কবি জয় গোস্বামীর ঢাকা সফর

ইফতেখার ওয়াহিদ ইফতি
Published : 12 Jan 2008, 06:00 PM
Updated : 12 Jan 2008, 06:00 PM


ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরি ক্যান্টিনে হঠাৎ আড্ডায় কবি সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে জয় গোস্বামী


কবি আল মাহমুদের বাড়িতে পহেলা সাক্ষাৎ

খালেদ আমার বন্ধু। ওয়ার্ডস এন পেজেস-এর অপারেশন দেখেন। আমাকে জানালেন ইন্ডিয়া বাংলাদেশ বুকস রাইটার্স ফেস্টিভাল হচ্ছে ঢাকায়। ৩/১১/২০০৭ তারিখে একটা কবিতার সেশন আছে ওয়ার্ডস এন পেজেস-এ, ওই ফেস্টিভালের আওতায়। আমি যেন থাকি। ওখানে ওইদিন জয় গোস্বামী থাকবেন।

আমি যেহেতু বিখ্যাতদের ছবি তুলি তাই জয়ও আমার প্রিয় কবি। খালেদের ওখানে গেলে জয়ের কিছু ছবি তুলতে পারবো। জয়ের আগেই আমি ওয়ার্ডস এন পেজেস-এ হাজির হলাম। অপেক্ষা করছি, জয় কখন আসেন। দোতলা থেকে দেখলাম নিচে গাড়ি থেকে জয় নামছেন। আমি নিচে নামলাম। হাত বাড়িয়ে পরিচয় দিলাম, 'আমি ইফতি–ইফতেখার ওয়াহিদ ইফতি, ছবি তুলি।' জয়ের সঙ্গে ছিলেন কবি মারুফ রায়হান। উনি বললেন, ইফতি ভালো ছবি তোলে।

………
ওয়ার্ডস এন পেজেস-এ রাইটার্স-পাবলিশার্স মিটিং সেশনে মহিউদ্দিন আহমেদ ও নিমা রহমান-এর সঙ্গে
……….
এর পর আমি জয়দাকে নিয়ে গেলাম দোতলার লাইব্রেরীর সামনের দিকে। সেখানে জয়ের অনেকগুলো ছবি তুললাম, পোর্ট্রেট। অনুষ্ঠান শুরুর আগেই আমরা দর্শকসারির পেছনে বসলাম। কথায় কথায় জয় গোস্বামী জিজ্ঞেস করলেন, আল মাহমুদের বাসা, কবি আল মাহমুদের বাসা কোথায়? আমি জানালাম, এই তো এই তো, এখান থেকে দশ মিনিটের পথ। জয় বললেন, আমাকে একটু নিয়ে যাবেন? আমি বললাম, নিশ্চয়ই। বললেন, চলেন। আমি বললাম, এইখানের সেশনটা শেষে আমরা যাবো।

সেশন শেষ হওয়ার আগেই আমরা দুজন কাউকে কিছু না বলে নিচে নামলাম। শুধু খালেদকে বললাম, জয়দাকে নিয়ে মাহমুদ ভাইয়ের বাসায় যাচ্ছি। নিচে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমরা রিকশার অপেক্ষা করছি, এর মধ্যে এলেন ঔপন্যাসিক ও গল্পলেখক শাহীন আখতার আর ফিল্ম মেকার অঞ্জনদা–জাহিদুর রহিম অঞ্জন। জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কোথায় যাও? বললাম, আল মাহমুদের বাসায়। ওনারা আমাদের সঙ্গে যেতে চাইলেন। আমি বললাম, চলুন।

আমরা রিকশা খুঁজছি, এর মধ্যে কবি কামরুল হাসান আমাকে ফোন দিলেন। জানতে চাইলেন, আমি কোথায়। বললাম, কবি জয় গোস্বামীকে নিয়ে আল মাহমুদের বাড়ি যাচ্ছি। তিনি বললেন, তিনিও যেতে চান।

আমি-জয়দা এক রিকশায়, অন্য রিকশায় শাহিন আপা-অঞ্জন দা। আর এক রিকশায় কামরুল হাসান। আমাদের রিকশাকেও ফলো করছে পিছনের দুই রিকশা। রাস্তায় জয়দার সঙ্গে অনেক কথা হলো। ঢাকার কবিরা কে কোথায় আড্ডা মারে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম আগেও ঢাকায় এসেছেন কিনা। এর মধ্যে বললেন, ইফতি, ব্রাত্য রাইসুকে কীভাবে পাবো? আমি বললাম, আজ না কাল। উনি বললেন, কাল। আমি বললাম, ফোন দিবো। ওঁর সাথে আমার যোগাযোগ আছে। বললেন, এই দু'জন মানুষের সাথে আমি দেখা করতে চাই। তা না হলে বাংলাদেশে আসাটা সার্থক হবে না।

আমরা মাহমুদ ভাইয়ের বাড়ির সামনে এসে গেলাম। সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করলাম মাহমুদ ভাই আছেন কিনা। বললো আছে। উপরে উঠে মাহমুদ ভাইকে ডাকলাম। মাহমুদ ভাইয়ের নাতনি দরজা খুলে দিল। ভেতরে বসলাম। বললাম, বলো ইফতি কবি জয় গোস্বামীকে নিয়ে এসেছে দেখা করতে। মাহমুদ ভাই আসতেই জয়দা তার পা ছুঁয়ে সালাম করলেন। বললেন, আপনি আল মাহমুদ! একের পর এক মাহমুদ ভাইয়ের কবিতার লাইন আওড়াচ্ছিলেন জয় গোস্বামী। বলছিলেন, আপনার সাথে দেখা করতে পেরে আমি ধন্য।

আল মাহমুদেরও জয়ের কবিতা পছন্দ, জানালেন। মাহমুদ ভাই জয়কে ধরে বুকে তুলে নিলেন। তারপর সোফায় গিয়ে বসলেন। এক কবি অন্য কবির কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। কবিতার জীবন, ব্যক্তিগত জীবন, দাম্পত্য জীবন ইত্যাদি ইত্যাদি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের গল্প হলো। জয়ের দেখা শক্তির গল্প হলো। আল মাহমুদ তার বন্ধু শক্তির স্মৃতিচারণ করলেন। কামরুল হাসান, শাহীন আপা, অঞ্জন দাও কবিতা বিষয়ে অনেক কথা বললেন। জয়ের কবিতা পেলেই আল মাহমুদ তা পড়েন জানালেন। বললেন, জয় নিশ্চয়ই বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিমান কবি। জয়ও মাহমুদ ভাইয়ের সোনালী কাবিন-এর সনেটগুলো বাংলা কবিতায় মাইল ফলক হয়ে থাকবে বলে জানালেন। আরও জানালেন জীবনানন্দ দাসের পর আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যের অনেক বড় কবি।

জয় সম্বন্ধে একটু না বললেই নয়। দুই কবির প্রথম সাক্ষাত। জয় কখনো দাঁড়িয়ে কখনো বসে হাত-পা নেড়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে কথা বলেন। চিনি ছাড়া রঙ চায়ে চুমুক দিতে দিতে উঠে লাফ দিয়ে আল মাহমুদকে বলেন, 'কী সব লিখেছেন! বাহ বাহ!!'

জয়দার পড়াশোনা কতটুকু পর্যন্ত হয়েছে জিজ্ঞেস করলেন আল মাহমুদ। জয়দা উত্তর দিলেন এগারো ক্লাস পর্যন্ত পড়েছেন। ব্যক্তিগত জীবন জানতে চাইলে জয়দা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লেন। প্রথমে বললেন তার মেয়ের কথা। ভীষণ ভালোবাসেন মেয়ে বুকুনকে। বললেন, বুকুন তার মেয়ে ঠিক, কিন্তু তিনি তার জন্মদাতা নন। 'ও আমার স্ত্রী কাবেরীর প্রথম ঘরের সন্তান। কাবেরীকে আমি যখন বিয়ে করি তখন বুকুনের বয়স তিন বছর।' বুকুনের কারণে তিনি নিজে আর কোনো সন্তান নেননি। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জয় তার স্বভাবসুলভ তুলনা দিলেন–এক সময় তিনি খুব বেড়ালের বাচ্চা পছন্দ করতেন। কোথাও বেড়ালের বাচ্চা পড়ে থাকলে তা তুলে বুকে জড়িয়ে নিজের ঘরে নিয়ে আসতেন। যত্ন করে পালতেন। বুকুন তার ঘরে আসার পর ওকে নিয়ে এমনই মগ্ন হলেন যে, কোথাও বেড়ালের বাচ্চা পড়ে আছে, কাঁদছে, তা তার আর কানেই আসতো না।

জয় জানালেন, যাদের তিনি প্রচণ্ড ভালবাসেন তারা কেউ তাঁর কবিতা পড়ে না, লেখালেখিতে কোনো উৎসাহ দেয় না। বললেন, তিনি নিঃসঙ্গ, পরিবারের কেউ তার কবিতার সঙ্গী নয়। নিজের কষ্টের কথাও বললেন। সহজ স্বীকারোক্তি দিলেন, এক সময় প্রচণ্ড অভাবের সাথে সংগ্রাম করেছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুধ বিক্রি করেছেন। না খেয়ে থেকেছেন। আল মাহমুদও জীবনে অনেক সংগ্রাম করেছেন জানালেন।

দুই কবি একই সোফায় পাশাপাশি বসে ছিলেন। রাত বাড়ছে। আমরা বিদায় নিতে চাই। আল মাহমুদ বললেন জয়কে, 'তুমি আবার এসো। আছো তো কদিন, তোমার স্ত্রীকে নিয়ে এসো। আমি তো কোথাও যাই না, চোখেও কম দেখি। তুমি আমার বাড়িতে এসেছ, আমি অনেক খুশি হয়েছি। ইফতিকেও অনেক ধন্যবাদ।' এর পর আমরা বিদায় নিলাম। নেমে বিদায় নিলেন শাহীন আপা ও অঞ্জনদা। আমি কবি কামরুল হাসান আর জয়দা রাস্তায় হাঁটছি।


কবি কামরুল হাসানের সঙ্গে গুলশান-এ রাস্তা হাঁটছেন জয় গোস্বামী
……..
গুলশান এক নম্বর থেকে দুয়ের সেন্টার পয়েন্ট হোটেলে যাবো, রিকশা পাচ্ছি না। পরে লোকাল বাসে উঠে গেলাম তিনজন। গল্প করতে করতে নামলাম গুলশান দুয়ে। হোটেলে গেলাম হেঁটে হেঁটে। জয়দার রুমে ঢুকলাম। কবি মারুফ রায়হানের আসার কথা ছিল। তিনি আমাদের সঙ্গে আড্ডায় বসলেন। বললেন, আল মাহমুদের বাড়িতে গিয়েছেন? জয়দাও আনন্দের সঙ্গে জানালেন, 'হ্যাঁ, ইফতি, আমি আর কামরুল ভাই মাত্র ওখান থেকে এলাম।'

কথা বলতে বলতে রাত অনেক হলো। আমি উঠতে চাইলাম। জয়দা বললেন, ইফতি কাল একটু আজিজ মার্কেট যাবো। বললাম, ঠিক আছে, আমি যাই, কাল দেখা হবে।

২.
পরদিন নভেম্বরের চার তারিখে সকাল এগারোটায় গেলাম সেন্টার পয়েন্ট হোটেলে, জয় দার ঘরে। দেখি জয়দা ইন্টারভিউ দিচ্ছেন নিউ এইজ পত্রিকার আনিস ভাইকে। ইন্টারভিউ শেষে আমরা সিএনজি করে রওনা হলাম আজিজ মার্কেটের দিকে। নেমে ঢুকলাম বইয়ের দোকান বইপত্র-তে। ওখান থেকে লিটল ম্যাগ ও তরুণ কবিদের বই কিনতে চাইলের জয়দা। সোহেল হাসান গালিব, মাদল হাসান, রাদ আহমেদসহ শূন্য দশকের অনেকের বই কিনে দিলাম তাকে। তারপর তক্ষশীলা গেলাম। অনেকে জয়দার সাথে কুশল বিনিময় করলেন। কেউ কেউ বই কিনে অটোগ্রাফ নিলেন কবি জয় গোস্বামীর। তারপর দোতলায় উঠতে উঠতে রাইসুকে ফোনে চেষ্টা করলাম।

এরপর ঢুকলাম নালন্দা ক্যাফেতে। শূন্য দশকের কবিরা ছিল ওখানে। গালিব, মাদল ও অন্যরা ছিল। এ ছাড়া আশির দশকের প্রতিষ্ঠান বিরোধী গল্পলেখক সেলিম মোরশেদ, নব্বই দশকের কবি শামিম সিদ্দিকীসহ অনেকের সঙ্গে জয় গোস্বামীকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। এর মধ্যে ব্রাত্য উপস্থিত হলেন। কবি কামরুল হাসানও উপস্থিত হলেন আমাদের আড্ডায়। জয়দার সঙ্গে চলচ্চিত্র আন্দোলনের পথিকৃৎ মুহাম্মদ খসরু হাত মিলিয়ে কুশল বিনিময় করলেন। এলেন সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, মতি ভাই, মজনু শাহ।

এক সময় আমরা ফিরবার জন্য প্রস্তুত হলাম। আজিজ মার্কেট তখন বন্ধ হয়ে গেছে। পেছন থেকে ঘুরে বের হলাম। শূন্য দশকের কবিরা জয়দার সাথে পরদিন দেখা করতে যাবে, সে কথা আমাকে বলল। আমিও ওদের জন্য সময় নিলাম পরদিন ৬ তারিখ। ওরা এগারোটা বারোটায় আসবে। আমি শাহবাগ মোড় থেকে বিদায় নিলাম। কবি কামরুল হাসান আর ব্রাত্য রাইসু গেলেন জয়দাকে হোটেলে পৌঁছে দিতে। তারপর ওঁরা মাঝরাত পর্যন্ত ছিলেন হোটেলে, জানতে পারলাম। আমি শাহবাগে আড্ডা মেরে বাসায় ফিরলাম। রাতে জয়দার সাথে ফোনে কথা হলো। জানালেন, রাইসু আর জয়দা আল মাহমুদের বাসায় যাবেন ইন্টারভিউ নিতে।

৩.
নভেম্বরের পাঁচ তারিখে বারোটার দিকে জয়দার হোটেলে গেলাম। ঢুকতেই জয়দা বললেন, 'তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি। অনেক লোকজন আসে ইন্টারভিউ নিতে কিন্তু আমি ইন্টারভিউ দিতে চাই না।' কেউ দেখা করতে চাইলে আমাকে বলতেন, দেখা করবো? আমি বলতাম, আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছেন? উনি বলতেন, তুমি যা বলবে আমি তাই করবো। আমি বলতাম, এটা কোনো কথা। আপনার সাথে দেখা করতে আসলে কেন দেখা করবেন না। বললেন, একজন নিচে বসে আছেন শরিফা বুলবুল। দেখা করতে চান, ইন্টারভিউ নিতে চান, অনেকক্ষণ বসে আছেন, কী করবো বলো? আমি বললাম, ইন্টারভিউ নিতে এসেছেন তাহলে দিয়ে দেন, বসিয়ে রাখা ঠিক হবে না। শরীফা বুলবুল এসে ইন্টারভিউ নিলেন। উনি চলে যাবার পর জয় বললেন, শাহরিয়ার ফোন করেছিল। একা দেখা করতে চেয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'আমি কি চলে যাবো?' বললেন, 'না তুমি থাকো।' কবি আবু হাসান শাহরিয়ার এলেন। আমাকে দেখে একটু অবাক। আমি বললাম, 'জয়দা আমি নিচে আছি, আপনারা থাকেন।' শাহরিয়ার ভাই বললেন, 'ইফতি তুমি থাকো।' আমি থাকলাম। এর মধ্যে নজিব তারেক এলেন। শিল্পী নজিব তারেক টি শার্টে প্রথম কবিতার কাগজ এর কিছু টি শার্ট জয় গোস্বামীর জন্য এনেছেন। আমি বাইরে বেরিয়ে গেলাম। ওরা তখন কথা বলছেন ভিতরে। কিছুক্ষণ পর ওনারা চলে গেলেন। দুপুর হয়ে গেছে। জয়দা বললেন, চলো ইফতি খেতে যাই। খেয়ে আমরা যাবো পাবলিক লাইব্রেরীতে। ওখানে একটা গানের সেশন আছে। ওটা শেষ করে ধানমণ্ডি ওমনি বুকস-এ গিয়ে আমি কবিতা পড়বো।

৪.
আমি আগের দিন জয়দাকে বলেছিলাম এক জায়গায় নিয়ে যাবো। জয়দা বললেন, ওমনি বুকসের প্রোগ্রাম শেষে আমরা যাবো। তুমি যেখানে বলবে আমি যাবো। খেয়ে আমরা পাবলিক লাইব্রেরীর দিকে রওনা হলাম। আমি জয়দা কাবেরী বৌদি আর সুদীপ সেন।

পাবলিক লাইব্রেরী পৌঁছে গেলাম। সেখানে দেখা হলো অনেকের সাথে। চা খাব বলে ঢুকেছি লাইব্রেরী ক্যান্টিনে দেখি কবি সৈয়দ শামসুল হক ও আনোয়ারা সৈয়দ হক। ওঁরা আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। চা খেতে খেতে অনেকক্ষণ আড্ডা হলো। সৈয়দ হক তার বই দিলেন জয়কে। আনোয়ারা সৈয়দ হক কথা বললেন। অনেক আড্ডা শেষে ঢুকে পড়লাম লাইব্রেরী অডিটরিয়ামে। গান শুনলাম ইন্ডিয়ান দুই গায়িকার। জয়দা অবশ্য পথে বলেছিলেন ওরা খুব ভাল গায়। গান শেষে আমি আর জয়দা ওমনি বুকসের দিকে রওনা হলাম। পথে আমাদের সাথে দেখা হলো কবি সাখাওয়াত টিপু ও সৈকত হাবিবের সঙ্গে। তারা আমাদের গাড়িতে উঠলেন। বললেন, জয়ের কবিতা শুনতে ওমনি বুকস যাচ্ছেন তারাও।

গাড়িতে সৈকত হাবিবের কথায় জয়দা একটু উত্তেজিত হলেন। আমরা ওমনি বুকসে পৌঁছে গেলাম। জয় গোস্বামীর দেরি দেখে তারা আগেই সেশন শুরু করে দিয়েছিলেন। অনেক লোকজন ওখানে উপস্থিত ছিলেন। আমরা গিয়ে দেখি কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন তার কবিতা পড়ছেন। এরপর জয় পড়বেন। ওখানে ছিলেন অদিতি ফাল্গুনীও। তিনি তার বই দিলেন জয়দাকে। জয়ের কবিতা পড়া শুরু হল। জয় ৫/৬টা কবিতা পড়লেন।


ধানমণ্ডির ওমনি বুকস-এ কবিতা পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন জয়।

ওখানে চা চক্র শেষ করে আমরা নিচে নামলাম। এরপর আমাদের গন্তব্য ইমতি ভাইয়ের বেগ আর্ট-এ। আগে থেকেই ইমতি ভাইকে বলা ছিল। আমরা তার অনুরোধেই ওখানে যাচ্ছি। জয় গোস্বামী ইমতি ভাইয়ের প্রিয় কবি। রিকশায় করে ধানমণ্ডি থেকে এলিফ্যান্ট রোডে বেগ আর্টে পৌঁছে গেলাম। ইমতি ভাইয়ের বাসায় ছিল টিংকু ও ওর পিচ্চি ছেলে। আর ইমতি ভাইয়ের প্রিয় কুকুর মতি। ওখানে অনেকক্ষণ আড্ডা হলো। জয়দা কোথাও কিছু খেতে চান না। একটা কথা না বললেই না। ভাত, ডাল সেদ্ধ আর আলু সেদ্ধ–এই হলো জয়দার খাবার। এর বাইরে উনি কোনো মাছ মাংস খান না। কোথাও গেলে বিস্কুট, চিনি ছাড়া লাল চা ।

ওই দিন কুকুর মতি খুব জ্বালাতন করেছে। কিছুতেই বিস্কুট খেতে দিচ্ছিল না জয়দাকে। বার বার তার কাছে গিয়ে তার গায়ে দুটি পা উঠিয়ে দিচ্ছিল। ওইখানে জয়দাকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিলাম। জয়দা তার নাটকীয় ভঙ্গিতে শক্তি কীভাবে কবিতা পড়তেন তা দেখালেন। একবার নাকি শক্তি এক মঞ্চে কবিতা পড়তে পড়তে শুয়ে পড়েছিলেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। ইমতি ভাইয়ের ওখান থেকে বিদায় নিয়ে আমরা ক্যাবে করে বেরিয়ে পড়লাম। আমি শাহবাগে নেমে গেলাম। জয়দা, কামরুল হাসান ও ব্রাত্য রাইসু যাবেন হোটেলে।

জয়দা আমাকে বললেন, ইফতি, কাল সকালে শূন্য দশকের কবিরা আসবে, তোমার মনে আছে তো? আমি বললাম, আছে। ওরা এগারোটা বারোটায় আসবে। আপনি আমাকে রাতে একটা ফোন দিয়েন।

রাতে জয়দা আমাকে ফোন করলেন। বললেন, তুমি যে ভাবে আমাকে এবার ঢাকা ঘুরালে আমার প্রিয় দুই কবির সাথে দেখা করিয়ে দিলে এটা আমার সারা জীবন মনে থাকবে। আর তুমি কবে কোলকাতা আসছো? আমি বললাম, যাবো, নিশ্চয়ই যাবো। আপনার কোলকাতায় আপনার সাথে ঘুরবো।

৫.
নভেম্বরের ৬ তারিখ। এ ক'দিন জয়দার কারণে আমি কোথাও যেতে পারি নাই। সব কাজ প্রায় বন্ধ করে জয়ের সাথে সময় কাটিয়েছি। জয়ের কথা, কবিতা, চিন্তা ও দর্শন শুনে এক ধরনের বিশ্লেষণ তৈরি করেছি জয়ের।

যাই হোক, ১২টার দিকে হোটেলে গেলাম। জয়দা অপেক্ষায় ছিলেন। আমার কবিতা লেখা নিয়ে কথা হলো। আমার একটা কবিতার লাইন জয়ের ভাল লেগেছে। যেহেতু আমার কবিতার বই নেই, তাই তিনি বললেন, ছাপা কবিতাগুলো তাকে আমি যেন দেই। তিনি আমার কবিতা পড়বেন। আমি ভোরের কাগজ-এ ছাপা আমার কবিতা সিরিজের একগুচ্ছ কবিতা ও আমার আগে হয়ে যাওয়া ফটো এক্সিবিশনের ব্রোশিওর নিয়ে গেলাম। মুদ্রিত কবিতাগুলো পড়লেন। শূন্য দশকের কবিদের কথা বললেন। বললেন, গালিব ও মাদলের কবিতা পড়ে ভাল লেগেছে। এর মধ্যে নিচ থেকে ফোন এলো। শূন্য দশকের কবিরা সবাই এসেছে। তারা সবাই একে একে ঢুকলো। জয়ের সঙ্গে কথা হলো। মাদল একটু রাজনীতি নিয়ে জয়দাকে চটানোর চেষ্টা করলো। জয়দাও কৌশলে তাকে এড়িয়ে গেলেন।

কিছুক্ষণ পরে মারুফ রায়হান ঢুকলেন। কারণ বিকেলে শেরাটনে মারুফ ভাই একটি কবিতা পাঠের আয়োজন করেছেন জয়দাকে নিয়ে। শূন্য দশকের কবিরা বিদায় নিতে আমরা দুপুরের খাওয়া খেয়ে রওনা হলাম। মারুফ রায়হান, আমি আর জয়দা। পথে জয়দা বললেন, জানো ইফতি, একটা মেয়ে ওই দিন পাবলিক লাইব্রেরীতে আমার সামনে এসে বলল, আপনি কবি জয় গোস্বামী? আমি বললাম, হ্যাঁ। ও বললো, আমি আপনার মেঘবালিকা। আপনি আমার মাথায় একটু হাত রাখবেন? আমি ওর মাথায় হাত রাখলাম। ও বলল, আপনি কোথায় উঠেছেন? আমি বললাম, গুলশান সেন্টার পয়েন্ট হোটেলে। ওই মেয়েটা ওর ফোন নাম্বার দিয়েছে। ও দেখা করতে চায়। কাল নাকি অনেকক্ষণ হোটেলে বসে ছিল।

আমি বললাম দেখা করেন। এই সব নিয়ে গাড়িতে যেতে যেতে বেশ ঠাট্টা করলাম মারুফ ভাই আর আমি। শেরাটনে পৌঁছে গেছি ফিনান্স ম্যানেজারের রুমে। গিয়ে দেখি কেউ আসেনি। আমরা বসলাম। একে একে সবাই এলো। মারুফ রায়হান জানালেন টোকন ঠাকুর আসবেন, আমি তাকে ফোন করলাম। কী একটা কারণে টোকন এলেন না। জয়দার সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। জয়দা অনেক বার টোকনকে আসতে বলা সত্ত্বেও টোকন রাজি হলেন না। রাইসু, মানস চৌধুরী, আয়েশা ঝর্না, সাখাওয়াত টিপু, আশিক মোস্তফা, ফারুক মাহমুদ, শেলী নাজ, কামরুল হাসান, বিন্তি আরও পরে এলো আফরোজা সোমা। ও রেডিও টুডের আউটডোর ব্রডকাস্টার ও কবি। সবাই কবিতা পড়লো। আমিও কবিতা পড়লাম। শুধু মানস কবিতা পড়লেন না। জয়দাও ৪/৫টা কবিতা পরলেন। আড্ডা শেষে মারুফ রায়হান, রাইসু, মানস আর জয় গোস্বামী চলে গেলেন সোমার সঙ্গে রেডিও টুডের গাড়িতে। আমি চলে গেলাম শাহবাগে। রাতে জয়ের হোটেলে যাবো, বললাম।

পরে শুনলাম সোমা মহাখালি ফ্লাইওভারে দাঁড়িয়ে জয়ের লাইভ ইন্টারভিউ করেছে। শাহবাগে আড্ডা শেষে জয়দার হোটেলে যাচ্ছি। আমার ফোন এলো। অপর প্রান্তে মেহেরীন (গায়িকা) বললেন, ইফতি ভাই আমি একটু জয় গোস্বামীর সাথে দেখা করতে চাই। আমি বললাম, গুলশান দুইয়ে আসেন। ওঁরা পরে এলেন জয়দার সাথে দেখা করতে। ওঁদের দেখা হলো। দেখা হল ওখানে আসলাম সানির সাথে (ছড়ালেখক)। নবনীতা দেবসেনের সাথে কিছুক্ষণ কথা হলো আমার। তারপর কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে বিদায় নিলাম।

৬.
সাত তারিখ সকালে জয়দা আর রাইসু আল মাহমুদের ইন্টারভিউ নিতে যাবেন। আগের রাতে জয়দা আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, আমি যাবো কিনা? আমি যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু ঘুমের কারণে যেতে পারলাম না। দুপুরে জয়দার হোটেলে গেলাম। রাইসু আর জয়দা দুজন আছে। জিজ্ঞেস করলাম, মাহমুদ ভাইয়ের সাথে ইন্টারভিউ কেমন হলো? রাইসু বললেন, 'ভালো, আপনি তো আইলেন না!' আমি বললাম, 'ঘুম।'

জয় আজ চলে যাবে। এ ক'দিনে আমার জয়কে বেশ আপন আপন লাগছে। জয় আমাকে বললেন, তোমাকে খুব মিস করবো। আমিও বললাম, আপনি চলে গেলে আমিও আপনাকে বেশ কদিন মিস করবো। তারপর হয়তো আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এর মধ্যেই মাহবুব লীলেন ঢুকলেন, জয়ের সঙ্গে কথা হলো। উনি মোবাইল ফোনে ছবি তুললেন জয়ের।

জয়দার সব ব্যাগপত্র গুছিয়ে দিলাম আমি। এর মধ্যেই কবি রাদ আহমেদ এলেন। হাই হ্যালো ছাড়া খুব একটা কথা হলো না জয়দার সাথে। ওঁ বিদায় নিলো। রাইসু তার আগেই চলে গেছেন। সব কিছু নিচে নামানো হয়ে গেছে। জয়দা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, বললেন, কোলকাতায় এসো। আমি বললাম, 'ভুলে যাবেন আমায়?' উনি বললেন, 'না।' নিচে নেমে এলাম। বেলাল চৌধুরী, রবিউল হুসাইন নিচে ছিলেন। কারণ সুনীলদাও একই সাথে যাচ্ছেন এয়ারপোর্টে। ওদেরকে গাড়িতে তুলে দিয়ে বিদায় নিলাম।

৭.
জয় চলে যাওয়ার পর আমার একটু খারাপ লাগলো। মনে হলো কে যেন আমার কাছ থেকে চলে গেছে।

আজিজ মার্কেটে এসে বসে বসে একা একা চা সিগারেট খাচ্ছি। মন একটু খারাপ। দেখি এক কোনায় রফিক ভাই বসে আছেন–কবি রফিক আজাদ। রফিক ভাইয়ের সাথে বসলাম। তার শরীরের খবরাখবর নিলাম। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে সিগারেট খেলাম। তারপর একটা ক্যাব নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। রাতে জয়দাকে ফোন করলাম। জয়দা ফোন পেয়ে খুশি হলেন। বললেন, 'ইফতি তোমাকে খুব মিস করছি। কোলকাতায় আসো।' আমি বললাম, 'জয়দা, আপনাকেও আমি খুব মিস করছি।'

জয়দা বললেন, 'আমি আবার ঢাকায় আসবো তোমার কাছে।' আমি বললাম, 'নিশ্চয়ই।'

ঢাকা, ২২/১২/২০০৭

ছবি ও স্লাইড শো: ইফতেখার ওয়াহিদ ইফতি