশ্বে তীব্র নিন্দা আর ঘৃণার জন্ম দিয়েছে।

৩০মে ১০ হাজার টন ত্রাণসামগ্রী (অধিকাংশ চিকিৎসা সংক্রান্ত) এবং সাত শতাধিক যাত্রী নিয়ে ছয়টি জাহাজের এক নৌবহর গাজার উদ্দেশ্যে সাইপ্রাস থেকে যাত্রা করে। লক্ষ ইসরাইল কর্তৃক অবরুদ্ধ গাজায় বসবাসকারীদের মানবিক সহায়তা প্রদান। ফ্রি গাজা মুভমেন্ট এই ত্রাণ তৎপরতার উদ্যোক্তা; তুরস্ক, গ্রিস, কুয়েতসহ কয়েকটি দেশ থেকে ত্রাণ সামগ্রীগুলো পাওয়া গেছে।

গাজায় বসবাসকারী হতভাগ্য মানুষগুলোর কাছে মানবিক ত্রাণবাহী নৌবহরটি পৌঁছাতে পারেনি। গাজা উপকূল থেকে ৬৫ কি.মি. দূরে থাকতেই তা ইসরাইয়েলি নৌবাহিনীর নির্মম আক্রমণের শিকার হয়। যদিও আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত সমুদ্র আইন অনুযায়ী এই আক্রমণ গ্রহণযোগ্য নয়। উন্মুক্ত সমুদ্র আইনের বিধিবিধান কোনোভাবেই অনুসরণ করা হয়নি। আক্রান্ত জাহাজ থেকে আত্মসমর্পণের প্রতীক হিসেবে সাদা পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। এতদসত্বেও মানবতাকর্মীদের জীবন দিতে হলো।

এই বর্বর ঘটনায় ৯ জন ত্রাণকর্মী নিহত, ৩৬ জন আহত এবং জাহাজের ক্যাপ্টেনকেও শারীরিক নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়। এই ঘটনা যে কোনো বিবেকবান মানুষকে পীড়িত না করে পারে না তা সে বিশ্বের সেখানেই বাস করুক, আর তার ধর্মীয় পরিচয় যাই হোক। মানবতাবিরোধী এবং সভ্যতাবিরোধী নির্মম এই হত্যা মেনে নেওয়া যায় না। সারা বিশ্ব ধিক্কার জানিয়েছে ইসরাইলী শক্তি-উন্মাদনার।

"
মধ্যপ্রাচ্যের এই রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে এই প্রথমবার বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ জানানো হলো তা নয়। এর আগে বহুবার এমনি ঘটনা সংগঠিত হয়েছে।… মানবিক ত্রাণবাহী নৌবহরে আক্রমণের নিন্দা জানিয়েছে আরব লীগ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ। প্যালেস্টাইনের রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাসের কাছে এটি হত্যাযজ্ঞ। আর মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার কাছে নিছক দুঃখজনক ঘটনা।

"

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিন্দা, প্রতিবাদ, ঘৃণা ইসরাইলী শাসকচক্রের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব বিস্তার করে বলে মনে হয় না।

মধ্যপ্রাচ্যের এই  রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে এই প্রথমবার বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ জানানো হলো তা নয়। এর আগে বহুবার এমনি ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। তুরস্কের নাগরিকদের হত্যার প্রতিবাদে সে দেশের প্রতিক্রিয়াও হয়েছে তীব্র। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'বেসামরিক নাগরিকদেরকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে ইসরায়েল আবার প্রমাণ করেছে মানুষের জীবন ও শান্তিপূর্ণ উদ্যোগের ব্যাপারে তারা উদাসীন।' হাজার হাজার তুর্কি নাগরিক প্যালেস্টাইনের পতাকাসহ বিক্ষোভ করেছে। মানবিক ত্রাণবাহী নৌবহরে আক্রমণের নিন্দা জানিয়েছে আরব লীগ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ। প্যালেস্টাইনের রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাসের কাছে এটি হত্যাযজ্ঞ। আর মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার কাছে নিছক দুঃখজনক ঘটনা।

তথাকথিত আত্মরক্ষার নামে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কূটচালে এবং বল প্রয়োগের মাধ্যমে মিসর, প্যালেস্টাইন আর জর্ডানের ভূখণ্ড দখল করে জন্ম নেয় ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ইসরাইল। ১৯৪৮ সনের ১৪ মে ইহুদী নেতা বেন-গারিয়ন এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। অন্যতম পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মাত্র ১৬ মিনিট পরে ডি ফ্যাক্টো স্বীকৃতি প্রদান করে। সম্মিলিত আরব বাহিনীর আক্রমণ, বিরোধিতা, প্রতিরোধের মুখে মার্কিন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্ত্র-অর্থের কার্যকর সহায়তায় মরুভূমির বুকে ইসরাইলের শেকড় প্রোথিত হয়েছে।

বল প্রয়োগের মাধ্যমে উগ্র ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে লক্ষ লক্ষ আরব জন্মভূমি ছেড়ে শরণার্থীতে পরিণত হলো। ঠাঁই হলো বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে। ইসরাইলী হামলা, আতঙ্ক আর মানবেতর জীবন হলো সঙ্গী। দীর্ঘ ৬২ বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই বৈরীতার মোকাবেলা করছে।

প্যালেস্টাইন সমস্যা এখন কেবল আরব-ইসরাইলের মধ্যে সীমিত নেই। ধর্ম, রাজনীতি, তেল, ভৌগোলিক অবস্থান–এমনি নানা কারণে এটি বহুপাক্ষিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্যালেস্টাইনের কাছে তা কোনো আশার বাণী নিয়ে আসেনি। কারণ ইসরাইল শান্তি প্রচেষ্টায় গোলকধাঁধা সৃষ্টি করে চলেছে নানা অজুহাতে।

২০০৭ সাল থেকে ১৫ লক্ষ লোকের এলাকা গাজা অবরোধ করে রেখেছে। অভিযোগ হামাসের সন্ত্রাসী তৎপরতা। প্রশ্ন হলো ইসরাইলের আচরণ কি তার চাইতে ভিন্নতর কিছু? কত দিন এই অবরোধ চলবে? এটা কী আন্তর্জাতিক আইন অনুমোদন করে? ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেডক্রস (আই সি আর সি) ইসরাইলের গাজা অবরোধ জেনেভা সনদের লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে। কিন্তু কথায় আছে, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী।

আসলে বহির্বিশ্বের দুষ্টস্বভাবের পররাষ্ট্রনীতিসম্পন্ন কতিপয় রাষ্ট্রের অনৈতিক মদত ও সহযোগিতা ইসরাইলকে এতটাই উদ্ধত করে তুলেছে যে এটি বিবেকবান কোনো রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানের আজ কোনো তোয়াক্কা করে না। ফলে, বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপই মধ্যপ্রাচ্য সংকটের বড় কারণ হয়ে আছে। বিশেষভাবে মার্কিন প্রশাসনের একাচোখা নীতি এই সংকটকে জটিল থেকে জটিলতর করেছে। মধ্যপ্রাচ্য সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আরব-ইসরাইল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কোনো বিকল্প নেই।

ইসরাইলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রায় দুই দশক আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩০ সালে ২৮ নভেম্বর লন্ডনের জুইস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে যে কথা বলেছিলেন তা আজও সত্য: "ইহুদী জাতীয়তাবাদ বলতে আমার বিশিষ্ট বন্ধু আইনস্টাইন যা বোঝেন, আমিও কিন্তু তা-ই বুঝি। ইহুদী জাতীয়তাবাদ ইহুদী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে রক্ষা করবে। আর এই কাজটি করতে গেলে আজকের বিশ্বে একটি জাতীয় আবাসভূমির প্রয়োজন হয়। এজন্য, বলাই বাহুল্য, যথার্থ পারিপার্শ্বিক এবং অনুকূল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ দরকার। একথা বুঝি। কিন্তু প্যালেস্টাইনে ব্যাপারটি সম্ভব হবে যদি ইহুদীরা তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আরবদেরও সাথে নেয়। এই রাজনৈতিক সহযোগিতা পেতে আপনাদের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপ কিছুই বিসর্জন দিতে হবে না। আমি তো দিব্য চোখে দেখতে পাই এই প্যালেস্টাইন কমনওয়েলথ যেখানে আরবরা তাদের ধর্মীয় জীবন যাপন করবে এবং ইহুদীরা তাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উদ্ধার করবে। (অনুবাদ: খালিকুজ্জামান ইলিয়াস)"