শিমূলের বিজয়োৎসব

মীর ওয়ালীউজ্জামান
Published : 31 Jan 2008, 05:28 PM
Updated : 31 Jan 2008, 05:28 PM

০৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনী সুরমা নদী পেরিয়ে সুনামগঞ্জে প্রবেশ করছে। সঙ্গে অন্যান্য সহযোগী গ্র"প। ক্যাপ্টেন মোতালিব সাব সেক্টর কমান্ডারের স্টাফ অফিসার শিমূল স্ফূর্তিতে, উৎসাহে সর্বক্ষণ টগবগ করছে।

জুলাই-আগস্ট মাসে যখন শিমূল সুনামগঞ্জ থেকে ওপরে, পাহাড়ে বালাট শরণার্থী ক্যাম্পে দেশত্যাগী মানুষের সেবায় মেতেছে, তখন হঠাৎ-ই সেখানে একদিন আগরতলা মামলার খ্যাতিমান প্রাক্তন আসামী ক্যাপ্টেন মোতালিব পরিদর্শনে আসেন। ক্যাম্প অফিসে প্রথম আলাপ।

বাড়ি কোথায়? বাজখাঁই আওয়াজে চমকে তাকাতেই শিমূল বুঝল, প্রশ্নের উত্তর তাকেই দিতে হবে।

ঢাকায়, স্যার। লেখাপড়া কদ্দূর? মাথায় খেলোয়াড়ী টুপি, ঢোলা, খাকি শর্টস আর গাঢ় সবুজ টিশার্ট পরিহিত খোঁচা দাড়িওয়ালা আনকুথ ক্যাপ্টেনকে দেখে শিমূল কৌতূহলী হয়েছিল। মানুষটাকে আরও জানতে হবে। জেনেওছিল ক্রমে। অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে। কাজ এবং আড্ডার মধ্য দিয়ে।

ইংরেজিতে এম. এ পরীক্ষা দিয়ে বসে ছিল সে, মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে পদ্মার ওপারে, মামাবাড়িতে ঘুরেফিরে মাসদুই কাটল। ইতোমধ্যে বন্ধু সয়েল সায়েন্সের মিটু ঢাকা থেকে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের একজন আমলার সইমোহরকৃত পরিচয়পত্র পাঠিয়ে দিল মাগুরায় নানাবাড়ির ঠিকানায়। মিটুর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বাবা ভূঁইয়া সাহেব সেটি সযত্নে তৈরি করেছিলেন। সেই সরকারী খবরপত্রের সাংবাদিকের পরিচয়পত্রের ভরসায় একদিন শিমূল চৌগাছির শান্তি-বলয় ছেড়ে যশোর এবং ঢাকা হয়ে সীমান্ত মহকুমা সুনামগঞ্জের সদরে গিয়ে উঠল মধুমিতা হোটেলে। আলাপ হল মহকুমা প্রশাসনের অনেকের সঙ্গে। ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বাতেনের টেবিলে বসে একাউন্ট খোলা হল এবং একদিন যথারীতি নদী পেরিয়ে লম্বা হেঁটে, সীমান্ত পেরিয়ে অনেকানেক শরণার্থীর সাথে বালাট ক্যাম্পে পৌঁছে গেল।

বৃত্তান্ত শুনে ক্যাপ্টেন মোতালিব দীর্ঘক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন। অবশেষে বললেন, এতবড় শরীরটা লইয়া ঘুরতাছ, এইবার চল তোমারে ফাইনজারি গুল্লির সামনে ঠেইলা দিমু। আছ আমার সাথে? শিমূল একপায়ে খাড়া। সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্প ব্যবস্থাপনার যে সব দিক সে দেখাশুনো করত, সে দায়িত্ব আরেকজনকে বুঝিয়ে দিয়ে মোতালিব স্যরের জিপে উঠে পিছনে বসল। গন্তব্য–জানা নেই। তো, সেই থেকে একসঙ্গে। মাঝে অবশ্য তাকে ক্যাপ্টেন মোতালিব ঠেলেঠুলে মূর্তি পাঠিয়েছিলেন। সেখানে তখন বাছাইকরা মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণ চলছিল। সংক্ষিপ্ত ট্রেইনিং শেষে, তড়িঘড়ি কমিশন নিয়ে সে আবার মোতালিব স্যর অর্থাৎ সাব-সেক্টর কমান্ডারের এসিস্ট্যান্ট নিযুক্ত হল।

অবশেষে এল বহুপ্রতীক্ষিত সুনামগঞ্জ পতন অথবা বিজয় দিবস। ডিসেম্বর ৬, ১৯৭১-এ ওরা শহরে ঢোকার আগেই পাকিস্তানী আর্মি এবং খালাখাফুরিয়া অর্থাৎ কালো সালোয়ার-কামিজ পরিহিত মিলিশিয়া সদস্যরা সুনামগঞ্জের পতন ঘটিয়ে, পিছু হটে, সিলেটে অবস্থান নিয়েছে। শিমূলরা দু'দিন আগে পৌঁছলে অবশ্য ব্যাপার অন্যরকম হতে পারত। কারণ, পাকিস্তানী বাহিনী সুনামগঞ্জ থেকে সিলেট–ওই ৪২ মাইল মোটরপথ পেরোতে দিন দুয়েক লাগিয়ে দিয়েছিল। চার-চারটে ফেরি ছিল তখন ওইটুকুন পথে। তারমধ্যে আবার একটি ছিল দড়িটানা, শতকরা একশ' ভাগ ম্যানুয়াল পারাপার–পাশাপাশি দুটো চওড়া নৌকো একসঙ্গে বেঁধে ওপরের পাটাতনে বাস-ট্রাক তুলে মাল্লারা দু'পাশে দাঁড়িয়ে হেঁইও-হেঁইও করে শুধু শারীরিক শক্তি খাটিয়ে মোটা কাছি টেনে এপার-ওপার করত। সাধারণ যাত্রীদের বাস সাড়ে ছয়-সাত ঘন্টায় ওই ৪২ মাইল পেরুত। যাক্ সে কথা।

ক্যাপ্টেন মোতালিব সুনামগঞ্জ শহরে পৌঁছে শিমূলদের কয়েকজনকে নিয়ে সোজা মহকুমা প্রশাসকের দপ্তরে গেলেন। অর্ডারলি ছুটে এসে সালাম করল। দরজার পরদা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশের আহবান জানালো। স্যর, আসেন। মোতালিব গটগট করে এসডিও-র কক্ষে ঢুকলেন, শিমূলদের ডাকলেন, এসো আমার সঙ্গে। অফিস ফাঁকা। জানাই ছিল। এসডিও, এসডিপিও, ল'ইয়ার ম্যাজিস্ট্রেট–সবাই পাকি বাহিনীর শহর ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গেই মহকুমা সদর থেকে সরে গিয়েছিলেন। খানিকটা শংকায়, কিছুটা অবস্থা-বুঝে-ব্যবস্থা করা যাবে এরকম মনোভাব থেকে।

ক্যাপ্টেন মোতালিব এসডিও-র টেবিলের একপাশে আর্মচেয়ারে বসে শিমূলকে বললেন, তোমার বন্ধুটি কোথায়? তাকে ডাক। নিশ্চয়ই আশেপাশে কোথাও আছেন, বলে সে বারান্দায় পা দিতেই মোমিনুল হককে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতে দেখল। সালাম দিল, স্লামালেকুম মোমেন ভাই, শইলডা বালা নি? মোমেন ভাই গোঁফের ফাঁকে মুচকি হাসছেন। আইছুইন নি সারেরা? ওয়েলকাম, ওয়েলকাম। কোলাকুলি হল। ক্যাপ্টেন সাব কই? শিমূল নিচুস্বরে বলল, আস্তে আস্তে, স্যর ভিতরে। আপনাকে ডেকে আনতে বল্লেন। চলেন। মোমেন ভাই হিপ পকেট থেকে চিরুনি বের করে পাতলা চুলে বুলোলেন। নিজের পোশাকের দিকে একবার তাকালেন। পরনে সেই শিমূলের ব্যবহৃত পুলোভার, শার্টের কলার মলিন, জীর্ণদশা ট্রাউর্জাস, পায়ে শিমূলেরই ব্যবহৃত খয়েরি স্যুয়েডের রাবার সোল জুতো। মুখের হাসিটি অতি নির্মল, নিশ্চিন্তির। ওরা দুজনে হাসিমুখেই ভেতরে ঢুকল।

আসেন স্যরেরা মোতালিবের চওড়া গলার আহ্বান শোনা গেল, কই ছিলেন আপনে? স্লামালেকুম, স্যর, একটু কাজে মুন্সেফ সাহেবের এজলাসে গিয়েছিলাম। ক্যান, মামলা মোকদ্দমা ছিল কোর্টে? না, স্যর, মামলা কোথায়? কে আসবে আজ মামলার কাজে? এই আপনাদের রিসেপশ্যন, থাকার জায়গা, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা–এইসব নিয়ে আলাপ করছিলাম দু'জনে। আর সিনিয়ার তো কেউ নেই এখন, তাই। মোমেন ভাই বিগলিত মনভোলানো সাদা হাসিতে বিকশিত হন। আপনে মানুষটা ভালো। আমার এই এসিস্ট্যান্টের কাছে অনেক শুনছি আপনার কথা। যাকগা, আমাগো লাইগা আপনার চিন্তা করতে হইবে না। আমরা ফৌজি মানুষ, আমাগো ব্যবস্থা একটা থাকেই। তয় আর সারেরা পলাইলো ক্যান? ভরসা রাখতে পারে নাই, না? হাঃ হাঃ শব্দে মোতালিবের হাসি ফাটলো। চা এসে গেছে। চায়ের কাপ তুলে চুমুক দিয়েই আবার প্রশ্ন–আপনি তো শহীদ আসাদের বন্ধু, তাই না? বিপ্লবী আমলা, না? গুড, গুড। এসডি, এসডিপিও–ওদের খবর পাঠান–কোন ভয় নাই, আমরা আগামীকাল থেকে প্রশাসন চালু করতে চাই। আমাদের পেছন-পেছন শরণার্থীদের লম্বা প্রসেশন আসতে দেখেছি। কি হল, হক সাহেব চা খান, শিমূল তোমরা চা নাও। ক্যাপ্টেন মোতালিবের অফিসিয়াল মেজাজ এসে গেছে, বাচনভঙ্গিও শালীন, গোছানো।

স্যর, আমি অলরেডি কয়েকটি ছেলেকে পাঠিয়েছি শহরের বাইরে। বিকেলের মধ্যে এসডিও সাহেবরা চলে আসবেন সম্ভবত। ওরা পিছুহটা পাকিদের ভয়েই সরে গিয়েছিলেন। বলা তো যায় না, আহত বাঘকে বিশ্বাস নেই কিছু। মোমেন ভাই মহকুমার কর্তাব্যক্তিদের পরিবার পরিজন নিয়ে সরে যাওয়ার প্রকৃত কারণ ব্যাখ্যা করলেন। ইয়েস, মোতালিব বললেন, ঘটনার আশঙ্কা খুবই ছিল যাচ্ছিই যখন, সব ব্যাটাকে কোতল করেই যাই। ম্যাসাকার হতে পারতো। ইউ ওয়্যার রাইট টু মুভ দেম এ্যাওয়ে ফর আ কাপ্ল অব ডেইজ। আমরা এখন উঠি। কি শিমূল যাবে না ক্যাম্পে? নাকি বন্ধুর সঙ্গে গপ্শপ চলবে অতঃপর? তবে মনে রেখ ছোকরা। এই শরীরটা আস্ত নিয়ে ফিরেছো। এখনও যুদ্ধ শেষ হয়নি। হক সাহেবের সঙ্গে আড্ডা সাথে সাথে এখানে শরণার্থীদের অভ্যর্থনা, তাদের থাকা-খাওয়া, তারপর বাড়ি যাবার ব্যবস্থা ইত্যাদি কিভাবে করবে, সেটাও ছকে ফেলবে। রাইট স্যর, তাই হবে। পাশেই ডাকবাংলোতে হক সাহেবের বসবাস, এই সামনের বারান্দা থেকে দেখা যায়। মেসেঞ্জার পাঠালেই আমি দশ মিনিটে পৌঁছে যাব, শিমূল বস্কে নিশ্চিন্ত করার চেষ্টা করে। আজ থাক, সব গোছগাছ হোক। কাল থেকে তুমি-আমি আবার নিয়ম করে দৈনিক দু'ঘন্টা ওয়ার ডায়েরির কাজটায় হাত দেব। ক্যামন? শিমূল এটেনশ্যনের ভঙ্গিতে গোড়ালি ক্লিক করে। মোতালিব স্যালুট নেবার ভঙ্গি করেন। সঙ্গীদের নিয়ে গট্মট হেঁটে বেরিয়ে যান।

এবারে প্রায় দেড়মাস পরে এলেন, শিমূল সাব। আর বোধহয় যেতে হবে না, মানে আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধি এসেসমেন্ট যা ইঙ্গিত করে, সেই বোধ থেকে বলা আর কি। বৈষ্ণব মোমেন ভাই কাঁচুমাচু হাসেন।

সেই অর্থে, হয়তো আর যেতে হবে না। এখন আমরা সবদিকে গুছিয়ে কেবল চূড়ান্ত বিজয়ের অপেক্ষায় থাকবো। পুর্নগঠন ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থাদি হাতে নেব জরুরি ভিত্তিতে। শিমূল আত্মপ্রত্যয়ে বাজল।

হ্যাঁ, মোতালিব সাবের কথাতেও তাই বুঝলাম। এবারে তেড়েফুঁড়ে দেশ গঠনের, বিধ্বস্ত মনুষ্যত্ব পুনর্বাসনের ব্রত আমাদের। দেশপ্রেমে মোমেনভাই টগবগ করে সদাই ফোটেন যেন। তার সবচেয়ে প্রিয় প্রসঙ্গ বাংলাদেশ আর গানবাজনা। আদতেই মাটির মানুষ।

চলেন, আমাদের আস্তানায় যাই। গ্যাদা রান্নাবান্না করে বসে আছে এতক্ষণে। মোমেন শিমূলের ডানা ধরে টানতে টানতে বারান্দায় পা রাখেন। ঝকঝকে অঘ্রানের মিঠে রোদে চারদিক ঈষদুষ্ণ। ধীরে হেঁটে ওরা দু'মিনিটে ডাকবাংলায় পৌঁছে গেল।

গ্যাদা লাফাতে শুরু করল ওদের ঘিরে, সারে আইছে। এইবার বাজার হইবো ভালোরকম্ রোজ-রোজ। কমলা কিন্যা সারের খাটের তলায় ভইরা রাখছি। শুইয়া শুইয়া হাত বারাইয়া টানবেন এক-একটা আর খাইয়া যাইবেন। ফুরাইলে তো এই গ্যাদা আছেই। আবার আনমু। ওর কথা শুনে মোমেন, শিমূল হাসে আর জামাজুতো খুলতে থাকে। গ্যাদা শিমূলের লুঙি এনে হাতে দেয়।

বাংলোর দু'পাশে দুটো দুই বিছানার ঘর। মাঝে ড্রইং-ডাইনিং, ওয়াস বেসিন যে যার জায়গায়। ওদের মুখহাত ধোবার আগেই গ্যাদা টেবিলে খাবার বেড়ে দেয়। সেই সবুজ উচ্ছে আর আলু ভাজা, শাক, কইমাছের ঝোল আর ঘন ডাল। অনেকদিন পর শিমূল পেটভরে খাচ্ছে। মোমেনভাই আবার গ্যাদাকে তাড়া দেন–গ্যাদা, সারেরে ভাল কইরা খাওয়াস্ না? কতদিন পর তোর বাংলা আর্মির সার আইছে, ক? গ্যাদা লাজুক হাসে, সারে আমগোর নিজের মানুষ, দ্যাখেন না, নিজে তুইল্যাই খাইতাছে? হ্যাঁরে গ্যাদা, এখন কইয়ের কি দর? কমলার? শিমূলের বাজারদর জানতে ইচ্ছে হয়। কইমাছ টাকায় ষোল-কুড়িটা, কমলা পচিশটা। এই সনে কইমাছ তো কেউ খায় নাই, আফনেরা দুইজন ছাড়া। হাওড়ে খালি লাশ আর লাশ আমিও আগে খাইতাম না, এহন খাই আফনেগো দেইখা। গ্যাদা সোৎসাহে কামারাডেরি প্রদর্শন করে। মোমেন, শিমূল প্রশ্রয়ের হাসি হাসে, কৃতজ্ঞতারও। গ্যাদাই তো ওদের সবচেয়ে কাছের সিলেটি বন্ধু এবং পথপ্রদর্শক। এই কম্বাইন্ড হ্যান্ডটি না থাকলে ওর ওই বৈরাগীর ঘর রক্ষা করতো কে?

খাওয়াদাওয়ার পর দুইসখা ওদের ঘরে গিয়ে যার যার বিছানায় চিত হয়। শিমূল অভ্যাসমত কাত হয়ে খাটের নিচে হাত দিয়ে কমলার খঞ্চা পেয়ে যায়। খোসা ছাড়িয়ে কমলার কোয়া মুখে চালান করে আর মোমেনকে জিজ্ঞেস করে এর-ওর কথা। হাই সাহেব কেমন আছেন? সা'দ মিয়া? আজাহার ভাই? ধর্মশালার ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব? ল'ইয়ার ম্যাজিস্ট্রেট আরকান আলী? পিন্সিপ্যাল আব্দুল মান্নান চৌধুরি? মোমেনভাই স্মিত হাসেন, এতজনের কথা একসঙ্গে কই ক্যামনে? বিকালে চলেন, ঘুরিফিরি আগের মতো, দেখা হোক মানুষজনের সঙ্গে, সব খবর পেয়ে যাবেন ধীরে ধীরে। আপনি আমাদের এত মানুষের কথা মাথায় রেখে যুদ্ধ করতেন কিভাবে? আহ্, কবে যে ভারত স্বীকৃতি দেবে আর ওই শয়তানগুলো আত্মসমর্পণ করবে।

ছোট্ট নিটোল একটি ভাতঘুম দিয়ে শিমূল উঠে সিগ্রেট ধরাতেই গ্যাদা ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে কাপ এগিয়ে দিল। সুনামগঞ্জের কনিষ্ঠতম ম্যাজিস্ট্রেট মোমিনুল হক ইতোমধ্যে অপরাহ্ণিক ক্রিয়াকর্ম সাঙ্গ করে পোশাক পরে তৈরি। শিমূল টয়লেট থেকে ফিরল, হাতমুখ ধুয়ে তৈরি হতে হতে শুনলো, মোমেন ভাই বারান্দায় কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন। বেরিয়ে দেখল, সুনামগঞ্জের একমাত্র ছবি তোলার কারিগর সুলেমান তার মিনল্টা বহুব্যবহৃত নিয়ে বসে আছে। ওকে দেখে সুলেমান উঠে দাঁড়াল, আসেন স্যার, আফনারার দুইজনের ফুটু নেই, আফনের এই চেহারা তো বেশিদিন থাকতো নাই। তাই হক সাবে খবর ফাটাইছেন। অগত্যা ছবি তোলা হল। মোমেন ভাইয়ের এরকম অনেক পাগলামির সঙ্গে ওর গত ছ'মাসে জানাচেনা হয়েছে। গ্যাদা, সুলেমান সার ছা খাইয়া যাইবেন, বুঝলি ? আমরা আসি, বলে মোমেন ভাই হাঁটা দেন। শিমূল অনুগমন করে।

কলেজ রোডে মিনিট দুয়েক হাঁটতেই হাই সাহেবের সঙ্গে দেখা। মহকুমা সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অফিসার। হার্দ্যকি করমর্দনের পর শিমূলের হাত ধরে টেনে নিয়ে চললেন রাস্তার পাশে তার বাসায়। ওরা বারান্দায় রাখা বেতের চেয়ারে বসল। হাই সাহেব ভেতরে গেলেন। ছোট্ট মেয়েটিকে কোলে নিয়ে ফিরলেন। শিমূল স্বাস্থ্যল শিশু দেখলেই হাত বাড়িয়ে দেয়, দিলও অভ্যাসবসে। শিশুটিও ঝাঁপালো। লুফে নিয়ে ওর টোপা গালে গাল ঠেকিয়ে উম্-উম্ করল, তারপর বাবার কোলে ফিরিয়ে দিল। মেয়েটি যাবে না। অতএব শিমূলের কোলে থিতু হল। ওকে আদর করার ফাঁকে-ফাঁকে, মেঘালয়ের মানুষজনের সম্পর্কে ও কথা বলে চলল। বিশেষ করে খাসিয়াদের কথা যে সে ভুলতে পারছে না, সেটা বারবার বলল।

চা চলছে, তারি মাঝে সারওয়ার সাহেব এলেন। পড়শি। মহকুমা ফ্যামিলি প্ল্যানিং অফিসার। তুলসীদাসের দোঁহা আওড়ানো ওর স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। 'গোরস ঘর ঘর ফিরে, মদিরা বৈঠল বিকায়' ধরনের একটি দোঁহা গুণগুণিয়ে সারওয়ার কুশল বিনিময় করলেন। বড় রসিক মানুষ। এদের কথা ভেবেই শিমূল দেশে ফিরেছে। অবশ্য ঠিক নেই কিছু। সে আবার মেঘালয়ে যাবে, যেতেই হবে, পাহাড় বড্ড টানে। অমোঘ সে টান। আর টানে পাহাড়ি মানুষের সহজ সরল আপ্যায়ন–আদর। মোমেন ভাই অবশ্য একফাঁকে ওকে ওর বর্তমান কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেন। না, না, এখন দু'চার ইপ্তা তো এখানেই থাকব। শিমূল ওদের আশ্বস্ত করে।

ওরা চারজনে পথে নামে আবার। ছোট্ট মহকুমা শহর। ছোট ছোট টিনের বাড়ি। সিলেট অঞ্চলে সেসময় অধিকাংশ বাড়িঘর ঐ বাংলো মতোই তৈরি করা হত। বড় বাংলোগুলোর বয়স বহু দশক পেরিয়েছে। টেকসইও বটে। এসডিও'র অফিস-বাসা পার হয়ে ওরা মুন্সেফ ইফতেখার রসুলের বাড়ির সামনে পৌঁছে গেল। সন্ধ্যে ঘনিয়েছে। ইফতি সাহেব একা থাকেন। পরিবার ঢাকায়। শিমূল লম্বা পা ফেলে, বাগানের ফুলগাছে হাত ছুঁইয়ে, বারান্দায় উঠে কড়া নাড়ল, মুন্সেফ সাহেব কি আছেন বাড়িতে? হাঁক শুনে ইফতি দরজা খুলে সরে দাঁড়ালেন, আরে কি সৌভাগ্য, দুপুরেই শুনেছি, হক সাহেবের মুখে–আগমনী সন্দেশ আপনার। ছন্দে ছন্দে সুদর্শন হাস্যমুখ মানুষটি আন্তরিকভাবে বেজে উঠলেন। তারপর বাগান পেরিয়ে তার দৃষ্টি রাস্তার ধারে অপেক্ষমান ত্রিমূর্তির ওপর পড়তে চেঁচিয়ে উঠলেন, হক্ সাহেব, আসুন স্যর। আস্তাজ্ঞে হোক, বলে শিমূলও বাও করল সাহেবি কায়দায়।

সকলে এলেন, বসলেন, তুমুল আড্ডা হল। আরেকপ্রস্থ চা আর সারওয়ার এবং হাই সাহেবের দিলখোলা হাসির মধ্য দিয়ে বহুদিনের শ্বাসরোধী বাতাবরণকে যেন ওরা নির্বাসনে পাঠিয়ে দিতে পারল। 'আমার সোনার বাংলা' গাওয়া হল কোরাসে। তারপর গাত্রোত্থান। ইফতি উস্কানি দেবার সুরে বলে উঠলেন, এরপর ম্যানেজারের ওখানে শেষ চা'টা খাওয়া হবে নাকি জনাবদের?

ওরা সকলেই জানে, ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের অফিসে কাজে যাওয়া যায়, কিন্তু তার বাসায় স্রেফ আড্ডা মারার জন্য মুন্সেফ যেতে পারেননা। তেমনি ম্যানেজারও সচরাচর জজ-হাকিমদের বাসায় গিয়ে উঠতে পারেন না। এটাই রীতি। ঔপনিবেশিক শ্রেণিবিভাজনচর্চা। মোমেন ভাই ব্যতিক্রম। বিপ্লবী। শহীদ আসাদের ত্যাগের এবং নীতির ধারক-বাহক। অতএব, মুন্সেফকে একা ফেলে ওরা তেমাথায় উঠে, বাঁদিকে ঘুরে, বড় কম্পাউন্ডওয়ালা বাড়িটাতে ঢুকে গেল। রেজা ভাইয়ের বাড়ি। বাড়ির মধ্যে আবার ছোট বাড়ি কয়েকটি। ওরই একটিতে ম্যানেজার বাতেনের বসবাস। জুলাই মাসে শিমূল এ শহরে নেমে হোটেলে উঠলেও, ওপারে চলে যাবার আগে সে এখানেই উঠেছিল প্রথমে। ক'দিন থেকে, উঠে গিয়ে তারার সরকারী ডাকবাংলোয় মোমেন ভাইয়ের রুমমেট বনেছিল পরে।

কড়া নাড়তে বাতেন হাসিমুখে তার স্বভাবসিদ্ধ বুলি 'ছুদুর ফুত্' বলে অভ্যর্থনা জানালো। কাজের ছেলেটিকে চানাচুর-মুড়ি মাখাতে বলল। আর কয়দিন, শিমূল সাব ? বাতেনের ব্যাগ্র ঔসুক্য শিমূল সোৎসাহে মেটালো, টেন ডেউজ এট দ্য মোউসট। নাকি বলেন মোমেন ভাই ? আপনার মুখে ফূলচন্দন বর্ষণ করি, তাই যেন হয়। আর পারি না। মোমেন ভাই ইজিচেয়ারে শরীর এলিয়ে দেন। বাতেন সাব, একখান নজরুল গীতি ্হউক। তারপর শিমূল সাবের গুরু বন্দনা হবে। তারপর চা খেয়ে রুখ্সত।

আড্ডার মেজাজে থাকলেও শিমূল জানালা দিয়ে দূরের রাস্তায় নজর ফেলছিল মাঝে-মাঝেই–শরনার্থীরা ফিরছে তো ফিরছেই। রাত হয়েছে। কিন্তু মানুষের পথচলার বিরাম নেই। জিজ্ঞেস করে, নভেম্বরের এই দিনে কি অবস্থা ছিল, বাতেন ভাই ? আরে শিমূল সাব, আপনারা তো ওই পারে–এই পারে আপনাদের দরকারমতো আসতাছেন, যাইতেছেন, সব খবর আপনাদের মোটামুটি জানা। কিন্তু আমরা খাঁচায় বন্ধ বিলাতি ইন্দুরের মতো ছিলাম; বিশেষ কইরা এই গত একদেড়মাস তো ওরা খ্যাপা কুত্তা হইয়া গেছিল। সন্ধ্যা-সকাল কার্ফিউ। রাস্তাঘাটে পাগলও থাকত না রাত্রে। শহরের সব কুত্তা ওরা মুখ্রিত আতঙ্কে গুলি চালাইতে চালাইতে শ্যাষ করছে। আফদ গেছে। গেছে তো? নাকি? বাতেন উঠে সবার হাতে মুড়ির বাটি তুলে দেয়।

মুড়ি চিবোনোর ফাঁকে ফাঁকে শিমূল হকের সঙ্গে ঘরমুখো ভারত প্রত্যাগতদের জন্য করণীয় বিষয়ে আলাপ করছিল। হক ভেবে পাচ্ছেন না, এইটুকু শহরে, যেখানে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা পর্যন্ত নেই, সেখানে এই বাস্তুহারাদের জোয়ার কিভাবে ম্যানেজ্ড করা হবে ? সিনিয়র প্রশাসকেরা তো বিশেষ কিছু করতে পারবেন না, হক চিন্তান্বিত, কেবল আমাদের কাজে বাঁ হাত না দিলেই হয়। আপনি তো সেটাই করবেন সারাক্ষণ, শিমূল বলে, খাটাখাটনি সব আমাদের ছেলেমেয়েরা করে দেবে, ভাববেন না বেশি। আপনি শুধু কর্তাদের সামলাবেন আর রিসোর্স যেখানে যা পান, আমাদের সরবরাহ করে যাবেন। হাসন রাজার ডাইন্যাস্টি ম্যানেজ করবেন আগরতলা ভেটেরান, ঠিক আছে? তাহলে এই কথাই রইল।

রইল, হক উঠলেন। বাতেন হাঁ হাঁ করে উঠল, মোমেন ভাই, গানই তো হইল না। বসেন, বসেন। ঠিক আছে, হক বলেন, তো জলদি গান হোক, কাল ভোর থেকে কাজে লাগতে হবে। সঙ্গীত পর্ব শেষ হতে রাত দশটা।

ডাকবাংলায় মাঝের ঘরের দরজা ভেজিয়ে গ্যাদা ঘুমোচ্ছিল। সাড়া পেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল। দু'চোখ কচ্লে উঠে দাঁড়াল। খানি দেই, সার? অবশ্যই, দিয়ে তুমিও খেয়ে নাও। শিমূল ঘরে ঢুকে কাপড় বদলায়। মোমেন ভাই হাত ধুয়ে খেতে বসে গেছেন। শিমূল রাতচরা–রাতে কাজ করতে, পড়তে, লিখতে, গান শুনতে সে ভালবাসে। তবে সামনের ক'দিন একটু নিয়মমাফিক আহারনিদ্রা সারতে হবে। বোঝাই যাচ্ছে, বেশ স্ট্রেসফুল যাবে আগামী ক'দিন।

ভোরে উঠে শিমূল আধঘন্টাটাক দৌড়ে এসে স্নানাহার সেরে ক্যাপ্টেন মোতালিবের সঙ্গে দেখা করতে গেল। ফরেস্ট অফিসে পেরিয়ে, রেঞ্জারের বাসার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। বেশ ভিড় জমেছে। নদীর পাড় ঢালু হয়ে নেমেছে। সুরমার পাড় আগাগোড়া অনেকদূর বাঁধানো ওখানটায়। নদীর পানি নেমে যাওয়ায় নিচে বেশ চওড়া এবং সামান্য ঢালু জায়গা তৈরি হয়েছে। দেখা গেল, তিনচারজন মানুষ সেখানে চার হাতপায়ে হামাগুড়ি দিচ্ছে। কি ব্যাপার? সে লাফিয়ে নিচে নামল। কাছে গিয়ে চম্কে উঠল। দুঃখবোধ হল তীব্র। প্রিন্সিপ্যাল সাহেবকে ওখানে ওই অবস্থায় দেখবে ভাবেনি। পাহারাদার যুবকদের জিজ্ঞেস করে জানল, রাজাকার সবাই পালিয়েছে। পাওয়া গেছে এই ক'জনকে। এদের বিরুদ্ধে কোন না কোনভাবে পাকিস্তানী দখলদারদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা বা সহায়তা যোগানোর অভিযোগ রয়েছে। তো, প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের কি অপরাধ যে তাকে গলায় দড়ি বেঁধে চারশেয়েদের মতো হামাগুঁড়ি দিতে হচ্ছে? প্রায় নগ্নশরীরে? এই শীতে? আর একটু এগোয় সে, এবং থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। খবরদারির কাজে নিয়োজিত যুবকদের একজন এগিয়ে এল। নিচুস্বরে বলল, এদের খাবার হিসেবে ঘাসপাতা দেবার হুকুম। আর পানীয়? এই যে সুরমার জল, সে হাত ইশারায় পাতলা কুয়াশার পর্দাঢাকা নদীকে নির্দেশ করে। এরপরে আর ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা সমীচীন নয় ভেবে শিমূল তার গন্তব্যে রওনা হল পা চালিয়ে।

গুড মর্নিং, স্যার, শিমূল এটেনশ্যনের ভঙ্গি করল। মোতালিব ডাকলেন, কাম, মাই বয়। দু'য়েকটি জরুরি বিষয়ে আলাপ সেরে নিই। আমারও দু'টো কথা আছে, স্যর। আগে আপনার বক্তব্য শুনি, শিমূল নোটপ্যাড আর কলম নিয়ে বসে। আমাদের দু'কাপ চা দাও, কড়া করে, মোতালিব গলা লম্বা করে হুাঁক দেন। মাউড়ারা হলে কি বলত, জানো? এ্যয় লওন্ডে, দো চায়ে লাও, কাড়াক্সে, তাই না ? মোতালিব তার হিন্দির দখল বিষয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান। না স্যর, আপনি ওদের চায়ের হুকুমটা ঠিকই শুনেছেন। কিন্তু ওই কাড়াক্সে'র মানে হল 'এক্ষুনি'। ও, তাই বলো। তুমি তো আবার ঢাকার বিহারিদের সঙ্গে ওঠাবসা করে অভ্যস্ত, আর আমি হইলাম গিয়া ময়মনসিংহের বাঙ্গাল, হাঃ হাঃ হাঃ। মুখের হাসি মুছে মোতালিব ফাইল নিয়ে বসলেন।

কাল সন্ধ্যায় তোমাকে আর ডাকিনি, নিশ্চয়ই বহুদিন পর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতেছিলে, মোতালিব প্রসন্নমুখে স্মিত হাসেন। এখন, আমাদের ফার্স্ট প্রায়োরিটি হল মহকুমা প্রশাসনের চাকা সচল করে দেয়া। সে ব্যবস্থা হচ্ছে। ও, তোমার এসডিও, এসডিপিও–ওরা কালই এসে গেছেন। আমার সঙ্গে দেখা করে গেছেন। আমরা একটু পরেই যাব সেখানে। ওদের একটু সাপোর্ট দিতে হবে, কোন কোন ব্যাপারে দাবড়াতেও হতে পারে কিঞ্চিৎ। সেটা তুমি করবে। অন মাই বিহাফ। না, না, এখন তুমি কথা বলবে না, কেবল শোনো। নোট কর ইন্সট্রাকশ্যনগুলো।

শিমূল মন দিয়ে শোনে, আর নোটা বইয়ে করণীয় টোকে। যারা দেশে ফিরছে এপথে, তাদের স্বল্পকালীন বিশ্রামের ব্যবস্থা, খাবার সরবরাহ, চিকিৎসা, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রশাসনের পক্ষে মোমেনুল হক এবং আমাদের হয়ে তুমি দেখবে। ইন্ডিয়াতে এই ক'মাস যা করেছো, সেটা কাজে লাগাও শার্পেন ইওর একোয়ার্ড স্কিল্জ, ম্যান। মোতালিব উৎসাহ দেন। এবার তোমার কি এজেন্ডা, বল।

শিমূল সুরমাপাড়ে যা দেখে এসেছে, বলল। মোতালিব কপালের রগ টিপে ধরে চুপ করে ছিলেন। অবশেষে বললেন, মনে রাখবে, আমাদের কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। আমরা কেবল সহায়তা দেব সবাইকে, বিশেষ করে প্রশাসনকে। বিবেককে ক'দিন একটু চাবকাবে। দেখবে, শুনবে, জড়াবে না, আমাকে এসে জানাবে। আমি তোমাকে যা বলব, তাই করবে। আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। বাঁচাতেও হবে। আমি দেওয়ানদের বাড়িতে আজ লাঞ্চ খাব। ওখানে ব্যাপারটা আলাপ করব। আশা করি, সুবাতাস বইবে। বিবেককে তা'বলে আমি কবরস্থ করতে বলছি না মোটেই। কেবল তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া জানানোটা আপাততঃ স্থগিত রাখবে। বোঝাতে পেরেছি তো তোমাকে? বলে মোতালিব সিগ্রেট ধরালেন।

শিমূল বুঝল। তাহলে আমি মোমেন ভাইয়ের অফিসে গিয়ে কাজে লেগে যাই, স্যর। দাঁড়াও, আমিও যাব। চলো দুই ভাই মার্চ করে যাই, ক্যাপ্টেন উঠলেন। এই শীতেও ওর পরনে সেই জলপাই রং নাইলন টিশার্ট, খাকি ঢোলা শর্টস আর ভারী বুট, হাতে ব্যাটন, কোন আর্মস নেই। শিমূলও গতকাল এপারে পৌঁছেই অস্ত্রশস্ত্র জমা করে দিয়েছে। প্রয়োজনে ছুটে এসে নিয়ে নেয়া যাবে। আপাতত: সে প্রয়োজন নেই। ওদের স্কাউটরা খবর পাঠিয়েছে। সিলেট পর্যন্ত সড়কপথ শক্রমুক্ত। সিলেটে ওরা ইপিআর হেডকোয়াটার্স খাজাঞ্চিতবাড়িতে ক্যাম্প করেছে। ঢাকার পতন হলেই আত্মসমর্পণ করবে। এখন দেশের মানুষের কথাই ভাবতে হবে সারাক্ষণ।

অজস্র স্যালুট আর 'স্লামালেকুম স্যর' সম্বোধনের তাপ পোহাতে পোহাতে ওরা পনের মিনিট হেঁটে এসডিও'র অফিসে পৌঁছে গেল। এসডিও'র অর্ডারলি আগের দিনের মতোই পর্দা তুলে ধরলে মোতালিব নিচুগলায় ওকে বললেন, পর্দাটা নামাও। ভিতরে গিয়ে বল আমাদের কথা। আমরা ততক্ষণ অপেক্ষা করব। এটাই নিয়ম। ঠিক আছে? মহকুমা আধিকারিকদের সঙ্গে ক্যাপ্টেন মোতালিবের আলাপ হল। ইতোমধ্যে হাসন রাজার নাতি আওয়ামী লীগের এমপি সাহেব এসে গেছেন। জোর মিটিং হল। সবাই যে যার দায়িত্ব বুঝে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। শিমূল ও মোমেন এসডিও'র জিপ নিয়ে ছুটল প্রথমে শহরের এমাথায় কলেজে, তারপর ওমাথা প্রবেশ-বহির্গমন পয়েন্টে সিলেট রোডের ধারে পিটিটিআই অর্থাৎ প্রাইমারি টিচার্স ট্রেইনিং ইন্সটিটিউট পানে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, ভারত প্রত্যাগতদের জন্য এই দু'টো জায়গায় সাময়িক আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে, এক্ষুনি।

দু'টো প্রতিষ্ঠানেই হাতে লেখা ব্যানার টানিয়ে, মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি তদারকিতে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের নানা কাজকর্মের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ওরা লাঞ্চে বাসায় ফিরতে না ফিরতেই খবর পেল দু'টো। এক, ভারত-ফেরত মানুষজন দুই আশ্রয়ে ভিড় করছেন ইতোমধ্যে, কারণ মহকুমা প্রশাসন এ বিষয়ে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে জানান দেবার ব্যবস্থা করেছে। দুই, মুক্তিযোদ্ধারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে বিবদমান এবং যুযুধান। পরের খবরটা খারাপ।

স্নান-খাওয়া সারতে সারতে শিমূল দ্রুত আশু কর্তব্য বিষয়ে ভাবছিল। খেয়েদেয়ে গ্যাদার সাইকেল নিয়ে ও ছুটল ক্যাপ্টেন মোতালিবের সঙ্গে দেখা করতে। এসডিও'র অফিসে না পেয়ে ক্যাম্পের পানে সাইকেল ছোটালো। ক্যাপ্টেন মোতালিব তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে। শিমূল সামনে গিয়ে সালাম দিল। তোমার কথা ঠিক, কিছু কিছু মুক্তিযোদ্ধা ঠিকই আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে ওই সব কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে, ওরা আর্মস সারেন্ডার করেনি, করবেওনা নাকি, বলে মোতালিব চিন্তান্বিত মুখে পেছন ফিরে নদীর সামনাসামনি হলেন। যুদ্ধই ভাল ছিল আমাদের জন্য, কেন যে ভারত আমাদের সহায়তা দিয়ে এর অবসান ঘটাতে চলেছে। আরও কষ্ট না করলে এ জাতের শুদ্ধি বা মুক্তি কোনটাই ঘটবে না, শিমূল অসহিষ্ণুভাবে বলে।

মোতালিব বলেন, শোনো, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। দেশে ফিরেই এদের বিশেষ করে স্থানীয়দের সঙ্গে পুরনো মানুষজন পরিবেশের পরিচয় ঘটছে। অনেকেই সহজে নিজেকে এখানে মেলাতে পারছে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে না? এটাই মানতে রাজী নয় এরা, বুঝলে? যাই বলেন স্যর, শিমূল মাথা ঝাঁকায়, এদের দেশপ্রেমট্রেম কোনকালে ছিল বলে মনে হয় না। আরে, সবার উপরে মানুষ সত্য–এই কথাটা মনে রাখলেই তো অহং -এর জ্বালা জুড়োয়। ইচ্ছে করে, একটা স্টেনগান ইস্যু করিয়ে নিয়ে ওদের একবার দেখে আসি। খবরদার। আমার হুকুম ছাড়া তুমি কোথাও যাবে না, মোতালিব গর্জে ওঠেন। হক সাহেব যখন তোমাকে ছুটি দেবেন, তখন এখানে চলে আসবে সোজা। বসে বসে আমরা সার্বিক পরিস্থিতি আলোচনা করব, ওয়ার ডায়েরি লিখব, কেমন? আর হ্যাঁ, সকালে যাদের দেখেছিলে নদীর পাড়ে, তারা এখন ঘরে ফিরে গেছেন। খুশি?

অত্যন্ত। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ, স্যর। হিল ক্লিক্ করে শিমূল লাফিয়ে সাইকেলে ওঠে। মনটা অনেক হালকা। রতœাদের বাড়ির দরজায় নেমে কড়া নাড়ল। মাসিমা দরজা খুলে সরে দাঁড়ালেন। এসো, বাবা। আমরা আজ সকালে এসেছি। কি যে ভাল লাগছে আমার। ছয়মাসের আর্বজনা জমে আছে বাড়িতে। পরিষ্কার করছি আমরা মা-মেয়ে। খুব ভাল হয়েছে, শিমূল ব্যস্তভাবে বলে ওঠে, আপনারা সংসার গুছোন, কোন কিছুর দরকার হলে আমাদের খবর পাঠাবেন। আমি মোমেন সাহেবের সঙ্গে ডাকবাংলায় উঠেছি আপাতত। রতœাকে বলবেন, সন্ধ্যেবেলা গানবাজনা হবে। ঠিক আছে বাবা, হক সাহেবকেও নিয়ে এস।

শিমূল সাইকেল চেপে এরপর প্রিন্সিপ্যাল মান্নান চৌধুরীর বাড়ির সামনে গিয়ে নামে। নিমগাছের গোড়ায় বাইক ঠেকিয়ে রেখে বাংলোর বারান্দায় উঠে বেল টেপে। পা ঘষটে কেউ আসছে দরজা খুলতে। শিমূল ভেতরে ভেতরে নাজুকবোধ করছিল, ভাবছিল, কি কথা, বলবে। চৌধুরী দরজা খুলে মাথা নিচু করে ঝুঁকে দেখলেন, হাতের ইশারায় ডাকলেন, কাম ইন, প্লিজ, ইয়াং ম্যান, আওয়ার সেভিয়ার্স। ভেতরে ঢুকে শিমূল চৌধুরীর করমর্দন করল, ওকে ধরে বসিয়ে, নিজে বসল। আর লজ্জা দেবেন না স্যর। ক্যাপ্টেন মোতালিব, হক সাহেব, মহকুমা প্রশাসন–আমরা সবাই যার পর নাই বিব্রত, দুঃখিত, ভবিষ্যতের কথা ভেবে ইতোমধ্যেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আমরা কী অর্জন করেছি ? কেন ? কাদের জন্য ? এই দ্যাখেন, আমি আপনার সমুখে বসে আমার মুক্তিযুদ্ধের কাগুজে অর্জন বিসর্জন দিলাম। কষ্ট চেপে, পকেট থেকে প্রধান সেনাপতির স্বাক্ষরকৃত সনদপত্র বের করে, টুক্রো টুক্রো করে, বারান্দায় উঠে গিয়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল শিমূল।

ওটা কী করলেন? হোয়াই ডিড ইউ ডু দ্যাট ? ওটাও অপরাধ হিসেবে কাউন্টেড হতে পারে, আপনি জানেন ? চৌধুরীর সন্ত্রস্ত কন্ঠ শুনে শিমূল আরো দুঃখ পেল। মানুষটা–একজন বড়ো মাপের মানুষ এমনই ধাক্কা খেয়েছেন অতি সম্প্রতি যে–একেবারে বেঁটে বামন হয়ে গেছেন। ছি, ছি, কেন মানুষ এমন করে ? মানুষের সঙ্গে ? জানেন শিমূল, ওদের মধ্যে আমার কলেজের ছাত্রও ছিল। আমি কলেজ খোলা রেখেছি। এই আমার অপরাধ। আমি কি আর ঐ কলেজে মাথা উঁচু করে ঢুকতে পারব? চৌধুরী নতমুখে বলেন। স্যর, আপনি কয়েকদিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে চলে যান, নইলে সিলেট বা ঢাকায় যান। শিমূলের পরামর্শ শুনে চৌধুরী বলেন, আমিও তাই ভেবেছি। অনেকদিন হল কোথাও যাওয়া হয়নি। আর, বাড়ির মানুষরাও অস্থির হয়ে রয়েছে।

আপনার জন্য একটা জিনিস রেখেছি, বলে প্রিন্সিপ্যাল সাহেব উঠতে না উঠতেই ভেতর থেকে পরিচারিকা ট্রেভর্তি নাশতা নিয়ে এলো। আজ গ্যাদার কইয়ের ঝোল বরাতে নেই, ভাবতে ভাবতে শিমূল পরোটা ভেঙে খাসির ঝোলে ভেজায়। ও একা বসে খাওয়া শেষ করতে চৌধুরী সাহেব একটা প্যাকেট নিয়ে ঢোকেন। এটা কী, স্যর ? হাতমুখ মুছে শিমূল চায়ের কাপ তুলে নিতে নিতে স্বাভাবিক ঔৎসুক্য প্রকাশ করে। সে জানে, ওতে বই আছে। এর আগেও উনি ওকে প্রিয় বই পড়া হলে গিফট্ করেছেন। আদ্যন্ত বিদ্যোৎসাহী মানুষ যাকে বলে, প্রিন্সিপ্যাল সাহেব তাই-ই।

টু কিল আ মকিংবার্ড উপন্যাসটি পড়ে আপনার জন্য রেখে দিয়েছিলাম। যুদ্ধফেরত আপনাকে দেব বলে। এই নিন। প্রিন্সিপ্যালের দু'হাত থেকে ভারি মলাটের বইটা দু'হাতে নিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে শিমূল গন্ধ শুঁকল একবার। শুকিয়ে আসা রক্তের গন্ধ পেল যেন।

শেষ দুপুরে ডাকবাংলার ঘরে চিত হয়ে শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে মোমেন ভাইকে শিমূল সব শোনালো। প্রিন্সিপ্যালের প্রসঙ্গ উঠতে গলা বুঁজে এল ওর, চোখের কোণ ভিজলো। হক বলে উঠলেন, থাক, আর বলতে হবে না। বুঝতে পারি। চলেন, বিকেলে চা খেয়ে, একবার ক্যাম্প দু'টোতে চক্কোর দিয়ে এসে রতœাদের বাড়ি বসব। এখন একটু চুপ করে, চোখ বুঁজে বিশ্রাম নিই।

সুনামগঞ্জ কলেজ এবং পিটিটিআই–দুই ক্যাম্পে শরণার্থী আগমনের চাপ বুঝে টয়লেটের ব্যবস্থা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়ে, রান্না করা খাবারের মান পরখ করে, মানুষজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে শিমূলের মনের ভার হাল্কা হল খানিক। অতঃপর জিপ ছেড়ে দিয়ে ধীরেসুস্থে হেঁটে ওরা রতœাদের বাড়ি পৌঁছে গেল। সন্ধ্যে উতরে গেছে।

শিমূল একতলার বারান্দায় উঠে চৌকিতে বসল। ডাকলো, মাসিমা, রতœা, কোথায় গেল সবাই ? এই তো আমরা ছাদে, ওপরে চলে এসো শিমূলদা, রতœার গলা শোনা গেল আকাশ পথে। লাফিয়ে সিঁড়ি ভেঙে শিমূল, হক দু'জনে ছাদে উঠে যায়। রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট থেকে টিমটিমে হলুদ আলো ছাদে পৌঁছেছে। একপাশে মাদুরে মা-মেয়ে বসে। শিমূল সটান শুয়ে পড়ল মাসিমার কোলে মাথা রেখে। হক্ দূরত্ব রেখে বসলেন। তারপর, রতœা, তোমার ডাক্তারি পড়া কদ্দূর এগিয়েছিল যেন? হকের প্রশ্নের উত্তরে রতœা হাত উলটে হতাশকণ্ঠে বলে, আর বোধহয় আমার ডাক্তারি পড়া হবে না। সব ভুলে গেছি এই ক'মাসে। মোমেন ভাই, কুকুরদৌড় কাকে বলে আগে জানতাম না, এখন বেশ জানি। ওসব কথা যাক্, রতœা, শিমূল বাধা দেয়, তুমি খালি গলায় গান কর, শুনি একটু। মনটা ভাল নেই মোটেও। রতœা হালকা গলায় বলে, কেন শিমূলদা, এত কষ্টের অর্জন আমাদের, এখন তো প্রায় নিশ্চিতই বলা যায়। ইন্ডিয়া দু'একদিনের মধ্যে আমাদের স্বীকৃতি দিয়ে দেবে, দেখো।

গা রতœা, দুটো কবিগুরুর গান গা, মাসিমা আদুরে গলায় বলেন। আমি ওদের জন্য একটু পায়েস করেছিলাম, নিয়ে আসি। দেখি শিমূল, বাবা, তোমার মাথাটা একটু ওপরে তোল, আমি উঠব। কী গান শুনবে বল, রতœা শিমূলের মাথায় হাত বোলায়, চুলের রাশি ঘেঁটে দেয়। গত বছর আমরা যখন তোমাদের কলেজে ক্যাম্প করেছিলাম, সেই এক সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় যা গেয়েছিলে, তাই গাও, শিমূল অস্ফুটে বলে। সেই গান তোমার এখনো মনে আছে ? দূর। আমার মনে নেই কিছু, বলে রতœা মুচকি হাসে। মোমেন ভাইকে অনুরোধ করে, মোমেনভাই, তারচে বরং আপনি কীর্তনাঙ্গের গান করেন একটা। শিমূল কোন কথা না বলে পাশ ফিরে শোয়। অন্তঃপর রতœা গান ধরে, নিচু গলায়, বসে আছি, বসে আছি সখা, আপনমনে…শিমূল হাসিমুখে আবার ওদের দিকে ফেরে। রতœা চক্রবর্তীর নিবেদনে কবিগুরুর গান যেন নতুন মাত্রা পায় বার বার, গান শেষ হলে শিমূল বলে ওঠে। নিঃশব্দে মাসিমার হাত থেকে পায়েসের বাটি তুলে নেয়। আহারে, জীবনে কত প্রাপ্তি, ভাবে আর পরমান্ন চাখে। চক্ষু মুঞ্জিয়া খালি পায়সান্ন খাইলে অইত না মহয়, সঙ্গীত হউক এইবার মিষ্টান্ন মথিত কণ্ঠে, রতœা খোঁচায়। মাসিমা ওকে বকেন, তোর দাদা না? গুরুজন মান্য করতে শেখ এবার। রতœা গাল ফুলিয়ে আড়চোখে শিমূলকে দ্যাখে। আলো আঁধারিতে চোখের কোণ ঝিকিয়ে উঠল নাকি?

আচ্ছা, আচ্ছা, আমি গাইছি তো। চেটেপুটে খেতেও দেবে না মেয়েটা, বলে শিমূল গান ধরে, ও অকূলের কূল, ও অগতির গতি…। মোমেনভাই দুই হাঁটুতে তালু আর আঙুল ঠুকে সঙ্গত করেন।

পরদিন সকালে যথারীতি দুই ক্যাম্পে তদারকি সেরে ক্যাপ্টেন মোতালিবের সঙ্গে বসে ডায়েরি লেখে দু'ঘন্টা, তারপর লাঞ্চ, বিশ্রাম, বিকেলে আবার ক্যাম্পে হাজিরা দিয়ে সন্ধ্যার পর মুন্সেফের বাসায় আড্ডা দিয়ে ঘরে ফেরে ওরা।

এভাবেই কাটে কটা কর্মব্যস্ত দিন। ক্যাম্পের ভিড় পাতলা হতে শুরু করে। মানুষ ঘরে ফিরছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিজয়ের খবর ভেসে আসে। মানুষ থিতু হতে শেখে আবার। অনেককেই নতুন করে সংসারযাত্রা আরম্ভ করতে হয়। দেশব্যাপী রাজাকার-আলবদর বাহিনীর মরণকামড় ও তজ্জনিত দুঃসংবাদ শিমূল-মোমেনকে বিষাদে আচ্ছন্ন করে প্রায়ই। তারই মধ্যে ওরা কাজকর্মে মেতে থেকে, আড্ডা দিয়ে দিন কাটায়। ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন মোতালিব শিমূল মোমেন দুজনকে ডেকে পাঠান।

সন্ধেবেলায় ডাক? কী ব্যাপার ? দুরুদুরু বুকে ওরা হাজিরা দেয়। মোতালিব সহাস্য অভ্যর্থনা জানান, আসেন হক সাহেব, এসো শিমূল। এক্ষুনি একটা জরুরি কাজে হাত দিতে হবে। আগে আদা-চা খাওয়া যাক। পৌষালি শীত নামছে খাইশ্যা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে, নাকি বল, শিমূল? পাহাড় জঙ্গল হল ওর হার্টল্যান্ড, বুঝলেন হাকিম সাব? কাজটা কী, বলেন স্যার, শিমূল ঔৎসুক্য চেপে রাখতে পারে না। শোনো, তোমাদের বন্ধু মুন্সেফ সাহেবের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে, মোতালিব কেজো গলায় বলেন, রসুলের কোয়ার্টার্সের সামনে যে খোলা জায়গা, সেখানে একটা শহীদ মিনার-কাম-বিজয়স্তম্ভ তোলো। আজ রাতেই। আমি বলছি, আমরা আগামীকাল ওখানে শহীদ স্মরণ ও বিজয়োৎসব করব। ব্যবস্থা কর। এসডিও-এসডিপিও সবাইকে বলা হয়েছে। তাহলে তো স্যর আর কোনো সমস্যা নেই, কেবল সময়স্বল্পতা ছাড়া। সেটাও সামলে নেয়া যাবে, কেবল স্তম্ভটি একটু ফ্রেশ দেখাবে কাল সকালে, শিমূল উঠে দাঁড়ায়। হয়ে যাবে স্যর। গুডলাক, বয়েজ, মোতালিবও উঠে দাঁড়ান। ভেবো না, আমিও তোমাদের সঙ্গে রাত জাগবো।

পরদিন সকাল ১১টায় শহীদ মিনার-কাম-বিজয়স্তম্ভের উদ্বোধন হল। অনুষ্ঠান সেরে স্নানাহার শেষে শিমূল বিছানায় গড়াল। ঘুমিয়ে কাদা তৎক্ষণাৎ। রাত নটায় ঘুম ভাঙল। গ্যাদা, চা দে। গ্যাদা মাঝের ঘর থেকে এসে ফ্লাস্ক থেকে ঈষদুষ্ণ চা ঢেলে দিল কাপে। মোমেন ভাই কই রে? স্যরে জরুরি মিটিংয়ে গ্যাছে এসডু সাবের বাসায়। বড় মিটিং হইতাছে, গ্যাদা গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে। কি বিষয়ে এত রাতে মিটিং? শিমূল একবার ভাবে, যাবে, আবার বিছানায় গড়ায় লেপমুড়ি দিয়ে। মোমেনভাই এসে ডেকে তোলেন ওকে। ১১টা বাজে, ওঠেন গো শিমূলসাব, আমার ক্ষুধা পাইছে, আসেন, ডানহাতের কাজ সারি আগে। অগত্যা শয্যাত্যাগ করে শিমূল টয়লেটে যায়, এসে খাবার টেবিলে বসে।

খেতে খেতে চিন্তান্বিত হক বলেন, শিমূল সাব, বাড়ি ফেরত যান এবার। এখানকার কাজও শেষ আপাতত। যুদ্ধ শেষ। আপনারা কেন্দ্রের মানুষ। পলিসি লেভেলে কাজ করবেন। আমরা প্রত্যন্তদেশে সেগুলো ইমপ্লিমেন্ট করবো। হয়ে গেল? এতই সোজা সবকিছুর সমাধান? শিমূল খেপে উঠে ভাতের প্লেট ঠেলে দেয়, এই হারামজাদাদের জন্য যে জান লড়িয়ে দিলাম কটা মাস, সেজন্য কিছুমাত্র কৃতজ্ঞতা থাকতে নেই? আমাদের কাজ শেষ করেছ, এবারে তুমি যাও। ব্যস? এই সুরমা, আপনারা, সুনামগঞ্জ কলেজ, সাদ মিয়াÑসবাইকে ছেড়ে চলে যাব ? মানে , যেতে হবেই? শিমূল হতাশভাবে উঠে গিয়ে দীর্ঘ দিনের বিরতির পর পানপাত্র নিয়ে বসে।

হক সাহেব ঘরে এসে শিমূলের প্যাকেট থেকে সিগ্রেট নিয়ে ধরান। নেহায়েত বিপন্ন তার বোধ থেকে তার এই ধূমপান, শিমূল জানে। কি হয়েছে, আমি জানতে চাইনা, সে দুহাত নেড়ে বলে। সেসব ঘোঁট পাকানো, পরশ্রীকাতর, কাপুরুষ মানুষের জোলো কাহিনী আপনাকে আমি শোনাবোও না, হক বলেন। মিটিং -এ ক্যাপ্টেন মোতালিবও ছিলেন। সব শুনে উনি শুধু বলেছেন, এরকম ঘটনা পৃথিবীতে আগেও বহুবার বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ঘটেছে, মাঝে মাঝে সংঘাতের সৃষ্টিও হয়েছে। তবে এবারে সেসব হবে না, শিমূল এখান থেকে স্রেফ চলে যাবে, আর আপনাদের ছায়া মাড়াবে না। ঠিক আছে? সবাই তখন চুপ করে ছিল, অভিযোগ উত্থাপনকারীরাও মাথা নিচু করে বসে ছিল।

হোয়াটয়েভার মাই ক্রাইম্জ আর, আই প্লিড গিল্টি টু অল অব দেম। উইদআউট ইভ্ন হিয়ারিং দেম, স্যর। দিস ইজ মাই সলেম সাবমিশান বিফোর দ্য কোর্ট অব ল, হুইচ ইউ ভেরি মাচ রেপ্রিজেন্ট, বলে শিমূল গ্লাস উল্টে দেয়। আমি কাল সকালে নদী পার হয়ে বালাট চলে যাব আমার ভারতীয় দোস্ত ধর্মের গদিতে, তারপর যা হয় করা যাবে। আপনাকে খবর পাঠাব, কোথায়, কখন, কি করছি, সব জানাব। দেখা হলে রতœাকে বলবেন, এ জীবনে মিটিল না সাধ, হায়…।

পুনশ্চ: কাহিনীতে বাস্তবনির্ভর কিছু উপাদান লেখক ইচ্ছে করেই রেখেছেন, বাকিটা কল্পনাপ্রসূত।

—-
ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts