যে কারণে প্রত্নসম্পদ বিদেশ পাঠানোয় বিরোধিতা

শামসুজ্জামান খান
Published : 4 Feb 2008, 06:37 AM
Updated : 4 Feb 2008, 06:37 AM

বাংলাদেশের বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফ্রান্সের গিমে জাদুঘরে (Musée Guimet) প্রদর্শনের জন্য বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর এবং সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনস্থ বগুড়ার মহাস্থানগড় সাইট মিউজিয়াম (Site Museum), পাহাড়পুর প্রত্নস্থান সাইট মিউজিয়াম, এবং কুমিল্লার ময়নামতি সাইট মিউজিয়াম থেকে ১৮৭টি মতান্তরে ১৮৯টি মতান্তরে ২১১টি পুরাকীর্তি পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ৩১ জুলাই ২০০৭-এ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সচিব এবিএম আবদুল হক চৌধুরী এবং গিমে জাদুঘরের পক্ষে ঢাকাস্থ ফরাসী রাষ্ট্রদূত জ্যাক আংগ্রি কস্টিলেস (Jacqes Angre Costilhes) চুক্তি স্বাক্ষর করেন। উভয় পক্ষে স্বাক্ষী হিসাবে স্বাক্ষর করেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালক ড. শফিকুল আলম ও গিমে জাদুঘরের কিউরেটর ভিনসেন্ট লেভর।


সিদ্ধার্থ গৌতম-এর গৃহত্যাগের রিলিফ (১১ x ৩৭ সেমি.)। পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকার নিমোগ্রাম থেকে পাওয়া কুশান যুগের এই শিল্পকর্ম সহ ১০০টি প্রত্নসামগ্রী আলফ্রেড ফুশার (Alfred Foucher, ১৮৬৫-১৯৫২) ফ্রান্সে নিয়ে গিয়েছিলেন। গিমে কালেকশন নং. এম ৩৩৯৭।
……..
এই চুক্তি অনুযায়ী অনেকটা চুপিসারে প্রত্নসম্পদগুলো ফ্রান্সে পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে প্রত্নতত্ত্ববিদ, জাদুঘর বিশেষজ্ঞ, চিত্র-ভাস্কর্য-স্থাপত্য শিল্পী এবং কলারসিকদের মধ্যে ক্ষোভ বিক্ষোভ প্রতিবাদ ও সমালোচনা দেখা দেয়। এমনকি রাজশাহী ও ঢাকায় কয়েকটি মামলা দায়ের করে প্রত্নসম্পদগুলো না পাঠানোর সিদ্ধান্ত চেয়ে আবেদন করা হয় এবং হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দেন। সে-সব মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে দেয়ায় ৪২টি প্রত্নসম্পদের প্রথম চালান ফ্রান্সে পাঠিয়ে দেয়া হয় জাতীয় জাদুঘরের ছুটির দিনে হোমবাউন্ড কুরিয়ার সার্ভিসের কাভার্ড ভ্যানে। ভ্যানের গায়ে লেখা ছিলো 'জরুরী ত্রাণ সাহায্য'। জনগণের অগোচরে জাতীয় জাদুঘর থেকে এই

………
১৮৯৮-এ আকা এফ. লুইজিনির তেলছবিতে নিজ জাদুঘরে এমিল এতিয়েন গিমে (১৮৩৬-১৯১৮)। গিমে ১৮৭৬ সালে জাপান, চীন ও ভারত থেকে প্রভূত প্রত্নবস্তু সংগ্রহ করে লিয়নে জাদুঘর দিয়ে বসেন ১৮৭৯ সালে। ১০ বছর পরে প্যারিসে নিয়ে যান জাদুঘরটি।
……..
রহস্যজনক পন্থায় প্রত্নসম্পদ বের করে ফ্রান্সে পাঠানোয় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দেশের মহামূল্যবান প্রত্নসামগ্রী বিদেশে পাচার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে। এবং ভ্যানগুলো জাদুঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় সমবেত বিপুল সংখ্যক শিল্পী, সংস্কৃতিপ্রেমিক ও সাধারণ মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং 'চোর' 'চোর' বলে ধ্বনি দিতে থাকে। তবু সরকারী নিরাপত্তাবাহিনীর সহায়তায় প্রত্নসম্পদগুলো বিমান বন্দরে পৗঁছে এবং ফ্রান্সে নিয়ে যাওয়া হয়।

প্রত্নসম্পদগুলোর দ্বিতীয় চালান সন্দেহজনকভাবে ফ্রান্স এয়ারের কার্গো বিমানে করে নেবার চেষ্টা করা হয় ঈদের ছুটিতে অত্যন্ত সঙ্গোপনে, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্দেশ্যপ্রণীত প্রত্নসম্পদ বিদেশে প্রেরণ সম্পর্কে মানুষ ইতোমধ্যেই সচেতন হয়ে ওঠায় সরকার ও ফরাসী কর্তৃপক্ষের তড়িঘড়ি প্রত্নসম্পদ অবৈধভাবে দেশের বাইরে পাঠানোর ব্যাপারে আবারও বাধা ও প্রতিরোধের মুখে পড়ে। কিন্তু নিরপেক্ষ সৎ ও অদুর্নীতিবাজ এবং দেশপ্রেমিক বলে প্রচারিত এই সরকার প্রবল জনমত, ২৭ জন দেশবরেণ্য সিনিয়র সিটিজেনের আবেদন, সুশীল সমাজের বিবৃতি, শিল্পী কলারসিক ও জাদুঘর বিশেষজ্ঞ এবং প্রত্নতত্ত্বের শিক্ষক-ছাত্রদের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে স্বৈরাচারী সরকারের মতো প্রত্নসম্পদ পাঠানোর সিদ্ধান্তে অটল থাকে।


প্রত্নসম্পদ পাঠানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

সরকারের কোন শক্তিশালী মহলের ক্ষমতার দাপটে প্রধান উপদেষ্টা পর্যন্ত নীরব থাকলেন আমরা সে রহস্যের খবর জানি না। আমরা আইন-বিশেষজ্ঞ, জাদুঘরবিদ, প্রত্নতত্ত্বের নবীন-প্রবীন বিশেষজ্ঞের সাতজনের একটি দল প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ প্রার্থনা করি। প্রধান উপদেষ্টা নন, তাঁর সচিব কাজী আমিন জাদুঘর, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, গোয়েন্দা সংস্থা এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে বৈঠকে বসেন।

………
বোধিসত্ত্বের মাথা, গান্ধার শিল্প, পাকিস্তান, ফুসার মিশন থেকে প্রাপ্ত, DAFA 1928 MG 17291
……….
আমাদের পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর ফ্রান্সে মহামূল্যবান প্রত্নসম্পদ পাঠানোর চুক্তির অসমতা, অস্বচ্ছতা ও জাতীর স্বার্থবিরোধী বিধি-বিধান ও ফাঁক-ফোকড় তুলে ধরেন। প্রত্নসম্পদ দেশে ফিরে না আসার অথবা নকল (রেপ্লিকা) ফিরে আসার আশঙ্কার বিষয়টি তুলে ধরেন। অন্যেরা ফ্রান্সের বিভিন্ন জাদুঘরে অবৈধ প্রত্নসম্পদ সংগ্রহের ইতিহাস তুলে ধরেন। সচিব বিষয়টি উপলব্ধি করে বা সাময়িক ভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার কৌশল হিসাবে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করার ঘোষণা দিয়ে সভাশেষ করেন। পরে প্রবীণ ঐতিহাসিক অধ্যাপক আবদুল মোমিন চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন। এই কমিটিতে আইনজ্ঞ, প্রত্নতত্ত্বের শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু এদের প্রস্তাব অনুযায়ী চুক্তি সংশোধন, প্রত্নসামগ্রী পরীক্ষা, ভুক্তি নম্বর পরীক্ষা, আইডেনটিটি নম্বর পরীক্ষণ ইত্যাদি করতে দেয়নি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং জাদুঘরের অসাধু ও কোনো না স্বার্থপ্রণোদিত কর্মকর্তারা। সরকারি আদেশ নির্দেশ প্রজ্ঞাপন ও ফাইল কমিটিকে দেখতে দেয়া হয়নি। এ ধরনের অসচ্ছ ও সন্দেহজনক ব্যবস্থায় ওইসব কর্মকর্তা সাত তাড়াতাড়ি ফ্রান্সে প্রত্নসম্পদ পাঠানোয় তৎপর হয়ে ওঠেন এবং প্রথম কিস্তি পাঠাতে সক্ষম হন। দ্বিতীয় কিস্তি পাঠাতে যেয়ে দুটি বিষ্ণুমূর্তি চুরি হয়ে যাওয়ায় বিপত্তি বাধে। এবং সরকার প্রত্নসম্পদ পাঠানোর সিদ্ধান্ত বাতিল করে এবং ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায় স্বীকার করে সংস্কৃতি উপদেষ্টা আইয়ুব কাদরী পদত্যাগ করেন। সব মিলিয়ে ফখরুদ্দিন সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। মুর্তিচোরদের বিমান বন্দরের নিরাপত্তা ভেদ করে অবিশ্বাস্য মূর্তিচুরির ঘটনায় সরকারের জেদ ও অনড় অপসিদ্ধান্তের অবসান ঘটলো। তবে দুঃখ এই, দেশপ্রেমিক, সংস্কৃতিমনস্ক ও ঐতিহ্যানুরাগী মানুষের আবেদন নিবেদন আন্দোলনে এই সরকার কান দিলো না। চোরদের অপকীর্তিতে সিদ্ধান্ত পাল্টালো।

এবার একটু পুরনো ইতিহাস ঘাঁটি। ২০০০ সালে মহাস্থান গড়ে প্রাপ্ত প্রত্নসম্পদ নিয়ে জাতীয় জাদুঘর ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে জাদুঘরে এক প্রদর্শনী হয়। মহাস্থানগড়ে উৎখননে অংশগ্রহণকারী ফরাসী প্রত্নতত্ত্ববিদরা তাতে নানা ভাবে সহযোগিতা করেন। পরে তারা ওই প্রদর্শনীটি ফ্রান্সসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। জাদুঘরের ডিজি হিসাবে এ উদ্দেশ্যে কথাবার্তা বলার জন্য আমাকে ফ্রান্স সফরে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি প্যারিস ও লিঁও শহরের জাদুঘরগুলি দেখি। প্যারিসের এশীয় জাদুঘর ম্যুজে গিমেও দেখি। ম্যুজে গিমে বা গিমে জাদুঘর দেখে অভিভূত হই। এশিয়ার প্রায় সব দেশের

……..
গুলের স্কুল, কাগজে গোয়াশ, ২২.৫ x ১৭.৫ সেমি., উত্তর ভারত থেকে সংগৃহীত মিনিয়েচার, কালেকশন নং: MA 3320
………
অমূল্য নিদর্শনবস্তু দিয়ে সাজানো এই জাদুঘর। তবে তখন বাংলাদেশের কোনো মাস্টারপিস দেখিনি। সেটা আমাকে স্বস্তি দেয়। ওদের জিজ্ঞাসা করি সব দেশ তাদের সেরা মিউজিয়াম পিস স্থায়ীভাবে দিয়ে দিল? উত্তরে মিলেছে নীরবতা। তখনই এই জাদুঘর সম্পর্কে আমার মনে প্রশ্ন জাগে। আমার সঙ্গে বাংলাদেশের মহাস্থান প্রদর্শনীর ইউরোপ সফরের কথা ওঠায় আমি বলি, প্রদর্শনী হতে হবে দ্বিপাক্ষিক। বাংলাদেশের প্রদর্শনী ফ্রান্সে যাবে। আবার বাংলাদেশেও আসবে ফ্রান্সের প্রদর্শনী। ফরাসীরা এতে গা করে না। তখন ভারতে ফ্রান্সের একটি প্রদর্শনী চলছিলো। সেই প্রদর্শনী ৭ দিনের জন্য ঢাকায় আনার জন্য আমি প্রস্তাব করি। নিরাপত্তার অভাব দেখিয়ে সে প্রস্তাবও তারা প্রত্যাখ্যান করে। ফলে বহু মাস্টারপিস সমৃদ্ধ গিমে জাদুঘরের কর্মকাণ্ড, তাদের ওইসব নিদর্শন সংগ্রহ-কৌশল ও ফরাসীদের মনোভাব সম্পর্কে আমার মনে নানা সন্দেহ-সংশয়ের জন্ম দেয়।

২০০১ সালে জাদুঘরের মহাপরিচালকের পদ থেকে আমার চাকুরীর মেয়াদ শেষ হয়। পরবর্তী মহাপরিচালক ড. ইফতেখারও যতদূর মনে করি শক্ত অবস্থান নেয়ায় ফরাসীরা সুবিধা করতে পারেনি। তবে শুনেছি, ২০০৫-এ তারা তৎকালীন মহাপরিচালক, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিস চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ফ্রান্সে নিয়ে যায় এবং তাদের রাজি করিয়ে গত বছরের জুলাই মাসের চুক্তির ভিত্তি তৈরি করা হয়। বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিগত বি.এন.পি জামায়াত জোট সরকারের সব গণবিরোধী ও অবৈধ কাজ, চুক্তি, সিদ্ধান্ত বাতিল করলেও দেশের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐহিত্যের মহামূল্যবান উপাদান বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার সহায়ক ও চুক্তি কেন করলেন তা এক দুর্জ্ঞেয় রহস্য। হয়তো প্রশাসনের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা জোট সরকারের অনুগত প্রশাসন-কর্মকর্তারা সরকারকে ভুল তথ্য দিয়ে বা এমন চুক্তির বিপদ সম্পর্কে অনবহিত রেখে আপাতদৃষ্টিতে শুভ বলে প্রতীয়মান এই চুক্তিতে সই করিয়ে নিয়েছে। এতে তাদের আর্থিকসহ নানা স্বার্থ এবং সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার মতলব থাকতে পারে। অন্যরকম গুঞ্জনও আছে। এই সরকারের ওপর বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং দাতাসংস্থার (বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের) প্রভাব খুব বেশি। এক্ষেত্রে নাকি তেল গ্যাস খনিজ সম্পদের মতো বাংলাদেশের আর এক শক্তি সাংস্কৃতিক সম্পদের ওপরও তাদের নজর পড়েছে। তাদের চাপেই নাকি অসহায় সরকার নতি স্বীকার করে ফ্রান্সের হাতে পুরাকীর্তির এই বিশাল সম্পদ তুলে দিতে বাধ্য হয়!

এবার যে কারণে আমরা প্রত্নসম্পদ ফ্রান্সে পাঠানোর বিরোধিতা করেছি তার দফাওয়ারি বিবরণ পেশ করি।

এক. এক জাদুঘর অন্য জাদুঘরকে অস্থায়ী বা স্থায়ী প্রদর্শনীর জন্য নিদর্শনবস্তু (Artifacts) ধার দেয়। তাহলে আমরা কেন এতো মরিয়া হয়ে গিমে জাদুঘরকে ধারদেয়ার বিরোধিতা করছি। বিরোধিতা করছি তার কারণ, দুই জাদুঘরের মধ্যে নিদর্শনবস্তু বিনিময় অস্থায়ী বা স্থায়ী ধার দেয়ার ব্যবস্থাপনাগত পেশাদারী দক্ষতা, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং সৎ ব্যক্তিত্বশালী কিউরেটর-কীপারের অভাব আছে। ফলে প্রত্নসম্পদের মতো মহামূল্যমান এবং পাচার হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিপূর্ণ দ্রব্যসামগ্রীর লেনদেন-রপ্তানি করা সম্ভব না। গিমে মিউজিয়ামে পুরাকীর্তি পাঠানোর ক্ষেত্রে যারা যুক্ত আছেন তারা তাদের ক. ব্যবস্থাপনাগত পেশাদারী দক্ষতা, ইনটিগ্রিটি বা চারিত্রিক দার্ঢ্যরে পরিচয় দিতে পারেননি, খ. প্রত্নসম্পদ বিদেশে পাঠানোর বাছাই ক্রিয়া দেশীয় বিশেষজ্ঞদের সম্পন্ন করার কথা। তা না করে স্থানীয় ব্যবস্থাপকদের দুর্বল চরিত্রশক্তি বা লাভ-লোভের ফলে ফরাসীরাই স্টোরে/গোডাউনে ঢুকে অত্যন্ত অনৈতিক পন্থা ও অবৈধ কৌশলে প্রত্নসম্পদের নানা দিক থেকে ছবি তোলে (রেপ্লিকা তৈরির জন্য যা সহায়ক); গ. বরেন্দ্র জাদুঘর এবং ময়নামতি জাদুঘর থেকে কখনোই স্থানান্তর করা হবে না এমন প্রত্নসম্পদ দেয়াল কেটে, রড কেটে দেশে এবং বিশ্বে একটি মাত্রই আছে এমন প্রত্নসম্পদ লুটেরাদের কায়দায় টেনে হিচড়ে বের করে আনা হয়। এধরনের দস্যুসুলভ আচরণ একটি সভ্য দেশ অন্য সভ্য দেশের কাছে আশা করে না।

দুই: ১৯৬৮ সালের দি এন্টিফুসিটি অ্যাক্ট-এর সেকশন ২২(২) এবং ২৩-অনুযায়ী এধরনের প্রত্নসম্পদ উপযুক্ত রপ্তানী লাইসেন্স ছাড়া অবৈধ ও বে-আইনীভাবে ফ্রান্সে পাঠানো হয়েছে। প্রতিটি প্রত্নসম্পদের জন্য আলদা লাইসেন্স দেবার কথা প্রত্নসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালকের। বে-আইনিভাবে তা না করে ওই দপ্তরের পরিচালক শুধু নো অবজেকশন (No Objection) সার্টিফিকেট দিয়েছে। এভাবে প্রত্নসম্পদ দেশের বাইরে যাওয়া পাচার ও চৌর্যবৃত্তির সহায়ক;

তিন: আমাদের আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়েছে ঢাকা বিমান বন্দরে দুটি বিষ্ণুমূর্তি চুরি বা পাচার হয়ে যাওয়ায়। কতটা অপেশাদারিত্বের ফলে এমন নিরাপত্তা ক্রটি এবং এরই ফলে পুরাকীর্তি চুরির ঘটনা ঘটতে পারে তা ভেবে অবাক হতে হয়;

চার: আমাদের সংবিধানের ১৪৫ ধারা অনুযায়ী কোনো সচিব রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ছাড়া এভাবে প্রত্নসম্পদ বিদেশে পাঠাতে পারেন না।

র্পাঁচ: তাই সংস্কৃতি সচিব একটি অবৈধ, অস্বচ্ছ, ক্রুটিপূর্ণ, দেশের স্বার্থবিরোধী এবং গিমে জাদুঘরের অনুকূল চুক্তিতে সই করেছেন। তাছাড়া সচিব ২০০৬-৯-এর কাস্টমস অ্যক্ট-এর সেকশন ১৬ ধারারও লঙ্ঘন করেছেন। ওই ধারায় 'দুর্লভ প্রত্নসম্পদ' বিদেশে প্রেরণ নিষিদ্ধ (Contra-banned);

ছয়: প্রত্নসম্পদ পাঠানোর ব্যাপারে নিদর্শনবস্তুর আইডেনটিফিকেশন মার্ক অমোচনীয় কালিতে দেয়া হয়নি। ফলে ফেরত আনার সময় আসল জিনিস এলো কিনা তা বোযা যাবে না। পাঠানোর তালিকাভুক্ত নিদর্শনগুলোর তিনদিক থেকে ছবি তোলা এবং ভিডিও রেকর্ড করেও রাখা হয়নি। এও আসল নিদর্শন বস্তু চিহ্নিতকরণের অন্তরায়;

সাত: ইউনিক মাস্টারপিস বিদেশে পাঠানো নিষিদ্ধ। সে নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে শুধু পাঠানোই হয়নি, ভুক্তি নম্বর (Accession no) না দিয়ে একই আর্টিফ্যাক্টের একাধিক নং দিয়ে যে বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে তাতে গুরুতর সমস্যা দেখা দেবে। এমনকি ওই ধরনের দ্বৈতনম্বর যুক্ত প্রত্নবস্তু ফেরতও না পাওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও দুর্লভ প্রত্নসম্পদ কুমিল্লা ময়নামতি জাদুঘরের 'বর্জসত্ত্ব'র ক্ষেত্রে এরকম দুটি নম্বর দেওয়া হয়েছে। ক্যাটালগে এর ভুক্তি নং ৭৬৩ আর ইনসুরেন্সে আছে ১১৬৫। এর ইনসুরেন্স দাবিতেও এ জন্য সমস্যা হতে পারে। এই মহামূল্যবান প্রত্নবস্তুটি দেয়াল কেটে এবং রড-উপরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে;

আট: গিমে জাদুঘরের সঙ্গে যে চুক্তি করা হয়েছে তাতে ক্ষতিগ্রস্ত পুরাকীর্তি রেস্টরেশনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে গিমে জাদুঘরকেই। এ এক ভয়ঙ্কর বিষয়। এর ফলে গিমে জাদুঘর সহজেই আসল রেখে রেপ্লিকা (নকল) তৈরি করে বাংলাদেশকে ফেরত পাঠালে বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে এর পরীক্ষা করার ব্যবস্থা আমাদের দেশে নেই। অন্য দিকে ফরাসীদের রেপ্লিকা তৈরির প্রযুক্তি অত্যন্ত উন্নত। তারা এমন রেপ্লিকা (নকল) তৈরি করতে পারে যে সাদা চোখে তো বটেই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগারেও তা ধরা কঠিন হয়ে পড়ে;

নয়: ফরাসী দেশের সুবিখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়াম এবং গিমে জাদুঘর যথাক্রমে তুরস্ক এবং চীনের সঙ্গে এরকম আসল রেখে নকল ফেরত দেয়ার ব্যাপার করেছে;

দশ: প্রত্নবস্তুর জন্য ফরাসীরা যে ইনসুরেন্স ধার্য করেছে তা এতই কম যে জার্মানীর Bengal Classical আর্ট বিশেষজ্ঞ Dr. Joachim Bantze একে Financial Fraud বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ বিশেষজ্ঞ মতে এডওয়ার্ড পি আলেকজান্ডার বলেন, "The Insurance must be carefully arranged from wall to wall of the lending museum–at the lender's valuation and with the lender's policy to be paid for by the borrower or with the borrower's policy agreed to by the lender." ('The Museum As Conservation', THE MUSEUMS IN MOTION, page 147)

এগার: প্রত্নবস্তু পরিবহনের দায়িত্ব হোমবাউন্ডকে দেয়া হয়েছে ফরাসীদের ইচ্ছায়। আন্তর্জাতিক নিয়মে পরিবহন সংস্থা ঠিক করার দায়িত্ব বাংলাদেশের।

বার: প্রত্নবস্তু প্যাকিং, প্যাকিং বস্তু ও উপাদান ঠিক করা ও তার তদারকির দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরের সংরক্ষণ বিজ্ঞানীদের তত্ত্বাবধানে। তা করা হয়নি! দীর্ঘ যাত্রায় ঝুঁকি, ঝাকি সহ্য করার ক্ষমতা প্রত্নসম্পদগুলোর আছে কিনা তাও পরীক্ষা করা হয়নি। ফলে সাধারণ পণ্যের মতো বহন করায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তের: ফ্রান্স থেকে ফিরে আসলে ৪২টি পুরাকীর্তির এবং বার বার বিমান বন্দরে যাওয়া ও জাতীয় জাদুঘরে ফিরে আসা প্রত্নসম্পদগুলোর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার আসল নকলের যাচাই হতে পারে চারটি পদ্ধতিতে:
১. Thermo Luminescent dating (মৃৎশিল্প ও টেরাকোটার জন্য)
২. Archaeo-magnetic Mathod (পাথরের ভাস্কর্যের জন্য)
৩. X. ray florescent method
৪. Carbon 14 dating method

এসব পদ্ধতিতে পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা বাংলাদেশে নেই। তাই ফেরত এলেও আসল নকল আমরা বুঝব না। বিদেশে পাঠিয়ে পরীক্ষা করতে হবে। যা অসম্ভব বলেই মনে হয়। Specific gravity system এ আমাদের সংরক্ষণবিদরা মুদ্রা এবং লৌহ পিতল তামা জাতীয় দ্রব্য পরীক্ষা করতে পারবেন।

সংযোজন

চৌদ্দ. এমতাবস্থায়, ফরাসীরা যদি প্রত্ন সম্পদগুলি ফেরত না দেয় বা নকল ফেরত দেয় তাহলে সেটা হবে আমাদের জন্য শতাব্দীর সবচেয়ে বড়ো সাংস্কৃতিক বিপর্যয়। সে কলঙ্কের ছাপ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গায়েই লাগবে।

পনের. ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের জাদুঘরসমূহে অন্য দেশের পাচারকৃত নিদর্শনবস্তু 'সরল বিশ্বাসে' (Good faith) সংগ্রহ করা দূষণীয় নয়।

ষোল. অন্য দেশ থেকে অবৈধভাবে সংগৃহীত উপাদান ফেরৎ দেয়া সংক্রান্ত ১৯৯৫-এর ইউনেস্কো সনদে ফ্রান্স স্বাক্ষর করে নাই।

এতোসব জটিল, ঝুঁকিপূর্ণ ও বিশেষ পেশাদারী ব্যবস্থা, পন্থাও সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দাবি করে বলেই আমরা প্রত্নসম্পদ বিদেশে পাঠানোর এত বিরোধিতা করেছি।

আশু করণীয়

এক. জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতায় ৪২টি প্রতœসম্পদ অবিলম্বে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে;

দুই. অবৈধ, ক্রুটিপূর্ণ, রহস্যময় এবং পাচার সহায়ক চুক্তি স্বাক্ষর এবং প্রতœসামগ্রী অতি উৎসাহে ও অস্বচ্ছ পন্থায় দ্রুত গতিতে পাঠানোর প্রক্রিয়ায় যুক্ত সাবেক সংস্কৃতি সচিব, যুগ্ম সচিব এবং বিভিন্ন জাদুঘর ও প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, পরিচালক, কীপার, কনজারভেশন রসায়নবিদ-টেকনিশিয়ানের অপরাধের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ ও তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে;

তিন. বিমান বন্দরের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও দায়িত্বে অবহেলা, নিরাপত্তা শিথিলতা করার ব্যাপারে তাদের যোগসাজশ আছে কিনা তা চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ববস্থা নিতে হবে;

চার. আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার জন্য জাতীয় জাদুঘরেই উপযুক্ত সংরক্ষণ বিজ্ঞানী থাকা সত্ত্বেও তাদের বাছাই ক্রিয়ায় যুক্ত না করে কেন টেকনিশিয়ান ও ডিপ্লোমাধারীদের যুক্ত করা হলো জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে তার জবাবদিহিতায় আনতে হবে;

প্রত্ন সম্পদের প্রচার, প্রসার ও সুরক্ষা: দীর্ঘস্থায়ী কর্মপন্থা নির্ধারণ

বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ সুরক্ষার জন্য মিশরের মতো প্রত্নসম্পদ সুরক্ষা ও তদসংক্রান্ত যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য একটি সর্বোচ্চ পরিষদ বা জাতীয় কমিশন গঠন করতে হবে। এ সংস্থা হবে স্বশাসিত ও সরকারী নিয়ন্ত্রণমুক্ত। এই সংস্থার প্রথম কাজ হবে একটি নতুন প্রত্নসম্পদ সুরক্ষা নীতিমালা এবং ১৯৬৮ সালের আইনের দুর্বলতা দূর করে একটি নতুন আইন প্রনয়ন করে পার্লামেন্টে পাশ করানো। এর সঙ্গে সঙ্গে দেশব্যাপী একটি পরিপূর্ণ (Comprehensive) প্রত্নসম্পদ জরিপ কাজ পরিচালনার (Archacological Survey) ব্যবস্থা করা এবং এর ভিত্তিতে সারা দেশের প্রতœসম্পদের সংগ্রহ সংরক্ষণ ও প্রদর্শন ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে নীতি ও কর্মপন্থা গ্রহণ। এই সংস্থার তৃতীয় ও চতুর্থ কাজ হবে অবিলম্বে উন্নতমানের সংরক্ষণ রসায়নাগার প্রতিষ্ঠা এবং দেশের প্রত্নসম্পদের বিস্তৃত বিবরণ ও ছবি সঙ্কলিত একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ প্রকাশ। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও জাদুঘর সমূহের অর্থ বরাদ্দ হবে এই সংস্থা কর্তৃক তাদের কাজের মূল্যায়নের ভিত্তিতে। দেশের জাদুঘরসমূহ এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই সংস্থার কাছে তাদের কাজের জবাবদিহি করবে। প্রত্যেক জাদুঘরকে প্রতি বছর তাদের কাজের প্রতিবেদন (Annual Report) প্রকাশ করতে হবে।

উপর্যুক্ত জাতীয় সর্বোচ্চ সংস্থা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও জবাবদিহিতার ভিত্তিতে পরিচালনার জন্য একজন সভাপতি, কোষাধ্যক্ষ ও তিনজন বিশেষজ্ঞ সদস্য সমন্বয়ে গঠিত হবে। রাষ্ট্রপতি হবেন এর পৃষ্ঠপোষক। সভাপতি ও সদস্যরা হবেন প্রবীণ ও বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক, আইন বিশেষজ্ঞ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে কোষাধ্যক্ষ সরকার কর্তৃক মনোনীত হবেন। এই সংস্থার জবাবদিহিতার জন্য ২৫ সদস্যের একটি কাউন্সিল থাকবে। এই কাউন্সিলের সদস্যরা হবেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালক, জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক, ঢাকা, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যবৃন্দ, এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি, জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান, একজন নৃতাত্ত্বিক, একজন ফোকলোরবিদ, একজন জাদুঘর বিশেষজ্ঞ, দুজন কনজারভেশন বিশেষজ্ঞ, সাধারণ ইতিহাস ও ইসলামের ইতিহাসের দুজন বিশিষ্ট পণ্ডিত, একজন বিচারপতি, একজন চারুশিল্পী, একজন ভাস্কর, দুজন সাংবাদিক/পত্রিকার সম্পাদক, একজন বিজ্ঞানী, একজন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, এনবিআরের প্রতিনিধি একজন, কাস্টমসের প্রতিনিধি, বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনের একজন কর্মকর্তা, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) দুজন প্রতিনিধি, সুশীল সমাজের এক বা দুজন সদস্য এবং বি.ডি.আর প্রতিনিধি।

প্রতিবছর সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী সংস্থার সদস্যদের নিয়ে একটি সাধারণ সভা হবে। এই সভায় সর্বোচ্চ সংস্থা এবং জাদুঘর ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কার্যক্রমের মূল্যায়ন ও বিচার বিশ্লেষণ করা হবে। এবং এই সাধারণ সভা সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়ন করবে সর্বোচ্চ সংস্থা এবং জাদুঘর ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। এই সংস্থার গঠন পদ্ধতি সরকার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে নির্ধারণ করবে।

জানুয়ারি ২০০৮

বন্ধুদের কাছে লেখাটি ইমেইল করতে নিচের tell a friend বাটন ক্লিক করুন: