শুধু দেহ লুপ্ত হয়

fauzia_khan
Published : 19 Jan 2008, 07:33 AM
Updated : 19 Jan 2008, 07:33 AM

২০০১ সাল থেকে আমি বাংলা নাটকের অভিনয়রীতি এবং সেই রীতির

………
ধামরাইয়ে শিমূলের বাড়িতে, পুকুরে ছিপ ফেলেছেন সেলিম আল দীন
……..
ভেতরে অভিনেত্রী শিমূল ইউসুফের বিচরণ বিষয়ক গঠিত হই শূন্যে মিলাই-এর চিত্র ধারণ এবং গবেষণার কাজ করছিলাম।

২০০৭ সালে শরতের কোনো একদিন, ধামরাইয়ে 'শিমূলেরবাড়ি'তে (অভিনয়শিল্পী শিমূল ইউসুফ-এর নামে এলাকার নাম 'শিমূলেরবাড়ি' হয়েছে। গ্রামে ঢোকার মুখেই সাইনবোর্ডে বেশ বড় করেই লেখা 'শিমূলেরবাড়ি') ওই ছবিরই শ্যুটিং-এর কাজে নাসির উদ্দীন ইউসুফ, শিমূল ইউসুফ এবং সেলিম আল দীন আসবেন। নিমজ্জন নাটকটি তাঁরা পাঠ করবেন। ঢাকা থিয়েটারের সাম্প্রতিক প্রযোজনা নিমজ্জন তখনো মঞ্চায়িত হয়নি। প্রস্তুতি চলছে। তাঁদের একত্রিত পাঠ প্রামাণ্যচিত্র গঠিত হই শূন্যে মিলাই-এর জন্য ক্যামেরায় ধারণ করব।

গাছে ছাওয়া ছায়ায় ঢাকা বাড়িটিতে শুটিং ইউনিট নিয়ে আমি আগেই পৌঁছে গেছি। নাসির উদ্দীন ইউসুফ এবং শিমূল ইউসুফ আমাদের ঘুরে ঘুরে তাদের সযত্নে লালিত বাড়ির বাসিন্দা নানান গাছপালা, গরু, হাস-মুরগির সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। রৌদ্র-উজ্জ্বল শান্ত দুপুর। এমন সময় হই চই করতে করতে সেলিম আল দীন আসলেন। মুহূর্তে সরগরম হয়ে উঠল বাড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসুলভ ভাবগাম্ভীর্য নেই। প্রাণের স্ফূরণে টগবগ করছেন।

…….
শিমূলেরবাড়িতে, পুকুরঘাটে বন্ধু নাসির উদ্দীন ইউসুফের সঙ্গে।
……..
দীর্ঘদিনের বন্ধু, শিল্প সহযোগী শিমূল এবং নাসির উদ্দীন ইউসুফকে কাছে পেয়ে তাঁর আনন্দের সীমা নেই। তিনি লাফিয়ে আমগাছের ডাল ভেঙে গরুকে পাতা খাওয়ান। পরক্ষণেই লাফ দিয়ে অচেনা লতানো ফুল তুলে নিয়ে ঘ্রাণ নেন। আমাদের শুটিংয়ের প্রস্তুতি শেষ। কিন্তু সেলিম আল দীনকে খুঁজে খুঁজে পাই না। তিনি কোথায় কোন গাছ, গাছের ঝাড়, লতা-গুল্ম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। ডেকে যদিও বা এনে তাঁকে বসানো হলো তো আবার হাতের মুঠোফোন বেজে উঠল। তিনি দূরে কোনো গাছের ছায়ায় নিবিড়তর জায়গায় গিয়ে আমগ্ন কথা বলেন। আমরা আবারও ডাকি। তিনি এসে যোগ দেন শিমূল এবং নাসির উদ্দীনের সাথে। শ্যুটিং শুরু হলো। সেলিম আল দীন নিমজ্জন নাটক থেকে পাঠ করছেন। নিবিষ্ট মনে শুনছেন শিমূল। সেলিম আল দীনের পাঠ থেকে তিনি তাঁর অভিনয়ের দিকনির্দেশনা মনে মনে ঠিক করছেন। সুরের খেলাও তখন তার মনে গেঁথে যেতে থাকে। সেলিম কোন শব্দে কতটা জোর দেন, কোথায়, কোন চরিত্রের প্রতি তাঁর অধিকতর দুর্বলতা সেটা এই পাঠ থেকেই জেনে নেন শিমূল। অস্থির সেলিমও তখন নিমজ্জনে একেবারে ডুবে গেছেন। পাঠ শেষে দৃশ্যটি নিয়ে নাসির উদ্দীন ইউসুফ আলোচনা করেন। দৃশ্য পরিকল্পনার কথা তিনি জনে বিনিময় করেন। পাঠ থেকে বিচ্যুত হয়েই সেলিম আবার ছেলেমানুষী শুরু করেন। অস্থিরতার চূড়ান্ত। তাঁর অস্থির ছেলেমানুষীর মধ্য দিয়ে আমি অসম্ভব এক প্রাণবন্ত সেলিম আল দীনকে জানতে শুরু করি। ফাঁকে ফাঁকে চলে গঠিত হই শূন্যে মিলাই-এর দৃশ্য ধারণ।

শিশুর মতো সরল সেলিম আল দীনকে এত কাছ থেকে দেখা সেই প্রথম। যদিও ১৯৯৮ সাল থেকেই পরিচয় তাঁর সাথে। কখনো কোথাও সৌজন্য বিনিময়। তখনো সেলিম আল দীনকে বিশেষ কেউ বলে চিনে উঠিনি।

১৯৯৯ সাল। মহিলা সমিতির মঞ্চে ঢাকা থিয়েটার প্রযোজিত বনপাংশুল নাটকটি দেখি। অঙ্কবিভাগ সম্বন্ধীয় কোনো আঙ্গিক বনপাংশুলে ছিল না। প্রায় সাড়ে তিনঘণ্টার বনপাংশুল আমাকে তাই রীতিমত বিস্মিত করেছিল তখন। সাহিত্যের শিক্ষার্থী হিসেবে নাটকের আঙ্গিক বলতে যা জানতাম এই নাটকটি তার চেয়ে আলাদা। এই আলাদা বৈশিষ্ট্য যে একেবারে অচেনা–তাও কিন্তু নয়। গান, নৃত্য, সংলাপ, দেহভঙ্গিমা, বর্ণনা–সব কিছুর সম্মিলনে আমাদের আজন্ম চেনা কাহিনী বর্ণনার এক অনিন্দ্যসুন্দর রূপকল্প বনপাংশুল। মঞ্চ পরিকল্পনায়ও ছিল অভিনবত্ব। দর্শকেরা তিনদিকে বসতেন। মধ্যবর্তী জায়গাটুকুতে দর্শকের সম উচ্চতায় শিল্পীরা অভিনয় করেন। এ যেন ছোটবেলায় গ্রামের বাড়ির উঠানে বসে দেখা সেই মেঘবন্দনা। খরার দিনে গীত গেয়ে বৃষ্টির আগমন প্রার্থনা করার দৃশ্য। নাটকটির আঙ্গিকশৈলির এই বিন্যাস এবং উপস্থাপনার চমৎকারিত্ব আমাকে ঢাকা থিয়েটারে আগ্রহী করে তোলে। তবে শিমূল ইউসুফই আমাকে তখন বেশি আকৃষ্ট করেছিলেন। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার নাটকটিতে তিনি প্রায় পুরু সময়টাই মঞ্চে অভিনয় করেন। গান, নৃত্য, সংলাপ, দেহভঙ্গিমা–সবমিলিয়ে তাঁর বর্ণনাত্মক অভিনয় কর্মের প্রতি আমার আগ্রহ হয় প্রবল। এই আগ্রহ থেকেই আমি গঠিত হই শূন্যে মিলাই-এর নির্মাণ শুরু করি।


শিমূলেরবাড়িতে, নিমজ্জন থেকে পাঠ করছেন সেলিম আল দীন, শুনছেন শিমূল ইউসুফ ও নাসির উদ্দীন ইউসুফ

২০০১ থেকে ২০০৭। এই দীর্ঘ সময় ধরে গঠিত হই শূন্যে মিলাই-এর কাজ করতে করতেই আমার পরিচয় ঘটে সেলিম আল দীন, নাসির উদ্দীন ইউসুফ এবং শিমূল ইউসুফ-এর নাট্যচিন্তার সাথে। তাঁদের সাহচর্যে আমি হাজার বছরের বাংলা নাটকের প্রবহমানতাকে নতুন করে চিনতে শিখি। জাতীয় নাট্য আঙ্গিক বিনির্মাণে তাঁদের প্রয়াস জানতে পারার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য পাঠ করা আমি বাংলা নাটকের ঐতিহ্য নতুন করে উপলব্ধি করি। ঢাকা থিয়েটার চর্চিত জাতীয় নাট্য আঙ্গিক বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠি। এই কৌতূহল থেকেই সেলিম আল দীন এবং নাসির উদ্দীন ইউসুফের সাথে একত্রে কথা বলার কথা ভাবি। আমাদের সম্মিলিত সময় হচ্ছিল না। ধামরাইয়ে শিমূলের বাড়িতে গঠিত হই শূন্যে মিলাই-এর শুটিং আমাদের সেই সুযোগ করে দেয়।

সেদিন, শরতের সেই উজ্জ্বল নীল আকাশে সাদা মেঘের নিচে, সবুজ গাছে ঢাকা শান্ত বাড়িতে বসে আমরা কথা বলি। বিষয় ঢাকা থিয়েটার, তাঁদের নাটকের চর্চা এবং সেই চর্চায় কেমন করে আজীবন দুজন একত্রে কাজ করে চলেছেন। আমরা একত্রে গাছতলায় বসে কথা শুরু করি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে শরীফ মিঞার কেন্টিন তাঁদের আড্ডার জায়গা ছিল। নাসির উদ্দীন কোনো বাক্য শুরু করেন তো সেলিম সেটা সম্পন্ন করেন। এভাবেই তাঁদের দুজনের কথাবার্তার মধ্য দিয়ে জেনে নেই মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে ওই প্রজন্মের কয়েকজন যুবকের সৃষ্টির উল্লাসে উদ্দাম কিছু সময়ের কথা। সদ্য যুদ্ধ জয় করে এসে তাদের প্রাণে তখন সৃজনের গান। কিন্তু সেলিম আল দীন বেশিক্ষণ এক জায়গায় স্থির থাকতে পারেন না। তিনি তখন প্রাণের স্ফূরণে টগবগ করছেন এবং ছুটে বেড়াচ্ছেন এখানে-সেখানে। এ-গাছের তলায়, ও-গাছের ঝাড়ে কিংবা লাল গাভীটির কাছে। ডেকে ডেকে তাঁকে কাছে নিয়ে আসি। তিনি যখন কথা শুরু করেন, আমি প্রচ- আত্মবিশ্বাসী ইতিহাস-জানা এক সেলিম আল দীনকে আবিষ্কার করতে শুরু করি। স্বভূমির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইতিহাসের অনুগত ছাত্র সেলিম তাঁর সাংস্কৃতিক দর্শনের পথ খুঁজে নেন ইতিহাসের পাতা খুঁড়ে। ইউরোপীয় নাট্যচিন্তার দাসত্ব ছেড়ে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন থেকে আমাদের নিজস্ব নাটকের হাজার বছর ধরে প্রবহমান ধারাকেই বেগবান করার যুক্তি তিনি আমাকে বলতে থাকেন অনর্গল–অসম্ভব প্রত্যয়ের সাথে। তাঁর এই প্রত্যয় আমাকে অনুপ্রাণিত করে এবং একই সাথে বাঙালির স্বর্ণালি ইতিহাসের সাথেও পরিচিত করে। ইতিহাস এবং ঐতিহ্য থেকে প্রয়োজনীয় উপাদান আহরণ করার যে শ্রম তিনি করেছেন তা দেখে আমি ধন্য হই। বহুদিন পর একজন মানুষকে আমার যথার্থ শিক্ষিত এবং সৃজনশীল মনে হয়। ইতিহাস-ঐতিহ্যের উপাদান তিনি কেবল তথ্য হিসেবেই গ্রহণ করেন না, বরং সেই উপাদান সৃজনশীল উপায়ে তাঁর লেখায় ব্যবহার করেন। তাঁর লেখনীতে তাই উঠে আসে বাংলাদেশের নানান জনপদের, নানান জনগোষ্ঠির মানুষ, তাদের জীবন, স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের মধ্য দিয়েও প্রতিদিন নতুন করে বেঁচে ওঠার কথা। একই সাথে অতি প্রাণবানভাবে উঠে আসে এই মানুষগুলো যে ভূমিতে বসবাস করে তার ভূগোল। কেবল মানুষই নয়, তার চারপাশের জীববৈচিত্র্য, ফুল-বৃক্ষ-লতা-গুল্ম–সকলের যে সামগ্রিক সংবেদনশীল জীবন আমাদের এই ব্রহ্মাণ্ডে তার প্রবহমানতার ছবি এক অনন্য শৈলীতে উঠে এসেছে সেলিম আল দীনের লেখনীতে। তাঁর সাথে কথোপকথনে তিনি অবিরল আত্মপ্রত্যয়ের সাথে আমাকে শোনাতে থাকেন তাঁর বিষয় এবং শৈলীর উৎস এবং একই সাথে তার প্রবহমানতার কথা।

শিমূলেরবাড়ির সেই কথোপকথন থেকে আবারও একটু পেছন ফিরে যেতে চাই। কবে থেকে শুরু হলো সেলিম আল দীনের সাথে কথা বলা? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে আরো পেছনে যেতে হয়। গঠিত হই শূন্যে মিলাই-র জন্য শিমূল ইউসুফ-এর সাক্ষাৎকার ভিডিওতে ধারণ করেছিলাম। ছয়/সাত ঘণ্টার দীর্ঘ সে সাক্ষাৎকার ট্রান্সক্রাইব করার পর বেশ সমৃদ্ধ মনে হলো। আমার প্রামাণ্যচিত্রে এত লম্বা সাক্ষাৎকার জায়গা দেয়া সম্ভব হবে না ভেবে এটি ছাপানোর কথা ভাবলাম। ২০০৬ সালে সাহিত্য বিষয়ক ছোট কাগজ উলুখাগড়ার একটি সংখ্যায় সেটি ছাপা হয়। পাঠকদের ইতিবাচক সাড়া পাওয়ায় ২০০৭ সালের একুশের বইমেলায় সাহিত্য বিলাস থেকে আমি গঠিত হই শূন্যে মিলাই নামে সাক্ষাৎকারটি বই আকারে ছাপা হয়। এই বইয়ের ভূমিকা লিখে দেবার অনুরোধ জানিয়ে সেলিম আল দীনের কাছে পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছিলাম। সাক্ষাৎকারটি পাঠ করে উচ্ছ্বসিত হয়ে তিনি ছয় পৃষ্ঠার দীর্ঘ একটি রচনা লিখে পাঠান। সচরাচর বইয়ের ভূমিকায় যা লেখা হয় এই রচনাটি তা ছিল না। বরং তাঁর সেই লেখাটি আমার আর শিমূলের কথোপকথনের অকথিত তথ্য ও তত্ত্বের অভাব পূরণ করেছিল। বইটির নামও আমি নিয়েছিলাম তাঁর অতি উত্তম রচনা যৈবতী কন্যার মন থেকে। অভিনয় শিল্পের সারবত্তা এমন শৈল্পিক ও সুন্দরভাবে অন্য কেউ আর বাংলা ভাষায় প্রকাশ করেছেন কিনা তা আমার জানা নেই। একজন অভিনয় শিল্পীর সাথে কথোপকথন বিষয়ক বইয়ের জন্য তাই দ্বিতীয় কোনো নাম আমি আর ভাবতে পারিনি। পরে আমার প্রামাণ্যচিত্রটির নির্মাণ যখন শেষ হয় তখন তার নামও আমি 'প্রাচ্যনারী' বদল করে 'গঠিত হই শূন্যে মিলাই' রাখি।

সেটা কবে এখন আর স্পষ্ট মনে নেই। ২০০৭ সালেরই কোনো একদিন সেলিম আল দীন আমার স্বামী, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের কর্মী মোসাদ্দেক মিল্লাতকে ফোন করলেন। তিনি জানতেন আমি চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়াশোনা করেছি। মিল্লাতের সঙ্গে বিস্তৃত কথা বলে আমার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বিষয়ে জেনে নেন। কারণ তিনি তখন বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ আয়োজিত ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন বিষয়ক কর্মশালার উপদেষ্টা। তিনি চাইলেন ফিল্ম আর্কাইভে আমি সম্পাদনা বিষয়ে কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের পড়াই। এর আগে আরো দু'চার জায়গায় অল্প সময়ের জন্য আমি পড়িয়েছি। তবে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে আমি যেদিন ক্লাশ নিতে যাই দিনটি আমার বিশেষভাবে মনে আছে। শুক্রবার। সকাল ১০টা থেকে ক্লাশ হচ্ছে। আমার ক্লাশ বেলা আড়াইটা থেকে। আগের দিন রাতে সেলিম আল দীন আমাকে ফোনে জানালেন যে তিনি পরদিন আর্কাইভে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। সত্যিই পরদিন পৌঁছে দেখি মহাপরিচালকের কক্ষে তিনি অপেক্ষা করছেন। কিছুক্ষণ কথা বলে আমাকে বললেন, তুমি নরম গলায় কথা বলো, ক্লাশে মাইক ব্যবহার করবে। শিক্ষকতার আরো কিছু টিপস দিলেন। ক্লাশের সময় হলে তিনি আমাকে সাথে করে ক্লাশে নিয়ে গেলেন এবং ছাত্রদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার এমন বিশদ পরিচয় এর আগে আর কেউ কখনো অন্যকে দিয়েছেন বলে আমি দেখিনি। এবং অবাক হয়ে দেখলাম ২০০০ সালে তাঁর প্রাচ্য নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন হবার পর দৈনিক প্রথম আলোর সাময়িকী পাতায় আমি যে একটি লেখা লিখেছিলাম তাও তিনি ভোলেননি!

সেদিন ক্লাশ শেষ হলো। পরদিন সেলিম আল দীন ফোন করে জানালেন, তিনি আর্কাইভে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন আমি ভালো পড়িয়েছি। সুতরাং আমাকে আরো ক্লাশ নিতে হবে। ছাত্ররা ভালো বলেছিল কিনা জানি না। তবে তাঁরই আগ্রহে সম্পাদনা বিষয়ে আমি আরো কয়েকটি ক্লাশ বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে নিয়েছিলাম। পরে ফিল্ম আর্কাইভের সেই কোর্সটির উপদেষ্টা তিনি না থাকায় শিক্ষক হিসেবে আমারও আর ডাক পড়েনি!

বাংলা নাটকের সনাতন অভিনয়রীতি এবং রীতির ভেতরে শিমূল ইউসুফ-এর বিচরণ বিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র গঠিত হই শূন্যে মিলাই-এর নির্মাণ শেষ হবার পর অনুভব করি বাংলা নাটকের অভিনয় রীতি নিয়ে আমার কাজ সম্পূর্ণতা পাবে না–যদি না আমি সেলিম আল দীনকে নিয়ে আরো একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করি। কারণ বর্ণনাত্মক যে ধারায় ঢাকা থিয়েটারের নাট্যকর্মীরা অভিনয় করেন সেটি মূলত সেলিম আল দীনের ভাবনার ফসল।

আমি সচরাচর ঈদে কেনাকাটা করি না, কারোর জন্য উপহারও কিনি না। গেল রোজার ঈদে–২০০৭ সালের অক্টোবর মাস সম্ভবত–সেলিম আল দীন, তাঁর স্ত্রী পারুল, নাসির উদ্দীন ও শিমূল ইউসুফ-এর জন্য আমার উপহার কেনার ইচ্ছে হলো। আমি একটু হুজুগে মানুষ। যখন যেটা ইচ্ছে হয় তা পূরণ না হলে আমি অস্থিরতায় ভুগি। সুতরাং দেরি না করে তাঁদের চারজনের জন্য ঈদের কাপড় কিনলাম। বাঙালি মুসলমানের জন্য খুবই সাধারণ সনাতন উপহার। ঈদের দুদিন আগে আমি সেলিম আল দীনকে ফোন করলাম। জানতে চাইলাম তিনি সেদিন জাহাঙ্গীরনগরের বাসায় আছেন কিনা। আমার আগমনের হেতু শুনে নিয়ে বললেন, তিরিশ কিলোমিটার রাস্তার ভিড় ঠেলে উপহার দিতে যাওয়াটা খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হয়ে যাবে। আমি অবশ্য ইচ্ছেতাড়িত মানুষ। কাজেই বাস ধরে চলে গেলাম। বাড়িতে ঢুকতেই পারুল ভাবির সাথে দেখা। অদ্ভুত রকম ভাবে দেখলাম, আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ না থাকলেও তিনি নাটক নিয়ে আমার প্রকাশিত সব লেখা পড়েছেন। পরে কথা বলতে বলতে জানতে পারলাম, তিনি সেলিম আল দীনের একটা সামান্য চিরকুটও তাঁর সংগ্রহে রেখে দিয়েছেন। কাজেই নাটক নিয়ে আমার লেখাগুলোও তিনি পড়েছেন এবং সযত্নে রেখে দিয়েছেন। তখনও সেলিম আল দীনের সাথে দেখা হয়নি। তিনি তখন ভেতরের বারান্দায় নাপিতের হাতে চুল কাটছেন। চুল কাটা শেষ হলে ভেতরে এসে আমাকে দেখে উচ্ছ্বসিত হলেন। এখানেও, আবারও, সেই প্রাণদীপ্ত অস্থির ভাবাবেগে পূর্ণ সেলিম আল দীনকে দেখলাম। ভেতরে আমি যখন ভাবির সাথে নানান বিষয়ে কথা বলছি তিনি তখন ডায়নিং টেবিলে বসে দিনলিপি লিখছেন আর ঘুরে ঘুরে আমাদের কথোপকথনে এসে যোগ দিচ্ছেন। ভাবি আমাকে হুতাশনে ভরা দাম্পত্যের কথা শুনাতে থাকেন। মনের বিষাদ তাঁর শরীরেও দাগ ফেলেছে। ভূমিষ্ট হবার আগেই যে সন্তান তাঁদের মারা গিয়েছিল তার শূন্যতা তো আর পূর্ণ হয়নি। এই অপূর্ণতার জন্য পারুল ভাবি পুরোপুরি তাঁর স্বামীকে দোষেন। কারণ তিনি শত চেষ্টা করেও সেলিম আল দীনকে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে পারেননি। তিনি মনে করেন সন্তানহীন শূন্য জীবনের জন্যে সেলিম আল দীনই দায়ী। ভাবির কথা যখন শুনছি আমি তখন মানুষে মানুষে যোগাযোগহীনতার কথা মনে মনে ভাবছি। দুজন মানুষ একত্রে এক ছাদের নিচে বসবাস করেও কত দূরের হয়ে যান! নিষ্ফলা দাম্পত্যের এমন দীর্ণ চিত্র আমাকে ব্যথিত করে। আবারও ঘুরে এসে যোগ দেন সেলিম আল দীন। তিনি আমাকে গাছপাকা সাগর কলা খেতে দেন। দুপুরে খেয়ে যেতে অনুরোধ করেন। তবে হঠাৎই সেলিম ভাই বললেন, অন্বিতাকে নিয়ে গাড়ি ঢাকায় যাবে, তুই-ও ওই গাড়িতেই ফিরে যা। অন্বিতা তাঁদের পালিত কন্যা। ভাবির বোনের মেয়ে। ওর বয়স নয়। গত পাঁচ বছর ধরে ক্যান্সারে ভুগছে। প্রবল পিতৃস্নেহে ফুটন্ত সেলিম আল দীন অন্বিতার চিকিৎসা তদারক করে চলেছেন তখনও। অন্বিতা ওর মা-বাবার সাথে পাশেই অন্য এক কোয়ার্টারে থাকে। অন্বিতাকে সেদিন ঢাকায় ধানমণ্ডিস্থ পপুলার হাসপাতালে কোনো টেস্ট করাবার জন্য নিয়ে যাওয়া হবে। সেলিম আল দীনের নিজস্ব বাহনে অন্বিতাকে নিয়ে ওর মা-বাবা পপুলারে যাবেন। আমিও তাই আর দেরি না করে ওদের সঙ্গী হই। সেলিম আল দীনের বাড়ি থেকে বেরুবার মুখে তাঁর লেখা ডায়েরির কিছু অংশ পড়ে শোনালেন। আমার যাওয়া ঘিরে বেশ কয়েকটি বাক্য তিনি লিখে ফেলেছেন ততক্ষণে! তাঁর সহকারি নোমানকে বললেন, পুত্র-র পাণ্ডুলিপি আমাকে প্রিন্ট করে দিতে। টেলিফিল্ম বানাবার জন্য তিনি পুত্র-র পাণ্ডুলিপি আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি তাঁকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে আমার আগ্রহের কথা জানালাম। তিনি সাগ্রহে সম্মতি জানালেন এবং বললেন, আমার বিশ্বাস তুই বানালেই এটা সবচেয়ে ভালো হয়।

আমার সঙ্গে তাঁর শেষ কথা হয় গত নভেম্বর মাসের সম্ভবত ২৫ তারিখ। আমি পরদিন শ্যুটিং করতে ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জের মুকসেদপুর যাব। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'মাসি পিসি' গল্প থেকে কাহিনী নিয়েছি। প্রথমবারের মতো ফিকশন শ্যুট করব। টেলিফোনে এই বার্তা শুনেই তিনি উচ্ছ্বসিত হলেন। ফিরে গেলেন স্মৃতিতে। মুকসেদপুরের বাটিকামারি। ওখানে বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের একটি শাখা আছে। কোনো উৎসব উপলক্ষে সেলিম আল দীন ঢাকা থেকে গ্রাম থিয়েটারের আরও কয়েকজন কর্মী নিয়ে সেখানে গিয়েছেন। ওখানে তাঁরা ছিলেন গ্রাম থিয়েটারের কর্মী রফিকের বাড়িতে। রফিকের মা লাউপাতা দিয়ে কৈ মাছের পাতুরি রান্না করেছিলেন। এটি ফরিদপুর অঞ্চলের অতি সুস্বাদু একটি রেসিপি। সেলিম আল দীন ওখানে একসাথে ১৮টি কৈ মাছ খাবার গল্প শোনালেন আমাকে। শুনে এ-পাশে আমি হাসি, ওপাশে উনিও আরও রসিয়ে রসিয়ে মাছ খাবার গল্প সবিস্তারে শোনান। আমি নিজস্ব অর্থায়নে 'মাসি পিসি'র চলচ্চিত্রায়ন করছি জেনে তিনি আশি হাজারের বেশি টাকা খরচ করতে বারণ করলেন। কারণ এক লাখের বেশি টাকায় আজকাল কোনো কিছু টেলিভিশনই নাকি কেনে না। দুঃখিত সেলিম ভাই, আমি আশি হাজারের মধ্যে 'মাসি পিসি'র নির্মাণ ব্যয় ধরে রাখতে পারিনি। একটু বেশিই খরচ করে ফেলেছি!


ঘাটলায় বসে সেলিম, ইউসুফ ও শিমূল

প্রিয় পাঠক, আবারও ফিরে যাই ২০০৭ সালে শিমূলেরবাড়িতে। সেদিন সেলিম আল দীন, নাসির উদ্দীন ইউসুফ এবং আমি–আমাদের মধ্যে বাংলাদেশের নাটক, ঢাকা থিয়েটারের নাট্যচিন্তা, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের প্রেরণা এবং চলচ্চিত্র বিষয়ে যেসব কথাবার্তা হয়েছিল, অডিও রেকর্ডারে তা ধারণ করেছিলাম। প্রায় পাঁচ ঘণ্টার সেই কথোপকথনও যে যথেষ্ট ছিল না সেটি বোঝা গেল ধারণ করা সাক্ষাৎকারটির শ্রুতিলিখন হবার পর। এই সাক্ষাৎকারটি আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে শিল্প ও সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা কালি ও কলম-এর বর্ষপূর্তি সংখ্যায় প্রকাশিত হবে। বেশ কিছু বিষয়ে আমার আরও কিছু জানার ছিল। এ-বছর জানুয়ারি মাসে কোরবানীর ঈদে ছুটি কাটাবার জন্য তিনি ফেনীতে তাঁর গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে আসার পর নাসির উদ্দীন ইউসুফের পুরানা পল্টনের বাড়িতে আমাদের আবারও একত্রে বসার কথা ছিল। হলো না। তার আগেই নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন আকস্মিকভাবে বেঘোরে মারা গেলেন। আমাদের কথোপকথন শেষ হলো না। তাঁকে নিয়ে আমার প্রামাণ্যচিত্রের নির্মাণও শুরু করা হলো না। পুত্র নিয়েও বিস্তৃত কথা হলো না।

আমি নিশ্চিত অনন্য সেলিম আল দীনের দেহই শুধু লুপ্ত হয়েছে। আমাদের কাছে রয়ে গেছে তাঁর সোনা ফলানো লেখাগুলো। বেঁচে থাকা কালে তিনি সামগ্রিকভাবে পঠিত না হলেও আগামী দিনে তাঁকে আমরা নিত্য নতুন আবিষ্কার করব। এবং তাঁর দেখানো পথে হেঁটেই বাংলাদেশের নাটক একদিন পৃথিবীর মানচিত্রে নিজের উজ্জ্বল উপস্থিতি সরবে জানাবে।

ঢাকা, ১৮ জানুয়ারি, ২০০৮